শিবাশীষ বসু
প্রাবন্ধিক, ইতিহাস-অন্বেষক
প্রথম পর্বের পর
তিন
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং শিশুপাঠ্যের সিলেবাসে ধর্মশিক্ষা নিয়ে প্রবল বিতর্ক চলেছিল দীর্ঘদিন। তাই বলা চলে শিক্ষার ক্ষেত্রে সেকুলারিজম বিদ্যাসাগরের একটি বড় কৃতিত্ব। শুধুমাত্র বাংলা শিশুপাঠ্য বই-ই নয়, সংস্কৃত শেখার প্রাথমিক বই, ঋজুপাঠ-এও কোনও ধর্মগ্রন্থ থেকে কোনও বাণী বা শ্লোক নেওয়া হয়নি। বিদ্যাসাগরের এই নীতির সমালোচনায় খড়গহস্ত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মহীন বোধোদয়-বর্ণপরিচয়ের তীব্র সমালোচনা করে বিবেকানন্দ বলেন, “‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’, ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’— ওতে কোনও কাজ হবে না। ওতে মন্দ বৈ ভাল হবে না। রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ্ থেকে ছোট ছোট গল্প নিয়ে অতি সোজা ভাষায় কতকগুলি বাঙলাতে আর কতকগুলি ইংরেজীতে কেতাব করা চাই। সেইগুলি ছোট ছেলেদের পড়াতে হবে।”[1] বিদ্যাসাগর জীবনীকার ইন্দ্র মিত্র স্পষ্টভাষায় মন্তব্য করেছেন, “স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের মুখ থেকে নির্গত হলেও বিদ্যাসাগরের রচনা সম্পর্কে এই উক্তি সম্পূর্ণ উপেক্ষাযোগ্য। স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া বিদ্যাসাগরের রচনা সম্পর্কে এরকম অশ্রদ্ধেয় উক্তি আর কেউ উচ্চারণ করেননি।”[2] জানি না বিবেকানন্দের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরমেশ আচার্যের কী মতামত, কারণ তিনি তো আবার রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ জুটির নব্যহিন্দু আন্দোলনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ— “তখনকার কলকাতার আবহাওয়ার ভদ্রলোক সমাজের বাঁধনের জন্য এ ধরনের কিছু ধর্মীয় আন্দোলনের দরকার ছিল।”[3]
অবশ্য বিবেকানন্দের মুখ থেকে এই ধরণের মন্তব্য অপ্রত্যাশিত নয়, কারণ তিনি সেকুলার ছিলেন না। তাই শিক্ষার শুরুতেই তিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থের আশ্রয় নেওয়ার পক্ষপাতী। বিবেকানন্দের মতে, “আসল ধর্মের রাজ্য যেখানে, সেখানে লেখাপড়ার প্রবেশাধিকার নেই।”[4] এমনকি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমও প্রথমদিকে ধর্মভিত্তিক-ই ছিল। রবি-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, প্রথমদিকে শান্তিনিকেতন আশ্রমের “ছাত্রদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের জন্য সাদা, বৈদ্য ও কায়স্থদের জন্য লাল ও বৈশ্যদের জন্য হলুদ আলখাল্লা জাতীয় পোষাক নির্ধারিত ছিল। অনতিপরে বর্ণভেদ ঘুচিয়ে সকলের জন্যই গৈরিক আলখাল্লা নির্ধারিত হয়…।”[5] আমাদের জাতীয় আন্দোলনের যুগেও কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছাড়া নীতিশিক্ষার কথা ভাবা হয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের স্ত্রীশিক্ষা প্রোজেক্ট নিয়েও সমালোচনায় মুখর ছিলেন বিবেকানন্দ— বেলুড় মঠে বসে জুন, ১৯০১-এ তিনি বলেন, “… শিক্ষাই বলিস আর দীক্ষাই বলিস, ধর্মহীন হলে তাতে গলদ থাকবেই থাকবে। এখন ধর্মকে centre (কেন্দ্র) করে রেখে স্ত্রীশিক্ষার প্রচার করতে হবে। ধর্ম ভিন্ন অন্য শিক্ষাটা secondary (গৌণ) হবে। ধর্মশিক্ষা, চরিত্রগঠন, ব্রহ্মচর্যব্রত-উদযাপন— এজন্য শিক্ষার দরকার। বর্তমানকালে এ পর্যন্ত ভারতে যে স্ত্রীশিক্ষার প্রচার হয়েছে, তাতে ধর্মটাকেই secondary (গৌণ) করে রাখা হয়েছে, তাইতেই তুই যে-সব দোষের কথা বললি, সেগুলি হয়েছে।”[6]
বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি নিয়েও বিবেকানন্দের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। তাঁর মতে এই শিক্ষাব্যবস্থার “প্রায় সবই দোষ, কেবল চূড়ান্ত কেরানী-গড়া কল বৈ তো নয়। কেবল তাই হলেও বাঁচতুম। মানুষগুলো একেবারে শ্রদ্ধা-বিশ্বাস-বর্জিত হচ্ছে। গীতাকে প্রক্ষিপ্ত বলবে; বেদকে চাষার গান বলবে।”[7] সম্ভবত এই শেষ লাইনটির লক্ষ্য ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত।
