Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তালিবানি পুনরুত্থান এবং হরেক মৌলবাদের ‘পারিবারিক সাদৃশ্য’

সুব্রত রায়

 



প্রাবন্ধিক, যুক্তিবাদী সমিতির নেতৃস্থানীয় কর্মী

 

 

 

Subtract from the New Testament the miraculous and highly improbable, and what will be the remainder?

George Eliot

আমেরিকায় ‘নাইন-ইলেভেন’-এর নাশকতার পর জনৈক ব্যাপটিস্ট ধর্মগুরু জেরি ফলওয়েল-এর মন্তব্য অনেকের স্মরণে থাকবে। তিনি খোদ হজরত মহম্মদকেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে বসেন! ব্যাপটিস্টরা হলেন প্রোটেস্ট্যান্টদের একটি গোষ্ঠী। পৃথিবীতে কেবল ধর্মে ধর্মেই প্রভেদ নেই, একই ধর্মমতের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার ভেতরেও বিস্তর মতানৈক্য। গোঁড়া প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিকদের খ্রিস্টান বলেই মনে করে না, ইউনিটেরিয়ানদের নাস্তিক ভাবতে পছন্দ করে, আর প্রাচ্যের ধর্মগুলোকে তো অহরহ ‘শয়তানোচিত’ বলে গাল পাড়ে! সন্ত্রাস চালিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা নিশ্চয়ই কাপুরুষোচিত ও ধিক্কারযোগ্য, কিন্তু তার জন্য কয়েক হাজার বছর আগেকার কোনও চরিত্রকে দোষারোপ করারও কোনও মানে হয় না। এরকম মনোভাব জন্ম নিতে পারে একমাত্র অযৌক্তিক গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ থেকে। জেরি-র মতো লোকেদের কাছে খ্রিস্টীয় বাণী ও কাহিনিগুলি আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণীয়, নিজস্ব বিচারবুদ্ধি ও যে কোনওরকম শর্তনিরপেক্ষভাবেই সেগুলি সত্যি। আর যারা তা মানে না, তাদের জন্য ঐশ্বরিক শাস্তিভোগ নিশ্চিত। অন্যদিকে, ‘নাইন-ইলেভেন’-এর হত্যাকারীরাও প্রত্যয়ী যে, কোরান ও মহম্মদের শিক্ষাগুলি যুগনিরপেক্ষভাবে অভ্রান্ত এবং তা অবমাননা করলেও পরিণতি একই। লক্ষণীয় যে, উভয় পক্ষই ‘ভিন্ন স্বর’-এর অস্তিত্বে সহনশীল নয়, যা নিশ্চিতভাবেই আধুনিক মেজাজের বিরোধী এবং এ কারণেই পরস্পরের প্রতি যুযুধান অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে।

ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি কাহিনি ও নির্দেশকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ ও প্রয়োগ করার এই যে শপথ, বা অন্তত শপথের দাবি, এরই নাম মৌলবাদ। ‘মৌলবাদ’ শব্দটি ইদানীং নানা ক্ষেত্রে ‘গোঁড়ামি’-র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, যা একেবারেই সুপ্রযুক্ত নয়। বস্তুত, ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ধারণাটির উৎপত্তি হয়, বিংশ শতকের গোড়ায় এর মূল প্রতিপাদ্যগুলি চিত্রিত হয় এবং বিংশ শতকের শেষপাদে এসে তা প্রযুক্ত হতে শুরু করে। এককালে রাষ্ট্র পরিচালনায় চার্চ ও পুরোহিততন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব ছিল, ইউরোপে সংঘটিত নবজাগরণ যে পরিস্থিতিটাকে আমূল বদলে দেয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা টমাস জেফারসন যাকে বলেছিলেন ‘ওয়াল অব সেপারেশন’, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সেই পাকাপাকি বিচ্ছেদ ঘটে যায়। আইনকানুন, শিক্ষা, জনগণতন্ত্রের নানান সৌধগুলির সঙ্গে ধর্মের আর কোনও প্রত্যক্ষ যোগসূত্র থাকে না। অর্থাৎ সেকুলার মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি আধুনিক ধারণাগুলি যতই সমাজে পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠল, এবং সর্বব্যাপী হয়ে উঠল বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভাব, ততই সমাজজীবনে ধর্ম অপাংক্তেয় হয়ে পড়ল।[1] এক সময়ে নীতিনৈতিকতা রক্ষার জন্য ধর্মকে অপরিহার্য বলে ভাবা হত, সেকুলার মূল্যবোধ মানবতার যথার্থ অবয়ব ফুটিয়ে তুলে তাকে প্রতিস্থাপিত করতে লাগল।[2] পরিস্থিতির মোকাবিলা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্ম তখন আধুনিকতাকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করলেও, ধর্মবেত্তাদের একাংশ কিন্তু ধর্মের আসন্ন পরিণতি আঁচ করতে পারলেন। ১৯১০ সালে কয়েকজন মার্কিন ও ব্রিটিশ ধর্মবেত্তা ক্যালিফোর্নিয়ার তৈলব্যবসায়ী স্টুয়ার্ট ভ্রাতৃদ্বয়ের উদ্যোগে সামিল হয়ে গড়ে তুললেন প্রোটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসের ‘মৌল’ ভিত্তি ‘দ্য ফান্ডামেন্টালস্: আ টেস্টিমনি অব ট্রুথ’। বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও কল্পকাহিনির আধুনিক সমালোচনাকে ঝাঁঝালো আক্রমণ করে এবং বাইবেলের শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে ১২টি ক্ষুদ্র পুস্তিকায় অতীতের কাল্পনিক স্বর্গরাজ্যের এক স্বপ্ন নির্মিত হল। এভাবে মানবসংস্কৃতিতে জন্ম নিল মৌলবাদ, যার মূল ভাবাদর্শটুকু একে একে প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। অর্থাৎ আধুনিককালের ‘সমাজ-সাংস্কৃতিক দূষণ’ রোধ করার নামে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ধর্মের মরণ কামড়ই হল মৌলবাদ, যা বিংশ শতকের শেষে প্রায় গোটা পৃথিবী জুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিঘটনা হিসেবে উঠে আসে। মৌলবাদ বিষয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বিতর্কিত গবেষণা পাঁচ খণ্ডে রচিত ‘দ্য ফান্ডামেন্টালিস্ট প্রোজেক্ট’-এর লেখকদ্বয় মার্টিন এমিল মার্টি ও রবার্ট স্কট অ্যাপেলবাই যাকে বলেছিলেন ‘মিলিট্যান্ট রিজেকশন অব সেকুলার মর্ডানিটি’ বা ‘সেকুলার আধুনিকতাকে আক্রমণাত্মক প্রত্যাখ্যান’। ধর্মের এই মরিয়া শেষ কামড়টি আধুনিক পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলির দাবার বোড়ে হয়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে, তাকেই আজ আমরা সভয়ে নাম দিচ্ছি ‘মৌলবাদী উত্থান’। কাজেই, এই বিশেষ তাৎপর্যটিকে বাদ দিয়ে শব্দটির প্রয়োগ সঙ্গত নয়।

