অরিজিৎ গুহ
প্রাবন্ধিক, গল্পকার
পেশোয়ারের ফলওয়ালা মহম্মদ সারওয়ার খান ব্যবসার সুবিধার্থে বোম্বেতে এসে থিতু হলেও যুদ্ধের বাজারের মন্দা তাঁর ব্যবসাকে গ্রাস করেছিল ভালোরকমই। ফলের ব্যবসার মন্দা ছোট ছেলেকে বাধ্য করেছিল অন্য পেশা বেছে নিতে। সেইমতোই ছোট ছেলে গিয়ে হাজির হল পুনেতে চাকরির সন্ধানে। ওখানে গিয়ে একটা চাকরি জোটাল একটা ক্লাবের ক্যান্টিনের ক্যান্টিন ম্যানেজারের অ্যাসিসট্যান্টের।
সেই ক্লাবে ক্যান্টিনের ঠিকাদার পরিবর্তন হয়ে গেলে চাকরিটা খোয়াতে হয়। বেশ কয়েকমাস চাকরি করে হাতে কিছু টাকা এসেছিল ছেলের। কাজেই চাকরি যাওয়ার পর বোম্বে এসে নতুন একটা ব্যবসা শুরু করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তার।
চার্চগেট থেকে দাদর যাওয়ার জন্য একদিন রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক পুরনো পরিচিতর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কথায় কথায় সেই ভদ্রলোক বললেন চলো আমার সঙ্গে বোম্বে টকিজ। আমিও যাচ্ছি একটা কাজে। দেখি ওখানে তোমার কোনও হিল্লে করে দিতে পারি কিনা।
ভদ্রলোকের সঙ্গে দাদরের বদলে ছেলেটা চলে গেল মালাডে বোম্বে টকিজ স্টুডিওতে। তখন বোম্বে টকিজের মালকিন দেবিকা রানি। দেবিকা রানিকে সেই পরিচিত ছেলেটির কিছু একটা হিল্লে করে দেওয়ার কথা বলতেই দেবিকা রানি প্রস্তাব দিলেন বোম্বে টকিজের সিনেমার হিরো হওয়ার। মাসে বেতন ১২৫০ টাকা। ১৯৪২ সালে ১২৫০ টাকা মাসে প্রচুর টাকা। প্রথমটা অবাক হলেও প্রস্তাব লুফে নিল সেই ছেলে।
বোম্বে টকিজের প্রথম দিনেই আলাপ হয় যার সঙ্গে তিনি তখন বোম্বে টকিজের সুপার হিরো। তাঁর ছবি ততদিন অব্দি পোস্টারেই দেখে গেছিল সেই ছেলে। প্রথম আলাপেই সেই ছেলেকে আপন করে নিলেন সেই হিরো যাঁর নাম অশোক কুমার। বছরখানেক কাজ শেখার পর দেবিকা রানির জহুরির চোখ চিনে নিয়েছিল আসল হীরেকে। ১৯৪৪ সালে জোয়ার ভাটা সিনেমায় অভিষেক হল সেই নবাগত হিরোর যার নাম ইউসুফ থেকে দেবিকা রানি দিয়েছিলেন দিলীপ কুমার।
তখনকার সময়ে অভিনয়ের একটা ধারা ছিল যে যত বেশি উচ্চকিত অভিনয় করতে পারবে, অর্থাৎ ডায়লগ থ্রোয়িং থেকে এক্সপ্রেশন যার যত বেশি হবে সেই তত ভালো অভিনেতা। এদিকে ছোটবেলা থেকেই দিলীপ কুমার ছিলেন গম্ভীর, সংযত একটু স্বভাবলাজুক গোছের। চিৎকার করাটা তার ধাতে মোটেই ছিল না। কাজেই অভিনয়ের ক্ষেত্রেও দিলীপ কুমারই প্রথম প্রথা ভাঙলেন চিৎকার না করে আস্তে ডায়লগ থ্রোয়িং-এ। এই ম্যানারিজমটা, যদিও এটাকে ম্যানারিজম না বলে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বলা যায়, সেই স্বভাবসিদ্ধ অভিনয়ের ধারাই হয়ত দিলীপ কুমারকে ট্র্যাজেডি রোলে বেশি করে ঠেলে দিয়েছিল। সেখান থেকেই ট্র্যাজেডি কিং নামকরণ। লোকে অবশ্য পছন্দও করেছিল তাঁর অভিনয়ের এই ধারাটা।
অমিয় চক্রবর্তীর পরিচালনায় যখন প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’ শুট করা হচ্ছে বোম্বে টকিজের সেটে, তখন সেই সেটের বাইরে থেকে এগারো বছর বয়সের একটা চাইল্ড আর্টিস্ট তাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল। সেই চাইল্ড আর্টিস্টের অভিষেক অবশ্য তার দু বছর আগেই। অমিয় চক্রবর্তীর হাত ধরেই ‘বসন্ত’ সিনেমায়। মমতাজ শান্তি আর উলহাসের সঙ্গে বেবি মুমতাজ নামে সেই চাইল্ড আর্টিস্টও বেশ ভালো অভিনয় করেছিল।
