Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ত্রিপুরায় তৃণমূল-বিজেপি দ্বন্দ্ব — নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত?

পরভীন সুলতানা

 



সহকারী অধ্যাপক, পি বি কলেজ, গৌরীপুর, অসম

 

 

 

পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে চোখধাঁধানো জয় এবং তৃতীয়বারের জন্য মসনদ দখলের পর এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং তার সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি এখন জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চাইছেন। এমনিতে বাংলায় লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে মমতা বিজেপিকে ভাঙার কাজ চালিয়েই যাচ্ছেন। এই কাজে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য এবং বিজেপির সবচেয়ে বড় ধাক্কা হল মুকুল রায়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন। পশ্চিমবঙ্গ-বিজেপির আরও অনেকেই মুকুল রায়ের অনুগমন করেছেন।

পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের মতো দলগুলি একেবারেই মুছে গেছে, এবং লড়াইটা হয়েছে শুধু তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যেই। তার পরেও বিজেপি সেখানে ১০০টা সিটও জিততে পারেনি। নির্বাচনের পরেও তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ থেকেই বিজেপিকে লাগাতার আক্রমণের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ফলে এরকম একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরি হতে পেরেছে যে বিজেপিকে যদি রুখতে হয়, তবে বিরোধীদের তৃণমূল কংগ্রেসকে যথেষ্ট গুরুত্ব এবং জায়গা দিতেই হবে। মমতা ব্যানার্জিও এই পট পরিবর্তন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তিনি চাইছেন এই সুযোগে বাংলার বাইরে নিজেদের উপস্থিতি বিস্তার করতে।

এই লক্ষ্যেই ত্রিপুরায় পায়ের তলায় মাটি বানাতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর শুধু ত্রিপুরাই নয়, তারা অসমের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও কথাবার্তা শুরু করেছে। তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি অখিল গগইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গগই বর্তমানে অসমের বিধায়ক এবং নবগঠিত রাইজোর দলের সভাপতি। যদিও তিনি আপাতত তৃণমূলে যোগ দেননি বা তৃণমূলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতেও রাজি হননি— কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা তাদের মধ্যে কোনও সমঝোতা দেখতেও পারি। ওদিকে কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ এবং মহিলা কংগ্রেস সভাপতি সুস্মিতা দেবকে নিজেদের দলে নিয়ে আসতে পেরে তৃণমূল একটা চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছে। বোঝা যাচ্ছে অসমে এখন তৃণমূলকে নেতৃত্ব দেবেন তিনিই। বলে রাখা দরকার, সুস্মিতা সাতবারের সাংসদ প্রয়াত কংগ্রেস নেতা সন্তোষমোহন দেবের কন্যা। তাঁর নেতৃত্বে অসমের বাঙালি-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় তৃণমূল এখন বড় কিছু করারই স্বপ্ন দেখছে।

অসমে এই কিছুদিন আগেই বিজেপি দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরেছে এবং সেখানে ২০২৬-এর আগে আর ভোট নেই। ফলে তারা এখন উত্তরপূর্বের আর একটি রাজ্য ত্রিপুরাতেই মনোযোগী হয়েছে, কারণ ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচন এই সামনের ২০২৩এ। এই গত নির্বাচনেই বিজেপি এখানে ২০ বছরের সিপিআই(এম) শাসনের অবসান ঘটিয়ে এই রাজ্যের মসনদ দখল করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস সেই ১৯৯৮ সাল থেকে ত্রিপুরাতে থাকলেও এখানকার সংসদীয় রাজনীতিতে কখনওই দাঁত ফোটাতে পারেনি। বস্তুত আগের বহু নির্বাচনেই তৃণমূল এখানে নিজেপির সহযোগী হয়েই নির্বাচনে লড়েছে। সেই সময়ে ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি (টিইউজিএস)-ও তাদের সমর্থনে ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলায় এই দুই পার্টি এখন যুযুধান— তার প্রভাবই পড়ছে নিকটবর্তী ত্রিপুরাতেও।

ত্রিপুরার এই বর্তমান সমস্যার সূত্রপাত প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাকের একটি দল সেখানে গ্রাউন্ড রিসার্চের কাজে পৌঁছনোর পর। প্রশান্ত কিশোর এবং আইপ্যাক বাংলার নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির হয়ে কাজ করেছিল এবং ত্রিপুরা নির্বাচনেও তারা সেটাই করবে এরকমটাই স্থির হয়েছে। ত্রিপুরা পুলিশ কোভিড বিধি লঙ্ঘনের দায়ে দলটির সদস্যদের গ্রেপ্তার করে। তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেন এটা ত্রিপুরার বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। যেহেতু আইপ্যাক তৃণমূলের সঙ্গে কাজ করে সেইজন্যই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ঋতব্রত ব্যানার্জির মতো তৃণমূল নেতারা ত্রিপুরায় পৌঁছন এবং আইপ্যাকের সদস্যদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। অভিষেক ব্যানার্জি অভিযোগ করেন ওই সদস্যদের আরটিপিসিআর রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে হেনস্থা করা হয়েছে।

