Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আফগানিস্তানে আমেরিকার চম্পট— দেশি শাসকের দাপট

অরিন্দম

 

 

প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি সহ মহাশক্তিধর রাষ্ট্র থেকে ভারত আর তাদের নামকরা গোয়েন্দাবাহিনি ধরতেই পারেনি তালিবানদের অগ্রগতি। আফগান সেনারা প্রকৃতপক্ষে আত্মসমর্পণ করেছে তালিবানদের কাছে। গত উনিশ বছর ধরে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমি জোটের সামরিক ছত্রছায়ায় যে আফগান সরকার চলছিল তার পতন ঘটেছে। কাবুল সহ দেশের অধিকাংশ স্থানের দখল নিয়েছে তালিবানেরা। কাবুল দখলের পরেই তারা দেশের পতাকা ও নাম বদলে দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ কাবুল ছেড়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালাচ্ছেন। এবং বিভিন্ন তালিবানবিরোধী প্রতিবাদের উপর গুলি চালিয়ে কণ্ঠরোধের চেষ্টা চলছে। আমরা জানি বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর মতান্ধ ধর্মীয় সংগঠনগুলির মধ্যে তালিবান অন্যতম। তাদের অতীত শাসনকাল আফগানিস্তানে এক বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি করেছিল। এবং তালিবান সরকার কাবুল দখলের পরে চাপের মুখে তাদের অতীতের তুলনায় কিছুটা নরম স্বরে কথা বললেও কোনও গণতান্ত্রিক আধুনিক সমাজের পক্ষে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং যে কোনও উদার গণতান্ত্রিক মানুষ ও সংগঠন তালিবানের মতাদর্শকে সমর্থন করতে পারেন না।

 

ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ও আফগান রাজনীতি

আফগানিস্তান বরাবরই ভূরাজনৈতিক-সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সঙ্গে বর্তমানে তেলের, গ্যাসের পাইপলাইনের দখলদারি, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ— এসবের গুরুত্বও কম নয়। বহু আগে আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান ছাড়াও গত দুশো বছরের আফগানিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলেই আমরা দেখতে পাব ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা বারবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই দেশ নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করেছে। লর্ড কার্জন আফগানিস্তানকে বলেছিলেন ‘ককপিট অফ এশিয়া’। ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ডের হাত থেকে আফগানিস্তান স্বাধীনতা পায়। আমানুল্লা খানের নেতৃত্বে আফগান সরকার তৈরি হয়, তারা একটা গণতান্ত্রিক সংস্কার ও আধুনিকীকরণের প্রয়াস চালায় কিন্তু ব্যর্থ হয়। তারপর গত শতাব্দীর ঊনআশি সালে সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে ঢোকার পর থেকেই ঐ দেশ আধুনিক বিশ্বের এক বৃহৎ উপনিবেশ। যদিও আফগানিস্তানে সোভিয়েত প্রভাব সত্তর দশক থেকেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর তার বিরোধী সামরিক শক্তি হিসেবে আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে গড়ে উঠছিল মুজাহিদিন, তালিবান, আলকায়দা-রা। কারণ সোভিয়েত রাশিয়ার বিরোধী শক্তি হিসেবে আরেকটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকেই সহায়তা করবে আমেরিকা তার নিজের স্বার্থ থেকেই। একদিকে সাধারণ আফগানদের সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আর পাশে রয়েছে সোভিয়েত রাশিয়াকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া তীব্রভাবে ধর্মীয় পশ্চাৎপদ হলেও সামরিকভাবে শক্তিশালী মুজাহিদিনরা (তখনও তালিবানেরা অতটা শক্তিশালী হয়নি)। শুধু তখন ইসলাম পরিচয় নয় তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাতি ও তার নেতৃত্ব। খাপছাড়া যে তথ্য পাওয়া যায়— সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা মুজাহিদিনদের পেছনে চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল আর উল্টোদিকে রাশিয়াও তাই। এই বিপুল অর্থ খরচ করা হয়েছিল উপজাতি নেতাদের ঘুষ দিয়ে কিনতে আর অস্ত্রের পিছনে। বিশ্বের অস্ত্রের কালোবাজারের অন্যতম মূল খরিদ্দার ছিল আফগান মুজাহিদিনরা। স্কুল নয় স্বাস্থ্য নয়, খালি অস্ত্র। সেইসময় একদিকে বিশ্বজুড়ে সাম্যবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলন চরম সঙ্কটের সামনে। আর আফগানিস্তানের বামপন্থীরা বেশিরভাগ সরাসরি সোভিয়েত সমর্থক হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও নষ্ট হয়ে গেছিল। ফলে ওখানকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাশ পুরো নিয়ন্ত্রণ করছিল মুজাহিদিনরা। পরবর্তীকালে ১৯৮৯-এ সোভিয়েত রাশিয়া চলে যাওয়ার পর আন্দোলনে ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আর ১৯৯৪ সাল থেকে আন্দোলনের রাশ তুলে নেয় একদিকে তালিবানরা, অন্যদিকে মাসুদের নেতৃত্বাধীন নর্দার্ন অ্যালায়েন্স।

