শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক ও গল্পকার, পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার
তালিবান শব্দটা কানে বাজলেই গা শিউরে ওঠে এক উৎকট নৃশংসতায়। ভাবলেশহীন মুখে প্রকাশ্যে নির্দোষ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া তাদের কাছে পবিত্র কাজ। তালিবানকে এতটাই ভয় যে ভিটেমাটি ছেড়ে তাদের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব দূরে সরে যেতে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও উড়োজাহাজের চাকায় ঝুলে দেশান্তরী হতে পেছপা হয় না সাধারণ আফগান। তাদের নৈকট্যে চূড়ান্ত অসহায়তায় মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন কাটায় মানবদরদী চিন্তাশীল নারী। আবার সেই তালিবানরাই আজ আফগানভূমের শাসক।
যেহেতু আজকের আফগানিস্তান আগের আফগানিস্তান নয় তাই অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন আজকের তালিবান সেই তালিবান নয়। তারা কী করবে আর কী করবে না সেই দিকেই তাকিয়ে আফগান জনগণ, গোটা বিশ্ব। এমতাবস্থায় নিজেদের ঘুঁটি নতুন করে সাজিয়ে নিচ্ছে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরব। সঙ্গে আরও। বলা বাহুল্য, আজকের আফগানিস্তানের নেপথ্যে জড়িয়ে রয়েছে বহুমুখী মতাদর্শের বিরোধ, বহুস্তরীয় ষড়যন্ত্রের নির্মাণ, বহুমাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক উপাদানের এক কুটিল সমন্বয়।
শুরু করা যাক ছিয়াশির বৈঠক দিয়েই।
বসন্ত আসেনি, এসেছে মুজাহিদ
১৯৮৬ সালের বসন্তকাল। ক্যালিফোর্নিয়ার শেরমান ওকসের হিলটন হোটেল। হোটেলে উঠেছেন প্রায় সাড়ে ছয় ফিট লম্বা প্রভাবশালী এক আফগান মুজাহিদ। সিআইএ-র খাতায় তিনি ‘টিম ওসমান’ নামে পরিচিত। হোটেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এফবিআই-এর স্পেশাল এজেন্ট গুন্ডারসন, মিশেল রুকনোসকুইটো ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্মকর্তা রাল্ফ ওলবার্গ। গুন্ডারসন একইসঙ্গে সিআইএ ও ন্যাশনাল সিকিউরিটির সার্ভিসেরও একজন জাঁদরেল এজেন্ট। রুকনোসকুইটো মিসাইল প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। ওলবার্গের আর একটি পরিচয়, তিনি দুঁদে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ী। আফগান রণাঙ্গনে রুশ সেনাদের হাতে একের পর এক ধরাশায়ী হচ্ছে আফগান মুজাহিদরা। বিশেষ করে রুশ বিমান আর হেলিকপ্টার গানশিপের হামলায় মুজাহিদরা নাস্তানাবুদ। তাদের জন্য দরকার আধুনিক অস্ত্র। সেই কারণেই টিম ওসমানের সঙ্গে এই বৈঠক। সমাধান হিসেবে পাওয়া গেল রুকনোসকুইটোর হাতে তৈরি স্ট্রিঙ্গার মিসাইল। প্রোটোটাইপ অনুসরণ করে অস্ত্র তৈরি হবে পাকিস্তানে। সেখান থেকে পৌঁছে যাবে মুজাহিদদের হাতে। এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে রণাঙ্গনে ফিরে যান ‘টিম ওসমান’। সিআইএ-র ‘টিম ওসমান’ ছদ্মনামের আড়ালের মানুষটি আর কেউ নন, খোদ ওসামা বিন লাদেন। পরের এক বছরে আফগান মুজাহিদদের হাতে পৌঁছে যায় পনেরোশো থেকে দু হাজার ম্যানপ্যাডস ওরফে স্ট্রিঙ্গার মিসাইল। বলা হয়ে থাকে, স্ট্রিঙ্গার মিসাইলের কারণেই টার্নিং পয়েন্টে পৌঁছে যায় আফগান মুজাহিদদের ধর্মযুদ্ধ।
১৯৭৩ সালে মহম্মদ দাউদ খান এক সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে মহম্মদ জাহির শাহকে সরিয়ে দিলে আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র শেষ হয়। সাধারণতান্ত্রিক আফগানিস্তানে ১৯৭৫-৭৭ সালের মধ্যে মহিলারা নানান সুযোগসুবিধা ও অধিকার পায় যা থেকে তারা দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে নূর মহম্মদ তারাকি-র নেতৃত্বে সে দেশের কমিউনিস্টদের মধ্যে খালক্ গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে। তারাকি দেশের রাষ্ট্রপতি এবং পরচম গোষ্ঠীর (PDPA পার্টির আর একটি গোষ্ঠী) নেতা বাবরাক কামাল উপ-প্রধানমন্ত্রী হন। এই নতুন সরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়ার কথা ঘোষণা করে এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই সময় রক্ষণশীল এবং মৌলবাদী কিছু ইসলামিক নেতা নতুন সরকারের সমাজ সংস্কারের বিরুদ্ধে গেরিলা সংগঠন তৈরি করে ‘মুজাহিদিন’ নাম দিয়ে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে সরকারের বিরুদ্ধে। দেখা দেয় গণতান্ত্রিক আইনের অনুশাসনের সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের চরম দ্বন্দ্ব। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করলে এই দ্বন্দ্ব নতুন চেহারা নেয়। সে বছরই আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে সিআইএ-র দৃশ্যমান এবং প্রাতিষ্ঠানিক সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। ৩ জুলাই আফগান মুজাহিদ সহ রুশ-বিরোধীদের গোপন সাহায্য দেওয়া বিষয়ে একটি নির্দেশনামায় সই করেন প্রেসিডেন্ট কার্টার। বিন লাদেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সূচনাও সে বছরই। ২২ বছর বয়সের বিন লাদেন তখন সৌদি আরবে প্রায় তিনশো মিলিয়ন ডলারের পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে আফগান রণাঙ্গনে মুজাহিদ হওয়াকেই নিজের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন। ফলত আফগান সমাজের ভিতরের দ্বন্দ্বটি সোভিয়েত রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরের দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। মার্কিন দেশ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে অন্য ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে এই অঞ্চলে। আরোপিত সোভিয়েত অনুশাসনের মধ্য দিয়ে নারীরা কিছু সুযোগসুবিধা পেলেও, এই অঞ্চলের অশিক্ষা ও চূড়ান্ত দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গড়ার কাজে পাকিস্তান ও বিন লাদেন দুইই হয়ে উঠল যুক্তরাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মোক্ষম ঘুঁটি। বকলমে এক বেসরকারি সৈন্যবাহিনি গড়ে তুলে কাজে লাগানো হল এই সকল অঞ্চলের সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলির ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্বকে। ঊষর আফগানিস্তানে ধর্মীয় উন্মাদনার প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহাওয়া আর তুমুল অস্ত্রব্যবসার উর্বর জমি তৈরি হল। আফিম চাষ ও ড্রাগ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একদিকে একটা বেআইনি অর্থনীতি গড়ে তুলে এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে অর্থ জোগানো হয়েছে। ফলত এই সকল অঞ্চলের সরকারগুলিরও প্রতিরক্ষা বাজেটও বেড়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক ফায়দা লুটেছে দুদিক থেকেই।
অনন্ত আতঙ্কের কারিগর
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ইরাক সিরিয়া ইয়েমেন লেবানন নাইজেরিয়া সোমালিয়া কাশ্মির কিংবা প্যালেস্টাইনের এ যুগের আতঙ্কিরা যে কৌশলগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের জঙ্গি তৎপরতা জারি রেখেছে তার গুরুদায় অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র তথা সিআইএর।
১৯৮৩ সালে হোয়াইট হাউসে আফগান মুজাহিদদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গোপনীয়তার সকল আগল ভেঙে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট রেগন। সে সময় তিনটি স্তরে আফগান মুজাহিদদের সাহায্য দিতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। মিলিটারি লজিস্টিক, টেকনোলজি এবং আদর্শভিত্তিক সমর্থন। সাহায্যের এই তৃতীয় ধাপটি ছিল অদ্ভুত— অকল্পনীয়। আফগান মুজাহিদদের জন্য মার্কিন সহায়তা যেন নেহাত মিলিটারি সাপ্লাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরি করে সেটাই ছিল আদর্শভিত্তিক এই সমর্থনের উদ্দেশ্য। মোদ্দা কথা হল, আফগানিস্তানের মাটি যেন জেহাদ তথা ধর্মযুদ্ধের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে তার একটা সুদূরপ্রসারী ছক বাস্তবায়নের জন্যই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কথিত এই ‘আদর্শভিত্তিক সমর্থন’। নিরন্ন আফগানদের মুখের অন্ন কিংবা শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা নয় বরং দরিদ্র এই ভূখণ্ডের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কট্টর উগ্রবাদী করে তোলার পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মাদ্রাসায় শিশুদের ইংরাজি অক্ষর জ্ঞান দেওয়া হত এইভাবে,
A for Allah, J for jihad. Our religion is islam. The Russians are the enemies of the religion of Islam.
