Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সিডিশনের ডিসিশন!

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, সেস্টাস-এর সম্পাদক

 

 

 

 

 

ব্রিটিশ সুশাসন সম্পর্কে দুর্মুখ সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁহার এক রচনায় লিখিয়াছিলেন, ইংরাজ রাজা সত্যবিমুখ নহে, স্বাধীন বাক্‌প্রকাশেও তাঁহাদিগের বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই। তাঁহারা এদেশীয়গণের নিকট শুধুমাত্র ইহাই যাচ্ঞা করিয়া থাকেন, ভারতীয়গণ ব্রিটিশ শাসন সম্বন্ধে স্বাধীন চিত্তে এই রূপ লিখিবেন ও বলিবেন যে পাঠ মাত্রেই পাঠকের মনে শাসকের প্রতি প্রেমদৃষ্টি জাগিয়া উঠিবে। মূর্খ ভারতবাসীগণ এই রূপ লিখিতে ও বলিতে অভ্যস্ত হইতে পারিতেছে না বলিয়াই ইংরাজদিগকে সিডিশন আইন আনিয়া প্রেম বর্ষণ শিক্ষাদান করিতে হইতেছে। সিডিশন বস্তুটি তত খারাপ নহে, নেটিভদিগের কাগজে পত্রে যদ্রূপ প্রচার হইয়া থাকে।

মাননীয় সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ বিচারপতি দক্ষিণী হইবার হেতু সম্ভবত চট্টোপাধ্যায়ের এই রচনাটির স্বাদ লাভ করেন নাই। তাই তাঁহার মনে প্রশ্ন জাগরুক হইয়াছে, স্বাধীন ভারতে সিডিশন মোতাবেক আইন কেন থাকিবে? ইহা কি ঔপনিবেশিক দাসত্বের ধারা বহনের প্রতীক নহে?

হায় হায় হায়!

হুজুর জ্ঞাত নহেন বলিয়া আমাদিগকে পুনরাবৃত্তি করিতে হইল, ভারত স্বাধীন হইলেও ভারতীয় শাসককুল কোনওকালেই ইংরাজবিমুখ হন নাই। ইহা কে না জানে, ভারতের জাতির পিতা চিরকালই ইংরাজদিগের দত্তক সুপুত্রের ন্যায় রাজনীতি করিয়াছেন। তাঁহারই প্রদর্শিত পথে পদব্রজরত অতীব পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু হইতে শুরু করিয়া রাজেন্দ্রপ্রসাদ, বল্লভভাই প্যাটেল আদি সকল নেতৃবর্গ ইংরাজ শাসকের আইপিসি, সিআরপিসিই কেবল নহে, মায় ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনটিকেও প্রায় তিন বৎসর যাবত বিতর্ক করিয়া ইহা-উহা চুনকর্ম করিয়া আপন সাথী ভীমরাও আম্বেদকর রচিত সংবিধান বলিয়া ঘোষণা করিতে ভ্রম করেন নাই। অস্ত্র আইন বলো, ১৪৪ ধারা বলো, আপদ আইন (Disaster Management) বলো, সর্বত্র ১৮২৪, ১৮৩৭, ইত্যাদি সালগুলির সালতামামি দেখিতে দেখিতে উহাদিগের পৌরাণিকতার অনুভবে হৃদয়ে এক অবিমিশ্র পুলক জাগিয়া উঠে। দেশি এই শাসকপুঞ্জও দেশবাসীর নিকট সেই একই প্রত্যাশা করিয়া বারংবার ব্যর্থ হইতেছেন। তাই তাঁহারাও সিডিশনের ডিসিশন বদলাইতে পারেন নাই।

ইংরাজ ধারায় কিঞ্চিতও কি পরিবর্তন হয় নাই?

