সুব্রত রায়
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য
It’s easier to fool people than to convince them that they have been fooled.
–Mark Twain
সন্দেহ প্রসঙ্গে
নিত্য তিন লাখ নতুন শিকারসহ অতিমারির জমকালো দ্বিতীয় ঢেউ চলছে একেই, তায় দশদিক থেকে ঘনীভূত হচ্ছে সন্দেহের ঘন মেঘ। টিকা পেতে অক্সিজেন ফুরোয়। হাসপাতালের শয্যা থেকে মৃতের সৎকার, সবেতেই দীর্ঘ প্রতীক্ষা। দ্বিতীয় ঢেউকে আবাহন করে ভোটরঙ্গ গিয়েছে। এখন, লকডাউন-বিধিনিষেধ কণ্টকিত অতিমারিকালে বেঁচে থাকা মানেই ভয়ে-উৎকণ্ঠায় সিঁটিয়ে থাকা। সংক্রমণের ভয়। অন্নসংস্থানের চিন্তা। বাড়তি হিসেবে মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে একরাশ সন্দেহ। ভাইরাস নিয়ে সন্দেহ, চিকিৎসা নিয়ে সন্দেহ, টিকা নিয়ে সন্দেহ, মাস্ক নিয়ে সন্দেহ, লকডাউন নিয়ে সন্দেহ, এমনকি সন্দেহ খোদ অতিমারি নিয়েও। এ অতিমারি শুধু ভাইরাসের নয়, নয় শুধু রোগেরও। এ অতিমারি সন্দেহ, অযুক্তি, আতঙ্ক আর অনাস্থারও।
আমি সামান্য বিজ্ঞানকর্মী। সন্দেহই আমার গজকাঠি, সন্দেহেই আমার পুষ্টি। মনে মনে অহোরাত্র সন্দেহ ভাঁজি, জনে জনে সন্দেহ করতে প্ররোচনা দিই। সব কিছুকে প্রশ্ন করো, মগজে পুঁতে নাও সন্দেহের বীজ। নিছক বিশ্বাসের ছাঁচে ফেলে কোনও কিছু মেনে নিও না, তর্ক করো, যাচাই করো। প্রশ্নবিমুখ করে তোলার জন্য এদেশে শৈশব কোনও ঘাটতি রাখে না, তবুও বিজ্ঞানের দুয়ারে এসে পড়লে সন্দেহকে নিতান্ত দূরে সরিয়ে রাখা কঠিন। অতিমারিকাল যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই দেখতে পাচ্ছি তা হয়ে উঠেছে সন্দেহময়। পৃথিবীজুড়ে তথ্যচলনের দুর্দম গতিতে ভর করে হরেক সন্দেহ অহরহ উঁকি দিচ্ছে মনের গহীন কোণে। সত্যিই কি রোগটা ভয়াবহ? টিকায় কি আদৌ কাজ দেবে? সর্বক্ষণ নাকের গোড়ায় মুখোশ এঁটে থাকলে কি আটকাবে ভাইরাস? না কি উলটে ফুসফুসেরই বারোটা বাজাবে? সাবান-স্যানিটাইজ়ার বিধৌত আমাদের প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকা কি শুচিবাইগ্রস্ত রাঙাপিসিমাদেরও লজ্জা দিচ্ছে না? অতিমারির নামে এ কোনও বদ মতলব নয় তো? নয় তো পৃথিবীটাকে তটস্থ করে ফায়দা লোটার ফন্দি? এই যে এত এত সন্দেহ, এত প্রশ্ন, এতে বিজ্ঞানকর্মী হিসেবে আমাদের আনন্দিত হবারই কথা। কিন্তু, সব সময়েই তা হতে পারছি কি? নাকি, কখনও বা সন্দেহাধিক্যে হয়ে পড়ছি বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন, ক্রমেই ঘুলিয়ে যাচ্ছে যৌক্তিক সন্দেহ আর বাতিকগ্রস্ত আতঙ্কের সীমারেখা?
আসলে, মুশকিলটা হল, দুটো জায়গায়। প্রথমত, সন্দেহ আর প্রশ্ন অপরিহার্য, কিন্তু সন্দেহ আর প্রশ্নকেও তো যা খুশি তাই হতে দেওয়া যায় না, কারণ তারও থাকে যুক্তির দায়, বৈজ্ঞানিক বোধ ও শৃঙ্খলার দায়, সত্যের প্রতি দায়। দ্বিতীয়ত, সওয়ালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জবাবেরও যে গোনাগাঁথা নেই! ‘পোস্ট-ট্রুথ’ যুগের উথালপাতাল স্রোতধারাতে সন্দেহ-জাগানিয়া তথ্যের সঙ্গে সন্দেহ-নিরসনকারী তথ্যেরও ঢালাও জোগান। সত্যতা নিয়ে দুশ্চিন্তার দায় নেই, ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিলেই হল। অথচ তবুও তো, সত্য হল সত্যই, কবেই বা তা ব্যক্তিগত পছন্দের তোয়াক্কা করেছে! নিকট অতীতে করোনা নিয়ে আমেরিকা ও ব্রাজিলের তাচ্ছিল্য আর বেপরোয়া মনোভাব অনেক মাশুল দিয়েছে। সরকারি অজ্ঞতা অদক্ষতা ঔদাসীন্য নির্মমতায় আমরাও কি মূল্য চুকিয়েছি কিছু কম? কাজেই, সত্যের বিকল্প নেই। তবে সত্য চেনার কাজটা বড় সহজ নয়। বিরাট এই তার্কিক পরিসরটির মধ্যে ঢুকে আছে রকমারি দৃষ্টিভঙ্গি আর বিচিত্র সব দৃষ্টিকোণ। বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন— সব দলা পাকিয়ে একাকার। অবশ্য এই জটিল গোলকধাঁধা থেকে বিজ্ঞানকর্মীর পিট্টান দেবার উপায় নেই, এই সঙ্কটে জট ছাড়ানোর দায় তারই।
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?
দ্বার আটকে ভ্রমটাকে হয়তো সাময়িকভাবে রুখে দেওয়া যায়, কিন্তু এতে সত্যের অভিঘাতও বিলম্বিত হয়। আজকের দিনে মনের দরজায় একেবারে খিল এঁটে থাকাও একপ্রকার অসম্ভব। তথ্যের ত্বরিত চলাচলের সুড়ঙ্গগুলোই আজ সচেতনতার উৎস, ক্ষমতারও। একজন সচেতন মানুষ তাকে এড়িয়ে যাবেন কীভাবে? আর কেনই বা? কেবল ছেঁকে নিতে জানলেই হল!