১৯৮৪ সালে আফগানিস্তানে মাকতব-আল-খিদমার বা এমএকে নামের একটি সংগঠন গড়েছিলেন বিন লাদেন। কাকতালীয় হলেও একই বছর প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হক পাকিস্তানে শরিয়া আইন চালু করেছিলেন। মূলত সেটা ছিল সিআইএর পরামর্শে পাক-আফগান অঞ্চলে যোদ্ধাদের জন্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে পাকিস্তান তথা আইএসআই-র আরও একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
১৯৮৫ সালের মার্চে ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি’-র আওতায় মুজাহিদদের জন্যে সামরিক ও আদর্শভিত্তিক সাহায্য বাড়ানোর নির্দেশনামায় সই করেছিলেন রেগন। যার আওতায় ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আফগান মুজাহিদদের দেওয়া অস্ত্রের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬৫ হাজার টন। পাকিস্তানের আইএসআই ও সিআইএ যুগলবন্দিতে যোদ্ধার প্রশিক্ষণ চলতে থাকে দিনরাত। ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দশ বছরে এমএকেসহ বিশ্বের ৪৩টি মুসলিম দেশের অন্তত ৩৫ হাজার উগ্র মুসলিম যুবককে জিহাদি ট্রেনিং দিয়েছে সিআইএ। এছাড়াও সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছিল আফগান মুজাহিদরা। ১৯৭৯ থেকে ২০০১ সালের অক্টোবরে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত পাকিস্তানের আইএসআই, যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা এই তিন পক্ষ মিলে আফগান রণাঙ্গনকে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের বীজতলায় পরিণত করেছিল।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুক একবার বলেছিলেন, ‘We may be fighting the wrong enemy in the wrong country…’। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক এই কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের আফগান ব্যুরো প্রধান কারলোত্তা গল। নাইন-ইলেভেন হামলার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ও জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে গভীর অনুসন্ধানে কারলোত্তা দেখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অন্যতম সহযোদ্ধা আইএসআই কীভাবে নিত্যনতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম দিয়ে চলেছে। আবার সেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেই রণাঙ্গনে যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
নাইন-ইলেভেন তেমনই এক হাতেগড়া মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি।
আঠাশ পাতার ‘ক্লাসিফায়েড’ নাইন-ইলেভেন
২০০১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। ফ্লোরিডার সারাসোটা এলাকার কোরাল দ্বীপের এক রিসর্টে তখন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। ঠিক তিনদিন আগেই আরও দুজন মানুষ ফ্লোরিডায় বেড়াতে যান, মোহাম্মদ আতা ও মারোয়ান আল শেহ্-হি। দুজনেই নাইন-ইলেভেন ট্র্যাজেডির বিমান ছিনতাইয়ের নায়ক। বুশের রিসর্টের ছাদে প্রহরায় ছিল ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিশাইল। আকাশে নিঃশব্দে টহল দিচ্ছে AWACS (Airborne Warning and Control System)-এর বিমান। প্রশ্ন ওঠে, যদি এটাই স্বাভাবিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না হয়ে থাকে তবে এই নিরাপত্তা কারণ কী। ১১ সেপ্টেম্বরের ভোরের আলোয় শর্টস টি-শার্ট আর জগিং শু পরে মেক্সিকো উপসাগরের সৈকত ধরে বুশ যখন এগিয়ে চলেছেন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তারক্ষীরা ঘিরে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কোনও এক দেশের টিভি চ্যানেলের ক্রু। এর ঠিক দু দিন আগেই সাক্ষাৎকার প্রার্থী দুই সাংবাদিকের হাতে খুন হয়েছেন আফগানিস্তানে তালিবান-বিরোধী লড়াইয়ের নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের নেতা আহমেদ শাহ্ মাসুদ। আফগান মুক্তি আন্দোলনের এই প্রভাবশালী নেতা আতঙ্কীদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ মাসুদকে ভালোবেসে ‘পাঞ্জশির-এর সিংহ’ বলে ডাকত। তিনি বেঁচে থাকলে আফগানিস্তানকে ঘিরে আজকের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকম হত। ভিডিও ক্যামেরাকে বোমা বানিয়ে মাসুদের ওপর আত্মঘাতী হামলার জন্য আল কায়েদা ও আইএসআইকে দায়ী করা হয়েছিল। এই বিবৃতি আসে ১৪ সেপ্টেম্বর। অথচ তার আগে পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল এই মৃত্যুসংবাদ।
