Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তারান্তিনো, সিজন দুই — চোদ্দ

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ঘরে এই মুহূর্তে আটজন।

এর আগে মহেশ সেনকে নিয়ে সাতজন জীবন্ত মানুষ ছিল ঘরে। এখন মৃত মহেশ সেনকে নিয়ে ঘরে আটটা লোক। জীবিত যে সাতজন, সেই সাতজনের প্রত্যেকের মধ্যে একজন করে খুনি বসত গেড়ে রয়েছে। প্রত্যেকের চোখেমুখে চাপা রাগ, চাপা ঘেন্না, চাপা আক্রোশ।

এই নাটকের যবনিকা পতন হতে চলেছে, বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু নতুন চরিত্রটির আগমনে ঘরের পরিবেশ পালটে গেছে। পালটে গেছে শত্রুমিত্রর অঙ্কও।

জয়চাঁদের পিছু নিয়ে নিচে নেমেছিল জনার্দন সান্যাল। আর সে ঘরে এসে ঢুকল যখন, তখন তার দুহাত তোলা, সে অস্ত্র সমর্পণ করেছে। একই অবস্থা জয়চাঁদেরও। আর ঠিক তাদের পেছনে বন্দুক হাতে প্রমথরঞ্জন।

এই এখানে এসে আজকের নাট্য থমকে গিয়েছে পুরোপুরি। প্রমথরঞ্জনের অপ্রত্যাশিত এই আগমন কিছুটা হতবাক এবং বিহ্বল করে দিয়েছে সকলকে।

মৃত্যুকে যখনতখন বরণ করতে হবে, সে বিষয়ে এই ঘরের সকলেরই কমবেশি বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে প্রমথরঞ্জন ঘরে এসে উপস্থিত হওয়ার পর থেকে যেন সব হিসেব গুলিয়ে গেছে।

এবার যেন ঘরের সমীকরণটা দাঁড়িয়েছে এরকম, প্রমথরঞ্জন বনাম বাকি সকলে।

প্রথম মুখ খুলল জনার্দন সান্যাল, ‘আপনি বোধহয় জানেন না এই ঘরে একজন পুলিশের দারোগা আছে…’

কথা শেষ হল না জনার্দনের।

–চোপ বাঞ্চোৎ! তুই কে আমি জানি ভালো করেই। তোর মুরোদ কত তাও জানা আছে।
–এত বড় সাহস…

জনার্দনের কথা শেষ করার অবকাশ দিল না প্রমথরঞ্জন।

–তোকে এই স্বদেশিগুলোর পেছনে লেলিয়ে দিয়ে যে দুটো শুয়োরের বাচ্চাকে আমার পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদেরও বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি, কত ধানে কত চাল!

ফাদার এবার মুখ খুলল।

–ব্যাপারটা আপনি বোধহয় ঠিক বুঝতে পারছেন না। আমাদের আপনার সঙ্গে শত্রুতা নেই কোনও।
–আমাদের বলতে?

ফাদারের কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, চোখা প্রশ্ন ছুড়ে দিল সনাতন হাজরা।

–আমি আমাদের সকলের কথা বলছি।

ঠান্ডা গলায় বললেন ফাদার।

–আর ন্যাকামো করে কী লাভ ফাদার!

সনাতনের কণ্ঠস্বর ক্রমশ কঠিন হচ্ছে।

–এখন কি এটা নিয়ে ভাবার খুব প্রয়োজন আছে মিঃ হাজরা? কে কার লোক, এটা কি আদৌ এখন খুব জরুরি?
–হ্যাঁ জরুরি! ফাদারের কথার মাঝেই প্রায় গর্জে উঠল সনাতন হাজরা। কারণ এখানে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মহেশ সেনের লাশ এখনও পড়ে আছে। টাটকা! আপনারা সকলে মিলে খুন করেছেন ওকে!

সনাতন হাজরার কথার মাঝেই প্রমথরঞ্জন বলে উঠল,

–বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

সকলের চোখ ঘুরে গেল প্রমথরঞ্জনের দিকে। এক ধাক্কায়।

–কারা মেরেছে? এই স্বদেশিগুলো?

কথাটা বলে প্রমথরঞ্জন আড়চোখে তাকাল সূর্যবাবুর দিকে।

সূর্যবাবু খেঁকিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।

–আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন?

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল প্রমথরঞ্জন।

–আপনি কি মনে করছেন? জেলে আমি আপনাকে দেখিনি?
–শাট আপ!

গর্জে উঠল সূর্য মিত্র।

–কোথাকার একটা দু পয়সার মার্ডারার!
–যে দু পয়সার মার্ডারার আপনার চেয়ে বেশি মূল্য ধরে সরকারের খাতায়!

সূর্য মিত্রর কথার উত্তরে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দিল প্রমথরঞ্জন।

সনাতন হাজরা এবার কথা বলল। কথাটা প্রমথরঞ্জনের উদ্দেশে।

–আপনি কী চান?
–এই হল গিয়ে আসল কথা। আপনি বুদ্ধিমান লোক দেখছি। কী নাম আপনার?

সনাতন হাজরাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে করতে বলল প্রমথরঞ্জন।

–সেটা জরুরি নয়।

শান্ত গলায় বলল সনাতন হাজরা।

–অবশ্যই জরুরি! আমি জিজ্ঞেস করছি যখন, তখন চুপচাপ উত্তর দিন!