কিন্তু, ওই জুতসই ছাঁকনিটা খুঁজতে গিয়েই জেরবার! আমরা বিজ্ঞানকর্মীরা মূলত বিজ্ঞানকে সমাজের কাছে নিয়ে যাই, বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে সমস্যার সমাধান খুঁজি (একই সঙ্গে, সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণেও বিজ্ঞানকর্মীর ভূমিকা বড় কম নয়)। কিন্তু এতে সব সময় সুরাহা হয় না। কোনও কালেই বিজ্ঞান সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, ভবিষ্যতের জন্য কিছু জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। বিজ্ঞান ধর্মগ্রন্থ নয়, ‘সব জানি’ বলাটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ‘নভেল’ ভাইরাসের অনেক কিছু বিজ্ঞান জেনে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু অনেক কিছু এখনও জানতে বাকি। অজ্ঞানতার ওই ফাঁকফোকর গলে ঢুকে আসছে রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শনের একের পর এক মারকাটারি ধারণা, ঢুকে আসছে একের পর এক সন্দেহ। প্যানডেমিকের হাতে হাত মিলিয়ে চলছে এক জব্বর ‘ইনফোডেমিক’ও— ভুয়ো খবরের ভুলভুলাইয়াতে হাবুডুবু খাচ্ছে সত্যিকারের তথ্য। উপরন্তু, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বেহাল দশায় অবস্থা হয়ে উঠেছে জটিলতর। গড়ে উঠছে একের পর এক ন্যারেটিভ। একটায় বিজ্ঞানে ঝোঁক তো অন্যটায় রাজনীতিতে! বিজ্ঞানকর্মী এই ন্যারেটিভগুলিকে উপেক্ষা করতে পারেন না। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষপ্রকৃতির নিয়ম খোঁজে। কিন্তু বিজ্ঞান নিজে নিরালম্ব তো নয়; বস্তুত, গবেষণার গতিপ্রকৃতি ও তার প্রয়োগের রূপরেখা স্থির করতে লাগে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, এমনকি দর্শনও। ভেবে দেখুন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন কয়েক মাসের মধ্যে ‘কোভ্যাক্সিন’-এর ট্রায়াল সমাপ্ত করার হুঙ্কার ছাড়েন, তখন ‘বিজ্ঞান’ বেচারার জড়োসড়ো হয়ে পেছনের বেঞ্চের ছাত্র হওয়া ছাড়া উপায় থাকে কি? এমনকি, পরবর্তীকালে কার্যকারিতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবার আগেই দেশের বিপুল জনসমষ্টিকে ওই টিকা দেওয়া শুরুও হয়ে যায়। বিজ্ঞানের এই নিদারুণ অপব্যবহারের দায়ভার ‘বিজ্ঞান’-এর কাঁধে চাপানো যায় না। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করার প্রশ্নে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় বা তথ্যের মধ্যে থেকে অগ্রাধিকারের প্রশ্নে রাজনীতি, অর্থনীতির মতো বিষয়গুলিও নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। কাজেই, এ সন্দেহটি আদৌ অবান্তর নয় যে, বিজ্ঞান ঠিক পথে এগোচ্ছে তো (বিজ্ঞান বেপথু হয় বই-কি, তা না হলে ‘পরমাণু বোমা’ শব্দটাই আমাদের অচেনা থেকে যেত)? তাই, উত্থাপিত ন্যারেটিভগুলিকে বিনা বিচারে উপেক্ষা করা চলে না। ঝাড়াইবাছাই করলে এদের মধ্যে অন্তত দুটো স্বতন্ত্র ন্যারেটিভ আমরা দেখতে পাব। কোভিড-১৯ অতিমারিকে ঘিরে গড়ে ওঠা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপাদানগুলিকে শনাক্ত ও কাটাছেঁড়া করতে ওই ন্যারেটিভগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচিত হওয়া দরকার।
কিছুদিন যাবৎ হোয়্যাটস্অ্যাপ মারফত একটি অডিও-বার্তা অসংখ্য বার ‘শেয়ার’ হয়ে অনেকেরই সাধের মুঠোফোনে এসে নোঙর ফেলেছে। এতে জনৈক ‘শুভজিৎ’ ও অন্যান্যদের প্রশ্নের জবাবে জনৈক উত্তরদাতা (সন্ন্যাসী? মিশনস্থ ‘মহারাজ’?) প্রত্যয়ী গলায় অতিমারি নিয়ে এক বিরাট ধনতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের কথা বলে চলেছেন। কতকটা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর ভঙ্গিতে তিনি উন্মোচন করে চলেছেন পূর্বেকার বছরগুলিতে সন্তর্পণে নির্মিত হওয়া একের পর এক কূট ও গুহ্য চক্রান্ত। তাঁর বক্তব্যে ঘুরেফিরে আসছে ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড ওয়ান অর্ডার’, ‘নিউ নর্ম্যাল’-এর মতো শব্দবন্ধ। লক্ষণীয়রকম আত্মবিশ্বাসী, কর্তৃত্বপূর্ণ, পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত কণ্ঠে তিনি বলে চলেছেন সর্বগ্রাসী কর্পোরেটাইজ়েশনের ফলে নিদারুণ ভবিষ্যতের কথা, কৃত্রিমভাবে রোগ বানিয়ে ‘ওঝা হয়ে ঝাড়ানোর’ কথা, টিকার ছদ্মবেশে শরীরে বিষ ঢোকানোর কথা, এমনকি রোগগ্রস্ত করে দিয়ে জনসংখ্যা কমানোর কথাও। শান্ত গলায় তিনি সোজাসুজি মাস্ক পরতে নিষেধ করছেন, আর ঠারেঠোরে পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লেষিত ওষুধের বদলে প্রাকৃতিক ভেষজ ব্যবহারের। অর্থাৎ আলোচক রোগটাকে মেনে নিচ্ছেন, তার ভয়াবহতাকেও; কিন্তু এর জন্মবৃত্তান্ত ও চিকিৎসা-প্রতিরোধ নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ উসকে দিচ্ছেন। কানাঘুষোর এই ধরনটাকে আমরা বলব ‘প্ল্যানডেমিক’ ন্যারেটিভ, কারণ এর বৌদ্ধিক জোগান এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত ‘প্ল্যানডেমিক’ শিরোনামের একটি ভিডিও ও একটি তথ্যচিত্র থেকে। তথ্যচিত্রের শেষে নামকরণের ব্যাখ্যা আছে এভাবে: Plandemic = ‘Plan’ (n., a detailed proposal for doing or achieving something) + ‘demic’ (adj., characteristic of orpertaining to a people or population)[1]। অর্থাৎ, ‘প্ল্যান’ বা পরিকল্পনা করে তৈরি ‘এপিডেমিক’ বা মহামারি।
অন্য ন্যারেটিভটিরও মূলে আছে ধনতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের ধারণা, তাতে যথেষ্ট মর্যাদা নিয়ে আছে ওষুধ আর টিকা বেচার বাজার অর্থনীতির প্রসঙ্গ। কিন্তু এখানে জোরটা পড়েছে অন্যত্র— অতিমারির বাস্তব ভিত্তি নিয়েই তোলা হয়েছে প্রশ্ন। এই ধারায় বিশ্বাসীদের অধিকাংশই ভাইরাসের কৃত্রিমতার তত্ত্বে আস্থা রাখেননি বা ওষুধ হিসেবে সংশ্লেষিত রাসায়নিকের বিরোধিতা করছেন না। এর প্রবক্তাদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, এমনকি বিজ্ঞানীরাও। এঁরা কেবল ভয়াবহতা ও মারণক্ষমতার দিক থেকে সার্স-কোভ-২-কে বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি নন। ভাইরাস সংক্রমণের মামুলি অভিজ্ঞতাগুলির থেকে কোভিড-১৯-কে খুব বেশি আলাদা ভাবতেই এঁদের সবিশেষ আপত্তি। কাজেই, মাস্কের ব্যবহার গুরুত্ব হারিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে, অতিমারিটাই তাঁদের চোখে হয়ে উঠেছে এক কৃত্রিম আতঙ্ক। রাষ্ট্র, বহুজাতিক ওষুধ সংস্থা ও অর্থনীতির অন্যান্য নির্ণায়ক শক্তি মিলিতভাবে নাকি নিজেদের স্বার্থেই রচনা করেছে এই নিদারুণ অতিমারি-লাঞ্ছনার ভুবন, ক্রমাগত ঢক্কানিনাদে যা বিশ্বজনীন এক আতঙ্কের চেহারা নিয়েছে! আমরা এই ন্যারেটিভটির নাম দিতে পারি ‘প্ল্যানজ়াইটি’ (Planxiety = ‘Plan’ + ‘anxiety’), অর্থাৎ বানিয়ে তোলা উদ্বেগ।
