নাহার তৃণা
মরি হায় রে হায় দুঃখে পরান যায়
বৃক্ষে এমন পেরেক মারিলে প্রাণে বাঁচা দায়
মরি হায় রে হায়
গুমড়ে ওঠা করুণ একটা সুর গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে আবু তৈয়ব। পায়ে পুরনো কেডস, মাথায় লাল সবুজ নকশাকাটা মাথাল। শহরের নানা প্রান্তে, বিশেষ করে বৃক্ষবহুল পথ ধরে আবু তৈয়ব প্রায়শই হেঁটে বেড়ায়। কোনও গাছে পেরেক গাঁথা সাইনবোর্ড দেখা মাত্র থমকে দাঁড়ায়। প্রায় ছুটে গিয়ে গাছটাকে জাপটে ধরে উথলে ওঠা কষ্টে খানিক কেঁদে নেয়। তারপর এক এক করে সযত্নে পেরেক তুলে সাইনবোর্ড মুক্ত করে গাছকে গাছ। নেশাগ্রস্তের মতো এই কাজে কয়েকদিন পর পরই সে পথে নামে। পেরেক খাওয়া গাছের খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে অত্র অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই চষে ফেলেছে সে। এ পর্যন্ত প্রায় বিশ-ত্রিশ কেজির মতো পেরেক তুলেছে আবু তৈয়ব। পায়ে কেডস আর মাথায় মাথাল চাপিয়ে হুটহাট তাকে বেরিয়ে পড়তে দেখা যায়।
জমিতে কাজের সময় ওই মাথালটাই ব্যবহার করে তৈয়ব। পূর্বপুরুয়ের রেখে যাওয়া সামান্য জমিজিরাত আছে। তিন কামরার টিনের বসতভিটা বাদে বাকিটা চাষের জমি। তিন মৌসুমের বাধা চাষি নয় তৈয়ব। আউশ মৌসুমে সে ধান চাষ করে আর বছরের বাকি সময় নিজের ছোট্ট মনোহরি দোকানটা চালায়। তাও নিয়মিত নয়। দোকানটা বড় রাস্তার উপর হওয়ায় ক্রেতাসমাগম মন্দ না। তার দোকানে চায়ের ব্যবস্থাও আছে। সেটা বাড়তি আয়ের উৎস। জুলেখার হাতের চা চলে ভালো। যেদিন যেদিন দোকানে জুলেখা বসে সেদিন চা-পিপাসুদের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। দোকানে বসার ব্যাপারে আবু তৈয়বের তেমন আগ্রহ নাই। তার যাবতীয় আগ্রহ আর ব্যস্ততা গাছকেন্দ্রিক। রাস্তার দুপাশের গাছেদের নিরাপত্তা নিয়ে তার ভাবনার অন্ত নাই। সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর গাছ লাগিয়েই খালাস। গাছগুলো এতিমের মতো পড়ে থাকে। যার যেমন ইচ্ছা সেভাবে গাছগুলোর উপর জোর খাটায়। বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে রাস্তার গাছগুলো ছেয়ে থাকে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষ পেরেক ঠুকে গাছে বসিয়ে দিয়ে যায় হরেক কিসিমের বিজ্ঞাপন। তাতে কী না থাকে। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে পুরুষের গোপন অঙ্গ বড় ছোটর ধন্বন্তরি চিকিৎসার সাতকাহন, হারানো কিংবা প্রাপ্তির বিজ্ঞপ্তি। আরও থাকে পুরনো ফ্রিজ-টিভি বিক্রির হদিশ, টিউশানি, গাত্রবর্ণ ফরসার ক্রিম ইত্যাদি নানা বিচিত্র পণ্যের প্রচার প্রচারনার আয়োজন। সিটি করপোরেশনেরও এসব নিয়ে কোনও হেলদোল নাই। আবু তৈয়ব ছুটে ছুটে বারকয়েক গেছে করপোরেশন অফিসে নালিশ জানাতে। ছিঁটিয়াল বলে হয় তাকে নিয়ে তামাশা জমিয়েছে দারোয়ানেরা। নয়ত দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানকার বড় সাহেব কেন, মেজ বা ছোট, নিদেনপক্ষে একজন পিওনের সঙ্গেও তার কথা বলার সুযোগ হয়নি।