 

স্বাধীনতা এক মায়া

রাশিয়া তার সেনাবাহিনি প্রত্যাহার করবার চার বছর পর ১৯৯২-এ পতন হয়েছিল সোভিয়েত প্রভাবাধীন নাজিবুল্লা সরকারের। ঠিক যেমন ২০২১ সালে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পর তিন মাসের মধ্যে পতন ঘটল আশরাফ গনি সরকারের। ১৯৯২ থেকে ৯৬ সাল তালিবানদের কাবুল দখলের আগে অবধি হেকমতিয়ার, দস্তুম, মাসুদ, রব্বানি প্রভৃতি বিভিন্ন যুদ্ধবাজ উপজাতি নেতাদের মধ্যে আফগানিস্তান ভাগ হয়ে গেছিল। শুধু তাই নয়, এই মুজাহিদিনরা পয়সার জন্য বিদেশি বিশেষ করে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের কাছে গাছ, টেলিফোনের তার, কারখানা যা পেয়েছে বিক্রি করে দিয়েছে। সাধারণ জনগণের বাড়ি দখল, মেয়েদের লাঞ্ছনা সব করেছে। অনেক আফগান এই অরাজকতা থেকে মুক্তি পেতে তালিবানদের স্বাগত জানিয়েছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার— তার পরের তিরিশ বছরে বামপন্থীরা কর্পূরের মতন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। তাদের কোনও আন্দোলনের খবর পাওয়া যায় না।

