Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এখানে ফুটবল বেঁচে থাকার রসদ…

অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

 



ক্রীড়াপ্রেমী, খাদ্যরসিক, ব্লগার

 

 

 

সদ্য শেষ হল কোপা আমেরিকা ২০২১। যা হওয়ার কথা ছিল আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়াতে, করোনার ছোবলে তা স্থান পেল ব্রাজিলে। ২০১৯-এর পর সাম্বার দেশেই আবার বসল পৃথিবীর সব থেকে পুরনো ফুটবল টুর্নামেন্টের আসর। ১৯ মিলিয়ান কোভিড পোজিটিভ কেস থাকা সত্ত্বেও কনমেবল এবং বলসোনারোর উদ্যোগে যেভাবে হঠাৎই কোনওরকম প্রাক-প্রস্তুতি ছাড়া এত বড় একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হল তা অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায়!

এবারের কোপা আমেরিকাতে বাইরের কোনও দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, ফলে ফর্ম্যাটে সামান্য পরিবর্তন এসেছিল৷ দশটি দেশকে পাঁচ, পাঁচ করে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়৷ প্রত্যেকের সবকটি ম্যাচ খেলার পর শেষ দল বাদ পড়ে এবং বাকি চারটি দল কোয়ালিফাই করে কোয়ার্টার ফাইনালে৷ যেহেতু কেবলমাত্র একটি দলের বাদ পড়ার কথা, তাই ফুটবলমহলে প্রতিযোগিতার দলগুলির জেতার খিদের প্রতি প্রশ্ন উঠতে শুরু করলেও, খেলা শুরুর পর তা যথারীতি দমে যায়!

এই টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ফেভারিট ছিল ব্রাজিল। সমস্ত  বিভাগে শক্তিশালী খেলোয়াড়দের নিয়ে জেতার সবথেকে বড় দাবিদার ছিল তারাই। উল্টোদিকে অনেকটাই আন্ডারডগ হিসাবে শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। লিও মেসির নেতৃত্বে কোচ স্ক্যালোনি দল সাজিয়েছিলেন অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্য দু ক্ষেত্রে নজর রেখেই। উরুগুয়ে প্রতিবারের মতোই ওস্কার তাবারেজের অধীনে অন্যতম ফেভারিট হিসাবেই শুরু করেছিল এই প্রতিযোগিতা। কিন্তু টুর্নামেন্ট যত এগোয় উরুগুয়ের পুরনো এক ঘরানার ফুটবল ধরা পড়ে যেতে শুরু করে প্রতিপক্ষের কাছে। মাঝমাঠের সঙ্গে আপফ্রন্টের কোনওরকম ঠিকঠাক যোগাযোগ লক্ষ করা যায় না। ফলস্বরূপ সুয়ারেজ কাভানি থাকা সত্ত্বেও উরুগুয়ের আক্রমণভাগকে বড় নিস্তেজ লাগে। এবং তারা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়!

ব্রাজিল যথারীতি টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই জাঁকিয়ে খেলতে থাকে। প্রতি ম্যাচে প্রচুর গোল না পেলেও নেইমার এবং প্যাকোয়িতার কানেকশন এবং ওয়ান টাচ ফুটবল মুগ্ধ করে দেয় ফুটবল দর্শকদের। তুলনায় আর্জেন্টিনার নীতি ছিল অনেকটাই ডিফেন্সিভ এবং আক্রমণভাগ ছিল সেই লিওনেল মেসি নির্ভর। তবে গ্রুপ পর্বের শুরু থেকেই তাঁর ফর্ম এবং ডিটারমিনেশান দেখে বোঝা যেতে শুরু করে এবার অন্তত কিছুতেই তিনি খালি হাতে ফিরতে আসেননি। মাঝমাঠে তাঁর পরেই এই টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলেন রড্রিগো ডি পল। তার ওয়ার্ক রেট, অ্যান্টিসিপেশান ক্ষমতা, প্রেসিং এবং স্পেশিং সেন্স মুগ্ধ করে তোলে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের৷ ডিফেন্সে পাহাড় হয়ে ওঠেন ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো এবং গোলরক্ষক এমি মার্টিনেজ। আর নিজের পুরনো ফর্মে ফিরে মেসিকে যোগ্য সঙ্গত দিতে শুরু করেন দি মারিয়া!

রড্রিগো ডি পল

কোয়াড্রাডো আর দিয়াজের তত্ত্বাবধানে কলম্বিয়ার আক্রমণভাগ সুন্দর ফুটবল খেললেও তাদের ডিফেন্সের নীতি যে শুধু জঘন্য ফাউল এবং চোরাগোপ্তা মারের উপর টিঁকেছিল তা তাদের ম্যাচ দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তুলনায় এবারের কোপার শ্রেষ্ঠ চমক ছিল পেরু। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই তারা যথেষ্ট সুন্দর ফুটবল উপহার দিয়েছে। এসবের পরেও কোনওরকম অঘটন না ঘটিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে পেনাল্টি শুটআউটে এমি মার্টিনেজের অসামান্য পারফরমেন্সের জোরে ফাইনালে পৌঁছায় আর্জেন্টিনা। উল্টোদিকে নেইমার প্যাকোয়িতার যুগলবন্দিতে পেরুকে হারিয়ে ফাইনালে নিজেদের স্থান নিশ্চিত করে ব্রাজিল!