পরবর্তীকালে বিবেকানন্দের দেখা পথ ধরে ধর্মশিক্ষার দাবি ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। আখ্যানমঞ্জরী, চরিতাবলী ইত্যাদি শিশুশিক্ষার বইতে বিদ্যাসাগর একজনও ধর্মনেতাকে জায়গা দেননি। ফলে জীবনীকার বিহারীলাল সরকার তার মধ্যে ‘কুশিক্ষার বীজ’ দেখতে পান। বিহারীলাল লিখেছিলেন, “জীবনচরিতে যে সকল বিজাতীয় ও বিদেশীয় চরিত্রের অবতারণা হইয়াছে, তাহাতে শিক্ষণীয় গুণ থাকিতে পারে; ফলে কিন্তু অলক্ষ্যে ইহাতে কেমন একটা কু-শিক্ষা আসিয়া পড়ে। জীবনচরিতের বিষয়ীভূত চরিত্রপাঠে ধারণা জন্মে তাঁহারা মনুষ্যের আদর্শ; সুতরাং তাঁহাদের অন্যান্য আচার, ব্যবহার, শিক্ষা, দীক্ষা প্রভৃতিও অনুকরণীয়। কাজেই সেই সকলের অনুকরণেই প্রবৃত্তি সহজে ধাবিত হয়।”[8] বিহারীলালের মতে তাহলে সুশিক্ষা কীভাবে হবে? “স্বধর্মপরায়ণ হিন্দুর অথবা পুরাণান্তর্গত পূণ্যশ্লোক পবিত্র চরিত্রাবলীর যে কোনও গুণ যে কোনও আকারে প্রকটিত হউক না কেন, তাহা হিন্দু সন্তানের শিক্ষণীয়। সেই প্রকটিত গুণানুসরণে হিন্দুসম্তান চরিত্রসৃষ্টির যেখানে গিয়া উপস্থিত হউক না কেন, দেখিবে, হিন্দুর চরিত্র-গঠনোপযোগী উপকরণ তথায় জাজ্বল্যমান।”[9] এইসব কথায় বিরক্ত হয়ে পরবর্তীকালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘জাতিগঠনে বাধা — ভিতরের ও বাহিরের’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন,
আমরা এখন ‘জাতীয় শিক্ষা’ চাই। কিন্তু জাতীয় শিক্ষা কি? জাতীয় শিক্ষা অর্থে কি বটতলার বই পড়া? আৰ্য্যসমাজের লোকে জাতীয় শিক্ষার অর্থ করছেন বেদ পাঠ করা; কেন না তাঁদের মতে বেদ অভ্রান্ত। বিবেকানন্দের ভক্ত বলবেন— বেদান্ত পাঠ কর— দ্বৈত, অদ্বৈত ও বিশিষ্ট দ্বৈতবাদ বিচার কর। আবার কেহ বা বলবেন— রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ পাঠ কর। কিন্তু হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান প্রভৃতি নানা ধর্মাবলম্বী ভারতবাসীগণ সকলে এই ব্যবস্থায় সমমত হবেন কি? মুসলমান ‘জাতীয়’ অর্থে বলবেন— কোরান পড়। খৃষ্টান বলবেন— বাইবেল পড়। এত মতের অনৈক্য হলে আসল কাজে যে বাধা পড়বেই। পরম ধার্মিক হিন্দু রাজার রাজত্বকালে (পড়ুন শ্রীরামচন্দ্র) শূদ্র তপস্যা করছে বলে তার শিরচ্ছেদনের ব্যবস্থা হল; মনুমহাশয় ব্যবস্থা করেন যে শূদ্রের কর্ণে বেদোচ্চারণ-শব্দ প্রবেশ করলে উত্তপ্ত তরল সীসক সেই কর্ণে ঢেলে দিতে হয়। এই মনুস্মৃতি নিয়ে জাতীয় শিক্ষার ব্যবস্থা হয় কি?[10]
স্পষ্টতই, সুকুমারমতি শিশুর মনে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বীজ বপন না করে প্রকৃত মানবতাবাদীর কাজই করেছিলেন বিদ্যাসাগর। কীভাবে করেছিলেন? ব্যাপাটা বুঝতে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ‘মিথ্যা বললে ঠাকুর পাপ দেয়’— শিশুদের উপদেশ দিতে গিয়ে আজও অভিভাবকদের মুখে একথা শোনা যায়৷ কিন্তু ‘বর্ণপরিচয়ে’ বিদ্যাসাগর লিখলেন,
কখনও কাহাকেও কুবাক্য কহিও না। কুবাক্য কহা বড় দোষ। যে কুবাক্য কহে, কেহ তাহাকে দেখিতে পারে না। … সদা সত্য কথা বলিবে। যে সত্য কথা কয়, সকলে তাহাকে ভাল বাসে। যে মিথ্যে কথা কয়, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না, সকলেই তাহাকে ঘৃণা করে। তুমি কখনও মিথ্যা কথা কহিও না। … কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইও না। তাঁহারা যখন যাহা বলিবেন, তাহা করিবে। কদাচ তাহার অন্যথা করিও না। পিতা মাতার কথা নস শুনিলে, তাঁহারা তোমায় ভাল বাসিবেন না।[11]
লক্ষণীয় যে, এর মধ্যে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে৷ একদিকে অতিপ্রাকৃত সত্তাকে অস্বীকার করা, অন্যদিকে, নিছক পাপপূণ্যের বায়বীয় ব্যাপার নয়, কুবাক্য বা মিথ্যা বলা-না বলা, অথবা পিতামাতার অবাধ্য হওয়া–না হওয়ার সঙ্গে একটি মানবিক সম্পর্কের স্থায়িত্ব যুক্ত করে দেওয়া, এই দিকটিই এসেছে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সেটি হল, নবজাগরণের সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গি৷
চার
চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বিদ্যাসাগরের জীবনী প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে। চণ্ডীচরণ ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম, তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে তাঁর চিন্তা ও বিচারকেও যে প্রভাবিত করেছিল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হলে যে কোনও সংস্কার কার্যই যে ব্যর্থ হয়, এই ধারণা সমসাময়িক কয়েকজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মতো তাঁরও ছিল। তাই বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার কার্য কেন প্রত্যাশিত সাফল্য লাভ করতে পারেনি, সে সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে চণ্ডীচরণ লেখেন, “… ধর্ম্মকে প্রাণরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়া সমাজ-সংস্কারের সূচনা করিতে হয়। ধর্ম্মরূপ ভিত্তির উপর যাহার প্রতিষ্ঠা, সেই সংস্কারকার্য্যই বাস্তবিক সুসিদ্ধ হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমাজ-সংস্কার কার্য্য সম্পূর্ণরূপে শাস্ত্র ও শাস্ত্রগত ধর্ম্ম-ব্যাখ্যাসম্মত হইয়াছিল, সে বিষয়ে কোন ত্রুটি হয় নাই, কিন্তু তাঁহার সংস্কার ব্যাপার ধর্ম্ম সংস্কার প্রসূত হয় নাই বলিয়া বিশেষ ভাবে স্থায়িত্বলাভ করিল না।”