কুন্তল রুদ্র
কবি, প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিকার; প্রাক্তন অধ্যাপক
ভাদ্রমাসে ভাদুর গানেও ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বভারতীর যন্ত্রণার কাহিনি। আমাদের শিরোনামটি সেই গানের একটি লাইন। পাঁচিল আর পাহারায় ঘেরা বিশ্বভারতী ‘ভূতের ওঝা’র মারে অতিষ্ঠ এখন। গত ২৩ আগস্ট তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে বিদ্যাভবনের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র সোমনাথ সৌ ও ফাল্গুনী পান এবং সঙ্গীতভবনের ছাত্রী রূপা চক্রবর্তীকে। শিক্ষাক্ষেত্রে ‘ভূতের ওঝা’র মারের কথাটা বলেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতীর তখনও জন্ম হয়নি। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক এডমন্ড ফার্লে ওটেনের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে কয়েকজন ছাত্র তাঁকে লাঞ্ছিত করেন। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিশন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে সুভাষচন্দ্র বসু, আনন্দমোহন দাস এবং সতীশচন্দ্র দে, এই তিন ছাত্রকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাদের কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ নামক ঐতিহাসিক প্রবন্ধে লেখেন:
জেলখানার কয়েদি নিয়মের নড়চড় করিলে তাকে কড়া শাসন করিতে কারও বাধে না; কেননা তাকে অপরাধী বলিয়াই দেখা হয়, মানুষ বলিয়া নয়। …. কিন্তু ছাত্রদিগকে জেলের কয়েদি বা ফৌজের সিপাই বলিয়া আমরা তো মনে ভাবিতে পারি না। আমরা জানি, তাহাদিগকে মানুষ করিয়া তুলিতে হইবে। মানুষের প্রকৃতি সূক্ষ্ম এবং সজীব তন্তুজালে বড়ো বিচিত্র করিয়া গড়া। এইজন্যই মানুষের মাথা ধরিলে মাথায় মুগুর মারিয়া সেটা সারানো যায় না; অনেক দিক বাঁচাইয়া প্রকৃতির সাধ্যসাধনা করিয়া তার চিকিৎসা করিতে হয়।
যারা সব ব্যাধির ক্ষেত্রে ‘ভূতে পাওয়া’কেই একমাত্র কারণ ধরে নিয়ে মেরে ধরে, গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে ভূত তাড়ানোর নামে আসলে ছাত্রছাত্রীদেরই মারটা দেয়, তাদের ভূমিকা সম্পর্কে প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করেছিলেন তার গভীরতা ও প্রসার আজ আবার নতুন করে ধরা দিচ্ছে। ঠিক কী ছিল সেই মন্তব্য? আসুন, একবার দেখে নিই:
…যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া তাদের কোনওমতেই উচিত হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া। ছাত্রদের ভার তাঁরাই লইবার অধিকারী যাঁরা নিজের চেয়ে বয়সে অল্প, জ্ঞানে অপ্রবীণ ও ক্ষমতায় দুর্বলকেও সহজেই শ্রদ্ধা করিতে পারেন; যাঁরা জানেন, শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা; যাঁরা ছাত্রকেও মিত্র বলিয়া গ্রহণ করিতে কুণ্ঠিত হন না।
সেদিনের প্রেসিডেন্সির মত আজকের বিশ্বভারতীতেও ভূতের ওঝার রাজত্ব রীতিমত জাঁকিয়ে বসেছে। ওঝা এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা উল্লিখিত তিন ছাত্রছাত্রীর জীবনকে চরমতম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছেন। বহিষ্কৃত ছাত্র দুজনের বাড়ি বীরভূমের গ্রামাঞ্চলে, এবং ছাত্রীটির বাড়ি বাঁকুড়া জেলার শালতোড়া থানার এক গ্রামে। এরা অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অনেক আশা নিয়ে পরিবারগুলি লেখাপড়ার জন্য তাদের বিশ্বভারতীতে পাঠিয়েছিলেন। কী অপরাধ এই বহিষ্কৃত ছাত্রছাত্রীদের? তাদের শিক্ষার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীন উদাসীনতা, অন্যান্য আবশ্যিক প্রয়োজনগুলির প্রতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা্মূলক মনোভাব, চরম দুর্ব্যবহার, তাদেরই সামনে