এ নিয়ে বিস্তারে যাওয়ার আগে এ ধরনের ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক ন্যারেটিভের একটি আশ্চর্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য খেয়াল করা দরকার। দুটিতেই দাবি করা হচ্ছে, পৃথিবীর মহাশক্তিধর কিছু ব্যক্তি/সংস্থা গোপনে পরিকল্পনা করে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটাচ্ছে, কিন্তু কোথাওই পরিষ্কার করে বলা হচ্ছে না এ ষড়যন্ত্রের ‘মোটিভ’-টা কী, অর্থাৎ, এত বিরাট কাণ্ডকারখানা করে এসব ঘটিয়ে কার কী লাভ। প্রথমটিতে বলা হচ্ছে মাইক্রোসফট-গুগল-ফেসবুক-আমাজন জাতীয় কয়েকটি প্রধান কর্পোরেট সংস্থা চায় অতিমারি ঘটিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ লোককে মেরে ফেলতে, যাতে বাকি অল্প কিছু লোককে দাস বানিয়ে রাখা যায়। কিন্তু, অনেক লোকজন মেরে ফেললেই বাকিরা কীভাবে দাস হয়ে যাবে, তার পরিষ্কার ব্যাখ্যা কোথাও নেই। দ্বিতীয় ন্যারেটিভ-টিতে ইঙ্গিত রয়েছে, ওই একই সংস্থারা নাকি প্রভাব খাটিয়ে এলিট বিশেষজ্ঞকুল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর জাতীয় সরকারগুলোর সাহায্যে একটা তুচ্ছ ব্যাধিকে ভয়ঙ্কর মহামারি বলে ইচ্ছে করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, যাতে ওষুধ আর টিকার রমরমা ব্যবসা করা যায়। কিন্তু আতঙ্ক ছড়িয়ে লকডাউন করে দিলে তো ওষুধপত্র ছাড়া বাকি সব কিছুরই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে (এবং হয়েছেও), এবং সে সব ব্যবসারও মালিকদের পয়সাকড়ি-যোগাযোগ-ক্ষমতা এসব তো কম নয়, তারা খামোখা এ বেয়াদবি সহ্য করতে যাবে কেন? আর, সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্য রুটিরুজি বন্ধ হয়ে হাহাকার পড়ে গেলে সরকারের কোষাগারই বা কীভাবে ভরবে, আর মানুষের পকেটে টাকাপয়সা না থাকলে ওষুধপত্রই বা কীভাবে বিক্রি হবে? না, এ সব অনিবার্য ও স্বাভাবিক প্রশ্নের কোনও পরিষ্কার উত্তর নেই।
যেভাবে মানুষ এ সব তত্ত্ব বিশ্বাস করছেন এবং দ্রুত গতিতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, লক্ষণীয় তার ভেতরকার যুক্তি-বিরোধী প্রক্রিয়াটিও। অনেকেই আছেন, যাঁরা এই দুটো ন্যারেটিভে একসঙ্গে বিশ্বাস রাখতেও অসুবিধে বোধ করেননি, যেহেতু দুটিতেই ‘ভিলেন’ একই। কিন্তু, গণহত্যার জন্য পরিকল্পনা করে এক ভয়ঙ্কর অতিমারি সৃষ্টি করা, আর টিকা বেচবার জন্য এক তুচ্ছ রোগকে অতিমারি বলে চালিয়ে মিথ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি, এ দুটো যে একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না, এই সহজ কথাটা কেউই বিচার করে দেখছেন না।
‘প্ল্যানডেমিক’
২০২০ সালের মে মাসের গোড়ায় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘Plandemic: The Hidden Agenda Behind Covid-19’ নামক ২৬-মিনিটের ভিডিও-টি ক্যালিফোর্নিয়াস্থিত একটি ফিল্ম প্রযোজনা সংস্থা নির্মাণ করে।[2] মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন টিকা-বিরোধী সংগঠনের হাত ধরে এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়ায় এবং অচিরেই কোভিড-১৯-কে ঘিরে গড়ে ওঠা ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলির মধ্যে অগ্রণী হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র ফেসবুকের কথাই যদি ধরি, তুলে নেওয়ার আগে ভিডিওটি ১৮ লক্ষ মানুষ দেখে ফেলেন এবং দেড় লক্ষ বার তা ‘শেয়ার’ হয়। পরবর্তীকালে এই ভিডিওটিতে পরিবেশিত বক্তব্যের ভিত্তিতে ‘Plandemic: Indoctornation’ নামক ৮৪-মিনিটের তথ্যচিত্রটি প্রস্তুত করা হয়, যা একই বছরে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি মুক্তি পায়। ভিডিওটি জুড়ে আছে মার্কিন ভাইরাস গবেষক জুডি মাইকোভিট্স্-এর একটি সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ভিডিওটির নির্মাতা মিকি উইলিস নিজেই। মাইকোভিট্স্ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে কোভিড-১৯ অতিমারিকে একটি ‘পরিকল্পিত চিত্রনাট্য’ বলে সাব্যস্ত করেন। তাঁর বক্তব্যের সারাৎসার:
(১) কোভিড-১৯ ভাইরাসটির জন্ম প্রাকৃতিকভাবে হয়নি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কারিকুরির সাহায্যে একে পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে বানানো হয়েছে। অভিযোজনের মাধ্যমে আসতে এর অন্তত ৮০০ বছর লাগত। অতীতে ইবোলা ভাইরাসকেও পরীক্ষাগারে এমনভাবে পালটে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তা মানবদেহে বাসা বাঁধতে পারে।
(২) সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে, কিন্তু কোভিড-১৯ সংক্রমণের জন্য ওর ভূমিকা একবাক্যে মেনে নেওয়া যায় না। আরএনএ ভাইরাস কখনও শরীরের তাপমান এতখানি বাড়ায় না, যতখানি বর্তমান অতিমারিতে ঘটতে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া, এই রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য বছর কয়েক আগে উদ্ভাবিত ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকারও বড়সড় ভূমিকা রয়েছে।
(৩) লক্ষণহীন ও ক্ষীণ-লক্ষণযুক্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে রোগ ছড়ায় না; কারণ, এক্ষেত্রে সংক্রামিত দেহের অনাক্রম্যতা ভেতর থেকে রোগটাকে ‘পরিষ্কার’ করে দেয়।
(৪) যে কোনও টিকাই আসলে দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পক্ষে হানিকর।
(৫) মাস্ক পরলে সংক্রমণ বাড়বে বই কমবে না, কারণ মাস্ক ‘অভ্যন্তরীণ ভাইরাসকে সক্রিয়’ করে তোলে। (তথ্যচিত্রে দেখা যায়, ডাঃ এরিকসন নামক জনৈক চিকিৎসক নিজের ও তাঁর সহকর্মীর মাস্ক না ব্যবহারের যুক্তি দিচ্ছেন এভাবে যে, তাঁরা জীববিজ্ঞানটা জানেন বলেই নাকি মাস্ক পরার গরজ দেখাননি!)
(৬) বর্তমান অতিমারির উৎপত্তির পেছনে ‘ফাইভ-জি’ মোবাইল নেটওয়ার্ক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-লব্ধ অণুজীব, প্লুটোনিয়াম তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদিরও প্রভাব রয়েছে।
(৭) লকডাউন-এর নামে সমুদ্র সৈকতগুলি বন্ধ করে রাখার মানেই হল, মাটি, বালি ও সমুদ্রের জলে থাকা সংক্রমণ নিরাময়কারী অণুজীবগুলিকে স্বেচ্ছায় পায়ে ঠেলে দেওয়া।
এবং সর্বোপরি, (৮) কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থা গোটা পৃথিবীর ওপর তাদের ধনতান্ত্রিক আধিপত্য কায়েম করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সুচারুভাবে এই অতিমারিটি গড়ে তুলেছে। (এই প্রসঙ্গে মাইকোভিট্স্ মাইক্রোসফ্ট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস-এর অধিকর্তা অ্যান্টনি ফাউচি ও রকফেলার ফাউন্ডেশন-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।)
জুডি মাইকোভিট্স্-এর বক্তব্য অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় ঠেকবার কথা, এবং ঠিক তাইই ঘটেছে। আপনারা বাজারচলতি সন্দেহপ্রবাহের মধ্যে এর অনেকগুলিকেই অবিকৃতভাবে খুঁজে পাবেন। কিন্তু একই সঙ্গে, বিস্ময়কর এটাও যে, একজন ভাইরাসবিদ কীভাবে এতগুলি ‘বৈপ্লবিক’ কথা একযোগে উচ্চারণ করতে পারেন!
