অশোক মুখোপাধ্যায়
[০] বৃহৎ কিতাব!
স্বাধীনতার পৌনেশতবর্ষের মুখে দাঁড়িয়ে এটা বলা অন্যায় হবে যে স্বাধীন ভারতের জন্য যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, তার পেছনে কোনও মনন-প্রয়াস ছিল না। বছর তিনেক ধরে অনেকগুলো বৈঠক এবং অনেক বিতর্ক করেই অবশেষে সংবিধান রচিত এবং ১৯৫০ সালে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৫২ সালে এর ভিত্তিতেই সারা দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। লোকসভায় এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে। এতে প্রথম থেকেই প্রাপ্তবয়স্ক সমস্ত নাগরিকদের ভোটাধিকার স্বীকৃত ছিল। ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ-ভাষা নির্বিশেষে। জনসংখ্যার নিরিখে সেই থেকে ভারতের শাসককুল একে বিশ্বের “বৃহত্তম গণতন্ত্র” বলে থাকেন।
মানবেন্দ্রনাথ রায় নামক দেশ ও জাতির আর এক ভারি নিন্দুক বুদ্ধিজীবী অবশ্য সংবিধান রচনার প্রাক্কালে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে এক জনসভায় ঘোরতর মন্দ বাক্য উচ্চারণ করে বলেছিলেন, যে সমস্ত খয়ের খাঁ রায় বাহাদুর কিছুকাল আগেও ব্রিটিশ শাসকদের পদলেহনে ব্যস্ত থাকতেন, তাঁদের অনেকেই এখন জাতীয়তাবাদী সাজসজ্জা (খদ্দরের টুপি ও কুর্তা) পরে সংবিধান সভা আলোকিত করছেন। এদের হাত দিয়ে আর যাই হোক, জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ফুল ফুটবে না।
ভারতের কমিউনিস্টরা রায়ের তুলনায় নেহরুর প্রতি বরাবরই বেশি ভক্তি দেখালেও, আমার মতে ভারতীয় সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা অবশ্যই রায়ের প্রায় বিস্মৃত বিশ্লেষণকে অভ্রান্ত প্রমাণ করতে পেরেছে।
কেন একটু পরেই নীচে ব্যাখ্যা করে বলছি।
পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে অনেক বিদ্বজ্জন ভারতের সংবিধানকে সেকুলার বলে দাবি করে থাকেন। এই দাবির মধ্যে খানিক গর্বও মিশে থাকে। উল্টোদিকে সংঘ পরিবার যেহেতু এই সংবিধানকে এর “ধর্মনিরপেক্ষ” চরিত্রের জন্য এবং মুসলিমদের প্রতি তথাকথিত পক্ষপাতিত্বের দোষারোপের ভিত্তিতে বিরোধিতা করে থাকে, বহু বামপন্থী বন্ধু মনে করেন, এটাই সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রমাণ করে।
আমার মতে এই সংবিধান আগে কখনওই ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে তৈরি হয়নি, এবং পরেও যখন এর ভূমিকায় সেকুলার লেবেল লাগানো হয়েছে (১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়), তখন এর চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে আগের তুলনায় আরও অনেক দূরে আরও খারাপ দিকে সরে গেছে।
নীচে এই বিষয়ে আরও কথা বলব।
বাক্স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আমাদের সংবিধানে অনেক ভালো ভালো ধারা উপধারা অনুধারা আছে। ১৯ ও ২০ নং ধারা সমূহ। সেই ধারাগুলিকে আবার একই সংবিধানেই অন্য পাল্টিধারা দিয়ে খর্ব করার ব্যবস্থা করে রাখা আছে। ব্রি-ব্রি-ব্রি——হত্তম গণতন্ত্র বলার সময় আমরা এক গুচ্ছ ধারার কথা যতটা বলি, অন্য গুচ্ছের কথা সেই অনুপাতে উচ্চারণই করি না।
সেগুলিও এখানে সংক্ষেপে দু একটি উদাহরণ সহ বলার চেষ্টা করব।
[১] গণতন্ত্র
গণতন্ত্র থেকেই বাতচিত শুরু করা যাক।
ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের পাঠকরা সকলেই বোধহয় ইংরেজ জমানার বড়লাট আর ছোটলাটের কথা শুনেছেন। লাট < লর্ড। বড় লর্ড ছিলেন দিল্লির ভারতশাসক, সংক্ষেপে ভাইসরয় (< Vice of the Royal Authority)। তার হাত পা হিসাবে থাকতেন বিভিন্ন প্রদেশের সুবাদার, গবর্নর, ওরফে ছোটলাট। তা, সেই গোরাদের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানেও এই ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যকে চিরস্থায়ী করার প্রচেষ্টা দেখা গেল। রাজ্যে নির্বাচিত সরকারের মাথায় কেন্দ্রের শাসনদণ্ড চালনার জন্য আর ছোটলাটের বাড়িগুলিকে রাজকীয় কায়দায় ব্যবহার করার জন্য রাজ্যপালের পদ তৈরি করা হল। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের অনুসরণেই আর কি!