[12] বিদ্যাসাগরের সেকুলার ও বস্তুবাদী মানসিকতাটি চণ্ডীবাবু এক্ষেত্রে উপলব্ধি করতে পারেননি বলেই মনে হয়। দৃশ্যত অত্যন্ত ক্ষুব্ধ গোঁড়া হিন্দু জীবনীকার বিহারীলাল সরকারও তীব্র সমালোচনা করেছিলেন বিদ্যাসাগরের— “হিন্দুধর্ম্মের অন্তস্থলে প্রবেশ করিবার অধিকার তাঁহার ছিল না; হিন্দু সমাজের গঠনের মূল-তত্ত্ব এইজন্য তিনি লক্ষ্য করিতে সমর্থ হইতেন না। তিনি হিন্দুর যে সামাজিক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, তাহাতে ইহার পরিচয় পাওয়া যায়।”[13]
এখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের কয়েকটি মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৮৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, নিউ ইয়র্ক থেকে শিষ্য আলাসিঙ্গাকে লিখিত— “তথাকথিত সমাজসংস্কার নিয়ে মাথা ঘামিও না, কারণ গোড়ায় আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে কোনপ্রকার সংস্কারই হতে পারে না। তাঁর কথা প্রচার করে যাও, সামাজিক কুসংস্কার এবং গলদ সম্বন্ধে ভালমন্দ কিছু বলো না।”[14] এবং ৩০ জুলাই ১৮৯৫, ওই একই ব্যক্তিকে লিখিত— “বাজে সমাজসংস্কার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না, প্রথমে আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে সমাজসংস্কার হতে পারে না। কে তোমায় বললে, আমি সমাজসংস্কার চাই? আমি তো তা চাই না! ভগবানের নাম প্রচার কর, কুসংস্কার ও সমাজের আবর্জনার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলো না।”[15]
বিবেকানন্দ যে সময়কালে বলেছেন, দেশের লোক ধর্মানুগত, তাই তাদের শিক্ষা দিতে হবে ধর্মের পথে এবং তাদের শেখাতে হবে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ করতে, তার অনেক আগেই, আধুনিক নবজাগ্রত চিন্তার ভিত্তিতে বিদ্যাসাগর বলেছেন, “ধর্ম যে কী, তাহা মনুষ্যের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোন প্রয়োজন নাই৷ … আমার বোধ হয় যে, পৃথিবীর প্রারম্ভ হইতে এরূপ তর্ক চলিতেছে ও যাবৎ পৃথিবী থাকিবে, তাবৎ এ তর্ক থাকিবে; কস্মিনকালেও ইহার মীমাংসা হইবে না৷”[16] রামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থের লেখক শ্রীম বিদ্যাসাগরের মুখে ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব শুনেছিলেন— “তাঁকে তো জানবার জো নাই! এখন কর্তব্য কী? আমার মতে কর্তব্য, আমাদের নিজের এরূপ হওয়া উচিত যে, সকলে যদি সেরূপ হয়, পৃথিবী স্বর্গ হয়ে পড়বে। প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত যাতে জগতের মঙ্গল হয়।”[17] স্পষ্টতই, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ব্যাপারটাকে বিদ্যাসাগর বরাবরই সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ রেখে ধর্মীয় ভাবধারা থেকে মুক্ত যুক্তি, পরীক্ষিত সত্য এবং বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই চলতে চেষ্টা করেছেন৷ তিনি বুঝেছেন, অতিপ্রাকৃত সত্তা আছে কি নেই, সে প্রশ্নের মীমাংসার প্রচেষ্টার খুব প্রয়োজন নেই, যেটা প্রয়োজন তা হল, পার্থিব মানবতাবাদী চিন্তা ও কর্মের প্রসার। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতে, “বস্তুতই দুঃখদাবানলের কেন্দ্রস্থলে উপবেশন করিয়া জগতের মঙ্গলময়ত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা করা তাহার প্রকৃতির বিরূদ্ধ ছিল। বোধ করি, সেই জন্যই ঈশ্বর ও পরকাল সম্বন্ধে নিজ মত প্রকাশ করিতে তিনি চাহিতেন না। তাঁহার প্রবৃত্তি তাঁহাকে যে কৰ্ত্তব্যপথে চালাইত, তিনি সেই পথে চলিতেন। মনুষ্যের প্রতি কৰ্ত্তব্য সম্পাদন করিয়াই তিনি সন্তুষ্ট থাকিতেন, গণ্ডগোলে প্রবৃত্ত হইবার তাঁহার অবসর ছিল না। এমন দিন কবে আসিবে, যে দিন মনুষ্যসমাজ সাম্প্রদায়িক কোলাহলের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইবে; যে দিন আপামর সাধারণ বিতণ্ডা ত্যাগ করিয়া বিদ্যাসাগরের অনুবৰ্ত্তী হইয়া মনুষ্যের প্রতি কর্তব্যনির্ণয়ে মন দিতে অবকাশ লাভ করিবে।”[18]