হইয়াছে বইকি! দুইচারখানি (ক), (খ), (ক)-এর একের তিন, (ট)— এইরূপ অনেকগুলি অনুধারা ও উপধারাতেই ভারতীয় স্বাতন্ত্র্যের জ্বলজ্বলে চিহ্ন অঙ্কিত রহিয়াছে। কিন্তু মূল ধারাগুলিতে ইংরাজ শাসনের প্রীতিমূলক স্মৃতি ভারতীয় জাতীয় নেতাগণ কদ্যাপি অস্বীকার করিবার মতো দুর্বিনয় প্রদর্শন করেন নাই।

মানবেন্দ্রনাথ রায় নামক দেশ ও জাতির আর এক মহা কুলাঙ্গার অবশ্য সংবিধান রচনার প্রাক্কালে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে এক জনসভায় ঘোরতর নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করিয়া কহিয়াছিলেন, যে সকল খয়ের খাঁ রায়বাহাদুর কিয়ৎকাল পূর্বেও ব্রিটিশ জুতার প্রতি লেহনোন্মুখ হইয়া থাকিতেন, তাঁহাদের অনেকেই এখন জাতীয়তাবাদী সাজসজ্জা (এক বিশেষ ধরনের টুপি ও কুর্তা) পরিধান করিয়া সংবিধান রচনা করিতেছেন। ইঁহারা জাতিকে দাসত্বের বাস ভিন্ন কী দিবেন? ধিক্‌ সেই রায় সন্তানকে!

ওডিশার এক বিশিষ্ট কবি, বাঞ্ছানিধি মোহান্তিও কলির প্রত্যূষে অনুরূপ একখানি গীতি রচনা করিয়া গাহিয়াছিলেন, যাহার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তবক ছিল এই রূপ—

রাজা জমিদার ধনী সাহুকার—
ত্যাগমালা পিন্ধি হেলেনি বাহার।
তাঙ্ক খদর বসন মধুর বচন
তাকু দেখি তুমে ভুলিব কি?
গোরা বদলরে কলা হেলে জোঁক
পুরিব কি কোটি মনিসর দুঃখ?
চাষি মুলিয়ার রকত নিগড়ি
দিল্লি দরবার গড়িব কি?

ইঁহারা জাতির কলঙ্ক স্বরূপ। জাতীয় নেতৃবৃন্দ আপ্রাণ প্রয়াসে জাতির মানসলোক হইতে ইঁহাদিগের স্মৃতি বিদূরিত করিয়া গোরা-পাদুকা লেহক সকলকেই জাতির সম্মুখে আদর্শ বলিয়া উত্থাপন করিয়াছেন। গোরায় কালায় বংশগতি স্বীকার ভারতীয় স্বাধীনতার প্রথম ও প্রধান কথা। অতএব গোরাগণের হুকুমতে প্রস্তুত কানুনসকল কালা ভক্তবৃন্দ পরম ভক্তি সহকারে স্বদেশি বিধিপুস্তকে কোনও রূপ বিকৃতি সাধন ব্যতিরেকে সংরক্ষিত করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন।

ইংরাজের ১৯১৫ সালে প্রবর্তিত নিবর্তনমূলক বিধি বিবিধ পরিচয়ে মোদ্দা ভারত রক্ষা আইন (Defence of India Rule) নেহরুর হস্ত ধারণ করিয়া তাঁহার কন্যার সলতানত অবধি সগর্বে ভারতীয় শাসনে বিদ্যমান ছিল। কন্যা পিতার কর্মকে কথঞ্চিত রূপান্তর সংঘটিত করিয়া জরুরি অবস্থার মুক্ত দিবসে আনিলেন মিসা (Maintenance of Internal Security Act), আফস্পা (Armed Forces Special Power Act), ইত্যাদি। মিসা এক কালে বিদায় গ্রহণ করিল বটে, কিন্তু সন্তান স্বরূপে প্রদান করিয়া গেল টাডা (Terrorism and Disruptive Activities [Prevention] Act), যাহাকে আবার বর্জন করিয়া গৈরিক শাসন আনিল পোটা (Prevention of Terrorism Act), প্রভৃতি। দিল্লিতে যখন অটল বাজপেয়ীর গৈরিক রাজত্বের অবসানে জওহরলালের দৌহিতৃবধূর তত্ত্বাবধানে ত্রিবর্ণ রাজ প্রত্যাবর্তন করিল ইউপিএ নামক এক সংযুক্ত আভরণে, মনমোহন সিং টাডা ও পোটাকে সম্মিলিত করিয়া প্রসব করিলেন মোর্চার পাঞ্জানুযায়ী ইউএপিএ। মাননীয় উচ্চতম ন্যায়াধীশ যাহার অস্তিত্বে চিত্তবৈকল্য অনুভব করিতেছেন। বর্তমান শান্তিপ্রিয় গৈরিক উজির-এ-আলম দামোদরের দাস মহোদয় ইহার যথাযথ প্রয়োগের নিমিত্ত সুদূর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই উদাহরণ হইতে প্রেরণা লইয়া এনআইএ উদ্ভাবন করিয়াছেন, যাহাতে গোরাকালের শাসনরীতিকে অধিকতর কুশলতার সহিত অগ্রসর করিয়া লওয়া যায়!