দিলীপ কুমারকে প্রথম যেদিন সেটের বাইরে থেকে বেবি মুমতাজ দেখেছিল তখনই সে অবাক হয়েছিল সেই হ্যান্ডসাম হিরোকে দেখে। তখনও অবশ্য সে জানত না বেশ কয়েক বছর পর সেই হ্যান্ডসাম হিরোর বিপরীতেই সে অভিনয় করবে।
বোম্বে টকিজের সূত্রে অশোক কুমারের সঙ্গে পরিচয় হয় তা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তা ছাড়াও কলেজের বন্ধু রাজ কাপুরকে আবার যেন নতুন করে পাওয়া হল।
রাজ কাপুর বিখ্যাত পৃথ্বীরাজ কাপুরের ছেলে হলেও বেশ কয়েকবছর বাবার বন্ধু কিদার শর্মার কাছে ক্ল্যাপার বয়ের কাজ করে কাজ শিখেছেন। অবশেষে ১৯৪৭-এ ‘নীলকমল’ সিনেমা করে প্রথমবারের মত ব্রেক পেয়েছেন। রাজ কাপুরের সূত্রেই দিলীপ কুমারের সঙ্গে আলাপ হয় নার্গিসের। এই তিনজনের বন্ধুত্ব তখন ফিল্ম দুনিয়ার একটা বেশ ভালোরকম আলোচনার বিষয়। ১৯৪৯ সালে মেহবুব খানের ‘আন্দাজ’ সিনেমায় ওই বন্ধুত্ব আরও পাকা হয়েছিল।
‘নীলকমল’ সিনেমায় রাজ কাপুরের বিপরীতে হিরোইন ছিল ‘বসন্ত’ সিনেমার সেই চাইল্ড আর্টিস্ট। যে ‘জোয়ার ভাটা’র সেটে লুকিয়ে প্রথমবার দিলীপ কুমারকে দেখেছিল সেই বেবি মুমতাজ। তখন অবশ্য সে আর বেবি নেই বা চাইল্ড আর্টিস্টও নয়। তখন থেকেই সে আস্তে আস্তে হয়ে উঠছে ভারতবর্ষের সর্বকালের গ্ল্যামার কুইন। বেবি মুমতাজ নাম থেকে যার নাম পরিবর্তন করে মধুবালা রেখেছিলেন দেবিকা রানি। ১৯৫১ সালে প্রথমবার দিলীপ কুমার-মধুবালা একসঙ্গে স্ক্রিনে এলেন ‘তারানা’ সিনেমায়।
‘তারানা’র সেটে মধুবালা তাঁর হেয়ার ড্রেসারকে দিয়ে দিলীপ কুমারকে একটা চিরকুটে প্রেম প্রস্তাব পাঠালেন। দিলীপ কুমার বাচ্চা মেয়ের খেয়াল বলে চিরকুটটা পড়ে একটু মুচকি হেসেছিলেন। সেই সময়ে দিলীপ কুমারের পক্ষে যদিও অন্য কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটা সম্ভব ছিল না, কারণ উনি তখন উমা কাশ্যপের সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছেন। ১৯৪৮ সালে ‘শাহিদ’ নামে একটা সিনেমায় দুজনে মিলে অভিনয় করেছিলেন, সেখান থেকেই দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা। উমা কাশ্যপকে আমরা চিনি কামিনী কৌশল নামে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা ছিল। কামিনী কৌশলের দিদি হঠাৎ একটা অ্যাক্সিডেন্টে দুই শিশুসন্তানকে রেখে মারা যান। শিশুসন্তানদের সঠিক পরিচর্যার স্বার্থে কামিনী কৌশলকে আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে করতে হয় দিদির বরের সঙ্গে। কাজেই যখন দিলীপ কুমার কামিনী কৌশলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, আর কামিনী কৌশলও মন দিয়ে ফেলেছেন দিলীপ কুমারকে, তখন তাদের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কামিনী কৌশলের দিদির প্রাক্তন স্বামী, বর্তমানে তাঁর নিজের স্বামী। কামিনী কৌশল নিজে এই বিয়ের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও সমাজ নামের বাধাকে ভয় পেয়ে আর বেরিয়ে আসতে পারেননি। বেশ কয়েক বছর দুজনের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও যখন দুজনেই দেখলেন এই সম্পর্কের আর পরিণতি নেই, তখন দুজনেই সরে এলেন সম্পর্ক থেকে।
বেশ কয়েকবছর পর ১৯৬৩ সালে দুজিনের এই গল্পটা নিয়েই বি আর চোপরা ‘গুমরাহ’ নামের একটা সিনেমা করলেন।
