সুজাত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
ফুটবল ও সিনেমাভক্ত। রাজনৈতিক কর্মী
ওয়েম্বলিতে দর্শকরা তখনও ঠিকমতো নড়েচড়ে বসেননি। খেলা শুরুর দু মিনিটের মধ্যেই ইটালির ডিফেন্ডারদের অলক্ষ্যে ওভারল্যাপে উঠে এসে বক্সে ঢুকে পড়া ল্যুক শ-এর গোল, ট্রিপিয়ারের নিখুঁত ক্রস হাফভলিতে মিট করে। প্রথম পোস্টের নীচের কোণ দিয়ে চমৎকার ফিনিশ। উদ্বেলিত ওয়েম্বলি, তার সঙ্গে গোটা ইংল্যান্ড। তবে কি দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছরের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে? এত বছর ধরে কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ না পাওয়ার আক্ষেপ মিটতে চলেছে? ইউরোর ইতিহাসে প্রথমবার সেরার শিরোপা উঠতে চলেছে ‘থ্রি লায়ন্স’-দের মাথায়?
বাকিটা আপনারা জানেন। ইটালির দুরন্ত প্রত্যাবর্তন, সারা ইউরো জুড়ে অসামান্য ফুটবল খেলা অন্যতম সেরা ফুটবলার এবং ইউরোর সেরা একাদশে জায়গা করে নেওয়া লেফট ব্যাক লিওনার্দো স্পিনাজোলাকে ছাড়াই ইংরেজদের ঘরের মাঠে গিয়ে অসাধারণ জয়, রীতিমত দাপট দেখিয়ে।
কোভিড-১৯ নামক সর্বনাশা অতিমারির প্রকোপে পড়ে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল বাড়তি একটা বছর, ইউরো শুরুর জন্য। সারা বছর ধরে যতই ভারত এবং ইওরোপের ক্লাব ফুটবল দেখি, আন্তর্জাতিক ফুটবলের মাহাত্ম্যই আলাদা। বিভিন্ন নামকরা ফুটবলারদের বিশ্বকাপ, ইউরো বা কোপা আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে নিজের দেশের জার্সি গায়ে জ্বলে ওঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, সারা বছর ক্লাব ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্ষণ বা মাঝমাঠ সামলানো, চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ বা মহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতার ওই মহার্ঘ্য ট্রফিটা হাতে তোলার অদম্য ইচ্ছে, এবং অবশ্যই নিজেদের জাতীয় পতাকা ও জার্সির রঙে আয়োজক দেশকে ভরিয়ে দিয়ে ফুটবল খেলাটাকে আরও রঙিন করে তোলা বিভিন্ন দেশের সমর্থকেরা।
রোমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর যখন ইউরোর ঢাকে কাঠি পড়ল, খুব বেশি মানুষ ভাবেননি ইটালি চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। টানা ২৭ ম্যাচে অপরাজিত থেকে ইউরোতে খেলতে এলেও নয়। সেমিফাইনাল বা ফাইনালে উঠে তারা অনেককে চমকে দিতে পারে এমনটা অনেকেই ভেবেছিলেন, তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে প্রধান দাবিদার ছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, এবং একইসঙ্গে পাল্লা ভারী ছিল একসঙ্গে একাধিক বিশ্বমানের সৃষ্টিশীল আক্রমণাত্মক ফুটবলার ও শক্তিশালী ফরওয়ার্ড লাইন সমৃদ্ধ পর্তুগাল ও ইংল্যান্ড, এবং ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে সবার ওপরে থাকা বেলজিয়ামের মতো ব্যালেন্সড সাইডের দিকে।
রবার্তো ম্যানসিনি আমায় মুগ্ধ করেছেন। এভাবেও ফিরে আসা যায়!