বিজ্ঞানী হিসেবে মাইকোভিট্স্-এর কেরিয়ার কিন্তু বেশ গোলমেলে। মাইকোভিট্স্ নিজে গর্বিতভাবে দাবি করেছেন যে, এইচআইভি ভাইরাস পৃথকীকরণকারী দলের তিনি সদস্য ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৮৩ সাল নাগাদ ফ্রান্সে এইচআইভি ভাইরাস আবিষ্কারক লুক-আঁতোয়া মঁত্যানিয়ের গবেষণাগার থেকে ভাইরাসের নমুনা আমেরিকার যে গবেষণাগারে এসে পৌঁছয়, সেখানে মাইকোভিট্স্ ওই সময়ে চাকরি করতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, আদৌ বিজ্ঞানীদলে সামিল ছিলেন না। বাস্তবে, ২০০৯ সালে বিখ্যাত সায়েন্স পত্রিকায় গবেষণাপত্র প্রকাশের আগে বিজ্ঞানীমহলে তিনি আদৌ চেনা-মুখ ছিলেন না। আবার, ওই গবেষণাপত্রটির সুবাদে তাঁর যথেষ্ট দুর্নামও হয়। ওতে তিনি দাবি করেছিলেন যে, ‘ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম’ নামক অসুখটির জন্য ইঁদুরের দেহে প্রাপ্ত ‘এক্সএমআরভি’ নামক একটি ভাইরাসের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই অন্যান্য গবেষণায় তাঁর ওই চিত্তাকর্ষক দাবিটি সমূলে নস্যাৎ হয়ে যায় এবং ২০১১ সালে সায়েন্স গবেষণাপত্রটিকে প্রত্যাহার করে। তবে কেবল এটুকুই নয়, ওই একই বছরে তিনি আরেকটি লজ্জাজনক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর নিয়োগকারী সংস্থা হুইটমোর পিটারসন ইনস্টিটিউট তাঁর বিরুদ্ধে নথিপত্র চুরির দায়ে অভিযোগ আনে এবং এজন্য তিনি কিছুদিন কারাবাস করতেও বাধ্য হন,[3] অবশ্য পরে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেও নেওয়া হয়। কিন্তু বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর কেরিয়ার যাই বলুক না কেন, তাঁর দেখানো রাস্তাতেই পৃথিবীজুড়ে কোভিড-ষড়যন্ত্রের অসংখ্য বয়ান পুষ্টিলাভ করেছে। কাজেই, তাঁর কথায় আমাদের ফিরে ফিরে আসতে হবে।
‘প্ল্যানজ়াইটি’
সার্স-কোভ-২ ভাইরাস সত্য, কোভিড-১৯ নামক অসুখটাও সত্য। কিন্তু অতিমারির নামে নাকি চলছে এক নিষ্ঠুর ধাপ্পাবাজি! ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাঃ স্থবির দাশগুপ্তের লেখা ‘কোভিড-১৯ — কোথায় এলাম, কোথায় যাচ্ছি’ শীর্ষক পুস্তিকাটি এই ‘প্ল্যানজ়াইটি’ ন্যারেটিভের আদর্শ নমুনা হতে পারে।[4] সেখানে যা যা দাবি করা হয়েছে তা এইরকম:
(১) ‘নভেল করোনা ভাইরাস’ নামক ভাইরাসটি করোনা ভাইরাসেরই ‘মিউটেশন’ ঘটা প্রজন্ম, কোনও নতুন প্রজাতি নয়। কাজেই, ‘নভেল’ কথাটা গা-জোয়ারি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
(২) ২০০৯ সালের পূর্বে অতিমারির যে মানদণ্ড ছিল, তা মানলে বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘অতিমারি’ বলা যায় না। প্রথমত, এটা কোনও নতুন ভাইরাসের কারণে ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, তীব্র সংক্রমণ ও প্রচুর মৃত্যু ঘটছে না।
(৩) কোভিড-১৯ কোনও নতুন ব্যাধি নয়। ‘ফ্লু-এর মতো সেও আমাদের বহু প্রাচীন সহযাত্রী’, একে বড় জোর ‘তীব্র ফ্লু (‘ব্যাড ফ্লু’)’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
(৪) টিকা না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে সংক্রমণ ছড়াতে দিলেও ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হবে না— এ কথা অবৈজ্ঞানিক। ‘ওষুধ শিল্প যদি মনে করে, টিকা বানাবে, তাহলে নাকি বুঝতে হবে টিকার দরকার আছে!’
(৫) টিকা প্রস্তুতিতে জৈবপ্রযুক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু এতে কোনও ‘অটো ইমিউন ডিজিজ’ তৈরি হবে কিনা, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? (আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার নামে জিনচর্চাকে ডাঃ দাশগুপ্ত নাৎসি আমলের ‘ইউজেনিক্স’ চর্চার সঙ্গে তুলনা করেছেন।)
(৬) মামুলি সংক্রমণ কর্পোরেট কলকাঠিতে (ডাঃ দাশগুপ্ত এ প্রসঙ্গে ‘নিউ নর্ম্যাল’, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ ইত্যাকার শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন) হয়ে উঠেছে আতঙ্কের ‘অতিমারি’। ‘একটা ভাইরাসের আগমন [sic.] একটা জাতির জীবনে সর্বগ্রাসী কোনও সঙ্কট হতে পারে না।’
এই ‘প্ল্যানজ়াইটি’ ন্যারেটিভটির উৎস খোদ ইউরোপে। বিগত কয়েক দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র নানা কর্মকাণ্ডে যে সন্দেহের বাতাবরণ গড়ে উঠছিল, তা থেকে এটি পুষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন জার্মান বিজ্ঞানীর নাম করা যায়। এঁদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন সুচরিত ভাকদি (নাম দেখে বাঙালি ভাববেন না, ইনি আসলে থাই-মার্কিন বংশোদ্ভূত জার্মান), উলফ্গ্যাং উওডার্গ ও মাইকেল ইয়েডন। ডাঃ দাশগুপ্ত নিজেও তাঁর চিন্তাভাবনার মূল উৎস হিসেবে সুচরিত ভাকদি ও কারিনা রেইস লিখিত ‘Corona False Alarm?: Facts and Figures’ বইটির উল্লেখ করেছেন। বস্তুত, ২০০৯ সালেই উওডার্গ সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণকে ‘অতিমারি’ ঘোষণার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। ২০১০ সালে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে টিকা প্রস্তুতকারী বহুজাতিক সংস্থার অনৈতিক গাঁটছড়ার অভিযোগও তোলেন। কোভিড-১৯ অতিমারিতেও এই বিজ্ঞানীত্রয় জার্মান সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তৎপরতা নিয়ে সন্দিহান। রোগটির প্রকৃতি, ভয়াবহতা, টিকার ভালোমন্দ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে তাঁরা বলতে চান যে, ‘অতিমারি’ অভিধাটি কোভিড-১৯ সংক্রমণের ক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত নয়, এটি একটি অতিকথন মাত্র।
কৃত্রিম-অকৃত্রিমের দ্বন্দ্বে
২০০৩ সালে চিনে যখন সার্স (SARS, Severe Acute Respiratory Syndrome) নামক রোগটির প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটল, তখনই রুশ বিজ্ঞানী সের্গেই কোলেসনিকভ দাবি করেছিলেন যে, হাম ও মাম্পস্-এর ভাইরাস দুটির মিশেল দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে ওই ভাইরাস। কিন্তু বিজ্ঞানীমহলে এই তত্ত্ব বিশেষ সাড়া জাগাতে পারেনি, কারণ জীববিজ্ঞানীরা বিলক্ষণ জানতেন যে, এরকম হওয়ার কথা নয়। হাম ও মাম্পস্ ভাইরাস হল প্যারামাইক্সো ভাইরাস, ভাইরাস নামক অনুজীবটির শ্রেণিবিন্যাসগত শাখাপ্রশাখায় যার সঙ্গে সার্স নামক করোনা ভাইরাসের অনেকটাই দূরত্ব। এদের জিনগত সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ‘করোনা ভাইরাস’ নামটি হালে জনপ্রিয় হয়েছে বলে আমরা অনেকেই খবর রাখি না যে, করোনাভাইরাস নামক ভাইরাসের অস্তিত্ব প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল আজ থেকে একশো বছর আগে, ১৯২০ সালে; তা জানা গিয়েছিল উত্তর আমেরিকায় মুরগিদের শ্বাসনালীর সংক্রমণের কারণ খুঁজতে গিয়ে। ১৯৬০-এর দশকে পৃথকভাবে ব্রিটেন ও আমেরিকায় সাধারণ সর্দিকাশি সৃষ্টিকারী ভাইরাসের মধ্যে প্রথম নমুনা পাওয়া গিয়েছিল মানবদেহে বাসা বাঁধতে সক্ষম করোনা ভাইরাসের। ১৯৬৮ সালে ‘করোনা ভাইরাস’ নামটি প্রথম ছাপার হরফে প্রকাশিত হয়, সূর্যের করোনা অংশের আলোকচ্ছটার সঙ্গে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ফুটে ওঠা ‘স্পাইক’-খচিত ভাইরাসের সাদৃশ্য থেকে নামটির জন্ম। মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, এরকম অনেকগুলি করোনা ভাইরাস সম্পর্কে জানা গেছে। এদের অধিকাংশই সাদামাটা, কেবল তিনটি ভাইরাস ভয়ঙ্কর বলে সাব্যস্ত হয়েছে— সার্স-কোভ-১ (সার্স-১ নামেও পরিচিত, ২০০৩), মার্স-কোভ (MERS-CoV, Middle East Respiratory Syndrome-related Coronavirus, ২০১২) ও সার্স-কোভ-২ (২০১৯)।