তাদের সম্মানীয় শিক্ষকদের প্রকাশ্যে অপমান, সমস্ত রকমের প্রচলিত নিয়মনীতি ধ্বংস করে স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, বিশেষ দলীয় প্রচারের জন্য নিজের পদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো ও অর্থের অপব্যবহার, বাইরের গুণ্ডাদের ডেকে এনে ছাত্রদের উপর হামলাবাজি সংগঠিত করা, সুদীর্ঘ ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসব-অনুষ্ঠানগুলিকে মূর্খের মত বিকৃত করা, পদে পদে সকলকে ভয় দেখানো, মতপ্রকাশের ও দাবি জানানোর গণতান্ত্রিক পরিসরকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অরাজকতার কেন্দ্রে পরিণত করায় বর্তমান উপাচার্যের যে নিন্দনীয়, আপত্তিকর, হিংস্র ভূমিকা, তার বিরুদ্ধে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এই তিনজনও ভয়হীন চিত্তে প্রতিবাদী হয়েছেন।
সভ্যসমাজে সিরিয়াস কোনও অভিযোগে কাউকে শাস্তিপ্রদানেরও বহুল প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত কিছু পদ্ধতি-প্রক্রিয়া আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করতে হয় এবং নির্দিষ্ট অভিযোগ চার্জশিটের আকারে তাকে পাঠিয়ে তার উত্তর আহ্বান করতে হয়। লক্ষণীয়, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে এই সকল পদ্ধতির কোনও ধার ধারেননি। আইনসম্মতভাবে তদন্তের ক্ষেত্রে শো-কজ নোটিস এবং নির্দিষ্ট চার্জশিট যে আবশ্যিক, লিখিতভাবে সে-কথা অভিযুক্তরা কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো সত্ত্বেও তাদের কোনও শো-কজ নোটিস বা চার্জশিট দেওয়া হয়নি। যেমনতেমনভাবে তাঁরা একটি চিঠিতে অভিযোগ উত্থাপন করে অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে তদন্ত শুরুর আগেই কোনওরকম প্রমাণ ছাড়াই পূর্বসিদ্ধান্তের মত তার সঙ্গে একটি মন্তব্যও জুড়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবত প্রাথমিক অভিযোগটিকে শক্তিশালী করার জন্যই এটি করা হয়েছিল। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ওই তিন ছাত্রছাত্রী অর্থনীতি বিভাগের কোনও একটি ঘরে নাকি তালা ভেঙেছেন! আর, সঙ্গের মন্তব্যটি হল, সেই তালা ভাঙার সঙ্গে উল্লিখিত বিভাগে অপর একটি অনুসন্ধানের যোগ থাকলেও থাকতে পারে। যেভাবে তালা-ভাঙার গল্পটিকে পরবর্তীকালে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তাতে বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সঙ্গতভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি করতে যেভাবে ঘোর অপরাধের মত করে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, তাঁরা কোথায় তালা ভাঙলেন, কোন্ ঘরে? নাঃ, উপাচার্য এবং তাঁর বশম্বদ পার্ষদরা গল্পটা এখনও সম্পূর্ণ সাজিয়ে উঠতে পারেননি। সেই অসম্পূর্ণ গল্পের ভিত্তিতেই মাথা কাটা হয়ে গেল তিনটি উজ্জ্বল ছেলেমেয়ের।
প্রশ্ন কিন্তু ফুরোয়নি, শান্তিনিকেতনের বর্ষণসিক্ত হাওয়ায় প্রশ্নগুলো বরং আরও ভারী হয়ে উঠছে। সেইসব প্রশ্নগুলি অনেকটা এইরকমের— ১) কোন্ ঘরের তালা ভাঙা হয়েছিল? কবে? কখন? ২) কেউ কি সাজাপ্রাপ্ত তিন ছাত্রছাত্রীকে তালা ভাঙতে দেখেছিলেন? কে তিনি? তিনি কি অর্থনীতি বিভাগের কেউ, অথবা কোনও নিরাপত্তাকর্মী? ৩) তিনি কি ঘটনার অব্যবহিত পরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ করেন, নাকি পরে উচ্চপর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি করে এবং ভয় দেখিয়ে তাঁকে অভিযোগ করতে বাধ্য করা হয়? ৪) সে ঘটনা কি লিখিত অভিযোগের আকারে বিশ্বভারতীর ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড বিভাগ এবং শান্তিনিকেতন পুলিশ থানায় নথিভুক্ত হয়েছিল? ৫) অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল, যিনি