সকাল ৮টা ১৩ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ইলেভেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের নির্দেশ না মেনে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে নিউইয়র্কের দিকে রওনা হয়েছে। যোগাযোগের রেডিও ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে দিয়েছে পাইলট। বোঝা গেল ফ্লাইট ইলেভেন হাইজ্যাক হয়েছে। তারপরেও (NORAD) নো রেডিও ঘোষণা করা হল না। তা হলে বলপূর্বক বিমানটিকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করত সামরিক বিমান। বুশের রিসর্টে প্রহরায় থাকা আধুনিক অস্ত্রের মতো আরও অনেক কিছুই তখন মার্কিন হাতের মুঠোয়। সাতাশ মিনিট পর যখন বোস্টন এয়ার ট্রাফিক কনট্রোল NORAD ঘোষণা করল ততক্ষণে ফ্লাইট ইলেভেন নিউ ইয়র্কের আকাশে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের খুব কাছাকাছি। ৯টার কিছুক্ষণ আগে সারাসোটার এলিমেন্টারি (Emma E. Booker Elementary School) স্কুলে প্রবেশ করলেন বুশ। ঠিক পনেরো মিনিট আগে উত্তর টাওয়ারের ৯৩ থেকে ৯৯ তলার মধ্যে ঢুকে পড়েছে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ছিনতাই হওয়া প্রথম বিমান। দ্বিতীয় বিমানটি দক্ষিণ টাওয়ার ভেদ করে ৯টা ০৩ মিনিটে। এরও তিন মিনিট পর প্রেসিডেন্টকে খবরটা পৌঁছে দেন চিফ অফ স্টাফ অ্যান্ডি কর্ড। বুশ তখন স্কুলের সেমিনার কক্ষে শিশুদের গল্প শোনাচ্ছেন। খবর পেয়ে বুশ অ্যান্ডি কর্ডকে পাল্টা কোনও প্রশ্ন করলেন না, কোনও নির্দেশ দিলেন না, সামরিক পদক্ষেপ বা পেন্টাগনের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইলেন না। বিশ্ব জুড়ে যখন ব্রেকিং নিউজ, ‘ইউএসএ ইস আন্ডার অ্যাটাক’, বুশ গল্প শোনাচ্ছেন বাচ্চাদের। ৯টা ১৬ মিনিটে পূর্ব-নির্ধারিত বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট জানালেন, “Ladies and Gentlemen, this is a difficult moment for America…”। এমন একটি ঘোষণা জাতিকে দেওয়ার আগে বা পরে বুশকে মোটেও তৎপর মনে হয়নি। তামাম বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া নাইন-ইলেভেনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজারো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভিড়ে ঠাঁই করে নিয়েছিল বুশের ওই মুহূর্তটিও যা কিনা অনেকের কাছে ‘রোম পুড়ছে আর নিরো বাঁশি বাজাচ্ছেন’ এমন উপমার সমার্থক হয়ে উঠেছিল।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, নাইন-ইলেভেনের আগে ও পরে অন্তত পাঁচটি চার্টার্ড বিমানে শতাধিক সৌদি নাগরিক বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়েছে। নাইন-ইলেভেনের ঘটনা নিয়ে ২০০৩ সালের জুলাইয়ে একটি রিপোর্ট দিয়েছিল কংগ্রেসের যৌথ তদন্ত কমিটি। ওই রিপোর্টে ২৮ পাতার একটি পরিচ্ছেদে সৌদি আরব তথা সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স বানদারের ভূমিকা, সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রে তার একাধিক এজেন্টের রহস্যময় উপস্থিতি, ঘটনার এক বছর আগে থেকে লস এঞ্জেলস, সান্তিয়াগো, লাস ভেগাস আর সারাসোটায় তাদের আনাগোনা এবং এফবিআই আইআইএর আশ্চর্যজনকভাবে মুখে কুলুপ এঁটে থাকা, এইসব কিছুই ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বুশ প্রশাসন রিপোর্টটি প্রকাশ করতে দেয়নি। কথিত ‘ক্লাসিফায়েড’-এর মোড়কে আজও গোপন রাখা হয়েছে বিশ্ব-ইতিহাসের বর্বরোচিত একটি ষড়যন্ত্রের দলিল। বুশের সুপরিকল্পিত মৌনভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার কথিত স্বাধীন গণমাধ্যম। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের যেসব গণমাধ্যমের অনুসন্ধিৎসু সংবাদকর্মীরা যৌক্তিক প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন তাদের চাকরি হারাতে হয়েছে। হাজারো প্রশ্ন জেগেছিলে খোদ সিআইএর অভিজ্ঞ দাপুটে পাইলট ফিলিপ মার্শালের মনে। দশ বছর গবেষণার পর ২০১২ সালে তিনি প্রকাশ করেন তার সাড়া জাগানো বই, The Big Bamboozle: 9/11 and the War on Terror। ২৮ পাতার বেশ কিছু অংশ ফাঁস করেছেন ফিলিপ এই বইতে। বুশ ও তার প্রশাসনের বিরূদ্ধে এমন গুরুতর এবং তার ভাষায় ‘দিবালোকের মত সত্য’ প্রকাশ করা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ফিলিপ। বইটি প্রকাশের এক বছর পর ২০১৩ সালে ফিলিপ ও তার দুই সন্তানের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। সবার মাথায় একটি করে বুলেট।
সোনার ডিম পাড়া হাঁস— তালিবান
একটা সময় ছিল যখন আফগানিস্তানের মানুষের ঘরের দেওয়াল থেকে শুরু করে গাড়ির ড্যাশবোর্ড পর্যন্ত সর্বত্র ঝোলানো থাকত আহমেদ শাহ মাসুদের ছবি। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে লাখো মানুষের ভিড় সামলাতে বিশাল স্টেডিয়ামে শোকসভার আয়োজন হয়েছিল। এমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার মধ্যে দিয়ে জাতীয় বীরে পরিণত হওয়াটাই কাল হয়েছিল মাসুদের জন্য। তিনি বেঁচে থাকলে আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের রণাঙ্গন বানানো এত সহজ হত না এবং তালিবান বিরোধী যুদ্ধে নিশ্চিত বিজয়ের পর মার্কিনপন্থী পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসানো যেত না। আফগানিস্তানে সুন্নি জঙ্গিদের উত্থানের অজুহাতে সম্ভাব্য মার্কিন প্রভাব ঠেকাতে মরিয়া ইরান-রাশিয়া উভয়ের কাছ থেকেই অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছিলেন মাসুদ। অন্যদিকে তালিবান এবং আল কায়দাকে মদত দিয়ে প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রণভূমি ও তার ছায়াশত্রু নির্মাণের মহাযজ্ঞটা সারছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
১২ সেপ্টেম্বর রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে নতুন যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ বলছেন,
The deliberate and deadly attacks which were carried out yesterday against our country were more than acts of terror. They were acts of war.
সে রাতেই সিআইএ প্রধান, প্রতিরক্ষামন্ত্রী আর পেন্টাগনের সামরিক কর্মকর্তাদের আফগান যুদ্ধের ছক প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন প্রেসিডেন্ট। নিজের দেশের তিন হাজার মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাতের মুঠোয় তখন অন্তহীন যুদ্ধ, নতুন শতকের নয়া আধিপত্যবাদের চাবিকাঠি। ২০ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বুশ বললেন,
The leadership of Al Qaeda has great influence in Afghanistan and supports the Taliban regime in controlling most of that country…The United States respects the people of Afghanistan–after all, we are currently its largest source of humanitarian aid–but we condemn the Taliban regime. By aiding and abetting murder, the Taliban regime is committing murder. And tonight the United States of America makes the following demands on the Taliban. Deliver to United States authorities all of the leaders of Al Quaeda who hide in your land…we will pursue nations that provide aid or safe haven to terrorism. Every nation in every region now has a decision to make: Either you are with us or you are with the terrorists.