গর্জে উঠল প্রমথরঞ্জন।

–আমি আপনাকে উত্তর দিতে বাধ্য একথা আপনাকে কে বলেছে? মিচকে হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে কথা বলতে থাকল সনাতন হাজরা। আমার হাতেও তো একটা পিস্তল রয়েছে। আমিও তো চাইলে আপনাকে গুলি…

কথা শেষ হল না সনাতনের। প্রমথরঞ্জনের বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে এল সোজা। গুলি ছুটে গেল সনাতনের পায়ের চেটো লক্ষ করে। একটা আর্তনাদ করে সনাতন সোজা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

সনাতনের পায়ের খড়ম ছিটকে বেরিয়ে গেল। এবং খড়মটা দু-আধখানা হয়ে গেল নিমেষে।

আর সেই খড়ম দু ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে সেই খড়মের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এল একটা আশ্চর্য জিনিস।

একটা হীরে।

যে হীরেটার রং আকাশি।

–মাই গড!

এই স্বগতোক্তিটা অপ্রত্যাশিতভাবে বেরিয়ে এল ফাদারের মুখ থেকে।

–যে হীরের জন্য আমরা হন্যে হয়ে যাচ্ছিলাম, সেই হীরে আপনার কাছে!

আহত, রক্তাক্ত অবস্থাতেও অতি কষ্টে বলে উঠল সনাতন,

–মানে! এই হীরে আপনারা খুঁজছিলেন?

হাতে গুলির জখম থেকে গলগল করে রক্ত বেরচ্ছিল সূর্য মিত্রর। প্রায় গোঙানির মতোই শোনা গেল তাঁর কণ্ঠস্বর,

–তার মানে রায়েদের বাড়ি থেকে আপনিই এই হীরেটা সরিয়েছিলেন!

অবিরত রক্ত বেরোচ্ছে সনাতনের পা থেকেও। সনাতন তার মধ্যেও না হেসে থাকতে পারল না।

–কী বলছেন আপনারা নিজেরাও জানেন না। বর‌ং জনার্দনবাবু জানবেন এই হীরের উৎস কী!

দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকা জনার্দন আতঙ্কে, বিস্ময়ে বলে উঠল,

–তার মানে এই সেই ঠগীদের কাছ থেকে…
–আজ্ঞে হ্যাঁ! অতি কষ্টে কথা বলতে শুরু করল সনাতন। এই সেই হীরে!
–জয়চাঁদ!

চাপা গলায় হুঙ্কার দিয়ে উঠল ফাদার।

–দেরি কোরো না। হীরেটা নাও!

মাটিতে পড়ে থাকা হীরেটা কুড়োতে ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়চাঁদ। আচমকাই। আর সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল জনার্দন সান্যাল।

–খবরদার! এই হীরে নিয়ে এই ঘর থেকে কেউ বেরোতে পারবে না আমি থাকতে! এই হীরে ব্রিটিশ সরকারের সম্পত্তি!

কথাটা শেষ হওয়ার পর একটা নিশ্বাস নেওয়ারও সময় পেল না জনার্দন সান্যাল। প্রমথরঞ্জনের বন্দুক থেকে গুলি এবার ছুটে গেল জয়চাঁদের ওপর উপুড় হয়ে থাকা জনার্দনের কাঁধ উদ্দেশ্য করে।

জনার্দন যন্ত্রণায় চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তার চিৎকার চলতে থাকল বেশ কিছুক্ষণ ধরে।

ঘরে সকলেই হতভম্ব। সেই অবস্থাতেই প্রমথরঞ্জন বলে উঠল,

–অ্যাঁহ্! ব্রিটিশ সরকারের সম্পত্তি! গুল মারার আর জায়গা পায়নি!

এবার একটু থেমে পরের কথাটা সে বলল জয়চাঁদের উদ্দেশে,

–এই যে ভায়া! লক্ষ্মী ছেলের মতো উঠে এসে ওই হীরেটা আমার হাতে দাও দেখি।

জয়চাঁদ প্রথমে উঠে দাঁড়াল। তারপর হিংস্রভাবে ধেয়ে গেল প্রমথরঞ্জনের উদ্দেশে। প্রথমে তার পেটে একটা সজোরে গুঁতো মেরে তাকে ধরাশায়ী করল। তারপর সে বেরোতে চেষ্টা করল ঘর থেকে।

কিন্তু তাকে কেউ একটা ঘরের বাইরে থেকে ধাক্কা মারল সবেগে।

জয়চাঁদ হাতের মুঠোয় হীরেটা কবজা করা অবস্থাতেই ঘরের মধ্যে গড়িয়ে পড়ল।

জয়চাঁদের গুঁতো খেয়ে দরজার সামনেই পড়ে গিয়েছিল প্রমথরঞ্জন। সে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল না। তার আগেই দরজা দিয়ে ঢুকল আরেক ব্যক্তি। প্রমথরঞ্জনের বুকে পা রেখে সে বলল,

–আমার পিস্তলটা ফেরত দে হারামজাদা!

পরনে উর্দি, ঠোঁটের কোণ থেকে বেরিয়ে আসছে রক্ত। কিন্তু চোখে তখনও আগুন জ্বলছে শাজাহানের।

 

(এরপর আগামী সংখ্যায়)