কাজেই, জুডি মাইকোভিট্স্ সার্স-কোভ-২-এর আবির্ভাব নিয়ে যে ইঙ্গিত করেছেন, তার শিকড় অনেক পুরনো। চিনের উহান শহরে রোগ সংক্রমণ প্রথম চিহ্নিত হওয়া এবং ওই একই শহরে একটি বিশ্বমানের ভাইরাসবিদ্যা গবেষণাকেন্দ্রের উপস্থিতি— চলতি অতিমারির ডামাডোলেও অঙ্ক মিলিয়ে দিতে সময় লাগেনি! বিশুদ্ধ বাণিজ্যিক কারণে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিখাদ পররাষ্ট্রনীতির কারণে তেমনি ভারত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজ নিজ দেশবাসীর মধ্যে দেদার চিনবিদ্বেষ ছড়ায়। ভাইরাসটিকে বিবেচনা করা হয় চিন-নির্মিত ‘জৈব অস্ত্র’ হিসেবে। এই চাপান-উতোরে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে ২০২০ সালের মার্চ মাসে বিশ্বখ্যাত নেচার পত্রিকার এক গবেষণা ভাইরাসটির জেনেটিক গঠন বিচার-বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট ভাষায় আমাদের জানায় যে, এই ভাইরাস হল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফসল।[5] লক্ষণীয় যে, ‘প্ল্যানডেমিক’ মু্ক্তি পাবার আগেই এই গবেষণার ফলাফলটি প্রকাশিত হয়েছিল। মাইকোভিট্স্ আন্দাজ করেছেন যে, সার্স-১ থেকে ভাইরাসটি বিবর্তিত হয়ে সার্স-২-তে পৌঁছতে ৮০০ বছর সময় লাগবে। এই অনুমানের পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নেই! সার্স-কোভ-১ ভাইরাসের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের মিল নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু অমিলও বড় কম নয়। মাইকোভিট্স্ খেয়াল করেননি যে, করোনা ভাইরাস হল ‘জ়ুনোটিক’ ভাইরাস অর্থাৎ যা প্রাকৃতিক নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির প্রাণীদেহে ঘাঁটি গাড়তে পারে। মজার কথা হল, সার্স-কোভ-১ ভাইরাসের জেনেটিক গঠনের চাইতে বাদুড়ের দেহে প্রাপ্ত করোনা ভাইরাসের প্রজাতিগুলির সঙ্গে সার্স-কোভ-২-এর জেনেটিক গঠন অনেক বেশি মেলে। কাজেই, এই অনুমানটাই যুক্তিসঙ্গত যে, বাদুড়ের দেহ থেকে সরাসরি বা আরও দু-একটা ধাপে (প্যাঙ্গোলিনের কথা শোনা যাচ্ছে) মানুষের দেহে ভাইরাসটির ‘স্পিলওভার’ (অর্থাৎ পোষক প্রজাতি বদল) ঘটে থাকবে। ফলত, বিবর্তিত হওয়ার যে সময় (evolutionary gap) মাইকোভিট্স্ ঠাওরেছেন, ততখানি সময় লাগার কথাও নয়। বিভিন্ন গবেষণায় অনুমিত হয়েছে যে, এজন্য মাত্র ২০ থেকে ৮০ বছরই যথেষ্ট।[6]
প্রকৃতিতে ভাইরাসের বিবর্তনের দিকে লক্ষ করলে ডারউইনের প্রজ্ঞা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। ভাইরাসের দুনিয়ায় নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব বিবর্তনবাদের প্রত্যক্ষ প্রমাণ জুগিয়ে চলেছে। অণুজীববিদ্যা এখন এতটা এগিয়েছে যে, পরীক্ষাগারে কৃত্রিম অণুজীব তৈরি করা হয়তো অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু সার্স-কোভ-২-এর বেলায় তেমনটা ঘটার কোনও প্রমাণ কেউ এখনও খুঁজে বের করতে পারেনি। জিনতত্ত্বের তথ্য কিন্তু স্পষ্টভাবেই বিপরীত ইঙ্গিত দিচ্ছে। রোগ ছড়াবার জন্য মারণ-ভাইরাস বানাতে গেলে ইতিমধ্যে হাতে আছে এমন একটি ভাইরাসের জিন-সম্ভার সম্পাদনা করে তা বানাতে হবে— কিছু জিন কেটে বাদ দিয়ে, এবং তার জায়গায় অন্য ভাইরাস থেকে কেটে আনা বিশেষ গুণসম্পন্ন জিন বসিয়ে। ল্যাবরেটরিতে সে কাজ সম্পন্ন করার পর ওই বিশেষ ভাইরাসটির সে কাটাকুটির ছাপ থেকে যায়, এক্ষেত্রে যা মোটেই পাওয়া যায়নি।[7]
এই প্রসঙ্গে, মার্কিন মুলুকের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে খ্রিস্টীয় সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাস ও বিবর্তনবাদে অবিশ্বাসের কথাটাও তোলা দরকার। ‘জেনেসিস’-এ বিশ্বাসী ও টিকাকরণ-বিরোধী ওইসব শিবিরগুলিকে ঘিরেই বরাবর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের রমরমা। ‘প্ল্যানডেমিক’ নির্মাতা মিকি উইলিস ওই শিবিরেরই বিশ্বস্ত সৈনিক, অতীতে তাঁর ফিল্ম ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস নিয়েও গুজব ছড়িয়েছিল।
অতিমারির সংজ্ঞা ও প্রযোজ্যতা প্রসঙ্গে
সুচরিত ভাগদি[8] (এবং তাঁর সূত্রে ডাঃ দাশগুপ্তও[9]) তাঁর বইতে অভিযোগ করেছেন যে, ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অতিমারির সংজ্ঞা বদলে ফেলে। আগে অতিমারি ঘোষণার নেপথ্যে থাকত প্রধানত তিনটি মানদণ্ড: (১) সংক্রমণ হবে নতুন ভাইরাসের কারণে, (২) বিভিন্ন মহাদেশে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, এবং (৩) সংক্রমণ হবে তীব্র ও প্রচুর মৃত্যু ঘটতে দেখা যাবে। ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অতিমারির নতুন মানদণ্ডে সোয়াইন ফ্লু-কে অতিমারি বলে সাব্যস্ত করে, যা পরে বিভিন্ন মহলে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। বর্তমান অতিমারি ঘোষণাকে যাঁরা পরিস্থিতির অতিমূল্যায়ন বলে মনে করেন, তাঁরা অতিমারির সংজ্ঞা বিষয়ক ওই পুরনো বিতর্কটিকে আবারও টেনে এনেছেন।
বস্তুত, অভিযোগটির মধ্যে আংশিক সত্যতা থাকলেও তা গোটা চিত্রটিকে উপস্থাপন করে না। ঐতিহাসিক কাল থেকেই ‘মহামারি’, ‘অতিমারি’ শব্দগুলি ব্যবহার হয়ে এলেও, শব্দগুলিকে চিরকালই আলগাভাবে উপস্থাপন করা হত, কখনও সুচিন্তিতভাবে তা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ‘মহামারি’ ও ‘অতিমারি’ শব্দ দুটির মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকায় রোগ ছড়িয়ে পড়ার দ্যোতনা নিহিত আছে। মহামারিবিদ্যার প্রচলিত ও আলগা সংজ্ঞা অনুযায়ী, অতিমারি হল—
An epidemic occurring worldwide, or over a very wide area, crossing international boundaries and usually affecting a large number of people.[10]
অর্থাৎ একাধিক ভৌগোলিক এলাকায় একই সঙ্গে ‘মহামারি’ ঘটলে তা ‘অতিমারি’ হয়ে ওঠে, যেমনটা ঘটেছিল অতীতে প্লেগ ও স্প্যানিশ ফ্লু-র মড়কের সময়ে। কাজেই, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া, তা সে বায়ু, জল বা সংস্পর্শ— যাকে কেন্দ্র করেই ঘটুক না কেন, তা অতিমারি ঘটিয়ে তোলার প্রধান চালিকাশক্তি। সংজ্ঞায় উল্লেখ না থাকলেও এ নিয়ে বিশেষ দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, ‘অতিমারি’ ঘোষণার ক্ষেত্রে কেউ কেউ সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়াকে বিবেচনা করতে চান, আবার কেউ কেউ সংক্রমণের তীব্রতাকেই মানদণ্ড স্থির করে এগোনোর পক্ষপাতী। আবার, প্রচলিত সংজ্ঞার এই ব্যাপকতর অর্থে মরশুমি রোগগুলোকেও অতিমারি বলা ছাড়া উপায় থাকে না। অথচ মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জাকে কিন্তু অতিমারি বলে ধরা হয় না। কাজেই, অতিমারির চলতি সংজ্ঞাটি অনেকাংশে অসম্পূর্ণ এবং সংশোধনের দাবি রাখে। একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে, অতিমারির বিবেচনায় উপরে আলোচিত বিষয়গুলির সঙ্গে রোগটার প্রকৃতি ও তাতে মানুষের হস্তক্ষেপের সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়টিকেও বাদ দেওয়া চলে না।