১৯৮৯ সালের পরের তেরো বছর বাদ দিয়ে আবার আমেরিকার নেতৃত্বে পুতুল সরকার আফগানিস্তানে চলছিল। এবং এই দুই পর্যায়েই সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে এক প্রগতিশীল সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের ছবি আমরা পেয়েছি। আজ প্রমাণিত হচ্ছে তা আসলে মিথ্যে এক মায়াজাল। এই দুই পর্যায়েই কাবুল সহ বড় বড় কয়েকটি শহরে সামরিক সুরক্ষাবলয়ে একধরনের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তার বাইরের অঞ্চলের আফগানরা চরম বঞ্চিত ও শোষিত হয়েছেন। বৃহৎ ধনী দেশগুলি এবং তাদের পুতুল সরকারের আফগানিস্তানের সার্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়নের কোনও ইচ্ছে বা উদ্দেশ্য ছিল না। খবরে প্রকাশ তালিবানেরা কাবুলে প্রবেশ করার পরেই পূর্বতন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি প্লেন ভর্তি করে গাড়ি ও সম্পদ নিয়ে পালায়। তার আগের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার একর জমি আত্মসাতের অভিযোগ আছে। শহরাঞ্চলে একটি বড় সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে। অনেকে আজকাল ঐ শহরকেন্দ্রিক নারীস্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদী সংবাদমাধ্যমের নারী সাংবাদিক বা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক শিক্ষা দেখিয়ে আমেরিকার পুতুল সরকারের প্রগতিশীলতা জাহির করতে চান। কিন্তু আসলে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রটি ভুলে যান— “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই”। জাতীয়তাবাদ আপাত প্রগতিশীলতা বিচার করে না। এখানে “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়” হচ্ছে তালিবান। সঙ্গে অবশ্যই আছে সংখ্যাগুরু পাশতুন জাতীয়তাবাদ। যার প্রতিনিধিত্ব করে তালিবানেরা। ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে আফগানিস্তান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৬৯তম (সূচক: ০.৫১১)। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ এই ত্রিশ বছরে আফগানদের মাথাপিছু জাতীয় গড় আয় কমেছে ১০ শতাংশ। যদিও গড় বিদ্যালয়ে সময় কাটানো বছরের পরিমাণ জনপ্রতি কিছুটা বেড়ে হয়েছে ৩.৯ বছর। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই পুতুল সরকারের সময় আফগান নাগরিকদের অর্থনৈতিক সামাজিক দুরবস্থা (জাতীয় গড় আয় বা জিএনআই। মনে রাখবেন এটা জিডিপি নয়) সোভিয়েত প্রভাবাধীন সময়ের চেয়েও খারাপ হয়েছে (২.৪৭৮ থেকে ২.২২৯)। আর যারা আশরাফ গনি সরকারের আমলের নারীস্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন তাদের জন্য জানাই ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী আফগানিস্তানের নারী উন্নয়ন সূচক হল ০.৩৯১ এবং গড় আয়ু ৬৬.৪ বছর, স্কুলজীবন মাত্র ৭.৭ বছর আর গড় জাতীয় আয় ০.৮১৯। ওইগুলোই ছেলেদের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ০.৫৯১, ৬৩.৪ বছর, ১২.৫ বছর এবং ৩.৫৬৬। এর তুলনায় নেপাল আর পাকিস্তানের মেয়েরা ঢের এগিয়ে। তাদের সূচক যথাক্রমে ০.৫৮১ ও ০.৪৫৬। সুতরাং গত কুড়ি বছরে এই সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন পুতুল সরকারগুলি সাধারণ আফগান জনগণের কাছে আধুনিক শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থানের কোনও সুযোগই পৌঁছে দিতে চায়নি। সাম্রাজ্যবাদীরা কখনওই তা চায় না। বরং এই কুড়ি বছরে পশ্চিমি দেশগুলি আফগানিস্তানকে চুষে লুঠের বখরা ভাগ করেছে। এমনকি ভারতও বাদ যায়নি। আমেরিকান বিভিন্ন সংস্থার সাহায্যকারী শক্তি হিসেবে পার্লামেন্ট ভবন বানানো, বাঁধ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা যার নিদর্শন। আফগান জনগণকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিয়ে সবাই মুনাফা করেছে।

ভারতের যেসব আলোকপ্রাপ্ত মানুষেরা আমেরিকার পরাজয়ে হাহুতাশ করছেন তাদের কাছে প্রশ্ন দরিদ্র শোষিত নির্যাতিত আফগান সাধারণ জনগণের কী দায় পড়েছে শহরাঞ্চলের মুষ্টিমেয় আলোকপ্রাপ্তদের বুর্জোয়া সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ার? পশ্চিমি জোটের তাবেদারি করবার?