সংসদীয় গণতন্ত্রে দুই দল না হোক, অন্তত দুই পক্ষ থাকে। শাসক দল ও বিরোধী পক্ষ। ভারতের মতো বড় দেশে রাজ্যগুলিতেও তাই। যদি একদলীয় শাসনের ইচ্ছা না থাকে, তাহলে ভারতে এমন হতেই পারে যে কেন্দ্রে যারা শাসক দল হবে, কোনও রাজ্যে তারা সরকারি আসনে নেই, সেখানে অন্য কোনও দল সরকার গঠন করেছে। ১৯৫৭ সালের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে হলও তাই। কেরলে সিপিআইয়ের নেতৃত্বে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের মুখ্যমন্ত্রিত্বে এক বামপন্থী সরকার গঠিত হল। কংগ্রেস সেই রাজ্যে বিরোধী আসনে বসতে বাধ্য হল। যেই না হল, অমনি দিল্লির তরফে ভারতীয় গণতন্ত্রের কোমরের জোর এক্স-রে করে দেখা হল। সংবিধানে এর কী কী প্রতিষেধক আছে খোঁজা শুরু হল। দেখা গেল, আছে: রাজ্যপাল আর ধারা নং ৩৫৬। রাজ্যপাল হলেন অনির্বাচিত এবং রাষ্ট্রপতি তথা কেন্দ্রের প্রতিনিধি। তাঁর রিপোর্টে যদি দেখা যায়, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়, তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে (আসলে কেন্দ্রীয় সরকারকে) সুপারিশ করবেন রাজ্যের সেই নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্রপতি বলবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে। ইত্যাদি। ১৯৫৯ সালে সেই রাজ্য সরকারকে ফেলে দেওয়া হল। কোটি খানেক লোক ভোট দিয়ে যে সরকারকে নির্বাচিত করেছিল, মাত্র দু-তিনজনের পরামর্শে এবং কলাকৌশলে তাকে ফেলে দেওয়া সম্ভব হল। সৌজন্য— ভারতীয় সংবিধান। The rule of majority is overruled by a microscopic minority!
এই হল গিয়ে সংবিধানে গণতন্ত্রকে রক্ষার অন্যতম কলাকৌশল।
সংবিধানের এই শাসকানুরাগী জেলিসত্তার কারণেই, সংবিধান নামক মহাগ্রন্থের আবির্ভাব আর কাশ্মিরে ভারত সরকারের সামরিক নির্যাতন প্রায় সমবয়স্ক। কাশ্মিরের ভারতভুক্তি চুক্তির অন্তর্গত দিল্লির কর্তব্য সংক্রান্ত সমস্ত ধারা এবং সেই সঙ্গে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা লঙ্ঘন করেই ভারত সরকার নেহরু থেকে মোদি পর্যন্ত সেখানে সামরিক শাসন চালিয়েছে। জওহরলালের আমলেই দিল্লি প্রশাসন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী (চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মিরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা) শেখ আবদুল্লাকে জেলে পুরেছে, দালাল বক্সি গোলাম মহম্মদকে গদিতে বসিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছে, ধীরে ধীরে কাশ্মিরে হতাশার বাতাবরণ তৈরি করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নেহরু থেকে মোদি—সকলেই আবার সেই একই সংবিধান থেকে অন্যান্য ধারা অনুধারার সাহায্য পেয়েছেন এবং নিয়েছেন। সংবিধান সেইভাবেই তৈরি।
ভারতীয় সংবিধানের বয়ানগুলি এমন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র পাঠ, গবেষণা, থিসিস, পেপার ইত্যাদি লেখার সময়ও আপনি প্রচুর উপকরণ পাবেন, আবার নেহরু থেকে মোদি যখন গণতন্ত্রকে কিমা বানাতে চাইবেন, তাঁরাও প্রয়োজনীয় মশলাপাতি পাবেন। ইন্দিরা গান্ধি যখন তাঁর নিজের দলে নেতৃত্ব পদ হারানোর সম্ভাবনায় ভুগছিলেন, তিনি এই সংবিধানের সাহায্যেই সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে দেন এবং তার দ্বারা দেশের জনগণের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ভেন্টিলেশনে ঢুকিয়ে দেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে নির্বাচন বেশি এবং সময়মতো হয় বলে এবং মাঝেমধ্যে শাসক দল পাল্টাপাল্টি হয় বলে অনেকে মনে করতে পারেন, ভারতীয় সংবিধানে গণতন্ত্রের জন্য অঢেল সুযোগসুবিধা রয়েছে। যাঁরা এমন মোহঝিমুনিতে ভোগেন, তাঁদের উদ্দেশে সংবিধান ভালো করে পড়ে দেখতে বলা ছাড়া আমার আপাতত আর কোনও বিশেষ পরামর্শ নেই। অন্য বিষয়েও কথা বলতে হবে।
[২] বাকস্বাধীনতা
কদিন আগেই সুপ্রিম কোর্টের সদ্য নিযুক্ত নতুন প্রধান বিচারপতি রামান্না ইউএপিএ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ইংরেজ চলে যাওয়ার এত বছর পরেও কেন ঔপনিবেশিক ধরনের আটক আইন থাকবে দেশে? সেই প্রসঙ্গে এই কাগজেই সপ্তা দুয়েক আগে সিডিশন প্রসঙ্গে আমি যা লিখেছিলাম, তার কিছু অংশের কথনভঙ্গি পালটে পুনরুক্তি করতে চাই:
ব্রিটিশ সুশাসন সম্পর্কে দুর্মুখ সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর এক রচনায় লিখেছিলেন, ইংরাজ রাজা সত্যবিমুখ নন, স্বাধীন বাক্প্রকাশেও তাঁদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তাঁরা এদেশীয়গণের কাছে শুধুমাত্র এটাই যাচঞা করে থাকেন, ভারতীয় লেখকগণ ব্রিটিশ শাসন সম্বন্ধে স্বাধীন চিত্তে এমন করে লিখবেন ও বলবেন যে পাঠ মাত্রেই পাঠকের মনে শাসকের প্রতি প্রেমদৃষ্টি জেগে উঠবে। মূর্খ ভারতবাসীগণ এইভাবে লিখতে ও বলতে অভ্যস্ত হতে পারছে না বলেই ইংরাজ শাসকগণ সিডিশন আইন এনে প্রেমবর্ষণের শিক্ষাদান করতে বাধ্য হয়েছে। সিডিশন বস্তুটি তত খারাপ নয়, নেটিভদিগের কাগজেপত্রে যেরকম প্রচার হয়ে থাকে।
অনেকেই জানেন না বলে বলে রাখি, ভারত স্বাধীন হলেও ভারতীয় শাসককুল কোনও কালেই ইংরাজবিমুখ হননি। কে না জানে, ভারতের জাতির পিতা চিরকালই নিজেকে ইংরাজদের দত্তক সুপুত্র ভেবে রাজনীতি করেছেন। তাঁরই প্রদর্শিত পথে পদব্রজরত ক্ষুরধার পণ্ডিত সমাজতন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, লোহার মতো শক্ত বল্লভভাই প্যাটেল ইত্যাদি সমস্ত নেতৃবর্গ ইংরাজ শাসকের আইপিসি, সিআরপিসিই কেবল নয়, মায় ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনটিকেও প্রায় তিন বৎসর যাবত তর্কবিতর্ক এবং চুনকাম করে তবেই তাকে ভীমরাও আম্বেদকর রচিত সংবিধান বলে ঘোষণা করতে ভুল করেননি। তাই দেখবেন, অস্ত্র আইনই হোক, ১৪৪ ধারা হোক, আপদ আইন (Disaster Management) হোক, সর্বত্র ১৮২৪, ১৮৩৭, ইত্যাদি সালগুলির পৌনপুনিক উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় এবং স্বাধীন দেশের বয়স কম হলেও আইনগুলির পৌরাণিকতার অনুভবে হৃদয়ে এক অবিমিশ্র পুলক জেগে ওঠে। দেশি এই শাসকপুঞ্জও দেশবাসীর থেকে সেই একই দাসভক্তি প্রত্যাশা করে বারংবার ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তাঁরাও সিডিশনের ডিসিশন বদলাতে পারেননি।
ইংরাজদের লিখিত বিধিনিয়মের ধারায় সামান্য পরিবর্তনও কি হয়নি?
হয়েছে বইকি! দুচারটে (ক), (খ), (ক)-এর একের তিন (ট)— এই রকম অনেকগুলি অনুধারা ও উপধারা সেই সব প্রবীণ অনুশাসনের গায়ে গায়ে বসে ভারতীয় স্বাতন্ত্র্যের জ্বলজ্বলে চিহ্ন বহন করছে। কিন্তু মূল ধারাগুলিতে ইংরাজ শাসনের প্রীতিমূলক স্মৃতি ভারতীয় জাতীয় নেতাগণ কখনও অস্বীকার করবার মতো অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেননি।
আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ আপ্রাণ প্রয়াসে জাতির মানসলোক থেকে বিপ্লবী বিদ্রোহীদের স্মৃতি মুছে দিয়ে গোরা-পাদুকা লেহকদেরকেই জাতির সামনে আদর্শ বলে উত্থাপন করেছেন। গোরায় কালায় অন্তর্লীন বংশগতি স্বীকার ভারতীয় বৈধভাবে চর্চিত স্বাধীনতার প্রথম ও প্রধান কথা। অতএব গোরা শাসকগণের হুকুমতে প্রস্তুত কানুনসকল কালা ভক্তবৃন্দ পরম ভক্তি সহকারে স্বদেশি বিধিপুস্তকে কোনও রকম বিকৃতি সাধন ছাড়াই সংরক্ষিত করতে চেয়েছেন।
ইংরাজদের দেশের বিধিবদ্ধ শীর্ষ শাসক রানিমাতার নির্দেশে ১৯১৫ সালে প্রবর্তিত নিবর্তনমূলক বিধি, বিবিধ পরিচয়ে যার মোদ্দা নাম ভারত রক্ষা আইন (Defence of India Rule), রানির স্নেহাঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে নেহরুর হাত ধরে তাঁর কন্যার সুলতানি আমল অবধি সগর্বে ভারতীয় শাসনে বিদ্যমান ছিল। কন্যা পিতার কর্মকে কিঞ্চিত রূপান্তর ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদ সম্প্রসারণ করে জরুরি অবস্থার মুক্ত দিবসে আনলেন মিসা (Maintenance of Internal Security Act), আফস্পা (Armed Forces Special Power Act), ইত্যাদি। মিসা এক কালে বিদায় গ্রহণ করল বটে, কিন্তু নির্বংশ হল না। সন্তান রূপে রেখে গেল টাডা (Terrorism and Disruptive Activities [Prevention] Act), যাকে আবার বর্জন করে অটলবিহারি বাজপেয়ির শাসনকালে গৈরিক রাজ নিয়ে এল পোটা (Prevention of Terrorism Act), প্রভৃতি। পরবর্তীকালে দিল্লিতে যখন অটল রাজত্বের অবসানে জওহরলালের দৌহিতৃবধূর তত্ত্বাবধানে ত্রিবর্ণ রাজ প্রত্যাবর্তন করল ইউপিএ নামক এক বাম-কংগ্রেস ঐক্যাভরণে, কম কথার লোক মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়ে টাডা ও পোটাকে সম্মিলিত করে প্রসব করলেন ইউপিএ মোর্চার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ইউএপিএ— মাননীয় উচ্চতম ন্যায়াধীশ যার অস্তিত্বের যৌক্তিকতায় এখন সন্দেহ পোষণ করছেন। বর্তমান শান্তিপ্রিয় গৈরিক উজির-এ-আলম দামোদরদাস মহোদয় আবার এর যথাযথ প্রয়োগের কথা ভেবে সুদূর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই (Federal Bureau of Investigation) নামক উদাহরণ থেকে প্রেরণা নিয়ে এনআইএ (National Investigation Agency) উদ্ভাবন করেছেন, যাতে গোরাকালের শাসন রীতিকে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এবং যে কোনও রাজ্যে কেন্দ্র যখন তখন নাক গলাতে ও হাত বাড়াতে পারে!