১৯৯৬ সালে যখন প্রথমবারের জন্য তালিবান বাহিনি আফগানিস্তানের দখল নেয়, তখন তারা শাসকের ভূমিকায় থাকা বিভিন্ন আফগান জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের দিকে ইসলামের নীতি থেকে বিচ্যুতির অভিযোগ তোলে এবং পাশ্চাত্য-দূষণ মুক্ত করে ‘বিশুদ্ধ ইসলামি সমাজ’ গড়ার ডাক দেয়। পশতো ভাষায় ‘তালিব’ শব্দের অর্থ হল ছাত্র। ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উত্তর ও দক্ষিণ আফগানিস্তানের পশতুন এলাকাগুলির স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্ররাই ছিল তালিবান বাহিনির মেরুদণ্ড, যাদের একাংশ ছিল পাকিস্তান থেকে আসা আফগান উদ্বাস্তু। আধুনিক শিক্ষা বঞ্চিত ও আধুনিক জীবনযাপন সম্পর্কে অজ্ঞ এই ‘তালিব’-রা ১৯৯৬ সালে জীবনে প্রথমবার কাবুলের রাস্তায় মুখ-বাহু ও হাঁটুর নীচ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অনাবৃত মেয়েদের দেখে এবং চমকে ওঠে। তালিবান শাসনে প্রাথমিকভাবে পূর্বতন সরকারের দুর্নীতি, শাসনক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, রাস্তাঘাটের দূরবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে উন্নতি ঘটলেও অচিরেই তারা ক্ষমতালিপ্সু শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নিয়মিতভাবে গণহত্যা চালানো, আধুনিক শিক্ষার দরজা বন্ধ করে দেওয়া, বিধর্মীদের উপরে আক্রমণ, জাদুঘর-পাঠাগার ধ্বংস, গানবাজনা খেলাধুলো নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি অনাচার ঘটতে থাকে। ‘দ্য কাইট রানার’ রচয়িতা আফগান ঔপন্যাসিক খালেদ হোসেইনি-র দেশেই অন্যতম জনপ্রিয় বিনোদন ঘুড়ি ওড়ানোকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে নারী স্বাধীনতার উপর। তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়, পর্দাপ্রথা কার্যকর হয়, কেবলমাত্র চিকিৎসাক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য সকল চাকরি থেকেই মেয়েদের বরখাস্ত করা হয়। নিকটাত্মীয়কে সঙ্গে না নিয়ে রাস্তায় বেরোনোও অপরাধ বলে গণ্য হয়। মাত্রাতিরিক্ত কর ও অন্যান্য প্রতিকূলতার কবলে পড়ে ধুঁকতে থাকা আফিম চাষ-নির্ভর অর্থনীতি আফগানিস্তানের মানুষকে ভয়ঙ্কর দুর্দশাগ্রস্ত করে, তা সত্ত্বেও ১৯৯৮ সালে আফগান নাগরিকদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগকে সামরিক কারণে তালিবানরা বাতিল করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে, তালিবানি মৌলবাদকে পুষ্ট করতে ক্ষুধাপীড়িত কর্মহীন অসহায় যুবকরাই ছিল ‘সাপ্লাই লাইন’।

এ বছর বাইডেন সরকার মার্কিন সেনাবহিনিকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই মধ্যবর্তী দু-দশকের (২০০১-২০২১) সাময়িক স্বস্তির অবসান ঘটতে কিছুমাত্র দেরি হয়নি, তালিবানরা দ্বিতীয়বারের জন্য আবার প্রায় গোটা দেশেই কর্তৃত্ব কায়েম করে ফেলেছে। অসংখ্য আফগান দেশত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে জায়গা নিয়েছেন, যাঁরা পারেননি নিদারুণ আতঙ্কে দিন গুজরান করছেন। ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি বাস্তব হয়ে ফিরে আসছে। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আর অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা বঞ্চিত দেশে এ ঘটনা হয়তো অবধারিতই ছিল। গোটা বিশ্বজুড়ে তালিবানদের প্রতি তীব্র নিন্দাবাক্য বর্ষিত হচ্ছে, পাশাপাশি বাইডেন সরকারও তাদের ভূমিকার জন্য সমালোচিত হচ্ছে। গোপন মিলিটারি অপারেশনে বিন লাদেন নিহত হয়েছেন, তালিবানদের যথেষ্ট কড়কে দেওয়া গেছে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত আফগান সরকার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কাজেই, মার্কিন সরকারের আর দায় নেই, ব্যয়ভার কমিয়ে মার্কিন অর্থনীতিকে বিপন্নতা থেকে বাঁচানোকেই বাইডেন সাহেব এখন আশু কর্তব্য বলে মনে করেছেন!