গাছেদের দুঃখে সদাই কাতর থাকে আবু তৈয়ব। গাছ যে মানুষের কত বড় উপকারী বন্ধু, সুযোগ পেলে সে কথা বলতে কসুর করে না। কখনও বক্তৃতার ঢঙে, কখনও গানের সুরে মানুষকে সচেতন করতে গেয়ে ওঠে—
বিপদের বন্ধু মোদের এই বৃক্ষ আদি
এসব কথা গেছেন বলে আমার প্রিয় দাদি
এলাকার উৎসাহিত কিছু ছাওয়াল পাওয়াল তৈয়বের সঙ্গে জুটে গেছে। সদর রাস্তার আশেপাশের গাছে বিজ্ঞাপন ঠুকতে আসা অনেকেই এখন তৈয়ব ভক্তদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচে। গাছের শরীরে পেরেক ঠোকা দেখে আবু তৈয়ব এমন ছটফট করে, যেন পেরেক গাছে নয়, তার শরীরেই ঠুকে দেওয়া হয়েছে। নির্বিচারে গাছ কাটার খবর শুনলে তো আর রক্ষা নাই। এমন আহাজারি জুড়ে দেয় যেন কোনও নিকটাত্মীয় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। সাধ্যে কুলালে খবর পাওয়া মাত্র অকুস্থলে ছুটে যায়। নইলে কাটা গাছের শোকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে আছাড়ি পিছাড়ি চলে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে শোরগোলের খবর আবু তৈয়বের কানে পৌঁছাতে বেশ খানিকটা দেরিই হয়, ততদিনে হাইকোর্টের রায়ে গাছকাটা স্থগিত হয়ে গেছে। আপাতত গাছেদের বিপদ নাই, খবরটা জানার পরও আবু তৈয়ব ‘ঢাকা যাব’র জিকির তুলেছিল। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এ যাত্রা ঢাকা যাওয়া ঠেকিয়েছে জুলেখা।
বছর কয়েক আগে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক প্রশস্ত করার সরকারি সিদ্ধান্তের তোপে হাজার খানেক গাছ কোতলের সম্ভাবনা, এমন খবর চাউর হওয়ার পর অমানুষিক যন্ত্রণার সময় গেছে আবু তৈয়বের। সরকারি ঘোষণার বিরুদ্ধে জড়ো হওয়া গুটিকয়েক সংস্থার প্রতিবাদে আবু তৈয়বও যশোর প্রেসক্লাবের সামনে সটান গিয়ে হাজির হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের সারিতে কাঁচা হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড ধরে দিনভর দাঁড়িয়ে থাকায় তার কোনও ক্লান্তি ছিল না। ওর প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল—
বৃক্ষ দেয় ফল ফলাদি আরও দেয় যে বাতাস
বৃক্ষ দেশে না থাকিলে হইবা কিন্তু ফটাশ।
লাইন দুটো সুর করে মাঝে মধ্যে গেয়েও উঠত আবু তৈয়ব। প্ল্যাকার্ডের লেখা পড়ে কেউ কেউ যে হাসি তামাশা করত না এমন নয়। সেসবও হত। কিছু সংস্থা যশোর-বেনাপোল সড়কের গাছ রক্ষায় ইতিহাসের দোহাই অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনেছিল। বিষয়টা আবু তৈয়বের জানার বাইরে ছিল। দু-একজনের কাছ থেকে যশোর-বেনাপোল সড়কের দুপাশে সারি সারি গাছেদের সাক্ষী রেখে, যুদ্ধের বছর শত, শত, উদ্বাস্তু মানুষের বর্ডার পার হওয়ার কাহিনি জানার পর সে নিজেও তাদের সঙ্গে গলা তুলেছিল। ভাগ্যিস আদালতের রায়ে গাছ কাটার নির্দেশ রদ হয়েছিল। হাজার হাজার গাছ কাটা পড়লে শোকে দুঃখে আবু তৈয়বের জীবনে চরমতম বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা তো ছিলই। তৈয়বের বউ জুলেখা প্রায় সেই কথা ভেবে শিউরে ওঠে। জুলেখা হৃদয়বতী, গাছ নিয়ে পাগলামি করা স্বামীকে বুকভরা মায়া দিয়ে আগলে রাখে। সেই আট-নয় বছর বয়স থেকে