অর্থাৎ, স্বাধীন ভারত তার স্বাধীন শাসন কৌশলে ১৯৪৭-২০২১ ক্যালেন্ডারে কোনও এক দিনও আপন ব্রিটিশ উত্তরাধিকার বিস্মৃত হয়নি। বরং সযত্নে তা রক্ষা করে চলেছে। এক দিনও এই দেশ বিনা বিচারের বিচার প্রচলনে পরাঙ্মুখ হয়নি। একে নিছক ঔপনিবেশিক দাসত্ব বললে আমাদের সাংবিধানিক স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার ও অসম্মান করা হবে।
স্ট্যান স্বামীর জেলে বিচারাধীন অবস্থায় কার্যত বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলার পর যখন বিশ্ব জুড়ে ধিক্কার ঝড় বয়ে গেল, নরেন মোদি জীবনে প্রথম একটি সত্য কথা বললেন: “যা কিছু করা হয়েছে সমস্তই আইন মেনে করা হয়েছে।” খুব সত্যি কথা। বিনা বিচারে আটকের আইন মেনে আটক করা থেকে শুরু করে জল পানের পাত্র জেলে নিয়ে যেতে না দেওয়া, করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও জামিনের শুনানি না করা, সব আইন অনুযায়ীই করা হয়েছে। অর্থাৎ, কিনা আইনগুলি এইভাবেই তৈরি। হিটলারও অবশ্য ইহুদিদের মেরে ফেলার আইন তৈরি করেই তারপর সেই আইন অনুযায়ীই গ্যাস চেম্বারে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে। ইহুদি হত্যার জন্য আপনি তাকে দোষ দিতে পারেন, কিন্তু আইন মানেনি বলতে পারবেন না।
এই বিশ্ব বাংলার, থুড়ি, জয় বাংলার কারাগারেই দেখা যাচ্ছে— অন্তত ৭১ জন রাজনৈতিক বন্দি আছেন, যারা বিনা বিচারে বিনা জামিনে কয়েদ হয়ে দশ বৎসরের বেশিকাল ধরে নাবান্নিক আতিথ্য উপভোগ করছেন। তাকেও এই নিবর্তনমূলক আইনেরই অপরিসীম সৌজন্য বলা যেতে পারে। সিপিএম-এর হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার পর তৃণমূল শাসনে দশজন বিচারাধীন বন্দি বিনা চিকিৎসায় অসুখে ভুগে মৃত্যুর গৌরব পেয়েছেন। সবই দেশের আইন মেনে। এদের একজন (নারী বন্দি)-এর জামিনের অন-লাইন মামলায় হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারক বিরক্ত হয়েছিলেন, লকডাউনে সম্ভবত তাঁর ভাতঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে মামলার আয়োজন করা হয়েছিল বলে। এবং সেই কারণেই, হ্যাঁ, ঠিক পড়লেন, সেই কারণেই সম্ভবত সেই জামিনের শুনানি দীর্ঘকালের জন্য মুলতুবি হয়ে গেল।
এই হচ্ছে ভারতে বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। আপনি যদি সেই বিচারক সংবিধানে প্রদত্ত ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত ধারা এবং আইনের বইতে লেখা “জামিন দেওয়াই স্বাভাবিক রীতি” লঙ্ঘন করেছেন বলে মামলা করেন, তিনি হয়ত উলটে আপনার বিরুদ্ধেই পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা চাপিয়ে দেবেন! ভারতীয় সংবিধানের আওতায় এগুলো বাস্তব এবং সম্ভব।
প্রশ্ন এখন দুটো: এক, বিনা বিচারে কয়েদ করে রাখার প্রয়োজন পড়ছে কেন? দুই, এই বিনা বিচারের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে কি ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদ করার অধিকার, ইত্যাদি সংবিধানে ঘোষিত মৌলিক অধিকারগুলিকে লঙ্ঘন করছে না? যদি করে থাকে, তার অর্থ হচ্ছে, স্বাধীনতার বিগত পঁচাত্তর বছর ধরেই সাংবিধানিক কত্তারা সংবিধানকে লঙ্ঘন করে চলেছে। সংবিধান মেনেই। সংবিধান এরকম ব্যবস্থা তৈরি করেই রেখেছে।
হ্যাঁ, কোনও ক্ষেত্রেই কি সংবিধানের ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারাকে সম্মান জানানো হচ্ছে না? হচ্ছে, অভিযুক্ত যদি নরেন মোদির নির্লজ্জ দালাল মিথ্যাবাদী কর্পোরেট স্বার্থের সরব মিশনারি অর্ণব গোস্বামী হয়, তাহলে বিনা বিচারে খুব বেশি হলে তিন দিন তাকে কয়েদ করে রাখা যাবে। সুপ্রিম কোর্ট আগ বাড়িয়ে তাকে জামিন দিয়ে দেবে। অন্য যে সাংবাদিকদের মোদি সরকারের নির্দেশে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে ফেলে রাখা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে দুবছর পরেও মামলা শুরু হওয়ার ব্যাপার নেই। বাকস্বাধীনতা, শুভ রাত্রি!