সংঘর্ষ বাড়তেই থাকল, কারণ এর মধ্যেই বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয় দল থেকেই অনেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া শুরু করল। ত্রিপুরার প্রেক্ষিতে ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই প্রথম ত্রিপুরাতে একটি বিজেপি-বিরোধী মোর্চা দানা বাঁধতে চলেছে। এর তাৎপর্য জাতীয় স্তরেও। মমতা ব্যানার্জি খুব পরিকল্পনা করেই উত্তরপ্রদেশ বা পাঞ্জাবের মতো উত্তরভারতের কোনও রাজ্যের পরিবর্তে নিজের দলের সংগঠন বাড়ানোর জন্য ত্রিপুরাকে পাখির চোখ করেছেন। ত্রিপুরায় বাঙালি প্রচুর, এবং তাঁরা সহজেই তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারবেন। বাম এবং কংগ্রেস ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হওয়ায় তৃণমূল আশা করছে তারা সেই শূন্যতা ভরাট করতে পারবে। যেমনটা হয়েছে বাংলায়।

এই মুহূর্তে ত্রিপুরাতে আরও একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান এবং শক্তিবৃদ্ধি ঘটছে— তিপ্রা মোথা। এই দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন রাজবংশের উত্তরাধিকারী প্রদ্যোৎ বর্মন। এদের দাবি এরাই হচ্ছে ত্রিপুরার ভূমিপুত্রদের প্রকৃত প্রতিনিধি, যাঁরা কিনা বর্তমানে ত্রিপুরায় সংখ্যালঘু হয়ে গেছেন। আইপিএফটি বা ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা-র গণভিত্তিতে বর্তমানে ব্যাপক ধস নেমেছে এবং স্বশাসিত পর্ষদের নির্বাচনে তিপ্রা ব্যাপকভাবে বিজয় অর্জন করেছে। তিপ্রা এখন পর্যন্ত এই অবস্থানে অনড় রয়েছে যে তারা সেই সব দলের সঙ্গেই হাত মেলাতে প্রস্তুত যারা তাদের বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ডের দাবিকে সমর্থন জানাবে। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণ যদি এমন কোনও দলের দিকে ঝোঁকেন যারা তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত করবে তবে সেটা মোটেই আশ্চর্যের কোনও বিষয় হবে না। আর তাঁদের সেই চাহিদার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের যে সাযুজ্য আছে তা বলাই বাহুল্য। এর সঙ্গেই আবার বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্বের কথাও মাথায় রাখতে হবে। দলের অনেকেই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবকে নিয়ে সন্তুষ্ট নন। ফলে এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তিবৃদ্ধি বিজেপিকে আরও সমস্যায় ফেলতে পারে।

সব মিলিয়ে, ত্রিপুরার আগামী বিধানসভা নির্বাচন খুবই কৌতূহলোদ্দীপক হতে চলেছে। ভোট ২০২৩এ, অতএব তৃণমূল কংগ্রেস সময় পাচ্ছে তাদের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধির। এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূলের এই ত্রিপুরায় নজর দেওয়ার কৌশল একদিকে যেমন তাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হতে পারে, তেমনই অন্যদিকে আবার বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকছে যথেষ্ট। শেষ বিচারে যার ফলে বিজেপিই লাভবান হবে।

আর, ২০২৩-এর ত্রিপুরার ভোটের প্রভাব নিশ্চিতভাবেই ২০২৪-এর সংসদীয় নির্বাচনের ওপরে পড়বে। আইপ্যাক-প্রধান স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা নিয়ে বর্তমানে খুবই চর্চা চলছে। প্রশান্ত নিজে পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তিনি আপাতত কিছুদিন বিরতি চান, ফলে ভাবা হচ্ছে ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে তিনি আবার মঞ্চে ফিরবেন।

নির্বাচনে বিজেপি কতটা অপরাজেয় তারও একটা প্রকৃত পরীক্ষা হতে চলেছে ত্রিপুরাতে। পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনও সামনে। সেখানে একদিকে ক্যাপ্টেন অমরিন্দার সিং-এর সরকার অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত, অন্যদিকে যোগী আদিত্যনাথ এটা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন যে উত্তরপ্রদেশ-বিজেপিতে তাঁর কোনও বিকল্প নেই। উত্তর-পূর্বের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে ভোটের ফল কী হয় তা আমরা এখনও দেখিনি। এই রাজ্যগুলির অনেক জায়গাতেই ভাষা-আন্দোলন বা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে বাংলাভাষী মানুষদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হতে দেখা গেছে। এই প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস, যাকে সাধারণভাবে একটি বাঙালি রাজনৈতিক দল হিসেবেই দেখা হয়, তাদের এই অঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে নিজেদের বিস্তার ঘটানোর বেশ কিছু প্রতিকূলতা বিদ্যমান। যদি তারা ত্রিপুরাতে সত্যি সত্যি জিততে পারে, তবে সেই বিজয় অন্যান্য রাজ্যে, বিশেষ করে যেগুলিতে বাংলাভাষী মানুষের বড়সড় উপস্থিতি আছে, সেগুলিতে সংগঠন বিস্তারের পক্ষেও সহায়ক হবে।