স্থবির হয়ে পড়া, চিরাচরিত রক্ষণাত্মক ইটালিয়ান ফুটবল, যা আমার মতো লাতিন আমেরিকান ফুটবলপ্রেমীদের কোনওদিনই সেইভাবে আকর্ষণ করেনি, তাকে ম্যানসিনি বদলে দিয়েছেন। আঁটোসাঁটো নিশ্ছিদ্র রক্ষণের সঙ্গে যোগ করেছেন সৃষ্টিশীলতা, গতিময়তা, জন্ম দিয়েছেন একের পর এক আক্রমণে প্রতিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া এক নতুন ইটালির।
গত বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে প্লেঅফে সুইডেনের কাছে দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ গোলে হেরে ছিটকে যাওয়ার পর ইটালির গর্বের ফুটবল সৌধে ধরেছিল লজ্জার ফাটল। ১৯৫৮-র পর প্রথমবার বিশ্বকাপের মূল পর্বের যোগ্যতা অর্জন করতে না পেরে এক অসাধারণ ফুটবল ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করে চলা আজ়ুরিরা ডুবে গেছিল হতাশার অন্ধকারে। সেই খাদের কিনার থেকে তাদের তুলে এনে ম্যানসিনি সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর এক সময়ের রক্ষণাত্মক, কিছুটা একঘেয়ে ফুটবল দর্শনকে বদলে। যার ফলে শুধু কিয়েলিনি বোনুচি জর্জিনিওর নেতৃত্বই নয়, তার সঙ্গে আমরা দেখেছি স্পিনাজোলার অসাধারণ সব ওভারল্যাপিং দৌড়, ডোনারুমা লোকাটেলি ব্যারেলা কিয়েসা পেসিনার মতো তরুণদের পেয়েছি সেরা ফর্মে, এবং ইনসিনিয়া ভেরাটির কাছ থেকে উপহার পেয়েছি অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ত শৈল্পিক ফুটবল।
এবার প্রথমবার এত বড় মঞ্চে প্রথম একাদশে সুযোগ পেয়ে নজর কেড়েছেন একঝাঁক তরুণ। তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন ইটালির জিয়ানলুইগি ডোনারুমা, নিকোলো ব্যারেলা, ফেডেরিকো কিয়েসা, ম্যানুয়েল লোকাটেলি, তেমনই আছেন ইংল্যান্ডের ডেক্ল্যান রাইস, কেলভিন ফিলিপস, বুকায়ো সাকা, জ্যাক গ্রিলিশ; ডেনমার্কের জোয়াকিম মেহলা, মিকেল ড্যামসগার্ড, ক্যাসপার ডলবার্গ; স্পেনের এরিক গার্সিয়া, পেড্রো লোপেজ় গঞ্জালেস ওরফে পেড্রি, ড্যানি ওলমো, ফেরান টরেস; চেক প্রজাতন্ত্রের প্যাট্রিক শিক; পর্তুগালের রেনাটো স্যাঞ্চেজ় (রেনাটো গত ইউরোতেও অসাধারণ খেলেছিলেন), জার্মানির কাই হ্যাভার্টজ়, নেদারল্যান্ডসের ডোনিয়েল ম্যালেন, ডেনজ়িল ডামফ্রিস; বেলজিয়ামের জেরেমি ডোকু, সুইৎজ়ারল্যান্ডের ব্রিল এম্বোলো, অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টোফ বমগার্টনার, কনরাড লাইমার; সুইডেনের অ্যালেকজ্যা়ন্ডার ইস্যাক, ইউক্রেনের রোমান ইয়ারেমচুক, অস্ট্রিয়ার হাঙ্গেরির আটিলা সালাই, রোল্যান্ড সালাইরা।
আমাদের রাত জাগা সার্থক হয়েছে তথাকথিত ছোট, অনামী দলগুলোর লড়াই, আর কিছু অবিশ্বাস্য ‘অঘটন’-এর জন্য। গ্ৰুপ অফ ডেথে দুর্দান্ত লড়াই করেছে হাঙ্গেরি, ফ্রান্স পর্তুগাল জার্মানির মতো হেভিওয়েট প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে। ক্লাইনহাইসলার শ্যাফার ন্যাগি সমানতালে পাল্লা দিয়েছেন পোগবা কন্তে ব্রুনো বার্নার্ডো ক্রুসদের মতো বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারদের সঙ্গে। শেষ ষোলোয় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে পিছিয়ে থেকেও স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন দেখেছি