বেআইনি নিয়োগের দায়ে একই বিশ্বভারতী প্রশাসন কর্তৃক চার্জশিটপ্রাপ্ত, সেই অভিযুক্ত অধ্যাপক কী করে এমন এক তদন্তের কো-অর্ডিনেটর হতে পারেন? তবে কি তথাকথিত এই তদন্তে অভিযুক্ত তিন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে উপাচার্যের চাহিদামত ভূমিকা পালন করলে তিনি নিজের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন, এমন কোনও বোঝাপড়া রয়েছে এর পিছনে? ৬) তদন্ত কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের প্রাক্তন ডিএসপি শ্রী সলিল ভট্টাচার্যকে এক্সটার্নাল মেম্বার মনোনীত করা হয়। বিশেষভাবে ঐ ব্যক্তিকেই বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী? ৭) বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকারীরা না-হয় উপাচার্যের তাসের দেশের নিয়মের অধীন হরতন-চিরিতন-রুইতন, তাই তাঁরা নিজেরা কিছু দেখেন-শোনেন-বোঝেন না, প্রশ্নহীনভাবে কর্তার ইচ্ছাকে ‘নিয়ম’ বলে কর্ম-অকর্ম-কুকর্ম সবই করেন; কিন্তু প্রাক্তন পুলিশকর্তা কি জানেন না অপরাধের তদন্তে ঘটনাস্থল নির্দিষ্ট করা একান্ত জরুরি? ‘Chember of a particular faculty member’— কোন্ ঘর পুলিশমশাই? অভিযোগে তার কোনও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই কেন? ‘আসামী তুমি কোনও একটি বিশেষ বাড়িতে চুরি করেছ’ কিংবা ‘তুমি কোনও একজন বিশেষ লোককে খুন করেছ’— এমন কোনও অভিযোগ, শাস্তিযোগ্য দূর অস্ত, আদৌ কি বিচারযোগ্য? ৮) অভিযোগ জোরদার করতে উপাচার্যের নির্দেশে বিশ্বভারতীর অর্থনীতি বিভাগের প্রধানও একটি তদন্ত করেছিলেন। সেই তদন্তে ওই বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সাক্ষ্যদানের জন্য প্রকাশ্য আহ্বান জানিয়ে নোটিস দেওয়া হয়। বিভাগে এত বড় ‘অরাজক’ ঘটনায় একজন ছাত্রছাত্রীও সেখানে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। সেটা কী প্রমাণ করে? তবে কি ওই বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা উপাচার্যের তাসের দেশের হরতন-রুইতন-চিরিতন নন? ৯) বিদ্যাভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, অধ্যাপিকা আশা মুখার্জি, যিনি বিগত তিন বৎসর অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে উপাচার্যের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে একটির পর একটি আপত্তিকর ও নিয়মবিরোধী কাজ করে গেছেন, যাঁর বিরুদ্ধে মারাত্মক ফৌজদারি অভিযোগের ভিত্তিতে বোলপুর আদালতে পুলিশ মামলা করেছে এবং বর্তমানে সে মামলা চলছে, তেমন একজন ব্যক্তিকে তদন্ত কমিটির সদস্য করার উদ্দেশ্য কী? উপাচার্যের নিদানে কি আসামীও তবে বিচারক? তাছাড়া, তিনি তো বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এই কমিটির সদস্য হন কী করে? হলে তো তাঁকেও পূর্বোক্ত প্রাক্তন পুলিশকর্তার মতই এক্সটার্নাল মেম্বার হতে হয়, কমিটির সদস্যতালিকায় তেমন কোনও উল্লেখ নেই কেন? ১০) যে-কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি কমিটির, সেই কমিটিকে সম্পূর্ণ অকেজো করে রেখে উপাচার্যের বশম্বদদের নিয়ে গড়া একটি কমিটি দিয়ে সেই কাজ করানোর কি কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল? ১১) বিচারের আগেই শাস্তি যে চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল তা বোঝা যায় ১৫ মার্চ উপাচার্যের এক ঘোষণায়। ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মিটিং-এ উপাচার্য সগর্বে ঘোষণা করেন, আপাতত ওই ছাত্রছাত্রীদের সাসপেন্ড করা হলেও তিনি তাদের বহিষ্কার করেই ছাড়বেন। এর পরেও এই তথাকথিত তদন্তের আর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা অবশিষ্ট থাকে কি?