এবার আসি তালিবান প্রসঙ্গে  

কারা কোথায় ষড়যন্ত্র করে আমেরিকার সাধের অহঙ্কারের টুইন টাওয়ার ভেঙে দিল আর তার দায় বহন করবে একটি বিশাল দেশের কয়েক কোটি নিরাপরাধ মানুষ! কারা অধিকার দিয়েছিল আমেরিকাকে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”-র ধুয়া তুলে একটি বিশাল দেশের কয়েক কোটি স্বাধীনচেতা মানুষের আত্মসম্মানকে নিলামে তুলে সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ পরাধীন দেশে পরিণত করবার এবং তাদের ওপর চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও পুতুল সরকার চাপিয়ে দেওয়ার। ভুলে গেলে চলবে না গত বিশ বছর যুদ্ধ কখনও থেমে ছিল না। তালিবানদের ওপর বোমাবর্ষণের নামে সাধারণ আফগানরা কীটপতঙ্গের মতন মরেছে। সন্ত্রাসবাদীদের গুরু আমেরিকা বা তাদের পশ্চিমি জোট যাকে আদর করে নাম দিয়েছে “কোল্যাটেরাল ড্যামেজ”। দেড় লক্ষের ওপর আফগান এই যুদ্ধে মারা গেছে। তখন বিশ্বের গণতান্ত্রিক বোধ কোথায় ছিল? এই প্রশ্ন তোলার মানে এই নয় যে তালিবানদের অত্যাচারকে সমর্থন জানানো। আসলে দুটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি লড়ছে। একটি সরাসরি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট ও সামরিক নিয়ন্ত্রণে চলা ও অন্যদিকে মূল বিদ্রোহী শক্তি হচ্ছে দেশের মাটির প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তালিবান। বিভিন্ন জাতি উপজাতি ও মুসলিম সামরিক গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল পাশতুন জনগোষ্ঠীর সুন্নি ধর্মীয় গোষ্ঠীভুক্ত তালিবান। বিদেশি লুঠেরা ও তাদের তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে তালিবানকে সমর্থন করা ছাড়া জনগণের সামনে অন্য উপায় ছিল কি? ছিল না।