আইনের চোখে, ইয়ে মানে, ভারতীয় সংবিধানের বিধিলিপির চোখে সকলেই সমান বলছেন? কথাটা কি সংবিধান বলেনি? বলেছে। কিন্তু যথোপযুক্ত ব্যবস্থা রেখে, যাতে সেই কথাকে শাসককুলের তেমন পাত্তা দিতে না হয়।
মজার কথা হল, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ইত্যাদি এক গুচ্ছ অধিকারকে ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার (fundamental rights) বলা হয়েছে। মৌলিক অধিকার মানে কী? যার কোনও খণ্ড হয় না। অর্থাৎ, যাকে রাষ্ট্রও লঙ্ঘন করতে পারে না। অলঙ্ঘনীয়। যেমন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে অধিকারের বিলে দ্বিতীয় সংশোধনী। খুবই বিখ্যাত একটা সাংবিধানিক অধ্যায়। সেই সংশোধনী বলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিস্বাধীনতা সংক্রান্ত আইন কখনও ভঙ্গ বা লঙ্ঘন করা যায় না। যথার্থই তা মৌলিক অধিকার। ভারতের ক্ষেত্রে এই “মৌলিক” শব্দটি একটি টুকলিবাজি। ক্যারিকেচার। অপপ্রয়োগ।
আচ্ছা, আমেরিকান রাষ্ট্র কি সেই মৌলিক অধিকার কখনও লঙ্ঘন করে না? হ্যাঁ, করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিক থেকে অনেক দিন পর্যন্ত যে ম্যাক্আর্থির জুলুমকাল চলেছিল, তা ছিল এই লঙ্ঘনের ইতিহাস। লঙ্ঘন করতে হয়েছিল। আইন ভাঙতে হয়েছিল। আইন মেনে করা যায়নি। ভারতে আইনের হাত অনেক, অনেক রকম এবং অনেক লম্বা। আইন মেনেই সমস্ত বেআইনি কাজ করা যায়।
এখানে শাসকদের কথা হল, বহু ক্ষেত্রেই যাদেরকে আমরা বন্দি করতে চাই, বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কাজ করলে তারা আইনের সুযোগ নিয়ে মুক্ত হয়ে যাবে। তাদের গ্রেপ্তারি সুরক্ষিত করতে হলে বিনা বিচার আটকের আইন ছাড়া রাস্তা নেই। প্রচলিত সাধারণ নিবর্তনের প্রয়াসে যতখানি সাক্ষ্যসবুত সংগ্রহ করতে পারলে এদেরকে বিপজ্জনক ব্যক্তি বলে আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব, তা প্রায়শই শাসকের হাতে থাকে না। কেন না, মামলাগুলো তো আসলে মিথ্যা, অভিযোগ সবই ভুয়ো। ইংরেজদের তৈরি আইনের মস্ত সুবিধা এই যে কয়েদ করবার জন্য শাসকের ইচ্ছাই পর্যাপ্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ-বিচার ইত্যাদি মানবসভ্যতার আধুনিক পশ্চিমি বিকারগুলির উদ্বোধনের প্রয়োজন হয় না। ভারতীয় ঐতিহ্যেও একলব্যের আঙুল কেটে দেওয়া হয়েছে, ঋষি শম্বুকের শিরোচ্ছেদ করা গেছে শুধুই ক্ষমতাবানের ইচ্ছার প্রসাদে। শ্রীকৃষ্ণদেব মহাশয় পাণ্ডবদের সামান্য প্রয়োজনে প্রান্তিক জনজাতির সমগ্র পরিবারকে আগুনে পোড়াতে উপদেশ দিয়েছেন। স্বাধীন ভারতের বিচারপদ্ধতিও শাস্তিপ্রদানের এই ঐতিহ্যকেই অনুসরণ করতে চায় বলে মনে হয়।
আমাদের বিশ্বজ্ঞানের বর্তমান সহজপাঠ উইকিপিডিয়া লিখেছে: “The Indian Constitution retained the principles of preventive detention encapsulated in the Defence of India Act, making one of the few countries where citizens of the country may be subjected to such measures.” সংবিধান রচয়িতারা কেউ তো আর অন্ধ বা বিবেচনাশূন্য ছিলেন না। তাঁদের অনেকেই ছিলেন ইংরাজের আইনশাস্ত্রে লন্ডন ফেরত ব্যারিস্টার! তাঁরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ছিলেন বোঝা যায়!