প্রবল স্বৈরাচারী ও প্রতিশোধপরায়ণ উপাচার্য ফ্যাকাল্টি মিটিং-এ তাঁর ঐ ঘোষণার মাধ্যমে তদন্ত কমিটির তিনজন ইন্টারনাল সদস্যকে তাঁদের করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন। সে বার্তা হল— যেনতেনপ্রকারেণ অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে বিশ্বভারতী থেকে বহিষ্কার করতেই হবে। এ সেই ‘ভূতের ওঝার’ মার, ১৯১৬ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনে প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষচন্দ্র বসুদের বিতারণের ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ যার আধখানা দেখেছিলেন। সেটিই ২০২১ সালের বিশ্বভারতীতে ফিরে এল পূর্ণরূপে। প্রেসিডেন্সির সেই তদন্তে মিথ্যাচার বা চক্রান্তের কোনও অভিযোগ অন্তত কেউ করেননি। বিশ্বভারতীর এই তথাকথিত তদন্ত সম্পর্কে সেই অভিযোগই অত্যন্ত জোরালোভাবে উঠে এসেছে। লক্ষণীয়, তদন্ত কমিটির ফাইন্ডিংস্-এ কিন্তু মূল অভিযোগ তালা ভাঙার কোনও উল্লেখই নেই। সেখানে বলা হয়েছে ভ্যান্ডালিজমের অর্থাৎ বিশৃঙ্খলার কথা। অভিযোগের সত্যতা যে বহিষ্কারের মত শাস্তির পক্ষে যথেষ্ট জোরালো নয়, তা বুঝতে পেরে অর্থনীতি বিভাগের সঙ্গে ছাতিমতলার ‘বিশৃঙ্খলা’কেও ফাইন্ডিংস-এ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রমাণ হিসাবে দুটি ঘটনাস্থলেরই ভিডিও এবং ফোটোগ্রাফের কথা বলা হয়েছে। চক্রান্তকারীও কখনও কখনও নিজেই নিজের জালে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমান উপাচার্য বিশ্বভারতীতে এসে সর্বত্র সিসিটিভি এবং গোপন ক্যামেরা লাগিয়েছেন। উল্লিখিত ভিডিও ও ফটো সেই সূত্র থেকেই পাওয়া। সেই সব ছবিতে ঠিক কী ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে দেখা গেছে ওই তিন বহিষ্কৃত ছাত্রছাত্রীকে? তাঁরা কি কাউকে মারধোর করেছেন? কোনও কিছু ভাঙচুর করেছেন? গালিগালাজ করেছেন? তেমন নির্দিষ্ট কোনও উল্লেখ নেই। তেমন কিছু করলে তা যে আবশ্যিকভাবেই উল্লিখিত হত সে সম্পর্কে সংশয়ের কোনও কারণ নেই। ছাত্র আন্দোলনে যেমন ঘটে তেমনই কিছু ঘটনা— উত্তেজনা, স্লোগান, ঘেরাও-এর চেষ্টা। এমন আন্দোলন কোথায় ঘটে না? একে যদি কেউ বিশৃঙ্খলা বলেনও, তার জন্য তিন-তিনজন ছাত্রছাত্রীকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করে তাদের জীবনের সর্বনাশ করা হবে? এর নাম কি শৃঙ্খলা? রবীন্দ্রনাথ কবি মানুষ, ভূতের ওঝার অন্ধিসন্ধি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত অবগত ছিলেন না। তাই কেবল তাদের প্রত্যক্ষগোচর মারের কথাটাই বলেছিলেন। ভূত ছাড়ানোর আগে ভূত লাগানোর চক্রান্ত ও সর্বনাশা কেরামতির কথা তাঁর জানা ছিল না।