পাশতুন, হাজারা, তাজিক, উজবেক, বালুচ সহ বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির বসবাস আফগানিস্তানে। এবং তারা বরাবরই স্বাধীনচেতা। তাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। হতে পারে তা আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অনুসারী নয়। কিন্তু আমেরিকার বা সোভিয়েতের ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া পছন্দমাফিক গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী বিকৃত সংস্কৃতি এক সামাজিক বিরূপতার জন্ম দিয়েছে। তারা কোনওদিনই এই সোভিয়েত ও আমেরিকার উপনিবেশ হওয়াটাকে মেনে নেয়নি। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে তালিবান ও আলকায়দার আর্থিক ও সামরিক ভিত্তি তৈরি করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আমেরিকা গত তিন দশকে মুসলিম ধর্মীয় দেশগুলির ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে চরমপন্থী সুন্নি মুসলিমদের নেতৃত্বে উঠে আসে ওসামা বিন লাদেন। ইসলামের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকাকে পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে গেরিলা কায়দায়। পূর্বতন সোভিয়েত ও বর্তমান ন্যাটো জোটের আক্রমণে অনাথ শিশুরা যারা পাকিস্তান সীমানা বরাবর গড়ে ওঠা ধর্মান্ধ চরমপন্থী সুন্নি ইসলামি মাদ্রাসাতে পড়েছে, তারা বিদেশিদের প্রতি চরম ঘৃণা নিয়ে বড় হয়েছে। এরাই তালিবানের মূল শক্তি। পিতৃতান্ত্রিক আফগান সংস্কৃতিতে মেয়েদের স্বাধীনতা এমনিতেই কম। সামন্তী চেতনাসম্পন্ন জাতি উপজাতিগুলির কাছে লুঠেরা সরকারের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা শহরাঞ্চলের ওপর থেকে চাপানো বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাধীনতার সংস্কৃতি আফগানি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ হিসেবেই দেখা দিয়েছে। তাই স্বাধীনতাপ্রিয় এক বিশাল সংখ্যক আফগান জনগণের কাছে শহরাঞ্চলের মহিলাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা সাধারণ আধুনিক শিক্ষার সুযোগের প্রশ্ন তুচ্ছ হয়ে গেছে। এসবই তালিবানদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামিক শরিয়ত আইন কার্যকর করার সুযোগ করে দিয়েছে। আফগান মহিলাদের সংগঠন আরএডবলুএ সেই ২০০১ সালে লিখছে আমেরিকান আক্রমণ ও সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি মৌলবাদী তালিবানদের এই অঞ্চলে ও বিশ্বে শক্তিশালী করে তুলছে। এবং গত কুড়ি বছর ধরে তারা আমেরিকা ও ন্যাটোর অপশাসনের অবসান চাইছে এবং দাবী করছে আমেরিকা যেন তাদের সঙ্গে মৌলবাদী ও প্রযুক্তিবিদদেরও নিয়ে যায়। তারা আরও বলছে এইসব ‘নারী অধিকার’, ‘গণতন্ত্র’, ‘দেশ গঠন’ জাতীয় বুলি আসলে আফগানিস্তানে তাদের দখল কায়েমের কর্মসূচি।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী মার্কিন সাম্রাজ্য কম্যুনিস্টদের ছাড়া এত ভয় কাউকে পায়নি। কিন্তু একটি প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ আর সন্ত্রাস দিয়ে  দিয়ে আরেকটি প্রতিক্রিয়ার সন্ত্রাস ঠেকানো যায় না। আল কায়দার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা দিশেহারা তাদের তৈরি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আইসিস বা তালিবান নিয়ে। আমেরিকার ন্যাজ গুটিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে পালানোর মধ্যে দিয়ে এটা মনে করা ভুল হবে যে তালিবানেরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে আদর্শগত আঘাত করতে চায়। ২০১৮ সালে মার্কিন অনুরোধেই তালিবান প্রধান বেরাদরকে মুক্ত করা হয়েছে। আর তালিবানের বড় বড় মাথাদের আশ্রয়স্থল গত পাঁচ-সাত বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রায়-উপনিবেশ সৌদি আরব, কাতারের রাজধানী দোহা। সুতরাং তালিবানরা রাশিয়া চিনের সহায়তা পেলেও তারা বেকায়দায় পড়া মার্কিন সরকারের সঙ্গে কথা চালিয়ে গেছে। গত তিন মাসে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত মার্কিন সেনারা কিন্তু তালিবানদের সামরিকভাবে বাধা দেয়নি। তালিবানও গনি সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই কাবুলে ঢুকতে চেয়েছিল। সুতরাং এই তালিবান কিন্তু এমনিতে প্রাক-পুঁজিবাদী মতাদর্শের ধারক হলেও তারা সাম্রাজ্যবাদের আপস করেই টিঁকে আছে। অনেকে তালিবানদের ক্ষমতা দখলকে জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলন বলেও দেখাতে চাইছেন। এ একদমই ভুল ধারণা। কারণ এর মধ্যে পাশতুন ও শিয়া আফগানদের সমর্থন থাকলেও তা সামরিক অভিযানের বাইরে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কোনও স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানেএর জন্ম দিতে পারেনি। যদিও সামরিকভাবে ক্ষমতা দখলের পর বিভিন্ন জায়গায় পুরুষদের জমায়েত দেখা গেছে। আবার বিভিন্ন তালিবানবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনও লক্ষ করা যাচ্ছে যা খুব জনপ্রিয় সমর্থনের ইঙ্গিত নয়। তালিবানেদের অতীত ও বর্তমান, যা কিনা ধর্ম, মাদক ও পাল্টা বহুজাতিক কোম্পানির তেল ও গ্যাসলাইনের দখলদারির উপর দাড়িয়ে আছে (যেমন ‘আনকোল’ আমেরিকান বহুজাতিক হলে ‘ব্রিদাস’ নির্ভর করে তালিবান সহায়তার উপর), তা আফগান জনগণকে কোনওরকম আর্থিক স্বাধীনতা বা সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের স্বপ্ন দেখাতে পারে না। যত দিন যাবে এই আপসের মাত্রা আরও স্পষ্ট হবে।

 