বর্তমান শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, নাগরিকদের ভিক্ষার্থে দু টাকার চাল গম দেব, এমনকি প্রয়োজনে বিনা পয়সায়ও দেওয়া যাবে। কিন্তু বাকস্বাধীনতা দিলে বিপদ। জমি-পাহাড়-জঙ্গল-জল ইত্যাদি যখনই তারা দেশি বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে বিনা পয়সায় দান খয়রাত করতে যাবে, সংশ্লিষ্ট জনসাধারণ তো বটেই, বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাতে বাধা দিতে থাকবে, প্রতিবাদ করবে, আন্দোলন করবে, ইত্যাদি রাষ্ট্রের সেই সব অকল্যাণকর কার্যাবলিতে বিঘ্ন ঘটাবে। ঝাড়খণ্ডের জেদ্দায় আদানির বিদ্যুৎ কারখানা তো করাই গেল না। এখন যেমন হরিয়ানায় ঘটাচ্ছে। অন্য সব আইনে তাদের এরকম কার্যকলাপ নিবারণ করা অসুবিধাজনক! একমাত্র ইংরেজদের রচিত এই অসাধারণ বিনা বিচারের বিচার অপপদ্ধতিই এইরকম আপৎকালে দ্রুত বিপদভঞ্জন করতে পারে বলে বহু পরীক্ষিত ও পর্যবেক্ষিত সংবাদ আছে। এক একজনকে ধরো আর জেলে পুরে দাও। জামিন দেওয়ার দরকার নেই, বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করারও তাড়াহুড়ো নেই। এবং সমস্তটাই আইন মেনে।
ভারতীয় সংবিধানই ভারতীয় শাসকদের হাতে এই চূড়ান্ত স্বৈরাচারী ক্ষমতার হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। অন্য ভাষায়, ভারতীয় শাসকরা যথেষ্ট দূরদর্শিতার সঙ্গে সংবিধানটি তৈরি করেছেন।
[৩] ধর্মনিরপেক্ষতা
অবশেষে আমরা আসব ধর্মনিরপেক্ষতার কথায়।
সংবিধান রচনা পরিষদে দু-দুবার ভোটাভুটি হয়, সেকুলার শব্দটা সংবিধানে যুক্ত হবে কিনা। দুবারই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। সংবিধান রচয়িতারা সততার সঙ্গে তাঁদের অ-সেকুলার মনোভাব বিজ্ঞাপিত করে যান। হ্যাঁ, আজ বিজেপি যে হিন্দু রাষ্ট্রের ঘোষণার দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, রচিত সংবিধান তার পক্ষে অসুবিধাজনক ছিল। সেই সঙ্গে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে, হিন্দু মন্দিরে সমস্ত বর্ণের হিন্দুদের প্রবেশের পক্ষে, ইত্যাদি প্রস্তাব রাখার দ্বারা ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবগত ভিত্তি থেকে সামান্য হলেও দূরে ছিল।
অনেকে ভাবেন, সংবিধান অনুসারে ভারতে সরকারি অর্থ মন্দিরে দেওয়া যাবে না। ধারণাটা ভুল। পুরনো মন্দিরে সরকারি পয়সায় রক্ষণাবেক্ষণের আইন রয়েছে দেশে। শুরু থেকেই। অনেক মন্দিরেই ভারত সরকার পয়সা ঢেলেছে স্বাধীনতার পর থেকেই। ওদিকে একশো বছরের পুরনো যে কোনও স্থাপত্য ভারত সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে। তার রক্ষণাবেক্ষণও ভারত সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেই দিক থেকে সাতশো বছরের পুরনো বাবরি মসজিদের বিতর্কিত কাঠামো ভারত ও উত্তরপ্রদেশ সরকারের আওতাভুক্ত ছিল। কীভাবে সেই দায়িত্ব পালিত হয়েছে সকলেই জানেন।
এমনকি, ১৯৪৯ সালে ২৩ ডিসেম্বর যেদিন গভীর রাতে বাবরি মসজিদের ভেতরে রামসীতার মূর্তি ঢুকিয়ে দিল আরএসএস কর্মীরা, ফৈজাবাদ জেলা প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে পরেরদিন সকাল থেকে রামের দায়িত্বভার গ্রহণ করে মসজিদে মুসলিমদের প্রবেশ বন্ধ করে দিল। এক মাস পরে সংবিধান সংসদে গৃহীত হয়। বাবরি সম্পর্কে নিঃশব্দ থেকে। জেলাশাসক নিশ্চয়ই সংবিধান-বিরোধী কোনও কাজ করেননি।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এলাহাবাদ হাইকোর্টে যখন আদবানি-উমা ভারতীদের বিচার চলছে, বিচারক জানতে চান, গৃহহীন রামলালার মাথার উপরে আচ্ছাদন আছে কিনা। এই এক প্রশ্নেই মালুম, আদালত ও বিচারব্যবস্থা সংবিধান থেকে কী ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রয়োগের প্রেরণা পেয়ে থাকে।