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পরিকল্পনায় নতুন শত্রুর নাম তালিবান। পশতু ভাষায় তালিবান মানে হচ্ছে ‘ছাত্র’। আফগানিস্তান থেকে যখন সোভিয়েত সৈন্যরা পিছু হটল, তখন ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে উত্তর পাকিস্তানে এই তালিবান আন্দোলনের জন্ম। এবং তালিবানদের প্রাথমিক এই উত্থানের নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও ছিল। এই আন্দোলনে মূলত পশতুন অর্থাৎ পশতুভাষীদের প্রাধান্য। ধারণা করা হয়, মাদ্রাসাগুলোতে প্রথম এরা সংগঠিত হয় যেখানে খুবই কট্টর সুন্নি মতাদর্শের ইসলামই প্রচার করা হত। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান, এই দুই দেশের সীমান্তের দুদিকেই আছে বিস্তীর্ণ পশতুন অধ্যূষিত অঞ্চল। তালিবান এসব অঞ্চলে খুব দ্রুতই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তালিবান নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় গেলে তারা শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে এবং কঠোর শরিয়া শাসন জারি করবে। সোভিয়েতরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মুজাহিদিনদের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্ব শুরু হয়। এমন টালমাটাল সামাজিক পরিস্থিতিতে তালিবান যখন প্রথম আলোয় আসে, তখন আফগানিস্তানের মানুষ সাধারণভাবে তাদের বিরোধিতা করেছিল এমন নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের পক্ষে যেটুকু জায়গা তৈরি হয়েছিল তা মূলত তাদের দুর্নীতি দমন, আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, তাদের নিয়ন্ত্রিত রাস্তা দিয়ে নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে।
তবে তালিবান একই সঙ্গে তাদের জারি করা কঠোর শরিয়া অনুশাসনে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মতো শাস্তি চালু করে। অপরাধী কিংবা ব্যাভিচারীদের প্রকাশ্যে হত্যা করা, চুরির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হাত কেটে নেওয়া এসবই বাস্তবায়িত হয়েছিল তালিবান শাসনে। পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের পুরো শরীর ঢাকা বোরখা পরা বাধ্যতামূলক করা হয় সেই সময়। তাছাড়াও তালিবান টেলিভিশন, সঙ্গীত এবং সিনেমা নিষিদ্ধ করে। দশ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই বলে নিয়ম জারি করে।
তালিবানের বিরুদ্ধে বহু ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসের অভিযোগ ওঠে। সবচেয়ে ভয়াবহ কাণ্ডটি তারা ঘটিয়েছিল ২০০১ সালে বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করে।
তালিবানদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় অনুশাসন ও গ্রামীণ সুরা কাউন্সিলের অনুশাসন দুটোই একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। একদিকে আফিম চাষ আর অন্যদিকে অস্ত্রব্যবসার মধ্যে দিয়ে তারা আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠল। পাকিস্তানের সামরিক বিভাগের দিকেও মোটা টাকার লেনদেন হতে থাকে। ফলত পাকিস্তানে কোনও নির্বাচিত সরকার শান্তিপ্রক্রিয়া জারি করতে গেলেই তার বিরুদ্ধে ঘটেছে বর্বর আক্রমণ। বেনজির ভুট্টোর মৃত্যু সেদিকেই ইশারা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আর আগের মতো ছিল না বিন লাদেনের। লাদেন কার্যত ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে হয়ে ব্যাপক যোগাযোগের মাধ্যমে এই অঞ্চলের দরিদ্র মুসলিম যুবকদের সন্ত্রাসবাদে সংঘটিত করে বিশাল শক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছিল। স্বভাবতই তার লক্ষ্য ছিল এই শক্তির ঘাড়ে চেপেই এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া। লাদেনের উসকানিতে তালিবানরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া শুরু করল। যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদের নারীবিদ্বেষী কাজগুলিকে সামনে এনে লাদেনের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করল। নাইন-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট ক্রমশ মজবুত হয়ে উঠেছে তখন। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ নামে অনিঃশেষ এক অন্যায় যুদ্ধের সূচনা সেখান থেকেই।
কখনও তালিবানদের সমর্থন, কখনও বা তাদের নির্মূল করার প্রকাশ্য জমজমাট পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে বস্তুত ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ে আধিপত্য কায়েম রাখা তখন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র ও চূড়ান্ত লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার সাফাই দিয়ে জো বাইডেন বলেছেন,
US troop should not be used for nation building, but to fight and win war. Barack Obama and Donald Trump both promised not to get mired in nation building.
সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং একইসঙ্গে আফগানিস্তানের জাতিগত সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ধরে রাখার এক মোক্ষম মন্তব্য বটে। আফগানিস্তানের সামাজিক অভিমুখ নতুন রাস্তা নেয় চিন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যের নতুন দ্বন্দ্বকে ঘিরে। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান দখল নেওয়ার শুরু থেকেই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা তালিবানদের নতুন করে ক্ষমতায় আনার জন্য আয়োজন শুরু করে চিন। চিন-পাকিস্তান জোট তালিবানদের শক্তি বাড়িয়ে আফগান সরকারকে আক্রমণ করতে সাহায্য করতে ইন্ধন জোগায়। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তালিবানদের হাত করে আফগানিস্তানের দখলদারিত্ব চিনের হাতে যাক এমন তারা কস্মিনকালেও চায় না। তথাকথিত তাবড়-তাবড় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি নিজস্ব ধূর্ততায় তালিবানদের সঙ্গে এমন এক মধ্যবর্তী অবস্থান নিচ্ছে যা প্রকট করে তুলছে একটিই বাস্তবতাকে। তালিবান যে তাদের সকলেরই সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
পুঁজি ও সন্ত্রাসের মিথোজীবীতা— যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও রাশিয়া
অস্বাভাবিক তাপমাত্রার হেরফের, হিন্দুকুশ অঞ্চলের রুক্ষ আবহাওয়া, চরম দারিদ্র্য সত্ত্বেও আফগানিস্তান দেশটি বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার গুরুত্বপূর্ণ পথ। এই কারণেই সবাই দখলদারিত্ব রাখতে চেয়েছে আফগানিস্তানের ওপরে, ফলে একটি স্বাধীন দেশ হয়েও জাতি হিসেবে বিকশিত হতে পারেনি আফগান জনগণ। অন্তর্দ্বন্দ্বে জেরবার ট্রাইবাল গ্রুপগুলিও রয়ে গেছে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে এমনই তো অভিপ্রেত। এমতাবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি যুবক সম্প্রদায়ের কাছে লাভজনক অবলম্বন। এই ধরনের নৈরাজ্যের ঘেরাটোপে এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানকে কাজে লাগিয়ে আফগান সরকার এক আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলবে তা কল্পনা করা বাতুলতার সামিল, যেখানে একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিকাল সার্ভের সঙ্গে যুক্ত মিরজাদ সায়েন্স ম্যাগাজিনে বলেছিলেন,
If Afghanistan has a few years of calm, allowing the development of its mineral resources, it could become one of the richest countries in the area within a decade.
এই খনিজ সম্পদের ওপর শ্যেনদৃষ্টি চিন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের। ভারতও পিছিয়ে নেই। বিজ্ঞানী ও সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ রড স্কুনোভার জানিয়েছেন,
Afghanistan is certainly one of the regions richest in traditional precious metals, but also the metals [needed] for the emerging economy of the 21st century… China, the next-door neighbor, is embarking on a very significant green energy development program, Lithium and the rare earths are so far irreplaceable because of their density and physical properties. Those minerals factor into their long-term plans.
উল্টোদিকে আফগানিস্তান পুনর্গঠনে অংশ নিতে চিনকে স্বাগত জানিয়েছে তালিবান। দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চিনের ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তারা। গত সপ্তাহে কাবুলের পতনের আগে থেকেই চিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছে তালিবান। গত মাসেই চিনের বন্দর শহর তিয়ানজিনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে দেখা করে তালিবানের প্রতিনিধিদল।
তালিবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেছেন,
চিন একটি বড় দেশ। তাদের বিশাল অর্থনীতি ও সক্ষমতা রয়েছে। আমি মনে করি, আফগানিস্তান পুনর্গঠনে তারা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্যদিকে রাশিয়া বলেছে, কাবুল থেকে তাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে আনার কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই।
জলবায়ু সঙ্কটের প্রকৃত সমাধান না খুঁজে যে সকল দেশ কেবলমাত্র প্রযুক্তির ব্যবহারে নতুন বাজার গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চয়ন সুরক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর তাদের জন্য দরকারি লিথিয়াম, কোবাল্ট ও rare earth element-এর ভাণ্ডারও এই আফগানিস্তানেই। না বললেই নয় যে, এই rare earth element-এর খনন সঠিক উপায়ে না হলে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য তুমুল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা। আইফোন এবং হাইটেক মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমকে ঘিরে যে সকল পুঁজিবাদী সংস্থা তাদের মুনাফা কয়েক বিলিয়ন বাড়িয়ে তুলতে rare earth element-কে কুক্ষিগত করতে আগ্রহী তাদের প্রতিনিধিরাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে অমানবিক মধ্যযুগীয় তালিবানদের সঙ্গে প্রকাশ্যে হাত মেলাচ্ছে। স্বভাবতই প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পুঁজি দুইই স্বমহিমায় বজায় থাকবে এমন ভাবনা সোনার পাথরবাটি ছাড়া আর কিছুই নয়।
উল্লেখযোগ্য, নাইন-ইলেভেন ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে যে পুঁজির খেলা চলেছিল তার অনেকটাই প্রকাশ্যে এনেছিলেন ফিলিপ মার্শাল তার ‘Capitalizing on Terror‘ অধ্যায়টিতে। সেখানে তিনি লিখেছেন,
Anyone with foreknowledge of the 9/11 attacks would, of course, have had an opportunity to capitalize with trades in stocks and commodities futures. Either these hijackers were placing bets that they wouldn’t be able to collect or someone damn close to the operation was parlaying inside information about the tactical plan…On the day before the attack, September 10, 2001, 4,416 put options were purchased on American Airlines (compared with 748 calls), on the same day that Reuters reported airline stocks were poised to “take off.” In both cases, the traders never cashed in the winnings and the FBI was unable to trace the amazingly insightful investors. No other airlines displayed these lopsided trading patterns…A jump in American Airlines put options 60 times above normal on the day before the attacks. No similar trading occurred on any other airlines. A Bloomberg Business Report and the Institute for Counterterrorism, or ICT confirmed these findings. Morgan Stanley saw, between September 7 and 10, an increase of 27 times on put options on its shares. Merrill-Lynch saw a jump of more than 12 times the normal level of put options in the four trading days before the attacks….