অর্থাৎ, মাই লর্ড, স্বাধীন ভারত তাহার শাসন কৌশলে কোনও দিবসেই আপন ব্রিটিশ উত্তরাধিকার বিস্মৃত হয় নাই। বরং সযত্নে তাহা রক্ষা করিয়া চলিয়াছে। এক দিবসও আমরা বিনা বিচারের বিচার প্রচলনে পরাঙ্মুখ হই নাই। ইহাকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব বলিলে আমাদিগের স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার ও অসম্মান করা হইবে। তাহা আমরা মানিয়া লইতে প্রস্তুত নহি। এই বাংলার কারাগারেই দেখুন না হুজুর— অন্তত ৭১ জন রাজনৈতিক বন্দি আছেন, যাহারা বিনা বিচারে বিনা জামিনে কয়েদ হইয়া দশ বৎসরের অধিক কাল ধরিয়া রাণিকীয় আতিথ্য উপভোগ করিতেছেন। এই নিবর্তনমূলক আইনেরই সৌজন্য বলা যাইতে পারে।

হুজুরকে বলি, বিনা বিচারে কয়েদ করিয়া রাখার প্রয়োজন পড়িতেছে, কেন না, বহু ক্ষেত্রেই যাহাদিগকে আমরা শাসককুল বন্দি করিতে চাহি, বিচারের প্রক্রিয়াজাত করিলে তাহারা আইনের দুর্বল স্থান সকল অবলম্বন করিয়া পুনর্পথভুক্ত হইয়া যাইবে। উহাদিগকে বন্দিত্বে সুরক্ষিত করিতে হইলে বিনা বিচার বিনা উপায় দেখিতেছি না। প্রচলিত সাধারণ নিবর্তনের প্রয়াসে যতখানি সাক্ষ্যসবুত সংগ্রহ করিতে পারিলে ইহাদিগকে বিপজ্জনক ব্যক্তি বলিয়া আদালতে ন্যায় বিচারকের সম্মুখে প্রমাণিত করা সম্ভব, তাহা প্রায়শই আমাদিগের হস্তে উপস্থিত নহে। আমরা যে কারখানায় বিচিত্র প্রকারের তথ্য উৎপাদন করিয়া থাকি, তাহাও অধিকাংশ সময়ে সামান্য পরীক্ষার আয়োজন করিলেই ভগ্নদশায় পতিত হয়। যে ব্যক্তি কৃষ্ণবর্ণ পোশাকান্তরালে লুক্কায়িত থাকিয়া শ্যামল বর্ণাঙ্কিত পাকিস্তানের নিশান লইয়া আমাদিগের অনাগরিক প্রকল্পের বিরোধিতা করিল, কিঞ্চিত তদন্তেই প্রকাশ পাইল, সে ব্যক্তি গৈরিক বংশলতিকারই এক প্রতিভাময়ী নারী, ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া মজলিশে প্রবেশ করিয়াছিল। ইহার ফলে উহাদিগকে কয়েদ করিতে প্রভূত বেগ পাইতে হয়।