আসলে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে ভারতীয় সংবিধান অনেক ক্ষেত্রেই বেশ উদার। সঙ্ঘ পরিবারের অনেক মৌলিক স্লোগানের আধার। যেমন গোরক্ষা প্রসঙ্গে সংবিধানের নীতিনির্দেশক ৪৮ নং ধারা। সম্পূর্ণ একটি হিন্দু ধর্মীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী রীতিকে সংবিধানে জায়গা দেওয়া হল। আর্যসমাজ থেকে আরএসএস পর্যন্ত সকলের দেড়শো বছর ধরে চালু স্লোগান। সেই সঙ্গে সকলেই জানেন, অধিকাংশ রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ করে ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষের সস্তায় আমিষের উৎস কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি যেবার জরুরি অবস্থায় ৪২-তম সংশোধন এনে সংবিধানকে সেকুলার (এবং সমাজতান্ত্রিক) বানালেন, তাঁর মাথাতেই আসেনি, এই ধারাগুলোও বদলাতে হবে, নইলে সেকুলার হয় না। উলটে, সেই বছরেই (১৯৭৫) তিনি রাজ্যগুলিকে গোরক্ষায় তৎপর হতে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। যাতে গোহত্যা অনুমোদিত রাজ্য থেকে পাশের গোরক্ষক রাজ্যে গরুর মাংস পাচার না হয়। সেকুলার শব্দটির প্রতি জওহরজাদির কী অসাধারণ দায়বদ্ধতা। সংবিধানে এই শব্দ চালাচালিতে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় এতটুকু ছাপ পড়ে না। তাঁর সুপুত্র রাজীব গান্ধি শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের একটা সুন্দর সেকুলার রায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সংসদে আইন করে শরিয়তের বাক্সে পুরে দেন। পারলেন কী করে? ভারতীয় সংবিধানে আটকাল না কিন্তু।
আর একটা উদাহরণ।
রামস্বামী পেরিয়ার তামিলে রামায়ণের উপর একটা পুস্তিকা লিখেছিলেন, যেটাতে রামচন্দ্র সম্পর্কে ব্রাহ্মণ্যবাদী উপস্থাপনার তীব্র সমালোচনা ছিল। সেই বইটি হিন্দিতে সচ্চি রামায়ণ নামে অনুদিত হয়ে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ সরকার তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সেই সরকার কিন্তু জনসঙ্ঘের নয়, কংগ্রেস পরিচালিত ছিল। সরকার রাষ্ট্র শাসক দল ভারতীয় সংবিধান থেকে এমন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশিক্ষণ পেয়েছে যে কহতব্য নয়।
মুসলিম পারসোনাল ল এইরকমেরই এক গোঁজামিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি) ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে একটা ধারা থাকা আর মুসলিম পারসোনাল ল এক জিনিস নয়। আর যদি ধরেও নিই, মুসলমানদের ধর্মচর্চার স্বাধীনতা দিতে হলে শরিয়তকে মান্যতা দিতে হবে (আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা মনে করি না এবং এর পুরোপুরি বিরোধী), তাহলে সেকুলার ভাবধারা এটুকু দাবি করে, শরিয়তের যা কিছু সংবিধানের অন্যান্য নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, কেবলমাত্র ততটুকুই রাষ্ট্র মেনে নেবে; সাংঘর্ষিক হলে মানবে না।
না হলে কী হয়?
সংবিধান এক জায়গায় নারীপুরুষের সমানাধিকার ঘোষণা করছে। শরিয়তে একজন মুসলিম পুরুষের এক সঙ্গে চারটে বিয়ে করার অধিকার আছে। যা গণতান্ত্রিক দৃষ্টিতে দেখলে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাট বৈষম্যের অবকাশ রাখে। বাস্তবে প্রতিটি মুসলমানই চারজন স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করে— সঙ্ঘের এই দীর্ঘকালীন প্রচার সর্বৈব মিথ্যা হলেও এই বৈষম্যের বাস্তব সুযোগ যে সেখানে আছে আধুনিক সভ্য মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন। তার মানে সংবিধানের এই দুটো জায়গা পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল। এই যে গেল, আমি অবাক হয়ে দেখেছি, এটা পর্যন্ত অনেকে বুঝতে চান না, বা, ধরতে পারেন না।
আবার এই জায়গায় মুসলিম নারী অপরাপর নারীদের তুলনায়ও সম-অধিকার বঞ্চিত হয়ে গেল। তাতেও সংবিধানের উপরোক্ত সমানাধিকারের ঘোষণা মার খেয়ে গেল। অর্থাৎ, আমাদের পূর্বসূরি সেই মান্যবরেরা মাথা খাটিয়ে এমন একটি বিধিকিতাব বানিয়েছেন, যার এক একটা অনুচ্ছেদ, অন্য কিছু অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ বিরোধী।