সুইসদের, গ্র্যানিত জাকা সেফেরোভিচ শাকিরিদের সৌজন্যে। দেখেছি একই রাতে ক্রোয়েশিয়ার একইভাবে স্পেনের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই, শেষ দশ মিনিটের মধ্যে দু গোল করে সমতা ফিরিয়ে এনে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যাওয়া। চেকদের আঁটোসাঁটো ডিফেন্সিভ অর্গানাইজ়েশনের সামনে আটকে গেছে গ্রুপ লিগে যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক এবং আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা নেদারল্যান্ডস। পেয়েছি সুইডেনের এমিল ফর্সবার্গের অনবদ্য ফুটবল, মরণবাঁচন ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ল্যুকা মড্রিচের ট্রেডমার্ক আউটস্টেপে অবিশ্বাস্য গোল, ডেনমার্কের হইবিয়ার্গের ধারাবাহিকভাবে খুব ভালো খেলা এবং ডেলানির যোগ্য সঙ্গত, প্রথমবার ইউরোর নকআউটে যাওয়া ইউক্রেনের ইয়ারমোলেঙ্কোর চমৎকার সৃষ্টিশীল ফুটবল।
স্পেনের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। ইউরোর আগে সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছিলেন লুইস এনরিকে, রিয়াল মাদ্রিদের কোনও ফুটবলারকে দলে না নিয়ে। আমার ব্যক্তিগত মত, সার্জিও র্যামোসের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ন্যাচো ফার্নান্ডেজ় স্কোয়াডে থাকতেই পারতেন। অনেকেই সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন, স্পেনের নবীন ফুটবলারদের নিয়ে গড়া এই দল ইউরোতে কতটা কী করতে পারবে তা নিয়ে। এনরিকে তাঁদের ভুল প্রমাণ করেছেন। প্রথমবার এত বড় প্রতিযোগিতায় খেলতে নেমে রক্ষণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমেরিক লাপোর্ট। বুস্কেটস আসার পর স্লোভাকিয়া ম্যাচ থেকে তাদের খেলা আরও জমাট হয়েছে। নবাগত পেড্রির পরিণত, বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল, ওলমোর স্কিলের দৌলতে স্পেনই একমাত্র দল যারা এবার ইটালিকে চাপে ফেলতে পেরেছিল।
এই ইউরোতে হ্যারি কেন ফর্মে আসার আগে ইংল্যান্ডের আক্রমণকে একটা সময় পর্যন্ত প্রায় একার হাতে টেনেছেন স্টার্লিং। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে মায়ের সঙ্গে হোটেলের শৌচাগার পরিষ্কার করার কাজ করা, বর্ণবৈষম্য এবং নিদারুণ দারিদ্র্যের শিকার হওয়া রহিম স্টার্লিং। ইংল্যান্ডের ডিফেন্স ও গোল সুরক্ষিত ছিল পিকফোর্ড, ম্যাগুআয়ার, স্টোনস, ওয়াকার এবং শ, তাদের পাঁচ বিশ্বস্ত প্রহরী এবং ওপরে রাইস ও ফিলিপসের মতো দুজন ডিফেন্সিভ স্ক্রিনের সৌজন্যে।
এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা তিন ফুটবলার, ব্যালন ডি ওরের অন্যতম প্রধান তিন দাবিদার, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, কেভিন ডি ব্রয়না এবং রবার্ট লেওয়ানডোস্কির এবারের ইউরোতে তাঁদের দলের পারফরমেন্স দেখে বেশ কিছুটা হতাশ হওয়ার কথা। রোনাল্ডো নিজে পাঁচটি গোল এবং একটি অ্যাসিস্ট করলেও পর্তুগাল দল হিসেবে বিশেষ আশাব্যঞ্জক ফুটবল খেলতে পারেনি। তাদের খেলায় ছন্দ, বোঝাপড়ার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। জার্মানির কাছে তারা পর্যুদস্ত হয়েছে, বেলজিয়ামের বিরুদ্ধেও গোলমুখ খুলতে না পেরে বিদায় নিয়েছে। ডি