অনেকে ভাবেন যে, ‘নাইন-ইলেভেন’-এর ঘটনা থেকে পৃথিবীতে মৌলবাদী হিংস্রতার সূত্রপাত হয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালের দুটি নাশকতার ঘটনা তাঁরা ভুলে যান। প্রথমটি ওকলাহোমা ফেডেরাল বিল্ডিং-এ ট্রাক-বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা, যাতে ১৬৮ জন নিহত হন, ৬৮০ জন গুরুতর আঘাত পান এবং বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটা ছিল যে পার্শ্ববর্তী ২৫৮টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটিয়েছিল প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যেকার একটি গোষ্ঠী। ২০০১ সালে ‘নাইন-ইলেভেন’-এর ভয়াবহতার আগে এটিই ছিল আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নাশকতার ঘটনা। অন্যটি ঘটেছিল টোকিও শহরের টিউব রেলের ভেতরে, এবং ওই একই বছরে। বিষাক্ত নার্ভগ্যাস ‘সারিন’ ছড়িয়ে নিরীহ যাত্রীদের মেরে ফেলার এই ঘটনার পেছনে ছিল বৌদ্ধদের একটি গোষ্ঠী। পৃথিবীতে ‘অহিংসা ও শান্তির ধর্ম’ হিসেবে চিহ্নিত বৌদ্ধদের নৃশংসতা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শ্রীলঙ্কায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দাঙ্গায় হাজার হাজার অবৌদ্ধদের খতম করা, ২০১৬ সাল থেকে বার্মায় রোহিঙ্গাদের ওপরে নৃশংস অত্যাচার করে দেশ থেকে বিতাড়ন— হিংসা আর অশান্তির যাবতীয় উপাদানেই ভরপুর তাদের কর্মকাণ্ড! কাজেই, বামিয়ান বুদ্ধ-কে ধূলিসাৎ করা তালিবানি তৎপরতাকে ‘সর্বোৎকৃষ্ট মৌলবাদ’ বলে ধরে নিয়ে ঘৃণাবর্ষণ আর হা-হুতাশ করলেও সমস্যাটা যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকখানি এলাকা জুড়ে ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা চালু হওয়া, ১৯৭৯ সালে ইরানে যার সূত্রপাত ঘটে, তা মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের দিকে গোটা বিশ্বের নজর ঘুরিয়ে দেয়। এরপর একের পর এক উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। ইহুদি মৌলবাদকে ঘিরে জিইয়ে থাকা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে তুলনীয় ‘ডোম অব দ্য রক’ ও আল-আকসা মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা), ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে ভারতের পাঞ্জাবে শিখ মৌলবাদের আত্মপ্রকাশ যা দেশের প্রধানমন্ত্রী নিধন ও জাতিদাঙ্গার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়, বাংলাদেশ-পাকিস্তানে মুসলিম মৌলবাদের ব্যাপক উত্থান, ভারতে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতনভাবে মুসলিমদের ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক ‘ইসলামোফোবিয়া’ ছড়ানো ইত্যাদি ঘটনা আজকের জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। মৌলবাদের এই হরেক বহিঃপ্রকাশের কোনও কোনওটি আধুনিকতার সকল শর্তকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে ব্যর্থ হওয়ায় অপেক্ষাকৃত নরমসরম, আবার কোনও কোনওটি ‘তালিবানি’ উগ্রতায় ভরপুর, কিন্তু এদের ভেতরকার সাদৃশ্যটিকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়। এরা সকলেই ধর্মের উপরে আধুনিকতার অভিঘাতের মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বাসীকে কল্পলোকের রঙিন স্বপ্নে মশগুল করে রাখে এবং দাঁতনখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আধুনিকতার সৌধগুলির দিকে। ভিটগেনস্টাইনের দার্শনিক ভাষা ধার করে এ ধরনের সদৃশতাকে বলা যায় ‘ফ্যামিলি রেজেমব্লেন্স’ বা ‘পারিবারিক সাদৃশ্য’।[3] কোথায় কোন মৌলবাদের বহিঃপ্রকাশটা কেমন হবে তা নিতান্তই পরিস্থিতিসাপেক্ষ, তাই নরম-গরমের বিচারটা কতকটা অর্থহীন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তালিবানরা যে প্রাচীন সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখাচ্ছে, সেই স্বপ্নপূরণ কি আদৌ সম্ভব? ধর্মগ্রন্থ রচনাকালের যে সামাজিক প্রেক্ষিত, তা কি আজকেও অবিকল একই রকম? মহম্মদের সময়কার আরব বেদুইনরা তো কবেই অন্তর্হিত হয়েছে! আধুনিক খ্রিস্টানদের সঙ্গে কি গ্যালিলি সাগরের তীরবর্তী কৃষক সম্প্রদায়ের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, যেমনটি বাইবেলে লেখা আছে? ভারতীয় হিন্দুরা আজকে কি চাইলেও রামচন্দ্রের যুগে ফিরে যেতে পারবেন? হাজার হাজার বছর আগের সমাজ-সংস্কৃতির কি পুনর্নিমাণ সম্ভব? তালিবানরা গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে অর্থাৎ শাসনকার্যে সাধারণের অংশগ্রহণকে মেনে নেয় না এই যুক্তিতে যে, তারা মনে করে একমাত্র বৈধ ও সঙ্গত হল আল্লাহের শাসন। কাজেই, মানুষের হাতে তৈরি আইনকানুন-সংবিধান তাদের কাছে মূল্যহীন ও বর্জনীয়। কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতা, আধুনিক মূল্যবোধ ইত্যাদিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এরকম ঐশ্বরিক শাসনব্যবস্থা কীভাবে একবিংশ শতকের পৃথিবীতে জমি খুঁজে নেবে? সৌদি আরব হল একনিষ্ঠভাবে শরিয়তি আইনকানুন মেনে চলা একটি ইসলামি শাসনব্যবস্থার দেশ, কিন্তু তাকেও পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে অতিরিক্ত মাখামাখির কারণে বিন লাদেন অভিযুক্ত করেছিলেন। অভিযুক্ত করেছিলেন ‘মুসলিম দুনিয়া’-র দিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে উলটে দেশের মাটিতেই মার্কিন সৈন্যঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু, তৈলসম্পদে বলীয়ান একটি দেশের পক্ষে কি আধুনিক অর্থনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা সম্ভব? আর অর্থনীতির নিয়মে গড়ে ওঠা বৈদেশিক সম্পর্কের হরেক সমীকরণ কি ফুটে উঠবে না একটি রাষ্ট্রের বিদেশনীতির মধ্যে দিয়ে? কাজেই, আধুনিক সভ্যতার শর্তগুলির সঙ্গে মৌলবাদের প্রতিজ্ঞাগুলি নিতান্তই বেমানান। তালিবানরা যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, বোমাবারুদ, রকেট লঞ্চার ইত্যাদি নিয়ে আফগানিস্তান দখল করল, কোনও ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ মেনে কি ওইসব ভয়াবহ অস্ত্র বানানো সম্ভব? আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোয় আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর গবেষণার উপরে ভিত্তি করে আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে যেসব অস্ত্র নির্মিত হচ্ছে, কোনও ধর্মগ্রন্থ বা কোনও কাল্পনিক ঈশ্বরের ভরসায় না থেকে মৌলবাদীরা তা নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নিচ্ছে। তাই, একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে যে, মৌলবাদীরা নেতারা আসলে নিজেরা এবং তাদের অনুগামী— উভয়ের সঙ্গেই নিদারুণ ভণ্ডামি করে চলেছেন।