তৈয়বকে সে দেখছে। তার অন্তর্গত দুঃখের সবটা হদিশ জানা আছে বলে স্বামীর ক্ষ্যাপামি নিয়ে তার তেমন সরব অভিযোগ নাই। যদিও স্বামীর ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের মাশুল তাকে আর ছেলেটাকেই গুনতে হয়। ভোগান্তি হলেও স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থাকায় উচ্চবাচ্যে যায় না। সংসারে অশান্তির ভোগান্তিকে দীর্ঘায়িত করার কোনও উৎসাহ তার স্বভাবে নাই। সংসারে শান্তি বজায় রেখে স্বামীর অতীত জীবনের তিক্ততা মুছিয়ে দিতেই বরং সে আন্তরিকভাবে উদগ্রীব থাকে। স্বামীর হুটহাট সংসার, দোকান সব ফেলে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর ঝোঁকটা বয়স বাড়লে আপসে কমে যাবে, এমন আশায় সংসারের হাল ধরেছে। ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই দোকানে গিয়ে বসে। কিছু শকুনস্বভাব খদ্দেরের চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার অস্বস্তি গোপন করে স্বামীর অনুপস্থিতিতে দোকান চালায়। সেসময় দশ বছরের ছেলে নবাবের সঙ্গ সামান্য হলেও তাকে ভরসা দেয়। দোকানের এককোণে বসে নবাব স্কুলের পড়া করে। পড়া শেষে নিজের মনে খেলা করে। তৈয়ব যখন দোকান সামলায় তখন রাত নয়টা দশটা অবধি দোকান খোলা থাকে। জুলেখা সন্ধ্যার আগে আগে দোকানের ঝাপ নামিয়ে বাড়ি চলে আসে। তাতে আয় কমলেও মানসিক শান্তি বজায় থাকে। যা দিনকাল পড়েছে, কখন কোন অঘটন ঘটে যায় কে বলতে পারে। জুলেখা যথেষ্ট সুন্দরী। সুন্দর হওয়াটা কখনও কখনও বিপদের আর পাপের সামিল।
গাছেদের জন্য আবু তৈয়বের দরদটা আজকের নয়। বালক বয়স থেকে গাছের প্রতি কেমন একটা নৈকট্য অনুভব করত সে। দাদিজানের কাছ থেকে তৈয়ব গাছেদের ভালোবাসতে শিখেছে। ভালোবাসার সেই গাছের সঙ্গে তার শৈশবের দুঃসহ স্মৃতির একটা গভীর সংযোগও আছে। পেরেক খাওয়া গাছগুলোকে যতবার সে জড়িয়ে ধরে, ততবার শৈশব স্মৃতি দূরত্ব উজিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। অসহায় আবেগে আবু তৈয়ব তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে। গাছের প্রতি কিছু মানুষের নিষ্ঠুরতা আবু তৈয়বকে গাছদরদি হতে উদ্বুদ্ধ করেছে ব্যাপারটা আদতে তেমন নয়। তার ব্যক্তিগত চরমতম দুঃখ ওই গাছের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। তার অন্তর্গত যন্ত্রণা গাছের প্রতি তাকে এতটা দরদি হতে শিখিয়েছে।
গাছ হল মায়ের জাত। তাকে ভালোবাসতে হয়, সম্মান দেখাতে হয়। শৈশবে দাদিজানের মুখে শুনতে শুনতে ওর ভেতর গাছের প্রতি মমতা জন্ম নিয়েছে। বালক বয়সে গাছেদের কষ্টের কারণ না হলেও উঠানের আমগাছ কিংবা পুকুরপাড়ের বিশাল কড়ইগাছের গোড়ায় প্রায় সে পেচ্ছাপ করত। পেচ্ছাপের ফোয়ারায় নকশা কাটা খেলায় খুব আনন্দ পেত। দাদিজান দেখলেই রেগে যেতেন। দাদিজানের কঠিন শাসনের জাঁতাকলে পড়ে তৈয়ব গাছ ঘিরে তার শিশুতোষ খেলাটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। দাদিজান নাতি-নাতনি অন্তপ্রাণ হওয়া সত্ত্বেও শাসনের ব্যাপারে যেমন কঠিন ছিলেন, স্নেহ উপুড় করার বেলাতেও ততটাই উদার ছিলেন। শুধু পেটের ছেলের পাশবিক স্বভাবটাকে শাসনে বাঁধতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে ছিলেন।