আমি বোঝাতে চাইছি, ভারতীয় সংবিধান হচ্ছে গীতা-কোরানের মতো। যে কোনও ধর্মগ্রন্থে আপনি প্রচুর ভালো ভালো প্রেমজাতীয় কথা পাবেন, আবার ঘৃণা-বিদ্বেষ-হত্যাকাণ্ডের সপক্ষে প্ররোচনাও পাবেন। ব্যক্তিস্বাধীনতাও আছে, তা নাকচ করার ধারাও আছে। পাশাপাশিই। ধর্মপ্রেমিক লোকে যে যার ধর্মগ্রন্থ থেকে ভালো ভালো কথাগুলিরই উদ্ধৃতি দেয়। মন্দ শ্লোক-আয়াত সকল লুকিয়ে রাখে। উচ্চারণই করে না। সংবিধানেরও তাই হচ্ছে। ৩০গ বা ৪৮ নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। বিশেষ করে ৪৮ নং গোরক্ষার ধারা এবং শরিয়তের চার বিয়ের অবকাশ। চেপে যায়।
১৯৬৩ সালে ডোনাল্ড ইউজিন স্মিথ নামক একজন আমেরিকান লেখক India as a Secular State নামে একটি বই লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধানে কিছু কিছু দুর্বলতা থাকলেও এতে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে একটা শক্ত ভিত্তি রয়েছে। আগামী বিশ বছরে ভারত সেই সব দুর্বলতা নিশ্চয়ই কাটিয়ে উঠবে।[1]
ভদ্রলোকের সেই ভবিষ্যদ্বাণীর দিকে তাকিয়েই কিনা জানি না, ঠিক বিশ বছর পরেই, ১৯৮০-র দশকে ইন্দিরা গান্ধি সংখ্যাগুরু ভোট রাজনীতি শুরু করেন, পাঞ্জাবে ভিন্দ্রানওয়ালাকে দিয়ে শিখ জঙ্গিবাদের কার্ড খেলে অকালি দলের ভিত ভাঙতে ব্যস্ত হন, আর পাঞ্জাব দেখিয়ে বাকি ভারতে হিন্দু কার্ড খেলতে থাকেন। আরএসএস সেই সময় কংগ্রেসের টিমের খেলোয়াড় এবং দোসর হয়ে যায়। ফির ভি হিন্দুস্তান মেঁ সেকুলারিজম চল রহা থা। ১৯৮৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পরের তিন দিন ধরে দিল্লিতে এবং সারা দেশে শিখ গণহত্যা ঘটিয়ে রাজীব গান্ধি তাকে মহীরুহ পতনের ফলে জমিতে কম্পন বলে যুক্তিবাহিত করে দেন। ভারত মেঁ সেকুলারিজম অওর আগে বঢ়তা রহা! ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধি প্রধানমন্ত্রী অবস্থাতেই ছুটে যান বাবরি মসজিদের তালা ভেঙে রামচন্দ্রকে উদ্ধার করে পুজো দিতে। তারপরই বিজেপি ব্যস্ত হয়ে ওঠে রামকে কংগ্রেসের কোল থেকে হাইজ্যাক করতে এবং বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার প্রস্তুতি নিতে। সংবিধানের নামে শপথ নিয়েই এইসব কাজকর্ম দিব্যি চলতে থাকে। সংবিধানের আওতাতেই বাবরি মসজিদ ভেঙে বিজেপি সংসদে দুই থেকে আশি হয়। তারা সংবিধানের নামেই শপথ নিতে পারে। তব তক ইন্ডিয়ান সেকুলারিজম কা পর্দা ফাঁস হো গয়া!!
এই সেদিন সংবিধানের নাম জপতে জপতেই সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের জমি রামলালার নামে হস্তান্তরিত করে ফেলল। আর দু-চারটে ধারা বদলে ফেলতে পারলেই বিজেপি-র পক্ষে— তত দিন টিঁকে থাকলে— এই সংবিধানকে জ্যান্ত রেখেই হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করতেও অসুবিধা খুব একটা হবে না। সংবিধান তার দিক থেকে প্রায় তৈরিই আছে। ৪৮-এর সঙ্গে একটা (ক) যোগ করে “জয়শ্রীরাম” জাতীয় স্লোগান হিসাবে ঢোকাতে হবে, মুখবন্ধে হিন্দু শব্দবন্ধ রাখতে হবে। ইত্যাদি।
[৪] সংহার/উপসংহার
যাঁরা আগামী দিনে ভারতে যথার্থ সেকুলার এবং গণতান্ত্রিক রাজ চাইবেন, তাঁদের এই সংবিধান থেকে সমস্ত অগণতান্ত্রিক ও ধর্মীয় প্রকরণ এবং তদনুরূপ দুর্বলতা ধরে ধরে ছাঁটাই করার জন্য জনমত গঠন ও গণআন্দোলন করতে হবে। তার আগে সেই সমস্ত ধারা-উপধারাগুলিকে চিনতে হবে। একে একটা পবিত্র গ্রন্থ ধরে নিয়ে খালি বিজেপি-কে সংবিধান মানছে না বলে গাল পাড়লে লাভ হবে না, বিজেপি-র বরং তাতে সুবিধাই হবে।
[1] “many of India’s Constitutional anomalies regarding the secular state will have disappeared.” Donald Eugene Smith (1963), India as a Secular State. Princeton University Press, Princeton. p. 14