প্রকৃত ঘটনা আসলে কী? বর্তমান উপাচার্য যে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বভারতীতে মাঝেমধ্যেই আন্দোলনে নামেন সেটি সংবাদমাধ্যমে বহুল প্রচারিত। অর্থনীতি বিভাগে ওই যে তথাকথিত বিশৃঙ্খলার ঘটনাটি ৯/১/২১ তারিখের বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেইদিন সকালে উপাচার্য রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে শান্তিনিকেতন ছাতিমতলায় অবস্থানে বসেছিলেন। দাবি, শান্তিনিকেতন মন্দির ও ছাতিমতলার পার্শ্ববর্তী সড়কটি বিশ্বভারতীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ওই রাস্তাটি এলাকার মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না-করে একতরফাভাবে যখন-তখন বিনা নোটিসে বিশ্বভারতী বার বার বন্ধ করে দেওয়ায় এলাকার মানুষ প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে সুরাহা চেয়েছিলেন। কোনও সাড়া না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন জানান এবং তাঁদের সমস্যার সত্যতা বুঝে ওই রাস্তাটি রাজ্য সরকার নিজেদের দায়িত্বে নেয়। এলাকার জনগণ এবং রাজ্য সরকার বিরোধী উপাচার্যের তথাকথিত আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে স্কুলস্তরের কিছু ছাত্রছাত্রী এবং কিছু অধ্যাপক-কর্মীকে সামিল করা হয়। বিশ্বভারতীর ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। উপাচার্য বিধিসম্মতভাবে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমস্যা নিয়ে আলোচনা না-করে আন্দোলনে নামছেন এবং মিডিয়া প্রচারের উদ্দেশ্যে সেই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলা হচ্ছে উপাসনাস্থল ছাতিমতলাকে, আর তাঁর পক্ষ সমর্থন করে বিজেপি দলের যুব শাখা ছাতিমতলার চারিদিকে পোস্টার টাঙিয়ে দিয়েছে। তার আগে বেশ কয়েকমাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও গবেষকরা তাঁদের নানা সমস্যার বিহিত চাইতে উপাচার্যকে খুঁজছিলেন আর তিনি প্রাইভেট সিকিউরিটির পাহারায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। ওইদিন উপাচার্যকে ছাতিমতলায় পাওয়া যাচ্ছে খবর পেয়ে দলে দলে ছাত্রছাত্রীরা সেখানে উপস্থিত হন এবং উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে চান। ছাতিমতলার মত পবিত্র উপাসনাস্থলকে উপাচার্য স্বয়ং তাঁর আন্দোলন-নাটকের জায়গা করে তুলে বিশ্বভারতীর পবিত্র ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছেন দেখে তাঁরা তার প্রতিবাদও করেন। কিছু উত্তেজক পরিস্থিতি যে তৈরি হয় তার কারণ উপাচার্যের নিজের এবং তাঁর প্রাইভেট সিকিউরিটি বাহিনির আচরণ। সিকিউরিটির লোকেরা উপাচার্যের নির্দেশে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উপর চড়াও হয়, তাঁদের গায়ে হাত দেয়, বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা উত্তেজিত হন। আসলে তাঁদের উত্তেজিত করা হয়, যাতে তাঁরা সেই উত্তেজনার বশে ভাঙচুর জাতীয় কিছু করে বসেন। কিন্তু তেমন আচরণ তাঁরা করেননি, উত্তেজিত হলেও তাঁরা সীমানা ছাড়াননি। সেই কারণেই উপাচার্য সেখান থেকে চলে যেতে পেরেছিলেন, অন্যথায় তিনি সেখানেই আটকে যেতেন। ফাইন্ডিংস-এ সাজাপ্রাপ্ত তিনজনের যে নেতৃত্বমূলক ভূমিকার কথা বলা হয়েছে সেকথা তাঁরাও স্বীকার করছেন। সুতরাং ফটোতে বা ভিডিওতে তাঁদের তেমন ভূমিকায় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তবে সেদিনের ছাত্র-আন্দোলনের ফলে উপাচার্যের পূর্বনির্ধারিত স্ক্রিপ্ট চটকে যায়। স্বভাবে যিনি ‘ভূতের ওঝা’ তিনি যে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধের ছক কষতে শুরু করবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেই ছকেই অর্থনীতি বিভাগে তালা ভাঙার ঘটনা সাজানো হয়। আর সোমনাথ ফাল্গুনী এবং রূপা যেহেতু সাম্প্রতিককালে বিশ্বভারতীর ছাত্র আন্দোলনের মুখ, উপাচার্যের নানবিধ অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, তাই ছলে-বলে-কুকৌশলে তাঁদের তাড়ানোর আয়োজন সম্পূর্ণ করে তোলা হয়।