ছেলের সামনে শুধু তিনি নন গোটা বাড়িটাই কুঁকড়ে থাকত। সেসব দিনের দগদগে স্মৃতি তৈয়বের পাঁজর ঘেঁষে জেগে থাকে। যা তাকে নিরন্তর দগ্ধ করে। শৈশবের কোনও স্মৃতিই তার মস্তিষ্কের কোষ থেকে মুছে যায়নি। মস্তিষ্ক যেন সযত্নে ধরে রেখেছে সবটা। সে দিব্যি মনে করতে পারে, বাপজান যতক্ষণ বাড়িতে থাকত গনগনে চুলার মতো মেজাজের তাপে সবাইকে দগ্ধ করার ঝোঁকে তড়পাত। তার প্রধান কাজ ছিল পদে পদে মায়ের কাজের ভুল ধরা। পান থেকে চুন খসার উপায় ছিল না। মায়ের সামান্যতম ত্রুটি দেখলেই শুরু হত খিস্তি। মুখের ধার কমে এলে হাত পায়ের ব্যবহার শুরু হত। মনের সুখে বউ পেটাত তৈয়বের বাপজান, আবু তালেব। সেসব অশান্তিময় সময়ে দাদিজান শান্তির বাণী আওড়াত। তাদের দুই ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরে আয়তুল কুরসি পড়ে চলত অবিরাম। দু চোখে বয়ে যেত জলের ধারা। অসহায় ভাই-বোন দুটি দাদির বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকত। শিকারির তাড়া খাওয়া ভীতা হরিণের মতো কাঁপত বুবুটা। তৈয়বের বুকের ভেতরটা কষ্টে ফেটে যেত তার বাকহীন বুবুজানের ভয়ে নীল হওয়া মুখটা দেখে। দাদিজান বিড় বিড় করত মাঝে মাঝে। আরে বউয়ের কী দোষ। পয়দা করনের মালিক আল্লাহ। তিনি ওরম পুতুলের মতো মাইয়ার মুখে জবান না দিলে বউয়ের কী করার আছে? সেই জিদ্দে তুই বউরে নিত্য মাইর দিবি? সংসারে অশান্তি করবি। আল্লাহ সইব না রে। আল্লাহ সইব না।
তৈয়বের বড় বোন পারুল মূক ও বধির। প্রথম দেখায় চট করে বোঝার উপায় ছিল না। পরীর মতো ছিল দেখতে। বাপজান দু চোক্ষে দেখতে পারত না বুবুজান কে। বাপজান বাড়িতে এলেই বুবু ছুটে গিয়ে দাদিজানের ঘরে গিয়ে লুকাত। দিনরাত ওরকম মেয়ের জন্ম দেওয়া নিয়ে মাকে কথা শোনাত। মাঝেমাঝে তৈয়বের ইচ্ছা করত বুবুটাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যায়। ইশারায় সে কথা বোঝাতে চেষ্টা করত সে বোনকে। কী বুঝত পারুল খোদা জানেন। ফিক ফিক করে হাসত কেবল। ওদের দুই ভাইবোনের খুব ভাব ছিল। দাদিজানের কড়া নির্দেশ ছিল এক পলকের জন্যও যেন সে বোনকে কাছ ছাড়া না করে। সব সময় যেন ছায়ার মতো আগলে রাখে। রাখতও তাই। শুধু একটা দিন তৈয়ব তার কর্তব্য ভুলে একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছন ছুটতে ছুটতে অনেকটা দূর চলে গিয়েছিল। ফিরে আসতে আসতে বিকেলটা আর বিকেল থাকেনি, আবার ঠিক সন্ধ্যাও না। পুকুরপাড়, রুমকিদের বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও বুবুর দেখা পায়নি। যখন সে ঘুড়ির পেছন ধাওয়া করে, বুবু তখন কড়ইগাছের নীচে খুকিবু, রুমকিবুদের সঙ্গে চুড়িভাঙা খেলছিল। ফিরে এসে কাউকেই দেখেনি। বাড়ি ফিরে গেছে ভেবে তৈয়বও বাড়িতে চলে এসেছিল। কিন্তু বাড়িতেও বোনের দেখা পায়নি। দাদিজান, মা বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে পাগলের মতো ছুটোছুটি করে সন্ধ্যাভর। সেদিন বুঝি হুট করেই রাত নেমে এসেছিল তাদের বাড়ির উঠানে। পরদিনও খোঁজাখুঁজি চলেছিল দিনভর। জলজ্যান্ত মেয়েটা কোথায় গেল সেটা নিয়ে বাপজানের কোনও হেলদোল দেখেনি ওরা। দুদিন পর পুকুর পাড় থেকে মায়ের আর্তনাদ শুনে দৌড়ে গিয়েছিল দাদিজান আর তৈয়ব।
ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো কড়ইগাছের ডালে ঝুলতে দেখা যায় পারুলকে। বড়মামু তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে, থানা পুলিশ দৌড়ঝাঁপ করেও তেরো বছরের একটা মূক-বধির মেয়ের উপর কে বা কারা অতটা নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে তার কোনও হদিশ পায়নি। সেই প্রথম তৈয়ব ‘গ্যাং রেপ’ শব্দটা শুনেছিল। অর্থটা না বুঝলেও ওটাই যে বুবুর মৃত্যুর কারণ সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি। ওই ঘটনার পরপরই দাদিজান শয্যা নেন। আর উঠে দাঁড়াননি। যে কয়দিন বেঁচে ছিলেন তৈয়বের দিকে এমন জলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। কষ্টে, অনুশোচনায় পুড়ে যেত তৈয়ব। লুকিয়ে কাঁদত একা একা। একদিনের ভুলের মাশুল এভাবে কেন আল্লাহ তাকে দিলেন সেটা ওর ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ধরত না। পারুলবুবুর মৃত্যুর সাতদিনের মাথায় দাদিজান ইন্তেকাল করেন।
দু দুটো মৃত্যুও তৈয়বের বাপজানের পাষণ্ড মেজাজকে ঠান্ডা করতে ব্যর্থ হয়। বরং ওই ঘটনার দায়ও মায়ের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছিল অমানুষটা। একদিন কীসব খেয়ে এসে মাকে চুলার পাড় থেকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে উঠানের আমগাছটার তলায় ফেলে বেধড়ক কিল লাথি চালায়। আর সমানে খিস্তি। আতঙ্কে তৈয়ব দৌড়ে দাদিজানের ঘরে গিয়ে খিল দিয়েছিল। তখন ও স্পষ্ট দেখেছিল জায়নামাজে বসে দাদিজান আয়তুল কুরসি পড়ছেন। ওর বুকের কাছ ঘেঁষে বুবুজান বসে আছে। বুবুর চোখেমুখে আতঙ্কের কোনও চিহ্নই নাই। একটুকরো মিটিমিটি হাসি লেপ্টে আছে। আর কিছু মনে নাই তৈয়বের। ঘুম ভেঙেছিল কিছু মানুষের হাঁকডাকে।
খবর পেয়ে বেলা বাড়ার আগেই বড়মামু ছোটমামু চলে এসেছিলেন। বড়মামু দাপুটে মানুষ। থানা পুলিশ তিনি একাই সামলে ছিলেন। ঘুম ভাঙার পর পুকুরপাড়ের কড়ইগাছটার কাছে ভিড় ঠেলে তৈয়ব এক পলক দেখেছিল মাকে। বেতস লতার মতো মায়ের ছিপছিপে শরীরটা দোল খাচ্ছে গাছের ডালে। কেউ ওকে দেখতে পেয়ে টেনে ভেতর বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। এক মাসের ভেতর তিন তিনটে মৃত্যু থাবা বসিয়ে তৈয়বের জীবন থেকে মানসিক শান্তি খুবলে তুলে নিয়েছিল। একটাই সান্ত্বনা পাষণ্ড বাপটা তার কর্মের ফল হাতে হাতে পেয়েছিল। মামুদের ক্ষমতা ছিল বলেই লোকটার বাকি জীবন গরাদের পেছনে কাটানোর বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