এই প্রসঙ্গেই এসে পড়বে ‘প্ল্যানজ়াইটি’ ন্যারেটিভে উত্থাপিত ‘নভেলটি’-র বিষয়টি। অর্থাৎ অতিমারি হতে গেলে ‘নতুন’ কোনও অজানা রোগের প্রকোপ থাকতেই হবে কিনা, সেই প্রশ্নটিকে এবার দেখে নেওয়া দরকার। দেখে নেওয়া দরকার, ‘নতুন’ বলতেই বা কী বুঝব সেটাও। বিগত দু-শতকে যে গোটা সাতেক কলেরা বিপর্যয়ের সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী, তাতে এই বিস্তীর্ণ সময় জুড়ে কলেরার একপ্রকার জীবাণুই সক্রিয় ছিল ভাবলে ভুল হবে। অবশ্য কলেরার কারণ আমরা জানি এবং তার প্রতিরোধের বিজ্ঞানও আমাদের অজানা নয়। কাজেই, এই মুহূর্তে কলেরা অতিমারির সম্ভাবনা হয়তো নেই এবং একে ‘পুরনো’ রোগ বললে কেউ বিশেষ আপত্তিও করবে না। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে বিষয়টি এতখানি সহজ সরল নয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা মোটেও ‘নতুন’ কোনও রোগ নয়, ষষ্ঠদশ শতকেও ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির প্রমাণ আছে। ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে ধরলে পৃথিবী অন্তত ছটি বড় মাপের সংক্রমণের সাক্ষী থেকেছে: ১৮৮৯-৯০ সালের ফ্লু (মৃত্যু ১০ লক্ষ), ১৯১৮-২০ সালের স্পেনীয় ফ্লু (মৃত্যু ১.৭-১০ কোটি), ১৯৫৭-৫৮ সালের এশীয় ফ্লু (মৃত্যু ১০-৪০ লক্ষ), ১৯৬৮-৬৯ সালের হংকং ফ্লু (মৃত্যু ১০-৪০ লক্ষ), ১৯৭৭-৭৯ সালের রুশ ফ্লু (মৃত্যু ৭ লক্ষ) এবং ২০০৯-১০ সালের সোয়াইন ফ্লু (মৃত্যু ১.৫-৫.৭ লক্ষ)। এছাড়া ফি-বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা মরশুমি রোগ হিসেবে দেখা দেয় এবং গোটা পৃথিবীতে গড়ে প্রাণ যায় ২.৯-৬.৫ লক্ষ আক্রান্তের। কলেরার মতো ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণও আমরা জানি এবং এর টিকাও প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণু অল্পকালের ব্যবধানেই তার জেনেটিক গঠনে বদল এনে নব নব রূপে আবির্ভূত হয় এবং এই নবোদ্ভূত চেহারার ভাইরাসকে নিয়ে আমাদের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। সার্স-কোভ-২ এর মতোই ‘নভেল’ কথাটি আমরা ২০০৯-এ সোয়াইন ফ্লু সৃষ্টিকারী এইচ১এন১ ভাইরাসের বেলাতেও প্রযোজ্য হতে দেখি। মানুষের দেহে আক্রমণ শানাতে পারে, করোনা ভাইরাসের এরকম দুটি প্রজাতির (species) কথা জানা গেছে— মার্স ও সার্স। সার্স প্রজাতিটির মধ্যে সার্স-কোভ-১ (২০০৩) ও সার্স-কোভ-২ (২০১৯) ছাড়াও প্রচুর ‘স্ট্রেইন’ বা রকমফের ভাইরাস আছে। কোনও কোনওটা মানুষের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ, আবার কেউ কেউ সর্দিকাশিটুকু ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয়। বিপরীতে, সার্স-কোভ-১ এবং ২ তীব্র সংক্রমণ গড়ে তোলে। এ নিয়ে বিতর্কের এখনও অবসান হয়নি যে, মানবদেহে তীব্র সংক্রমণ ঘটানো কোনও নতুন ভাইরাসের ট্যাক্সোনমিগত অবস্থান কী হবে— তাকে কি ইতিমধ্যেই শ্রেণিবিন্যস্ত পুরনো কোনও প্রজাতির ভেতরেই ঠাঁই দেওয়া হবে, নাকি নতুন প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হবে।[11] সার্স-কোভ-২-র মারণ ক্ষমতার বিচার এখনও বাকি আছে, কিন্তু করোনা ভাইরাসের ‘নতুন’ এই রকমটির সংক্রমণ ক্ষমতা নিকট অতীতের সমস্ত অতিমারিকেই ছাপিয়ে গেছে। আধুনিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান দিয়েও তাকে আটকানো যায়নি। কাজেই, একে নতুন ‘প্রজন্ম’ বলা হবে নাকি নতুন ‘প্রজাতি’ বলা হবে, তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। আপাতত ‘নভেল’ অভিধাটির প্রয়োগে আপত্তি দেখি না।
অনেকেই ভাবছেন যে, যেহেতু সার্স-কোভ-২ এর আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা ৩-৪ শতাংশের বেশি নয়, লক্ষণযুক্ত ও লক্ষণহীন প্রতিটি সংক্রমণকে হিসেবে নিলে হয়তো-বা তারও কম, তাই একে অতিমারি হিসেবে ঘোষণা করে নিতান্ত বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। বিশেষত সার্স-১ ও মার্স-এর কথা বিবেচনা করলে, যে রোগগুলির মৃত্যুহার ছিল যথাক্রমে সংক্রামিতের ১০ ও ৩০ শতাংশ, এই মৃত্যুকে নগণ্য বলাই চলে। যক্ষ্মারোগের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে যেখানে এই রোগে বছরে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান, সেখানে এই সংখ্যাটিকে তুচ্ছ বলে মনে হওয়াটা কিছু দোষের নয়। কিন্তু এখানে দুটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার।
প্রথমত, কেবলমাত্র মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে অতিমারি বিচার করা চলে না। এইডস রোগে মৃত্যুহার ৮০ শতাংশের ওপরে এবং এটি সংক্রামকও বটে। কিন্তু এইডসকে সাধারণত অতিমারি হিসেবে গণ্য করা হয় না। ইবোলায় মৃত্যুহার ছিল ৯০ শতাংশের উপরে, তাও কিন্তু কয়েকটি দেশে বিক্ষিপ্তভাবে মহামারি হিসেবে থেকে গিয়েছে, অতিমারি হয়ে উঠতে পারেনি। আগেই বলেছি, রোগ কীভাবে ও কত দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং কতখানি ভৌগোলিক এলাকায় বিস্তার লাভ করছে, ‘অতিমারিত্ব’ বিচারের জন্য তাও দেখা দরকার। উপরন্তু, সংক্রমণে প্রকৃত মৃত্যুহার [Infection Fatality Rate = (মোট মৃত্যু)/(মোট সংক্রামিতের সংখ্যা) × ১০০%] বের করা সব সময়েই অসুবিধাজনক, ফলে গোড়াতেই মৃত্যুহারের দিক থেকে রোগের ভয়াবহতা হিসেব করা যায় না। অবশ্য নথিভুক্ত সংক্রামিতের মধ্যে কত শতাংশ মারা যাচ্ছেন (Case Fatality Rate), তা সহজেই বের করা যায় এবং এরও গুরুত্ব আছে। চিন থেকে পাওয়া প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সংক্রমণের শুরুতে এই সংখ্যাটি ছিল ৩.৪ অর্থাৎ প্রতি হাজার জন সংক্রামিতের মধ্যে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৩৪ জনের। রোগ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে এই সংখ্যাটি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এগুলি ছাড়াও আরও কয়েকটি রাশি বা মাপকাঠি আছে, যা মহামারি/অতিমারি ঘোষণার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একজন সংক্রামিত ব্যক্তি গড়ে কতজনকে সংক্রামিত করতে পারে (Basic Reproductive Number, R0), জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা ক্রিয়াশীল হওয়ার পরে একজন সংক্রামিত গড়ে যতজনকে সংক্রামিত করতে পারে (Effective Reproductive Number, Rt), এবং একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সংক্রামিতের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে যত সময় নেয় (Doubling Rate)— এগুলির কথা। R0-এর মান ১ এর বেশি হলে মহামারির সম্ভাবনা আঁচ করা যায়। অনেকগুলি গবেষণায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২০২০ সালের গোড়ায় চিনের উহান শহরে এর মান ছিল ১.৪-৫.৭। ২০২০ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে Rt-এর মান ছিল ২-এর বেশি, যা স্পষ্টত সংক্রমণের সূচকীয় বৃদ্ধিকে (exponential growth) নির্দেশ করে। ২০ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সময়কালের মধ্যে চিনের বিভিন্ন প্রদেশে সংক্রামিতের সময় দ্বিগুণ হতে সময় নিচ্ছিল গড়ে ১.৪-৩.০৯ দিন। ধীরে ধীরে এই দিনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের অগস্টের শেষে ভারতে এর মান ছিল প্রায় ৩০ দিন। উপরে দেওয়া প্রতিটি তথ্যই পৃথিবী জুড়ে এক ব্যাপক সংক্রমণের দিকে ইঙ্গিত করছিল।