এর জন্য একজন উপাচার্যের পদমর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠানের গরিমাকে পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়ে পাড়ার মস্তানের মত অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকদের চাপ সৃষ্টি করতে এবং ভয় দেখাতেও তিনি পিছপা হননি। ১৩ জানুয়ারি ওই বিভাগে গিয়ে অধ্যাপক ও কর্মীদের প্রায় সাত ঘন্টা একটি ঘরে আটকে রেখে অভিযুক্ত তিন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা বয়ান দিতে তাঁদের বাধ্য করেন। তাঁর প্রশাসনে পাঁচিল ঘেরা বিশ্বভারতীর ভিতরে কী ঘটছে বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। প্রাইভেট সিকিউরিটির পাহারায় অধ্যাপক-কর্মীরাও সেখানে বন্দি হয়ে থাকেন। এইসকল চক্রান্তমূলক প্রয়াসের পরেও তালা ভাঙার মূল অভিযোগ প্রমাণ হয়নি বলেই তদন্ত কমিটির ফাইন্ডিংস-এ তার কোনও উল্লেখই নেই। অথচ, বহিষ্কারের যে নোটিস ওই তিন ছাত্রছাত্রীকে দেওয়া হয়েছে সেখানে লেখা হয়েছে— ‘তোমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছিল সেই অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ লিখিতভাবে এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার করে, উপাচার্য এবং বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নিজেদের শয়তানিকে নিজেরাই উন্মোচিত করেছেন।
কথাটা রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্রের যুগেও উঠেছিল, বাতাসে কান পাতলে আজও তার কিছু অনুরণন শোনা যায়। তবে কি ছাত্ররা যা-খুশি-তাই করবে, আর সেটাই মেনে নিতে হবে? উত্তরটা রবীন্দ্রনাথের থেকেই শোনা যাক:
আমার কথা এই, ছেলেরা যা খুশি তাই কখনোই করিবে না। তারা ঠিক পথেই চলিবে, যদি তাহাদের সঙ্গে ঠিকমত ব্যবহার করা হয়। যদি তাহাদিগকে অপমান কর, তাহাদের জাতি বা ধর্ম বা আচারকে গালি দাও, যদি দেখে তাহাদের পক্ষে সুবিচার পাইবার আশা নাই, যদি অনুভব করে যোগ্যতাসত্ত্বেও তাহাদের স্বদেশীয় অধ্যাপকেরা অযোগ্যের কাছে মাথা হেঁট করিতে বাধ্য, তবে ক্ষণে ক্ষণে তারা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করিবেই; যদি না করে তবে আমরা সেটাকে লজ্জা এবং দুঃখের বিষয় বলিয়া মনে করিব।