গোরাদিগের কানুনের মস্ত সুবিধা ইহাই যে কয়েদ করিবার জন্য আমাদিগের ইচ্ছাই পর্যাপ্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ-বিচার ইত্যাদি মানবসভ্যতার পশ্চিমি বিকারগুলির উদ্বোধনের প্রয়োজন হয় না। আমরা সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে একলব্যের অঙ্গুলি কর্তন করিয়া দিয়াছি, শম্বুকের মস্তক উৎপাটন করিতে পারিয়াছি কেবলই ইচ্ছার প্রসাদে। আমাদের শ্রীশ্রীকৃষ্ণদেব মহাশয় সামান্য প্রয়োজনে প্রান্তিক জনজাতির সমগ্র পরিবারকে অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া ফেলিতে উপদেশ দিয়াছেন। ভারতীয় বিচারও শাস্তিপ্রদানের এই ঐতিহ্যকেই অনুসরণ করিতে চায়। ইংরাজও ইহা যথার্থ অনুভব করিয়াই বিচারহীন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করিয়াছিল। আমরাও উহাই শিরোধার্য করিয়া চলিবারে উন্মুখ।

বিশ্বজ্ঞানের বর্তমান হস্তধৃত সহজপাঠ উইকিপিডিয়া লিখিয়াছে: “The Indian Constitution retained the principles of preventive detention encapsulated in the Defence of India Act, making one of the few countries where citizens of the country may be subjected to such measures.” হুজুর, সংবিধান রচয়িতাগণ তো আর অন্ধ বা বিবেচনা শূন্য ছিলেন না। উহাতে অনেকেই ছিলেন ইংরাজের আইনশাস্ত্রে ব্যারিস্টার! তাঁহারা বুদ্ধিমান ছিলেন বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায়!

নাগরিকদিগকে দুই টাকার চাউল গম, এমনকি প্রয়োজনে বিনা অর্থেও দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু বাক্স্বাধীনতা দিলে উহারা তাহার সদ্ব্যবহার করিতে পারিবে না। জমি পাহাড় জঙ্গল জল ইত্যাদি যখনই আমরা গরিব দেশপ্রেমিক অর্বুদপতি মুকেশ রামদেব প্রমুখকে বিনা পয়সায় দান খয়রাত করিতে চাহিব, বহু বদ মতলব বিশিষ্ট ব্যক্তি, এই যেমন যে লোকটিকে আমরা জেলে পুরিয়া প্রাণচ্যুত করিয়া দিলাম, তাহাতে বাধা দিতে থাকিবে, প্রতিবাদ করিবে, আন্দোলন করিবে, ইত্যাদি রাষ্ট্রের কল্যাণকর কার্যাবলিতে বিঘ্ন ঘটাইবে। এখন যেমন হরিয়ানায় ঘটাইতেছে। অন্য সকল আইনে তাহাদের এই প্রকার কার্যকলাপ নিবারণ করা অতি বিষম দায়! একমাত্র গোরাদিগের রচিত এই অসাধারণ বিনা বিচারের বিচার অপপদ্ধতিই এই রূপ আপদ কালে বিপদভঞ্জন করিতে পারে বলিয়া বহু পরীক্ষিত ও পর্যবেক্ষিত সংবাদ আছে।

হুজুর, ইহাকে উপনিবেশের দাসত্ব আইন বলিবেন না, ইহা আম্বানি-আদানি-রামদেব কুলের জীবনরঞ্জনী বিধি বলিয়া জানিবেন! উহাদের বক্তব্য—আইনের আবার সাদা কালো কী? কাজে দেয় কিনা দেখ। সিডিশনের ব্যাপারে আমাদিগকে এই সব বিবেচনার ভিত্তিতেই ডিসিশন লইতে হইতেছে।

দ্যাটস অল, মি লর্ড!