দ্বিতীয়ত, একটি রোগ সংক্রমণ কতখানি বিস্তার লাভ করবে, তা অনেকগুলি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। প্রাথমিক সংক্রমণের বিভিন্ন তথ্য থেকে এর গতিপ্রকৃতি আগে থেকে অনুমান করা যেতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা বাস্তবিকই কঠিন। বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা সার্স-কোভ-১ ও মার্স ভাইরাস কবলিত দেশগুলির তথ্য নাড়াচাড়া করলে দেখতে পাব যে, পূর্বেকার মহামারির অভিজ্ঞতাকে সফলভাবে কাজে লাগানোর জন্য ওইসব দেশে (যেমন ভিয়েতনাম বা দক্ষিণ কোরিয়া) সার্স-কোভ-২ সংক্রমণ অনেক নিয়ন্ত্রণে থেকেছে। দেশগুলি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিরোধমূলক নানা ব্যবস্থা, যেমন সংক্রামিতদের দ্রুত চিহ্নিতকরণ, অসংক্রামিত জনগোষ্ঠী থেকে তাদের পৃথক করে রাখা ইত্যাদি, কাজে লাগিয়ে আগাম হুঁশিয়ার থেকেছে। সার্স-কোভ-২ নিয়ে বিভিন্ন সাধারণ সংখ্যাতাত্ত্বিক অনুমান এইসব দেশের ক্ষেত্রে কিন্তু ফলেনি। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু-কে অতিমারি ঘোষণার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঠিক সিদ্ধান্তের পেছনেও অনেকগুলি অনিশ্চয়তা কাজ করেছিল। এই প্রসঙ্গে আসবে অতিমারির সংজ্ঞা বদলের প্রসঙ্গটি। ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইনফ্লুয়েঞ্জার সম্ভাব্য নতুন নতুন রকম বা ‘স্ট্রেন’কে মোকাবিলা করার জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তারই প্রকাশিত তথ্য হিসেবে তাদের ওয়েবসাইটে উল্লিখিত হয়: “An influenza pandemic occurs when a new influenza virus appears against which the human population has no immunity, resulting in several simultaneous epidemics worldwide with enormous numbers of deaths and illness.” কিন্তু ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু-র প্রকোপকে ‘অতিমারি’ ঘোষণার ঠিক মাসখানেক আগে এই বাক্যটি সম্পূর্ণ বদলে ফেলে লেখা হয়: “An influenza pandemic may occur when a new influenza virus appears against which the human population has no immunity.”[12] দুটো বাক্যের মধ্যে তুলনা করলে বোঝা যাচ্ছে যে, প্রচুর সংখ্যক সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রসঙ্গটি সংশোধনীতে বাদ পড়ে গেছে। কয়েক মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরে যখন সোয়াইন ফ্লু-র তরফে কোনও ‘অতিমারিসুলভ’ ভয়ঙ্করতা দেখা গেল না, তখন এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমহলের (এঁদের মধ্যে উওডার্গ ও ইয়েডন ছিলেন) প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। এ নিয়ে পরবর্তীকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে সাফাই দেয়, আশ্চর্যের হল, তাতে বাক্য পরিবর্তনটি বিষয়ে তেমন কিছুই বলা নেই। এতে তারা ‘অতিমারি’ শব্দটির প্রচলিত সংজ্ঞার ত্রুটি উল্লেখ করে এবং ২০০৯ সালের সংক্রমণকে অতিমারি ঘোষণা করার পেছনের যু্ক্তিকে তুলে ধরার চেষ্টা করে: (১) মরশুমি ফ্লু যে সময়ে আক্রমণ করে থাকে, দক্ষিণ গোলার্ধে তার বেশ কিছুটা আগে ও উত্তর গোলার্ধে সম্পূর্ণ অন্য সময়ে রোগের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল। (২) সারা বিশ্ব জুড়েই এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল (বস্তুত, তাদের ঘোষণার আগে ৭৪টি দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছিল, সংক্রামিতের সংখ্যা ছিল ২৭,৭৩৭ এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ১৪১)। (৩) Rt-এর মান সাধারণভাবে ছিল ১.২-১.৩, কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে ১.৫। (৪) মৃত্যুহার মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো হলেও কম বয়সিদের বেশি মৃত্যু ঘটছিল, যেমনটা মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার বেলায় দেখা যায় না কিন্তু পূর্ববর্তী ফ্লু মহামারিতে দেখা গিয়েছিল।[13] যুক্তিগুলি কিন্তু একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। কাজেই, অতিমারির ঘোষণাটিকে ভুল বলে মেনে নিলেও বুঝে নেওয়া কঠিন নয় যে, যে মাপকাঠিগুলির উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত ছিল না। অর্থাৎ অতিমারি ঘোষণার ক্ষেত্রে, বিশেষত যেখানে দ্রুতগতিতে জিনের গঠন বদলে যাচ্ছে এরকম জীবাণুদের সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তার অনুমানে বেশ খানিকটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
২০২০ সালে ১১ মার্চ সার্স-কোভ-২ সংক্রমণকে “alarming levels of spread and severity, and by the alarming levels of inaction”— এই যুক্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অতিমারি হিসেবে ঘোষণা করে। অর্থাৎ সংক্রমণের বিস্তার ও তীব্রতা উভয়েই শঙ্কাজনক ছিল বলে তারা মনে করেছে এবং এই সংক্রমণ রোধের কোনও আশু কার্যকর উপায় জানা ছিল না। পূর্বোক্ত ঘোষণার সময়ে সংক্রমণ ১০০টিরও বেশি সংখ্যক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গোটা পৃথিবীজুড়ে ৩৭০০০ জন সংক্রামিত ও ১১০০টি মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে নিজস্ব বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ঘোষণা করেছিল। এখানে আরও একটি আকর্ষণীয় বিষয় আছে। ভালো করে ভেবে দেখুন তো, ওই সিদ্ধান্তের জন্য অতিমারির ‘পালটে যাওয়া সংজ্ঞা’-কে কাজে লাগানোর কোনও সুযোগ ছিল কিনা। ওয়েবসাইটে যে বদল আনা হয়েছিল, তাকে খুঁতখুঁতে দৃষ্টিতে ‘সংজ্ঞার বদল’ বলে দেওয়া যদিও-বা সম্ভব হয়, তা করা হয়েছিল কেবল ইনফ্লুয়েঞ্জার কথা ভেবে, কোভিড-১৯ এর মতো অন্যান্য অসুখের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য— এ কথা কিন্তু কোথাও বলা হয়নি! যদিও, অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এই যে, স্থবির দাশগুপ্তের মত ‘প্ল্যানজাইটি’-তত্ত্বের সমর্থকেরা কোভিড-১৯ রোগটিকে একরকমের ফ্লু বলেই চালাতে চান!