বামপন্থাভারতউপসংহার

সোভিয়েতের পতনের আগে থেকেই সারা বিশ্বে বামপন্থীরা কোণঠাসা হচ্ছিল। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যে ক্রুশ্চেভি লাইন তা সচেতন শ্রমিকশ্রেণি-নেতৃত্বকে ক্রমশ কোণঠাসা করেছে। বারবাক কারমাল বা নাজীবঊল্লাহর মতন বিশ্বাসঘাতকরা ছিল আফগানদের সামনে বাম মুখ। ১৯২০ সালে কমিউনিস্ট ৩য় আন্তর্জাতিকের জাতীয় ও ঔপনিবেশিক সমস্যা সম্পর্কে থিসিসের খসড়ায় প্যান-ইসলামিক আন্দোলন সম্পর্কে লেনিন লিখছেন— প্যান-ইসলামবাদ এবং অনুরূপ যে সব ঝোঁক ইউরোপীয় ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনকে জড়াতে চায় খাঁ, জমিদার, মোল্লা প্রভৃতিদের প্রতিষ্ঠা শক্তিশালী করার প্রচেষ্টার সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা। পরবর্তীকালে এই প্রশ্নে ১৯ জুলাই ১৯২০-তে সাধারণ নীতি হিসেবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়— আমরা উপনিবেশের বুর্জোয়া মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করব, এবং তা করা উচিত কেবল সেই ক্ষেত্রে যখন এগুলি প্রকৃত বিপ্লবী আন্দোলন, যখন কৃষক সম্প্রদায় ও ব্যপক শোষিত জনগণকে বিপ্লবী প্রেরণায় শিক্ষিত ও সংগঠিত করার যে কাজ আমাদের, তাতে ঐ আন্দোলনের প্রবক্তারা বাধা না দেয়। তালিবানদের ক্ষেত্রে কোনটা প্রযোজ্য? একটিও নয়। তাহলে তালিবান, যারা সব অর্থেই প্রগতিশীলতার বিরোধী, তারা আফগান জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা হতে পারে? কখনওই নয়। পশ্চাৎপদ চেতনার সুযোগ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সবসময় নেয়। তালিবানও তাই করবে। তবে আশার কথা তালিবানদের বিরুদ্ধে সেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণআন্দোলনের খবর আসছে। তালিবানরাও অতীতের চরমপন্থী ইসলামি মৌলবাদ অনুশীলন করবার সাহস পাচ্ছে না।

ভারতীয় বামদের সমস্যা এই যে তারা দেশের শাসক বুর্জোয়াশক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশের মুক্তি আন্দোলনকে বিচার করে। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন সিপিআই(এম-এল) যে বিরোধিতা করেছিল তার অন্যতম কারণ ছিল মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধির সমর্থন। ঠিক একইভাবে বামপন্থীদের একটি বড় অংশ তালিবানদের আফগান জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা বানিয়ে দিতে চাইছে কারণ হিন্দু মৌলবাদী আরএসএস-বিজেপির প্রতি তাদের মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে। তারা আফগানিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রতিক্রিয়াশীল জাতিবাদ ও মৌলবাদকে দেখতে চাইছে না। আবার ভারতের শাসক গোষ্ঠীও এখন হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে পরিচালিত। মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলির যে কোনও রাজনৈতিক স্বাধীনতা তাদের বিচলিত করে তোলে। আর এখন তালিবান রণহুঙ্কারের সামনে তাদের গুরু আমেরিকার পিছু হঠা দেখে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে তাদের বিদেশনীতি অথৈ জলে। তারা কাদের ওপর ভরসা করবে ঠিক করতে পারছে না।

আফগানিস্তানের জনগণকেই ঠিক করতে হবে বিদেশি শক্তিকে হঠানোর পর প্রতিক্রিয়াশীল তালিবানদের এই চাপিয়ে দেওয়া ইসলামিক সংস্কৃতি বিরুদ্ধে তারা লড়াই গড়ে তুলবে কি না। একজন ভারতীয় মানুষ হিসেবে আফগানদের এই অবশ্যম্ভাবী মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আমার সমর্থন রইল…

 

তথ্যসূত্র

  1. তালিবান-  আহমেদ রসিদ, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস
  2. http://hdr.undp.org/sites/default/files/Country-Profiles/AFG.pd
  3. ৩য় আন্তর্জাতিকের ১৯২০ সালের জাতীয় আন্দোলন ও উপনিবেশ সংক্রান্ত সমস্যার খসড়া ও গৃহীত দলিল
  4. http://www.rawa.org/rawa/2021/08/21/rawa-responds-to-the-taliban-takeover.html