খানিকটা সমালোচনার সুরে হলেও জীবনীকার বিহারীলাল সরকার যথার্থই লিখেছিলেন, “…অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখকাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া, হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্ম্মকর্ম্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন? দয়াময় কৃপা করিয়া, কাল ধৰ্ম্মসিদ্ধির মানসে তাঁহার হৃদয়ে পর-দুঃখকাতরতার স্রোত এতই প্রবল করিয়া দিয়াছিলেন যে, বংশ-পরস্পরাগত ধর্মভাব ও শাস্ত্রজ্ঞান কোথায় ভাসিয়া গেল। বিধবার দুঃখ দেখিয়া বিদ্যাসাগর গলিয়া গেলেন। বহুবিবাহে কুলীনকামিনীর ক্লেশ দেখিয়া তদ্বিমোচনে বিদেশী রাজার আশ্রয় লইলেন। কিন্তু কী হইতে কী হইল? হিন্দু বিবাহে কী পবিত্র সম্বন্ধ, ব্রহ্মচর্য্যের চরম উদ্দেশ্য কী, কোথা হইতে কোন্ মুখ্যধর্ম্মসিদ্ধির জন্য ব্রহ্মচর্য্যের ব্যবস্থা হইয়াছে, কিরূপে ব্ৰহ্মচর্য্যে ব্যাঘাত পড়িল, কিরূপ ব্যাঘাতে সমাজের কী অনিষ্টের সূত্রপাত হইয়াছে, বিদ্যাসাগর তাহা বুঝিলেন না, তাঁহার অপার দয়াপ্রবৃত্তি তাঁহাকে তাহা বুঝিতে অবসর দিল না। তাঁহার সেই দয়াগুণে তাঁহার পৈত্রিক ধৰ্ম্ম, শাস্ত্র সবই ভাসিয়া গেল। এইরূপ বিদ্যাসাগরের চরিত্রে দেখিবে, দয়াগুণেই,— আত্মনির্ভরতাগুণেই তাঁহার নিকট আর কিছুই তিষ্ঠিতে পারে নাই। বিদ্যাসাগর কালের লোক। কালধৰ্ম্মই তিনি পালন করিয়া গিয়াছেন। ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে; হিন্দুধর্ম্মে আঘাত লাগিয়াছে। হিন্দুসমাজ বিশৃঙ্খলার স্রোতে ভাসিয়াছে। কিন্তু বিদ্যাসাগরের অপরাধ কী? যিনি তাঁহার হৃদয়ে এত দয়া— পরদুঃখকাতরতা দিয়াছিলেন, তিনিই জানেন, কেন এমন হইয়াছিল।”[19] তাঁর নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তি নয়; চিরকাল মানুষ-ই তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে ছিল, এইটাই সবচেয়ে বড় কথা। এই পার্থিব মানবতাবাদ-ই বিদ্যাসাগরকে বারংবার প্রণোদিত করেছে মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে গেলে তথাকথিত কোনও পরলোক নয়, বরং ইহলোকেই তা করতে হবে, এবং তা করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, দেশাচার ও কুসংস্কারের বাধাকে সবলে সরিয়ে।
পাঁচ
সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধে দেবাশিস ভট্টাচার্য লিখেছেন, বিদ্যাসাগরের মূল চারজন জীবনীকার, অর্থাৎ চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারীলাল সরকার এবং সুবলচন্দ্র মিত্র— এঁরা সকলেই ধার্মিক মানুষ ছিলেন, এবং সেইকারণেই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, বিদ্যাসাগর খানিকটা ব্যতিক্রমী হলেও “আসলে তিনি পরম ধার্মিকই ছিলেন, তা না হলে তিনি তাঁরই রচিত শিশুপাঠ্যে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও মহিমা ঘোষণা করেছেন কেন? সারাজীবন হিন্দু ব্রাহ্মণের সুনিশ্চিত চিহ্ন উপবীত ধারণ করলেন কেন? ‘হিন্দুর অভক্ষ্য’ কখনও খেলেন না কেন? তাঁর স্বহস্তে লেখা চিঠিপত্রের মাথায় সব সময়ে ‘শ্রীহরি শরণং’ লিখতেন কেন? পিতার মৃত্যুর পরেই বা পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করলেন কেন?”[20] দেবাশিসবাবুর মতে, ইদানীং এই একই প্রশ্নগুলোকে তুলে ধরে বিদ্যাসাগরকে আদ্যন্ত রক্ষণশীল হিন্দু ব্রাহ্মণ প্রমাণ করতে চাইছেন তথাকথিত প্রান্তিক-দরদী র্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবীরাও।
অনেকদিন আগে, আরেকজন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্ত মানুষ, রামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থের লেখক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ওরফে শ্রীম আমাদের জানিয়েছিলেন যে, বিদ্যাসাগর “হিন্দুদের ন্যায় শ্রাদ্ধাদি ধর্মকর্ম সমস্ত করিতেন, গলায় উপবীত ধারণ করিতেন, বাঙলায় যে-সকল পত্র লিখিতেন, তাহাতে ‘শ্রীশ্রীহরিশরনম্’ ভগবানের এই বন্দনা আগে করিতেন।”[21] এই মন্তব্যেরই ধুয়ো তুলে পরমেশ আচার্যের মতো র্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবীরা সরাসরিভাবে দাবী করেছেন বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক বা সংশয়বাদী বলা গবেষকরা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত, তিনি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন। “তা না-হলে গলায় পৈতা, শাস্ত্র মেনে বাপ-মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি করা, হিন্দুর অভক্ষ্য না-খাওয়া, চিঠিপত্রের মাথায় ঠাকুর দেবতার নাম এসব নজরেই এল না।”[22] জীবনীকার ইন্দ্র মিত্রও একই প্রসঙ্গ তুলে মন্তব্য করেছেন, “ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে কি চিঠিতে ঈশ্বরের নাম এমন করে লিখতে পারতেন বিদ্যাসাগর?”[23]