মায়ের আত্মহত্যার পর বড়মামু তৈয়বকে নিজের কাছে নিয়ে যান। তাকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়ে বড় মেয়ে জুলেখার সঙ্গে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেন। বিয়ে-সংসার ওসবে তৈয়বের কোনও মোহ ছিল না। বাপ-মায়ের অসুখী দাম্পত্য জীবন তার মনে ওসব নিয়ে বিতৃষ্ণা তৈরি করেছিল। বড়মামুর মতের বিপক্ষে কিছু বলতে পারেনি। তাঁর মর্জিমাফিক সবটা হয়েছিল। ওদের ঘর সংসার গুছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও বড়মামুর রায় ছিল চূড়ান্ত। ফেলে আসা ভিটায় নতুন করে ঘরদোরের বন্দোবস্তের যাবতীয় দায় বড়মামু সামাল দেন। ছোটমামু মনিহারি একটা দোকান দাঁড় করে দিয়ে যান। সবই ঠিকঠাক চলে। কিন্তু যখনই শৈশবের স্মৃতিগুলো হানা দেয় তৈয়ব কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে। অস্থিরতা গ্রাস করে তাকে। চিন্তাভাবনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়ত প্রথম প্রথম। পথে পথে ঘোরাঘুরি শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরত। ওরকম ঘোরাঘুরির সময় একদিন চোখের সামনে গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে একজনকে বিজ্ঞাপন বসাতে দেখে। ক্ষেপে গিয়ে লোকটাকে তাড়া করেছিল। দাদিজানের কথা মনে পড়েছিল। গাছ মায়ের মতো। তাকে ভালোবাসতে হয়। সম্মান করতে হয়।
মাকে ভালোবাসার বা সম্মান করার বয়সে পৌঁছানোর আগেই মা ওকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিল। যে বোনটাকে ছায়ার মতো ঘিরে থাকার কথা ছিল, একদিনের একটা ভুলের জন্য ওকে জব্দ করতেই বুঝি সে উড়াল পঙ্খী হয়ে উড়ে গেছে পরীরাজ্যে। গাছগাছালির ছায়ায় মা-বোনকে দেখতে পায় আবু তৈয়ব। গাছের শরীরে কেউ পেরেক ঠুকছে দেখলে বিগত দিনের অসহায় অক্ষমতা তৈয়বকে তাতিয়ে দেয়। মূক-বধির গাছের উপর মানুষের নিষ্ঠুরতার বিরদ্ধে সে রুখে দাড়ায়। মাকে তার ভালোবাসা হয়নি। গাছকে ভালোবেসে খামতিটুকু মিটাতে চায়। বোনকে নিরাপত্তার ছায়ায় রেখে নিশ্চিত জীবন দিতে পারেনি— গাছ কাটা দেখলেই ছায়া উজারের আতঙ্কে ক্ষেপে ওঠে। গাছেদের ভেতর আবু তৈয়ব মাকে খুঁজে পায়। বোনের উপস্থিতি টের পায়। পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে খানিক কেঁদে বুকের পাঁজর ঘেঁষে থাকা মেঘদিনের ব্যথা ধুইয়ে নিতে চায়। আবু তৈয়ব ভাবে একদিন সেও গাছ হয়ে যাবে। মা-বোনের আরও কাছাকাছি যেতে পারবে। গাছজীবনই ভালো। মনুষ্যজীবনের মতো সেই জীবনে নিষ্ঠুরতার লেশমাত্র নাই। খুনোখুনি নাই, পাষণ্ডতা নাই, গ্যাং রেপ নাই— কোনও অনাসৃষ্টিই নাই ওই ভুবনে। আছে কেবল উজার করে দিতে পারার তৃপ্তি।
কিন্তু মানুষ তো গাছেদের মতো নির্বিবাদী নয়। কেড়ে নেওয়াতেই তার সুখ। পথের ধারে গাছে গাছে বিজ্ঞাপন সাঁটতে-আসাদের খুব কম সংখ্যকই নিজস্ব ব্যবসার বিজ্ঞাপন দিতে আসে। যারা সে কাজে আসে তারা মালিকপক্ষের হয়ে গাছের বুকে বিজ্ঞাপন ঠুকে দিয়ে যায়। গাছের গায়ে বিজ্ঞাপন ঠুকতে পয়সা না লাগলেও বিজ্ঞাপন, কর্মী, এসবের পেছনে পয়সাপাতি খরচা হয় নিঃসন্দেহে। তৈয়বের মতো উটকো গাছদরদির জন্য তাদের প্রচারণায় বিঘ্ন ঘটে। বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ হওয়া পয়সাপাতি পানিতে পড়ে। স্বভাবতই সেটা নিয়ে আক্রান্তদের মনে ক্ষোভের জন্ম হয়। আবু তৈয়বের ওপর সেই ক্ষোভ উজারের সুযোগে থাকে অনেকে। এদিন সেই সুযোগটাও পেয়ে যায় বিজ্ঞাপনদাতাদের নিযুক্ত কতিপয় কর্মচারী।