এবারে ‘প্ল্যানডেমিক’ তত্ত্বের মূল উৎস হিসেবে আন্তর্জাল পরিসরে হাজির হওয়া দুটি ‘তথ্যচিত্র’-কে একটু খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া যাক— সেখানে এ তত্ত্বের সমর্থনে কী ধরনের তথ্য ও যুক্তি আছে, এবং তার সত্যতা বিষয়েই বা কী সিদ্ধান্তে আসা যায়।
সিনেমায় যেমন হয়
‘প্ল্যানডেমিক’ তথ্যচিত্রটি শুরু হচ্ছে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে নিউ ইয়র্ক শহরে অনুষ্ঠিত এক সভার দৃশ্য দিয়ে, যেখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন-এর সহযোগিতায় জন হপকিন্স সেন্টার ফর হেল্থ সিকিউরিটি-র উদ্যোগে চলছে অতিমারি মোকাবিলার জন্য এক উচ্চস্তরীয় মহড়া। ‘ইভেন্ট ২০১’ নামেই যার খ্যাতি। বস্তুত, তথ্যচিত্রে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, ২০২০ সালের অনেক আগে থাকতেই পরিকল্পনামাফিক একটা বড়সড় অতিমারি গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছিল। ইঙ্গিতটি পরিষ্কার যে, কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ পুষ্ট করার জন্য গোপনে সক্রিয় ছিল। এ ব্যাপারে আঙুল তোলা হয়েছে মাইক্রোসফ্ট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস (যিনি ইদানীং টিকা-ব্যবসাতেও লগ্নি করেছেন বলে খবর), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস-এর অধিকর্তা অ্যান্টনি ফাউচি ও রকফেলার ফাউন্ডেশন-এর দিকে। ‘প্ল্যানডেমিক’ ন্যারেটিভটি ছড়ানোর কাজে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে, এরকম একটি ওয়েবসাইটেও এ ব্যাপারে বিল গেটস ও অ্যান্টনি ফাউচির বক্তব্যের ভিডিও ও রকফেলার ফাউন্ডেশনের একটি নথির উল্লেখ আছে।[14] বিল গেটস নাকি অনুমান করেছিলেন ৩ কোটি মানুষের মৃত্যুর খবর। ফাউচি-ও অতিমারির সম্ভাবনা নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। প্রায় এক দশক আগে প্রকাশিত রকফেলার ফাউন্ডেশনের এক নথিতেও নাকি উঠে এসেছে করোনা অতিমারির নিখুঁত বর্ণনা। তথ্যসূত্র খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, এই অভিযোগের সবটুকুই অসত্য নয়। বাস্তবিকই বিল গেটস ও অ্যান্টনি ফাউচি বিগত কয়েক বছর ধরে তাঁদের বিভিন্ন বক্তৃতায় এক ভয়ঙ্কর অতিমারির সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন। রকফেলার ফাউন্ডেশনের নথিতেও রয়েছে আগামী দিনের এক রুদ্ধশ্বাস দৃশ্যকল্প। ২০১০ সালে প্রকাশিত ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বিকাশ সম্পর্কিত ওই নথিতে অনুমান করা হয়েছে এক ভয়াবহ অতিমারি পরিস্থিতির, ভাবা হয়েছিল তা ঘটবে ২০১২ সালে। কল্পনা করা হয়েছে যে, ২০০৯ সালে মহামারির জন্য দায়ী এইচ১এন১ ভাইরাসের চেয়ে তীব্র ও অধিক ক্ষমতাযুক্ত কোনও ফ্লু ভাইরাস দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্য আমেরিকার কয়েকটি দেশে অতিমারি ঘটাবে। নথিতে আনুষঙ্গিকভাবে এসেছে ওইসব দেশের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রসঙ্গ, এসেছে ভেঙে পড়া অর্থনীতির কথা।[15] সালটা আর ভাইরাসটা না মিললেও এই বর্ণনা স্বাভাবিকভাবে মনে করাতে পারে বর্তমান অতিমারি পরিস্থিতির কথা। ফলত, অনেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছেন ‘নিভৃতে রচিত এক কদর্য ষড়যন্ত্রের’ বয়ান। কিন্তু একটা বিষয় বিশ্বাসীরা ভেবে দেখেননি যে, ছকটা যদি কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীর সঙ্গোপনে রচিত একটি উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে তা সকলে জানতে পারলেনই বা কীভাবে? বিভিন্ন সভায় খোলাখুলি মত প্রকাশ করেই বা কীভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়? যে বিষয়টিকে পর্দার পেছনে লুকিয়ে রেখে সকলকে বোকা বানানো যেত, তাকেই কেন নথিতে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে সামনে আনার ব্যবস্থা করা হল?
এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও কয়েকটি দেশের সংক্রামক রোগ বিষয়ক কর্মসূচি খেয়াল করলে। ১৯৯৭ সালে হংকং-এ মুরগির খামার থেকে সরাসরি মানবদেহে ইনফ্লুয়েঞ্জার (এইচ৫এন১ ভাইরাস) সংক্রমণ ঘটে এবং আক্রান্তের এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কীভাবে অন্যান্য পশুপাখির দেহ থেকে ‘জ়ুনোটিক’ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। অতীতে ঘটে যাওয়া একরাশ ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারির ঘটনা এবং ভাইরাসটির জেনেটিক গঠনে ঘনঘন পরিবর্তন ঘটে যাওয়ার দৃষ্টান্ত সামনে রেখে এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের মতো কয়েকটি দেশ অদূর ভবিষ্যতে অতিমারির সম্ভাবনা আন্দাজ করে প্রস্তুতি শুরু করে, তা হয়ে ওঠে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। ১৯৯৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের কথা বিশেষভাবে মাথায় রেখে অতিমারির কয়েকটি পর্যায় নির্দিষ্ট করে। উদ্দেশ্য ছিল আগে থাকতেই সম্ভাব্য অতিমারি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা এবং নতুন সংক্রমণের ঘটনা ঘটলে নজরদারি চালানো ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। অতিমারির এই মানদণ্ডের (সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণ দেখা দেওয়ার মাসখানেক আগে এটির তৃতীয় সংশোধনী প্রকাশিত হয়) উপর ভিত্তি করেই ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চতুর্থ পর্যায় থেকে ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ ষষ্ঠ পর্যায়ের অতিমারি ঘোষণা করেছিল। কাজেই, অতিমারির প্রস্তুতি অনেক বছর আগে থেকেই চলছিল। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস বা এনএইচএস এ ব্যাপারে অনুশীলন ও প্রস্তুতির জন্য কাল্পনিক ‘এইচ২এন২ ভাইরাস’ ও কাল্পনিক রোগ ‘সোয়ান ফ্লু’-কে সামনে রেখে গোটা দেশব্যাপী এক ব্যাপক মহড়ার আয়োজন করে, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘Exercise Cygnus’।
নাঃ, এর কোনওটিই কিন্তু গোপনীয় কর্মসূচি নয়, সবই সরকারিভাবে নথিভুক্ত এবং সহজপ্রাপ্য, যা থেকে আমরা আজ বিষয়টি জানতে পারি (অবশ্য, গভীর পরিতাপের বিষয় হল, কোভিড-সংক্রমণ শুরুর সময়ে আমেরিকা ওইসব শিক্ষা বেমালুম ভুলে গিয়ে ট্রাম্প-এর মুখনিঃসৃত বাণীতে আন্দোলিত হয় এবং চরম মূল্য চোকায়)। কিন্তু, অতিমারির ‘নিভৃত’ মহড়ার তত্ত্বটি তবে কার জন্য?
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
[1] Plandemic: Indoctornation (2020): [Video], Plandemicseries.com, Online distributor: London Real, [Online], [26 Apr 2021]
[2] Plandemic: The Hidden Agenda Behind Covid-19 (2020): [Documentary Film], Elevate: California, [Online], [26 Apr 2021]
[3] Enserink, M.; Cohen, J. (2020): “Fact-checking Judy Mikovits, the controversial virologist attacking Anthony Fauci in a viral conspiracy video”, [Online], [26 April 2021]
[4] দাশগুপ্ত, স্থবির (২০২০): কোভিড-১৯: কোথায় এলাম, কোথায় যাচ্ছি, পরিপ্রশ্ন: নৈহাটি, ঠিকঠিকানা: কলকাতা
[5] Andersen, K.G. et al (2020): “The proximal origin of SARS-CoV-2”, Nature Medicine, 26:450-452
[6] Boni, M.F. et al (2020): “Evolutionary origins of the SARS-CoV-2sarbecovirus lineage responsible for the COVID19 pandemic”, Nature Microbiology, 5:1408-1417
[7] টীকা [৫] দ্রষ্টব্য
[8] Reiss, K.; Bhakdi, S. (2020): Corona False Alarm?: Facts and Figures, Chelsea Green Publishing: Vermont & London, p. e71
[9] টিকা [৪], পৃ. ১৭
[10] Kelly, H. (2011): “The classical definition of a pandemic is not elusive”, BullWorld Health Organ 2011; 89:540-541
[11] Coronaviridae Study Group of the International Committee on Taxonomy of Viruses (2020): “The species severe acute respiratory syndrome-related coronavirus: classifying 2019-nCoV andnaming it SARS-CoV-2”, Nature Microbiology, 5: 536–544
[12] Doshi, P. (2011): “The elusive definition of pandemic influenza”, Bull World Health Organ 2011; 89:532-538
[13] টীকা [৮] দ্রষ্টব্য
[14] Fetzer, J. (2020): “Proof that the pandemic was planned & with purpose”, [Online], [29 Apr 2021]
[15] Rockefeller Foundation, GBN Global Business Network (2010): Scenarios for the Future of Technology and International Development, pp. 18-21