লুকাস প্যাকোয়িতা

চোট থাকা সত্ত্বেও রোমেরোকে নামিয়ে ফাইনালে যে ঝুঁকি স্ক্যালোনি নিয়েছিলেন তা ঠিক ফলে যায়। গোটা ম্যাচে ৮০ মিনিট অবধি খেলে ব্রাজিলীয় আক্রমণকে প্রায় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রোমেরো। রক্তাক্ত পা নিয়েও নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ ম্যাচটা খেলে গেলেন মন্টিয়েল। আর ডি পলের পাস থেকে বল ধরে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন প্রতিবার চোটের কবলে ফাইনাল খেলতে না পারা দি মারিয়া। তার গোলে আটাশ বছর পর কাপ জেতে দিয়োগো মারাদোনার দল। শাপমুক্তি ঘটে। টুর্নামেন্টে অসামান্য পারফরমেন্সের জন্য শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় এবং গোলস্কোরার উভয়ের সম্মান পান লিওনেল মেসি। তবুও ব্যক্তিগত সাফল্য ম্লান হয়ে যায় টফ্রি জয়ের পর তার কান্নার সামনে। চারবার ফাইনালে উঠেও শেষ হাসি হাসতে না পারার বেদনা আনন্দাশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে!

অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া

সম্ভবত এবারই প্রথম কোপা এবং ইউরো একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। একদিকের ইউরোপের অর্থ, ঝাঁকমজক, ঝকঝকে ইউরো কাপ। তুলনায় করোনায় জর্জরিত ব্রাজিলে অনেকটাই ম্যাজমেজে কোপা আমেরিকা। মাঠের অবস্থাও এখানে তথৈবচ। ব্রাজিল কোচ তিতে নিজেও যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দুটি টুর্নামেন্ট একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়াতে দুপক্ষের খেলার মান নিয়েও উঠতে শুরু করে প্রশ্ন। অধিকাংশের মতে ইউরোর যে কোনও টিমের কাছেই হেরে নাস্তানাবুদ হবে কোপার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে তাই লাগার কথা। ২০০২-এর পর থেকে বিশ্বকাপ জেতেনি কোনও লাতিন আমেরিকান দল।

পেরু

২০১৪-য় লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ফাইনালে পৌঁছালেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ তবুও এই তত্ত্ব মেনে নেওয়া যায় না কোনওভাবেই। আর্জেন্টিনা ২০১৪-য় ফাইনালে ওঠার পথে, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের মতো দলকে হারিয়েছে। ১৮ বিশ্বকাপে বেলজিয়াম জিতলেও ব্রাজিলের আক্রমণের চাপে প্রায় নাজেহাল হয়ে পড়েছিল গোটা দল। কুর্তোয়ার উপর সেদিন ঈশ্বর ভর না করলে খেলার ফলাফল অন্যরকম হতেই পারত। ফ্রান্স বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেও, তার সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছিল আর্জেন্টিনা। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি নিয়েও ৪-৩ গোলে জিতেছিল তারা। তাই খেলায় কী হবে তা আগে থেকে বলা যায় না কখনও। তবুও একথা সত্যি যে ইউরোপে যেভাবে স্কাউটিং পদ্ধতি চলে, যেভাবে ছোট বয়স থেকে খেলোয়াড়দের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মঞ্চে পারফর্ম করার জন্য গড়ে তোলা হয় তার সিকিভাগও লাতিন আমেরিকায় নেই। আসলে ছিলও না কোনওদিন। লাতিন আমেরিকায় চিরকাল অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে আসার গল্প। সেখানে ফুটবলটা পেশা না, নেশার মতো। তাই আজও শ্রেষ্ঠ ফুটবলারদের তালিকা উঠলে সেখানে অধিকাংশ লাতিন আমেরিকানদের নাম আসে। সে মেসি হোক, নেইমার, সুয়ারেজ, কাভানি কিংবা দি মারিয়া। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবল আজও যে লাতিন আমেরিকান প্রতিভাকে অস্বীকার করবে, সেই সাহস অর্জন করতে পারেনি। তবুও বিশ্বসেরার মঞ্চে এই ভরাডুবির কারণ হল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল ফুটবল সংস্থার অপদার্থতা। আর্জেন্টাইন ফুটবল সংস্থার স্টাফদের মাইনে লিওনেল মেসিকে নিজের পকেট থেকে মেটাতে হয়। দেশে চূড়ান্ত ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতি জেনেও বিনা আলোচনায় কোপা আয়োজন করতে রাজি হয়ে যায় ব্রাজিল সরকার। এখানে ফুটবল খেলার আগে বাচ্চারা ঝাঁট দেয়, কাজ করে। পেটের জন্য। তারপরেও খেলে। বাঁচার মতো, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো লাতিন আমেরিকায় ফুটবল খেলা হয়। পরবর্তী বিশ্বকাপে কী হবে, তা জানা নেই। যেভাবে এবারও জানা ছিল না ১৮-র বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ ইতালি বসে যাবে ইউরো সেরার সিংহাসনে। তবুও ইউরোপের সমস্ত উন্নত এবং শ্রেষ্ঠ পরিকাঠামো থাকা দেশগুলির বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকান জবাব যে একেবারেই ফেলনা হবে না, একথা অতি বড় বিশেষজ্ঞও যে অস্বীকার করতে পারবেন না, সেকথা বলাই যায়!