বিদ্যাসাগরের চিঠিপত্রের গোড়ায় যে ‘শ্রীশ্রীদুর্গা শরণং’ অথবা ‘শ্রীশ্রীহরিঃ সহায়’ ইত্যাদি লিখতেন, জীবনীকার মনি বাগচি তার একটি চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে এটি বিদ্যাসাগরের অভ্যাসের ফলও নয়, বিশ্বাসের ফলও নয়— “যে কারণে চটি জুতা পায়ে দিতেন, থান-ধুতি মোটা চাদর ব্যবহার করতেন এবং ভট্টাচার্যের মতো মাথা কামাতেন, শিখা রাখতেন, ঠিক সেই কারণেই চিঠির শিরোনামায় দুর্গা বা হরিকে স্থান দিয়েছিলেন। সেই স্বজাত্যবোধ— হয়তো একেই তিনি বাঙালির জাতীয়ত্বের একটা অঙ্গ মনে করতেন।”[24] এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “চিঠির উপর শ্রীহরি লেখা থাকিলে লোক নাস্তিক হয় কি না ইহার উত্তর দেওয়া আমার অসাধ্য; তবে আমি শপথপূর্ব্বক বলিতে পারি যে, কোনও কোনও সময় বিদ্যাসাগর এই প্রকার বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন— ‘ঈশ্বর যদি থাকেন ত তিনি ত আর কামড়াবেন না।’ একথা আস্তিক না নাস্তিকের মুখে শোভা পায়, তাহা বিচক্ষণ ব্যক্তিরা বিবেচনা করিবেন।”[25] কৃষ্ণকমল নিজে নাস্তিক বলে বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক প্রমাণ করতে আগ্রহী ছিলেন, এমন একট অভিযোগ শোনা যায়, কিন্তু বিদ্যাসাগরের কথাবার্তাতে কোনওকালেই ঈশ্বরবিশ্বাসের কোনও পরিচয়ও পাওয়া যায় না।
স্বামী বিবেকানন্দ আবার সম্পূর্ণ অন্য ধরনের যুক্তি দিয়ে বিদ্যাসাগরকে ঈশ্বরবিশ্বাসী প্রমাণ করতে চেয়েছেন। বিদ্যাসাগরের মানুষের প্রতি গভীর প্রেমকে তিনি ঈশ্বরপ্রেম নামে অভিহিত করেছিলেন। ৮ মে ১৮৮৭, শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত একদিন কথা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের বেত খাওয়ার গল্পটি উল্লেখ করে বলেন, “তাই বিদ্যাসাগর বলেন নিজেই সামলাতে পারি না, আবার পরের জন্য বেত খাওয়া! (সকলের হাস্য) আমি নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু বুঝি না, আবার পরকে কি লেকচার দেব?” উত্তরে বিবেকানন্দের মন্তব্য— যে এটা বোঝেনি, সে আর পাঁচটা বুঝলে কেমন করে? … যে এটা বোঝে নাই, সে দয়া, পরোপকার বুঝলে কেমন করে? স্কুল বুঝলে কেমন করে? যে একটা ঠিক বোঝে, সে সব বোঝে।”[26] বিদ্যাসাগরের মানবপ্রেম যে তাঁর মানবতাবাদের প্রকাশ, এটা বিবেকানন্দের ধর্মবিশ্বাসী চিন্তাধারায় ধরা পড়েনি।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিয়ে বিদ্যাসাগরের নির্বিকার থাকবার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত মেলে ‘শ্লোকমঞ্জরী’তে। বাল্যকালে গঙ্গাধর তর্কবাগীশের কাছে শোনা সরস কবিতাগুলিরই সঙ্কলন এই গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই সঙ্কলনের মধ্যে ঈশ্বর অথবা পরমার্থ বিষয়ক একটি কবিতাও স্থান পায়নি। বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে ‘এডুকেশন গেজেট’ তির্যক ভঙ্গিতে লিখেছিল, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই সংগ্রহের মধ্যে দেববিষয়ক বা পরমার্থ বিষয়ক নাই বলিলেই হয়। হয় তাঁহার গুরুদেব সে সকল শিষ্যকে বলেন নাই, অথবা শিষ্যের স্মরণ নাই।”[27]
প্রাণপণ প্রচেষ্টায় বিদ্যাসাগরকে আস্তিকের খাটে শোয়ানোর বাসনায় ইন্দ্র মিত্র বিদ্যাসাগরের আর একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টার ফলেই ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড’ তৈরি হয়েছিল এবং তিনি বছর তিনেক এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু একসময় এই ফান্ডের কাজকর্মে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ায় এবং প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের কাজকর্ম বিদ্যাসাগরের পছন্দ না হওয়াতে তাঁদের একটি চিঠি লিখে বিদ্যাসাগর এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। ইন্দ্র মিত্র জানিয়েছেন, ১৮৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফান্ডের ডিরেক্টরদের কাছে লিখিত এই চিঠিতে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, “এই ফন্ডের সহিত আর সংযুক্ত থাকিলে ভবিষ্যতে আমাকে দুর্নামের ভাগী হইতে হইবে এবং ঈশ্বরের কাছেও জবাবদিহি করিতে হইবে। এই ভয়ে অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও এবং অত্যন্ত দুঃখের সহিত এই ফন্ডের সহিত আমার সকল সম্পর্ক ত্যাগ করিতেছি।” চিঠির এই অংশটুকু উদ্ধৃতি দেওয়ার পর ইন্দ্র মিত্রের সুচিন্তিত মন্তব্য— “ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহির ভয়! ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে কি ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহির কথা এমন করে লিখতে পারতেন বিদ্যাসাগর?”[28] এখন প্রশ্ন হল, নিজ গ্রন্থে বিদ্যাসাগরের প্রতিটি উদ্ধৃতির তথ্যসূত্র দিয়ে চলা ইন্দ্র মিত্র কেন বিদ্যাসাগরের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটির তথ্যসূত্র দিলেন না? আরেক জীবনীকার বিহারীলাল সরকার অবশ্য এই বিশেষ চিঠিটির প্রাসঙ্গিক অংশটি তুলে দিয়েছেন। আসুন দেখি, বিদ্যাসাগর ঠিক কী লিখেছিলেন— “যাঁহাদের হস্তে আপনারা কার্য্যভার অর্পণ করিয়াছেন, তাঁহারা সরল পথে চলেন না। এমন স্থলে, এ বিষয়ে লিপ্ত থাকিলে, উত্তরকালে কলঙ্কভাগী হইতে ও ধর্ম্মদ্বারে অপরাধী হইতে হইবে; কেবল এই ভয়ে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, নিতান্ত দুঃখিত মনে, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক, আমায় এ সংস্রব ত্যাগ করিতে হইতেছে।”[29] মন্তব্য নিশ্প্রয়োজন!
এই প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন বদরুদ্দীন উমর— “লোকাচার সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের নিজের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যে সমস্ত লোকাচারকে তিনি তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রতিবন্ধক মনে করতেন, সেগুলিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন এবং সেগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। কিন্তু যে সমস্ত লোকাচার অনেকখানি ‘নিরীহ প্রকৃতির’ ছিল, যেগুলিকে ‘মান্য’ করলে সমাজ–সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হত না, সেই সমস্ত লোকাচার ও প্রচলিত নিয়মগুলিকে তিনি ‘সশ্রদ্ধভাবে’ নয়, নিতান্তই যান্ত্রিকভাবে মান্য করে চলতেন। চিঠিপত্রের শিরোনামায় ‘শ্রীশ্রীদুর্গা শরণং’ ইত্যাদি লেখা এবং নিজ দেহে উপবীত ধারণ ইত্যাদি এই দ্বিতীয় ধরনেরই লোকাচার এবং প্রচলিত নিয়ম। এগুলি মান্য করার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আস্তিকতা অথবা জাতিভেদে বিশ্বাস কোনওটিই বিন্দুমাত্র প্রমাণিত হয় না। কারণ একদিকে তিনি যেমন কোনওদিন লোকাচারের দাসত্ব করেননি, অন্যদিকে তেমনি তিনি প্রতিটি লোকাচার, দেশাচার ও প্রচলিত সামাজিক ব্যবহারের (social practice) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণারও কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি। এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অতিশয় বাস্তবমুখী।”[30]
স্পষ্টতই, বিদ্যাসাগর তাঁর অসাধারণ এবং প্রখর বাস্তববোধের ফলে কয়েকটা আচার আচরণকে মেনে নিয়েছিলেন, যেমন উপবীত ধারণ করা, শিখা ধারণ করা, চিঠিতে শ্রীহরি শরণং লেখা, মাতার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে এগুলির কোনও মাহাত্ম্যই তাঁর কাছে ছিল না, তাই কোনও ঈশ্বর অথবা ধর্মীয় প্রেরণায় নয়, যন্ত্রের মতো তিনি কয়েকটি সিম্বলিক আচরণ পালন করতেন যেগুলি ক্ষতিকারক নয়, অথচ কাছের মানুষরা দুঃখ পাবেন না, অনাবশ্যক সংঘাত সৃষ্টি হবে না। আমার মনে হয়, এগুলি তাঁর এক ধরনের কৌশল ছিল যাতে রক্ষণশীল হিন্দুরা তাঁকে সরাসরি সমাজচ্যুত না করতে পারেন, ডিরোজিয়ানদের ক্ষেত্রে ঠিক যেমনটি ঘটেছিল। এই প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা যায়— “বাইরের সমাজে যখন ধর্মের নামে অধর্মের বন্যা বইছিল, তখন ধর্ম নিয়ে সামাজিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া তিনি নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করেছিলেন।”[31] ঈশ্বর আছেন কি নেই, এই নিয়ে তিনি অহেতুক মাথা ঘামাননি, বরং নদীর স্রোতে থেকে তিনি চিরকাল স্রোতের বিপরীতে সাঁতার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এইভাবে নিজেকে তিনি চিরকাল একটি ক্যামোফ্লাজে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন, যাতে তার আড়াল থেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রগতিশীল কাজগুলি নির্বিবাদে চালিয়ে যেতে পারেন। এমন কোনও হঠকারিতা করেননি যাতে হিন্দু সমাজপতিরা তাঁকে বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তাই অন্যের বিশ্বাসে তিনি কখনও আঘাত দেননি, কিন্তু বারবার আমরা দেখেছি, যে বিষয়গুলিতে তাঁর মৌলিক বিশ্বাসের প্রশ্ন অনিবার্যভাবে পথরোধ করেছে, সেগুলিতে তিনি দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন— শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার তাঁর ‘শিক্ষক বিদ্যাসাগর: যাপিত জীবন এবং পরিকল্পিত উচ্চারণ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের ঈশ্বর— সে প্রথাগত হিন্দুধর্মের বহুদেববাদ-ভিত্তিক হোক, আর ব্রাহ্মধর্মের একেশ্বরবাদ-ভিত্তিক হোক— সেই ঈশ্বর নামক ধারণা তাঁর ব্যবহারিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।”[32]