আজকে ধর্মীয় আইনকানুনকে শিরোধার্য করে কোনও দেশে শাসনব্যবস্থা প্রণীত হতে পারে, কিন্তু আধুনিকতার রং-রূপকে সম্পূর্ণ বর্জন করে তার অগ্রসর হওয়া সম্ভবই নয়। আবার, একই সঙ্গে, আধুনিকতাকে গ্রহণ করলে ধীরে ধীরে ধর্মের বিদায়ের রাস্তাও প্রশস্ত হয়ে উঠবে। ধর্মের কাছে এ এক উভয়সঙ্কট। সভ্যতার অগ্রগতির মোদ্দা গতিপথটিকে কখনও পালটানো যায় না। দেশে দেশে মৌলবাদী তৎপরতার যে ছবি ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে তাতে কেউ পৌরাণিক যুগের আগমনের আশায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেই পারেন, কিন্তু তা সভ্যতার গতিধারায় এক সাময়িক বিচলন মাত্র। এরকম ব্যতিক্রমী ঘটনা যে ঘটতে পারছে, তার কারণটা আধুনিকতার অসঙ্গতিগুলির মধ্যেই লুকোনো আছে। আধুনিক পৃথিবীতে অধিকাংশ দেশের শাসনব্যবস্থা ও আইন-কাঠামো সেকুলার হয়ে উঠলেও এখনও যে সমস্যার সমাধান হয়নি, তা হল অসাম্যের সমস্যা। আজকে সমাজব্যবস্থা টিঁকিয়ে রাখতে গেলে ডেলফির মন্দির থেকে ঐশ্বরিক নির্দেশ লাগে না, কিন্তু যারা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বা জাতির সঙ্গে জাতির অসাম্যকে টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের কায়েমি স্বার্থের কাছে ঈশ্বর নামক ধারণাটি খুবই উপযোগী। কারণ, বিভেদের বীজ ধর্মের মতো ভালো আর কেউ বুনতে পারে না! আর, তাই, কোনও কোনও আধুনিক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রও পেছনের দরজা দিয়ে মৌলবাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়, যা দিয়ে মৌলবাদ পুষ্ট হয়ে ওঠে।

এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবী জুড়েই আফগান জনসাধারণের জন্য উদ্বেগ ও তালিবানদের প্রতি বিরূপতার ছবি ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে। কোনও সন্দেহ নেই যে, তালিবানরা আফগানিস্তানে যে পরিমাণ সন্ত্রাস ও বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে ও করে চলেছে, তার তীব্র প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের আশু হস্তক্ষেপ জরুরি। কাজেই, আফগানিস্তানের পালাবদল নিয়ে আমাদের দেশের মানুষজনও যে উত্তাল হয়ে উঠবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। একেই আফগানিস্তান আমাদের প্রতিবেশী, তার ওপর উপমহাদেশের রাজনীতিতে এই পালাবদল তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ায় ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। অথচ আশ্চর্যের হল, এই দেশেই বিগত অর্ধ-দশকেরও বেশি সময় ধরে হিন্দু মৌলবাদের যে উন্মত্ততা দেখা যাচ্ছে তা তুলনারহিত। রাষ্ট্র পরিচালনা, আইনকানুন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির গৈরিকীকরণের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্বের যে আস্ফালন মুহুর্মুহু ধ্বনিত হচ্ছে তাতে পৌরাণিক কাহিনি হয়ে উঠছে ইতিহাস, ধর্মীয় ভাবাবেগ হয়ে উঠছে আইনের যুক্তি, জাতপাতের ঘৃণ্য প্রথা সোৎসাহে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করছে, ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হচ্ছে নাগরিকত্বের অধিকার, প্রাচীনত্ব ও দেশজ সংস্কৃতির দোহাই পেড়ে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে বিপত্তারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। মৌলবাদের এসব লক্ষণকে যদি চিনতে ভুল করি, যদি এখনই প্রতিবাদে মুখর না হই, তাহলে আসন্ন বিপদকে প্রতিহত করা যাবে না। কেবল তালিবানদের নিন্দা করেই আমাদের কর্তব্য যেন শেষ না হয়ে যায়। আমাদের সচেতনতাই পারে ইতিহাসের চাকাটিকে দ্রুত সঠিক রাস্তায় এনে ফেলতে, একথা আমরা যেন কখনও ভুলে না যাই। মৌলবাদ যতই আস্ফালন করুক না কেন, এ হল ধর্মের অশক্ত হয়ে যাওয়ার লক্ষণ, এ হল ইতিহাসের গতিপথে ধর্মের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার শেষ আর্তনাদ।


[1] পৃথিবীতে ধর্মবিশ্বাস যে ক্রমক্ষীয়মান তার আভাস অনেককাল ধরে পাওয়া গেলেও, বিংশ শতকের শেষদিক থেকে জনমত সমীক্ষাগুলির তথ্যে তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দ্রষ্টব্য: একুশ শতকের বিগত দুইটি দশক জুড়ে ‘পিউ ফোরাম’, ‘উইন গ্যালাপ’, ও ‘ওয়ার্ল্ড্ ভ্যালু সার্ভে’-র মত বিভিন্ন সংস্থার করা সমীক্ষাসমূহ এবং তার ভিত্তিতে সমাজবিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা। আন্তর্জালে খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
[2] বর্তমান পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষই আর নীতিনৈতিকতা বজায় রাখার জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে না। দ্রষ্টব্য: Tamir, C., Connaughton, A., Salazar, A. M. (2020): “The Global God Divide: People’s thoughts on whether belief in God is necessary to be moral vary by economic development, education and age”, Pew Research Center, July 20, 2020.
[3] তুলনাটি করেছেন ম্যালিস রুথভেন। দ্রষ্টব্য: Ruthven, M. (2007): Fundamentalism: A Very Short Introduction, Oxford: The University Press, pp. 6-7.