দুজনের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ঠিক এরকম সময়েই মধুবালা আবার দিলীপ কুমারকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠালেন। সেই দুর্বল মুহূর্তে, কয়েক বছরের একটা সম্পর্ক ছিঁড়ে যাওয়ার মুহূর্তে হয়ত দিলীপ কুমার আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন কাউকে। কাজেই যার প্রেম প্রস্তাবের চিরকুট একদিন ফেলে দিয়েছিলেন, তাঁর প্রস্তাবই আবার গ্রহণ করলেন।
দুজনের এই সম্পর্ক নিয়েও উত্তাল হয়েছিল বোম্বের ফিল্ম দুনিয়া। এবার দুজনের মাঝখানে এলেন মধুবালার বাবা আতাউল্লা খান। তাঁর পছন্দ ছিল না এই সম্পর্ক। অবশেষে অনেক তিক্ততা আর আদালতের কাঠগড়ার মাধ্যমে শেষ হয় সেই সম্পর্ক।
কে আসিফের প্রায় কুড়ি বছরের ভাবনার ফসল ‘মুঘল এ আজম’-এ যখন সেলিমের চরিত্রে দিলীপ কুমার আর আনারকলির চরিত্রে মধুবালাকে ভাবা হল ততদিনে দুজনের সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে গেছে। এক মধুর সম্পর্কের কষ্টকর পরিণতি ঘটে গেছে। অথচ ১৯৬০ সালে যখন রিলিজ করল ‘মুঘল এ আজম’, পর্দায় সেলিম-আনারকলির প্রেম দেখে এক ফোঁটাও কেউ বুঝতে পারেনি দুজনের ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে দিয়ে কী পরিমাণ ঝড় বয়ে গেছে।
সায়রা বানু বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসার পর ঠিক করলেন ফিল্ম জগতে কেরিয়ার শুরু করবেন। মেহবুব খানের ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’ সিনেমার পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৬১ সালে যা শেষ অব্দি রিলিজ হয় ১৯৬৬ সালে। সেই সিনেমায় দিলীপ কুমারের সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে ছিল সায়রা বানু। কিন্তু দিলীপ কুমার নিজে রাজি হননি। সায়রা বানুর পরিবার দিলীপ কুমারের পরিচিত ছিল। দিলীপ কুমার নিজে কখনওই চাননি যে নাসিম বানুর মেয়ে সিনেমায় কাজ করুক। সেই জন্যই ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’-তে কাজ করতে চাইলেও দিলীপ কুমার ঠিক রাজি ছিলেন না। যে বছর ‘জংলি’ রিলিজ করল তখন থেকেই সায়রা বানু বোম্বের ফিল্মজগতে হয়ে উঠলেন একটা সাড়া জাগানো নাম। সে বছরই বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে রিলিজ করেছে ‘গঙ্গা যমুনা’। দিলীপ কুমার বুঝতে পারলেন এই প্রতিভাকে আর আটকে রাখা যাবে না।
১৯৬৬-তে ‘রাম ঔর শ্যাম’-এর শুটিঙের সময় একদিন নাসিম বানু দিলীপ কুমারকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন মেয়ে সায়রার জন্মদিন উপলক্ষে। সেই অনুষ্ঠানে সায়রাকে অন্যরকমভাবে যেন দেখলেন দিলীপ কুমার। সেদিনের সেই সায়রাকে যেন পৃথিবীর সব থেকে রূপসী মনে হচ্ছিল। ওই দেখাতেই সায়রা বানুর প্রেমে পড়েন দিলীপ কুমার যিনি অবশেষে জীবনসঙ্গিনীতে রূপান্তরিত হন। জীবনের শেষ দিন অব্দি সায়রা বানুর সঙ্গে দিলীপ কুমারের এই বন্ধন অবিচ্ছেদ্য ছিল।
আরও অসংখ্য গল্প, এবং সবচেয়ে বড় কথা একের পর এক কিংবদন্তি-সম ছবি, এবং হয়ে ওঠা নিজেই এক জীবন্ত কিংবদন্তি। পাঁচ দশকের সেই প্রবাদপ্রতিম কেরিয়ার যখন শেষ করলেন তখন তাঁর ঝুলিতে সেরা অভিনয়ের সবচেয়ে বেশিবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জেতার রেকর্ড, যদিও পরে শাহরুখ খান সেটা ভেঙে দেন। কিন্তু শুধু অ্যাওয়ার্ড দিয়ে কি দিলীপ কুমারের মাপের একজন অভিনেতার মূল্যায়ন হয়? হয় না বোধহয়। তাই ৯৯ বছরে তাঁর চলে যাওয়াটা ঠিক চলে যাওয়া নয়। সেলিম এখনও ৯৯ নট আউট।