পরমেশ আচার্য তাঁর গ্রন্থে একটি কূট প্রশ্ন তুলেছেন, “…সাংখ্য ও বেদান্ত না মেনেও একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী হতে পারে।”[33] ঘটনা হল, এই দার্শনিক ধারণাটা আগে চার্বাকদের যুগে হয়তো ছিল, উনিশ শতকের আধুনিক মানুষের ক্ষেত্রে এই যুক্তি আদৌ ধোপে টেঁকে না, বলাই বাহুল্য। বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণত্বে বিশ্বাস করতেন না তাই গায়ত্রী মন্ত্র পড়তেন না; ঈশ্বরের বিষয়ে নির্বিকার ছিলেন তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে চিরকাল শুধু আলোচনার বাইরে নয়, নিজস্ব সামাজিক জীবনেরও বাইরে রেখেছেন; মূর্তিপুজো তাঁর বিশ্বাসের পরিপন্থী ছিল তাই পুজোর সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখতেন না, ঘরে গৃহদেবতা ছিল না, বেনারসে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করেননি অথবা উইলে অসহায় মানুষদের বিরাট তালিকা দিয়ে প্রতিমাসে কে কত সাহায্য পাবেন তার ফিরিস্তি, গ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয় এবং বিধবাবিবাহের জন্য কত খরচ বরাদ্দ তার হদিশ থাকলেও দেবসেবার কোনও উল্লেখ রাখেননি, অথচ জীবৎকালে ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্সকে এক হাজার টাকা দান করেছেন। বিদ্যাসাগরের উইল সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে ক্ষুব্ধ জীবনীকার বিহারীলাল লিখেছেন, “উইলে দেবসেবাদির কোন উল্লেখ নাই। উহাতেও বিদ্যাসাগরের মতিগতির পরিচয়।”[34] বিদ্যাসাগর ক্ষতিকারক দেশাচারের বিরোধিতা করতেন তাই সমস্ত আত্মীয়দের বিপক্ষে গিয়ে পুত্রের বিধবাবিবাহ দিয়েছেন; শান্তি স্বাস্ত্যয়ন ইত্যাদিতে বিশ্বাস ছিল না তাই মরণকালে কন্যা হোম-যজ্ঞের ব্যবস্থা করলে, সে ঘরে তিনি প্রবেশ পর্যন্ত করেননি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সেই দেড়শো বছর আগেও বিদ্যাসাগর তার শিশুপাঠ্য রচনাগুলিতে ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানেননি। কাহিনিগুলির সঙ্গে ঈশ্বরের ও ধর্মীয় সংস্কারের সংস্রব নেই, জোর দিয়েছেন তিনি নীতিশিক্ষার ওপর, ভালোমন্দ বুঝে সচ্চরিত্র গঠনের ওপর। মার্ডক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, “কীভাবে বিদ্যাসাগর শিশু ও কিশোরপাঠ্য বইয়ে না-ধর্মী (সেকিউলার) রীতিতে বস্তুবাদের মুলকথাটি তুলে ধরেছেন।”[35]
অন্তত দুটি ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দেয় যে ওই ক্যামোফ্লাজের আড়ালে থাকা বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত জীবনদর্শনে ধর্মভিত্তিক জাতপাত, উচ্চনীচ বা অস্পৃশ্যতার কোনও স্থান ছিল না। প্রথমটি হল, ১৮৬৬ সালে মেদিনীপুরে দুর্ভিক্ষের কাহিনি। বিদ্যাসাগর নিজের গ্রামে যে অন্নছত্র খুলেছিলেন তাতে খেতে আসা তথাকথিত নিম্নশ্রেণির স্ত্রীলোকদের মস্তকের চুল তৈলাভাবে জট পাকিয়ে থাকত। বিদ্যাসাগর নিজের হাতে সেই তথাকথিত অস্পৃশ্য মুচি, হাড়ি ডোম প্রভৃতি জাতীয় স্ত্রীলোকদের মাথায় তেল মাখিয়ে দিতেন। আরেকটি হল, ১৮৬৭ সালে বর্ধমানে ম্যালেরিয়া মহামারির রূপ নিলে বিদ্যাসাগর কেবল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য সরকারের নিকট পত্র লিখেই থেমে থাকেননি, নিজেও ম্যালেরিয়া কবলিত এলাকায় গিয়ে দাতব্য চিকিৎসালয় খুললেন। সেখানে স্বয়ং গরীব রোগীদের চিকিৎসা ও পথ্যের তদারকি করতেন। এলাকার অধিকাংশ মানুষ ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। বিদ্যাসাগর জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার ছাড়াই এঁদের চিকিৎসা করেছিলেন। একাধিকবার তাঁর কোলে অসুস্থ মুসলমান শিশুকে দেখা যেত।