মাস তিনেক আগে পলাশপুর বাজারের আশেপাশের গাছগুলোকে আবু তৈয়ব পেরেকমুক্ত করে এসেছিল। পলাশপুর বাজারের গাছগুলোতে নাকি আবারও পেরেক ঠুকে বিজ্ঞাপন বসানো হচ্ছে। সন্ধ্যায় দোকানে চা খেতে আসা বশির, হুরমতের কাছ থেকে খবরটা জানার পর থেকেই আবু তৈয়বের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হয়। রাতেই সিদ্ধান্ত নেয় ভোর থাকতে থাকতে পলাশপুর বাজারের দিকে যাবে। পলাশপুর আসতে যেতে মেলা সময় লাগে। যাওয়ার পথে রহিমুদ্দীনের ভ্যানটা গোটা দিনের জন্য নেবে কিনা একবার ভাবে। তারপর কি মনে হওয়ায় আবার সেটা বাতিলও করে। খুব ভোর ভোর ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ঘুমন্ত বউ আর ছেলের মায়া চুয়ানো মুখ দুটোর দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বুকের ভেতর মায়া নামের অনুভূতি গড়ান দেয়। আবু তৈয়বকে অবাক করে দিয়ে ওর দুচোখ জলেও ভরে ওঠে। নিজের এমন ভাবালুতায় অবাক হয় একটু। গা ঝাড়া দিয়ে আরেকবার ঘুমন্ত দুজনের দিকে তাকিয়ে, ঘরের দোরটা ভেজিয়ে দিয়ে পথে নামে গাছপাগল আবু তৈয়ব।
পলাশপুরের খবরটা কীভাবে ওরাও জেনে গিয়েছিল। আবু তৈয়ব রওনা দেওয়ার কয়েক ঘন্টা পর ওরাও জোট পাকিয়ে রওনা দেয়। ছটফটে দিনের আলোতে চারপাশ তখন সয়লাব। নিরাপদ দূরত্বে থেকে লোকগুলো তৈয়বের দিকে নজর রাখে। আজকে পাগলাটাকে জন্মের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ওদের কারও কারও হাত নিশপিশ করে।
বাতাসে কিসের একটা গন্ধ পায় আবু তৈয়ব। বুক ভরে টেনে নেয় সে বাতাস। ইতোমধ্যে সে কয়েকটি গাছ থেকে পেরেকের ভার নামিয়েছে। এমন বেরহমের মতো এলোপাথারি পেরেক ঠুকেছে দেখে বুকে ধাক্কা লাগে তৈয়বের। এই বুড়ো অশত্থের কী হাল করেছে দেখো! নিজের মনে বিড় বিড় করতে করতে গাছটার গায়ে হাত বুলায়। শরীরে কেমন এক শিহরণ টের পায়। দুইহাতের বেড় দিয়ে বয়সী গাছটাকে সে জাপটে ধরে। নাক ডুবিয়ে দেয় গাছের শরীরে। বহুবছরের স্মৃতি মাড়িয়ে তেলমশলার পাঁচমিশালি একটা সুবাসের সঙ্গে মা মা নরম গন্ধটায় নাক ভরে যায় তৈয়বের। সব ভুলে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিতে থাকে। খেয়াল করে না বেশ কিছুটা দূরে গুটি কয়েক লোক এগিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে ধারালো অস্ত্র। রোদের ঝিলিক পিছলে যায় অস্ত্রের শরীর বেয়ে।
কানের কাছে কে বলে আয় বাবা বুকে আয়? মা নাকি! ডাকটা সমস্ত শরীর দিয়ে শুনবে বলে আবু তৈয়ব আরও ঘন হয়ে গাছের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। গাছটাও বুঝি আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে তৈয়বকে। মায়ের বুকের ওমে মিশে যেতে যেতে গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয় আবু তৈয়ব। খানিক দূরে অপেক্ষায় থাকা ষণ্ডাগুলো, বাজারের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা কিসিমের মানুষেরা বিস্ফোরিত চোখে অবিশ্বাস্য, অভূতপূর্ব এক ঘটনা চাক্ষুষ করে।
গাছ অন্তপ্রাণ আবু তৈয়ব একটা গাছে পরিণত হয়।