বিস্ময়কর হলেও এটাই ভয়ঙ্কর বাস্তব।
ভবিষ্যৎ: রহমত আর আবদুর রহমানের আফগানিস্তান
কত মানুষেরই না ধারণা যে আফগানিস্তান দেশটি মরুময়, প্রাণহীন, রসহীন, কেবলমাত্র যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি আর দখলদারিত্বের ক্রমিক ইতিহাস। আনন্দের কথা যে সৈয়দ মুজতবা আলীর কলমের জাদুতে রুক্ষ দেশটির অন্তর্গত চাঞ্চল্য, তাদের জীবনযাত্রার যথাযথ মর্যাদা ‘দেশে বিদেশে‘-র রসময় লেখায় চমৎকার ফুটে উঠেছে। তাঁর লেখা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাইরে থেকে পাঠানদের শুষ্ক, রসকষহীন মনে হলেও একবার আলাপ হলেই তারা যে কাউকে আপন করে নিতে পারে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় তাদের মেহমানদারিতে। দারিদ্র্য জর্জরিত জাতি হলেও মেহমানদারিতে তাদের কোনও খামতি নেই। মুজতবা আলী লিখেছিলেন,
আজ বলতে পারি পাঠানের অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ নির্জলা আন্তরিক। অতিথিকে বাড়িতে ডেকে নেওয়ার মত আনন্দ পাঠান অন্য কোনো জিনিসে পায় না আর সে অতিথি যদি বিদেশী হয় তা হলে তো আর কথাই নেই। তারো বাড়া, যদি সে অতিথি পাঠানের তুলনায় রোগাদুবলা সাড়েপাঁচফুটী হয়।
‘পর্বতগৃহবাসিনী ক্ষুদ্র পার্বতীর সেই হস্তচিহ্ন’ আগলে রাখা কাবুলিওয়ালা রহমতকেও কেই বা ভুলতে পারে।
এই সকল মানুষদের সংখ্যা আজকের আফগানিস্তানে বড় একটা কম নয়।
কর্মক্ষেত্রে থেকে সন্ত্রাস ও পুঁজির মিথোজীবীতার কদর্য বাস্তবতা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ফিলিপ মার্শাল। তিনি তাঁর লেখা বইটি উৎসর্গ করেছিলেন ‘পৃথিবীর ভালো মানুষদের প্রতি যারা শতকরা ৯৯.৯৯৯৯ ভাগ‘। অবশিষ্ট একমুঠো খারাপ মানুষদের হাতেই পড়ে রইল রহমত আর আবদুর রহমানের মতো সহজ সরল সহৃদয় আফগান, সন্ত্রস্ত দরিদ্র আফগান, পুরনো অভিজ্ঞতায় নরক-আতঙ্কিত নারীসমাজ, আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে গোটা পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
তথ্যসূত্র:
- Fighting Back: The war on Terrorism-From inside the Bush White House, Bill Summon.
- George W Bush delivers his first public speech after 9/11 Attack.
- The Big Bamboozle: 9/11 and the War on Terror, Philip Marshall
- Text: Presidenr Bush Addresses the Nation. The Washington Post. 20 September 2001.
- The Taliban are sitting on $1 trillion worth of minerals the world desperately needs. Julia Horowitz. CNN. 19 August 2021.
- দেশে বিদেশে, সৈয়দ মুজতবা আলী
- Ghost Wars: The Secret History of the CIA, Afghanistan and Bin Laden, from the Soviet Invasion to September 10,2001, Steve Coll, Penguin UK; 2005th edition (3 March 2005)
- আল কায়েদা থেকে আইএস, সুজন কবির, নালন্দা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫
- The Wrong Enemy: America In Afghanistan 2001 – 2014, Carlotta Gall, Penguin; Latest Edition (15 May 2014).