অধ্যাপকের বিশেষণবাচক ওই ‘স্বদেশীয়’ শব্দটি বাদ দিলে উদ্ধৃত অংশটিতে উদ্বেগের যে অপ্রিয় কারণগুলি উল্লিখিত হয়েছে তার প্রত্যেকটি আজকের বিশ্বভারতীতে বিপুল প্রাবল্যে বিরাজমান। তাই ক্ষোভ এখানে অনিবার্য হয়ে উঠেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। সাসপেনশন চলাকালে পূর্বোক্ত তিন ছাত্রছাত্রী এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে তাদের অন্যায় সাসপেনশন প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা বিশ্বভারতীর আচার্য নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লেখেন এবং সেই চিঠির অনুলিপি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ও ইউজিসি-র চেয়ারম্যানের কাছে পাঠান। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই মর্মে আবেদন জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অবশ্য কোনও সাড়া মেলেনি। তবে ইউজিসি-র পক্ষ থেকে ২৩ জুলাই বিশ্বভারতীর রেজিস্ট্রারকে মেল করে ছাত্রদের দাবির ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু উপাচার্য বা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সাসপেনশন প্রত্যাহার দূরের কথা, তিনজনকেই তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করেছেন। প্রশ্ন হল, উপাচার্যের এই আচরণ কি কেবলমাত্র তাঁর নিয়োগকারী রাজনৈতিক শক্তিকে খুশি করার লক্ষ্যে চালিত? এই বিষয়ে অবশ্য জোরালো দ্বিতীয় মতও রয়েছে। কয়েক বৎসর আগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালীন এই একই ব্যক্তি মহিলাদের সম্মানহানি ও তাঁদের প্রতি আপত্তিকর আচরণ করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অপসারিত করে। অনেকের বক্তব্য হল, সেই জ্বালা মেটাতেই তিনি উপাচার্যের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্বভারতীর ছাত্র কর্মী অধ্যাপকদের প্রতি চূড়ান্ত অন্যায় চালিয়ে যাচ্ছেন, বিশ্বভারতীকে ধ্বংসের পথে প্রতিদিন ঠেলে দিয়ে তাঁর স্যাডিস্ট বিকারের পরিচয় দিচ্ছেন।
ছাত্ররা সমাজের প্রাণশক্তির প্রতীক। আজকের বিশ্বভারতীতে ওরা লোহালক্করে চাপা পড়া সেই রক্তকরবীর গাছটি। সমস্ত প্রতিকূলতা ফুঁড়ে তারা বেরিয়ে আসবেই। ভূতের ওঝা মানব-মনস্তত্ব বোঝেন না। এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিতে খোঁচা দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিত বরং ইতিহাস পড়ুন— দেশে দেশে স্বৈরাচারীদের পতনের ইতিহাস। বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, কর্মী, পেনশনার, প্রাক্তনী, বোলপুর-শান্তিনিকেতনের আপামর মানুষ, এমনকি শান্তিনিকেতনের ঘরবাড়ি, পরিবেশ, গাছপালা, পথঘাট, মাঠ, আলো-হাওয়া-আকাশ পর্যন্ত এই বিকৃতমনস্ক স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে পরিত্রাণ চাইছে প্রতিদিন। সেই পরিত্রাণেরই বার্তা লেখা আছে উল্লিখিত তিন ছাত্রছাত্রীর বহিষ্কারের বিজ্ঞপ্তিতে। ভাদুর গানে গানে সেই বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে বীরভূমের গ্রাম-গ্রামান্তরে:
গুরুদেবের শিক্ষার আলো
সবাইকে তো সুযোগ দিল
এখন ছাত্রজীবন তাদের হল হরণ
ভাদু শান্তিনিকেতন
ভাদুর শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, ছাত্র-শিক্ষক-কর্মী-প্রাক্তনী-আশ্রমিকদের শান্তিনিকেতন, সারা দেশের মানুষের শান্তিনিকেতন প্রতীক্ষা করছে, কবে সর্বনাশা ভূতের ওঝার হাত থেকে পরিত্রাণ মিলবে। এই মুহূর্তে আন্দোলনে উত্তাল শান্তিনিকেতনের দিন-রাত, পথ-প্রান্তর, আকাশ-বাতাস। বাকিটুকু কেবল সময়ের অপেক্ষা।