বাস্তববাদী বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন যে সহস্র বছরের কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতায় যে সমাজ আবদ্ধ তাতে যদি আলো জ্বালাতে হয় তাহলে সমাজের ভিতর থেকেই আঘাত করতে হবে। তাই তিনি উনিশ শতকের হিন্দুসমাজের অন্ধবিশ্বাস ও প্রথাগুলিকে সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে আঘাত করলেও সমাজপতিরা কখনওই তাঁকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। এইভাবেই সেকুলারিজম ও হিউম্যানিজম তাঁর চরিত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় সমাজচিন্তকদের মধ্যে পার্থিব মানবতাবাদের চিন্তাধারার প্রবক্তা তাই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
[1] পৃষ্ঠা ৪০৫, বাণী ও রচনা নবম খণ্ড, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৬০
[2] পৃষ্ঠা ৫৮৯, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[3] পৃষ্ঠা ৬২, বাঙালী প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
[4] পৃষ্ঠা ৩৫৯, বাণী ও রচনা নবম খণ্ড, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৬০
[5] পৃষ্ঠা ৪৪, রবিজীবনী পঞ্চম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৫
[6] পৃষ্ঠা ২০৫, বাণী ও রচনা নবম খণ্ড, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৬০
[7] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪০১
[8] পৃষ্ঠা ১৪৬, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৬১
[9] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৬
[10] পৃষ্ঠা ১৬৯, প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চক্রবর্ত্তী চ্যাটার্জী অ্যান্ড কোং, ১৯২৭
[11] পৃষ্ঠা ২৮০, বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী প্রথম খণ্ড, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, রঞ্জন পাবলিশিং হাউস, ১৯৩৯
[12] পৃষ্ঠা ৩০৩-৩০৪, বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান প্রেস, ১৯০৯
[13] পৃষ্ঠা ২৭২, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৬১
[14] পৃষ্ঠা ৯২, বাণী ও রচনা সপ্তম খণ্ড, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৬০
[15] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৯
[16] পৃষ্ঠা ২৩১-২৩২, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বুকল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৪৭
[17] পৃষ্ঠা ৪৮, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৩
[18] পৃষ্ঠা ১৯২, রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭
[19] পৃষ্ঠা ৩৮২, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৬১
[20] বিদ্যাসাগর, নাস্তিকতা ও মদীয় আচার্যদেবগণ সংক্রান্ত আরও কিছু কথা, দেবাশিস ভট্টাচার্য, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, অক্টোবর ২০২০
[21] পৃষ্ঠা ৪৮, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৩
[22] পৃষ্ঠা ৯৮, বাঙালি প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর এ অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
[23] পৃষ্ঠা ৬৩৪, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[24] পৃষ্ঠা ৩৪৫, বিদ্যাসাগর, মনি বাগচি, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, ১৯৫৭
[25] পৃষ্ঠা ৩০৪, পুরাতন প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর, বিপিনবিহারী গুপ্ত, বিদ্যাভারতী, ১৯৫২
[26] পৃষ্ঠা ১১৪৮, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৩
[27] পৃষ্ঠা ১৬৫, সমকালে বিদ্যাসাগর, স্বপন বসু, পুস্তক বিপণি, ১৯৫৯
[28] পৃষ্ঠা ৬৩৫, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[29] পৃষ্ঠা ৩১৭, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৬১
[30] পৃষ্ঠা ৫৪, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, বদরুদ্দীন উমর, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪
[31] পৃষ্ঠা ৩৮১, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১
[32] পৃষ্ঠা ৩০, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সৌরভ রঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত, সংবর্তক, ২০২০
[33] পৃষ্ঠা ৯৯, বাঙালি প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর এ অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
[34] পৃষ্ঠা ৩৪৩, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৬১
[35] পৃষ্ঠা ২২, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সৌরভ রঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত, সংবর্তক, ২০২০