ব্রয়না ডেনমার্ক এবং ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে দারুণ ফুটবল খেলেছিলেন। এই দুই ম্যাচেই ম্যাচ জেতানো গোল আর অ্যাসিস্ট ছাড়াও প্রচুর পেনিট্রেটিং পাস তাঁর পা থেকে এসেছিল, ফলে গোলের সুযোগ তৈরি হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু চোট আঘাতে জর্জরিত ডি ব্রয়নার বেলজিয়াম ইটালির সঙ্গে পেরে ওঠেনি। পোল্যান্ড দল হিসেবে একেবারেই মাঝারিমানের, তবে লেওয়ানডোস্কি নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন তাঁর দল নকআউটে যাবে। গ্ৰুপ লিগে সুইডেন বনাম পোল্যান্ড ম্যাচ এবং লেওয়ানডোস্কির দ্বিতীয় গোলটি অনেকদিন আমার চোখে লেগে থাকবে। পরবর্তী বিশ্বকাপে কি এই তিন মহাতারকা নিজেদের মেলে ধরতে পারবেন? রোনাল্ডো আর লেওয়ানডোস্কির পক্ষে কাজটা একদমই সহজ হবে না, কারণ ততদিনে তাঁদের বয়েস আরও দেড় বছর বেড়ে যাবে।
ডোনারুমা পিকফোর্ড ছাড়া তিনকাঠির নীচে এবার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সুইস গোলরক্ষক ইয়ান সমার, ড্যানিশ গোলরক্ষক ক্যাসপার শ্মাইকেল এবং সুইডিশ গোলরক্ষক রবিন ওলসেনের নাম। স্পেনের তরুণ গোলরক্ষক য়ুনাই সিমনকেও নির্ভরযোগ্য দেখিয়েছে, ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে তাঁর আত্মঘাতী গোল হজম ছিল নেহাতই বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা।
এবং, ডেনমার্ক। ছবির মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্যতম প্রতিনিধি, ইউটিউবে যাঁর খেলা দেখে ভালোবেসে ফেলি, সেই ফুটবলের জাদুকর মাইকেল লউড্রাপের ডেনমার্ক। ১৯৯২-এ সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ইউরোপিয়ান নেশনস কাপ জেতা, ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপেও চমকপ্রদ ফুটবল খেলা ডেনমার্ক। ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইউরোয় তাদের প্রথম ম্যাচ চলাকালীন মাঠের মধ্যেই দুনিয়ার অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে যাওয়া দেখে আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেছিল সারা বিশ্বের অগণিত ফুটবলপ্রেমীর। আবার একটা মার্ক ভিভিয়ান ফো, বা অ্যান্টোনিও পুয়েরতা বা ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়রের মতো ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে না তো আমাদের?
না, এরিকসেনকে অকালে চলে যেতে হয়নি। ওই চরম সঙ্কটের সময়ে, যখন তাঁর সতীর্থরা, এমনকী ফিনল্যান্ডের খেলোয়াড়রাও ওই ঘটনার অভিঘাতে হতবাক হয়ে পড়েছেন, তখন তাড়াতাড়ি এরিকসেনের কাছে গিয়ে তাঁকে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন দলের অধিনায়ক সিমন কেয়ার। শুধু তা-ই নয়, সেইসময় মাঠে ঢুকে পড়া মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, ক্রন্দনরতা এরিকসেনের সঙ্গিনী সাবরিনার কাছে গিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে প্রকৃত নেতার কাজ করে সারা বিশ্বের কাছে সিমন কেয়ার হয়ে ওঠেন এক বন্দিত নায়ক। এরপর আমরা দেখি ডেনমার্কের রূপকথার উত্থান। সেই ম্যাচে ফিনল্যান্ডের কাছে হেরে গেলেও পরের ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষে তাদের দুরন্ত পারফরমেন্স সত্ত্বেও ট্র্যাজিক হার ডেনমার্ককে করে তোলে প্রত্যেকটি ফুটবলপ্রেমীর চোখের মণি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য ৪-১ জয়ের সুবাদে ডেনমার্ক পৌঁছয় শেষ ষোলোয়। সেখানেও যথারীতি দাপুটে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে মন জয় করে নেন ড্যামসগার্ড ডলবার্গ পোলসেন ব্রেইথওয়েট মেহলা স্ট্রাইগার লারসেনরা। এর সঙ্গে হইবিয়ার্গ, যিনি প্রশ্নাতীতভাবে ইউরোর অন্যতম সেরা পারফর্মার, তিনি ডেলানি কেয়ার ক্রিস্টেনসেন ভেস্টেরগার্ডদের সঙ্গে নিজের দলকে টেনে নিয়ে যান সেমিফাইনালে। ডেনমার্কের স্বপ্নের দৌড় শেষ হয় কিছুটা রেফারির বদান্যতায় এক বিতর্কিত পেনাল্টিতে ইংল্যান্ড অতিরিক্ত সময়ে এগিয়ে যাওয়ার পর।
ফুটবল, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সুন্দর খেলা। তা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে, যখন রঙবেরঙের সাজে সেজে উঠে ফুটবল দর্শকরা, সমর্থকরা গ্যালারি ভরিয়ে তোলেন। যখন তাঁরা নিজেদের দেশকে সমর্থনের পাশাপাশি সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনায় নিজেদের আবদ্ধ না রেখে, কোনওরকম জ়িনোফোবিক মানসিকতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে অন্য সমস্ত দেশের ফুটবলার এবং সমর্থকদের দিকে বাড়িয়ে দেন ভ্রাতৃত্বের হাত। ফাইনালে টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিসের পর যেমন ইংল্যান্ডের সাকা, র্যাশফোর্ড ও স্যাঞ্চো, তিন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার তাদের দেশের অসভ্য বর্বর সমর্থকদের কাছে বর্ণবিদ্বেষের, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, তেমনই মুদ্রার অন্য পিঠে আমাদের মন জয় করেছেন ফিনল্যান্ডের সমর্থকরা। টিআরপির লোভে ক্যামেরা যখন সংজ্ঞাহীন এরিকসেন এবং তাঁর সঙ্গিনীর মুখের দিকে ফোকাস করতে চাইছে, তখন সেই সংবাদমাধ্যম এবং ক্যামেরার নজর থেকে তাঁদের বাঁচাতে চারিদিকে ঘিরে ধরে আড়াল করে রেখেছিলেন ডেনমার্কের ফুটবলাররা, কয়েক টুকরো কাপড়কে পর্দার মতো ব্যবহার করে।
সেই কাপড়গুলো আসলে কী ছিল জানেন? এতদিনে জেনে গেছেন বোধহয়। তবু আরেকবার মনে করিয়ে দিই, সেগুলো ছিল পাশের গ্যালারি থেকে ফিনল্যান্ডের সমর্থকদের ছুঁড়ে দেওয়া তাঁদের কয়েকটা জাতীয় পতাকা। সেগুলো তাঁরা দিয়েছিলেন অন্য এক দেশের নাগরিকের জন্য। কিছুক্ষণ পরে কোপেনহ্যাগেনের পার্কেন স্টেডিয়াম গমগম করে উঠছিল এক দলের সমর্থকদের স্লোগানে, ‘ক্রিশ্চিয়ান!’ আরেকদিক থেকে সমবেত স্বরে আওয়াজ আসছিল, ‘এরিকসেন!’
এখানেই ফুটবল জিতে যায়। মানবতা জিতে যায়। খেটে খাওয়া মানুষের খেলা, তাদের সংগ্রামের প্রতীক জিতে যায়। জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়া, বিশ্বজুড়ে শোষিত হওয়া কোটি কোটি মানুষ, ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হওয়া অসংখ্য মানুষের স্বপ্নগুলো ডানা মেলে উড়তে শুরু করে। হেরে যায় উগ্র জাতীয়তাবাদ, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করা, বিভিন্ন দেশের মধ্যে অকারণ শত্রুতা, যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা অসুস্থ শক্তিগুলো।