পুলক রায় চৌধুরী
শিক্ষক, লেখক, সমাজকর্মী
গভীর অসুখ যেন। ফুটে বেরোচ্ছে সমস্ত লক্ষণ। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা-প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষকসমাজ— কোনওকিছুই বাদ নেই!
স্থায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। হুঁশ নেই। আক্ষেপজনিত জনরোল নেই। অন্ধদের রাজ্যে এ যেন ফিরি হওয়া খানকতক চটকদার আয়না। উপর উপর ব্যালট-মুখী কিছু প্রকল্প। ‘হাতের বাইরে যাওয়া’ শিক্ষক-বিক্ষোভ পরিস্থিতিতে মন্ত্রীমশাইয়ের কিছু ‘রেটরিক’ আশ্বাস। আর শিক্ষক আন্দোলনের উপর বারবার নেমে আসা লাঠি-জলকামানের চাইতেও ভয়ঙ্কর, শাসকের ‘অশ্লীল’ আঘাত!
সমাজে শৈশবের সুরক্ষাকারী (একদা ‘সমাজ তৈরির কারিগর’!) শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পার্টি-ক্যাডার হিসাবে দেগে দিয়ে, পড়ুয়াদের নানা স্কিমের টার্গেট বেনিফিসিয়ারি বানিয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে আজ ধুলোর পাহাড়-ই জমছে।
শিক্ষার প্রকৃত দাবীগুলি, হাজার হাজার পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষাসহায়িকাদের আর্থিক সুরক্ষার দাবীগুলি চাপা পড়ে যাচ্ছে জনকল্যাণের বগবগিয়ে ধোঁয়া-ওঠা ইঞ্জিনের নিচে। চাপা পড়ে যাচ্ছে পড়ুয়া, শিক্ষক, ভবিষ্যৎ!
মুখ খুললেই দ্বীপান্তর! ৮০০ কিলোমিটার দূরে বদলির তুঘলকি-ফরমান নেমে আসে ২০২১-এও? এখন কি তবে পরাধীন ভারতের কালো আইন ‘কার্লাইল অ্যাক্ট’-এর পুনর্নবীকরণ ঘটেছে?
দলীয় রাজনীতির অঙ্গুলিহেলন ছাড়া যেন পাতা নড়াও নিষেধ। বাংলার কৃষ্টি শিক্ষা সংস্কৃতির জয়গান ঘোষণাকারী ‘বিশ্ববাংলা’-য় শিক্ষকের ওপর ধেয়ে আসছে পুলিশের লাঠি-জলকামান। তাতেও ক্ষান্ত হয় না! আন্দোলনকারী শিক্ষিকাদের ‘বিজেপি-ক্যাডার’ তকমা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার উগ্র চেষ্টাটাই আরও প্রকট হয়ে ওঠে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ভার্চুয়াল দেওয়ালের অভিভাষণে!
পাঁচের দশকে কিংবদন্তী শিক্ষক নেতা সত্যপ্রিয় রায়-অনিলা দেবীদের নেতৃত্বে বামমনস্ক শিক্ষকেরা সরকারবিরোধী নানা আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন। সেই সময় শিক্ষকদের বেতন মহাকরণের পিওনদের থেকেও একশো টাকা কম ছিল। তৎকালীন শিক্ষাসচিব ডি এম সেন আন্দোলনরত শিক্ষকদের বলেছিলেন, “ওই বেতনে যদি শিক্ষকদের না পোষায়, তাহলে তারা রাইটার্সের পিওনের চাকরিতে যোগ দিলেই পারে।” মাস্টারমশাইরা সেদিন এসপ্লানেড ইস্টে দিনরাত এক করে অবস্থানে বসেছিলেন। শিক্ষকদের আন্দোলন সেদিন আমজনতার আন্দোলনের চেহারা পেয়েছিল।
বাংলার প্রগতিপন্থী শিক্ষকরা ‘একদিনের কর্মবিরতি পালন’ করে জেলে পর্যন্ত গিয়েছিলেন এই বাংলায়। জেলে টানা ৫২ দিনের অনশন আন্দোলনে থাকা শিক্ষক নেত্রী অনিলা দেবী, পরবর্তীতে, ১৯৭৯ সালে, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৯ বছর ছিলেন ওই পদে। ‘পার্টি-ক্যাডার’ হিসাবে তাঁর সেদিনের আন্দোলনকে দমাতে পারেনি শাসক। পুলিশের উদ্যত লাঠিকে সংযত হওয়ার স্লোগান তুলেছিলেন তাঁরা শিক্ষকোচিত স্পর্ধায়— “পুলিশ তুমি যতই মারো/বেতন তোমার একশো বারো”।
শিক্ষকরা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করবে কিনা, মিছিল করবে কিনা, দাবী সংবলিত পোস্টার লাগাবে কিনা— এই দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছিল সেদিন। বর্ধমানের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক-নেতা বলেছিলেন, “শিক্ষকই হোন আর শ্রমজীবীই হোন— সর্বস্তরে বঞ্চিত মানুষের বাঁচার লড়াই একটি সূত্রে বাঁধা।” আর শিক্ষক নেত্রী অনিলা দেবী বলেছিলেন, “প্রতিরোধের লড়াইতে হতাশার কোনও স্থান নেই!”
তাহলে সেদিন পাঁচ শিক্ষিকা জ্যোৎস্না টুডু, শিখা দাস, পুতুল জানা মন্ডল প্রমুখরা ‘দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা থেকে কোচবিহার দিনহাটায় বদলির প্রতিবাদে’ শিক্ষাদপ্তরের রাজ্য কার্যালয়ের সামনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন কেন? শিক্ষক আন্দোলনে কেন এই সীমাহীন হতাশা?
শিক্ষক-সমাজকে জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অত্যন্ত সুচারু পরিকল্পনা যদি পার্টি অফিস থেকেই বসে নেওয়া হয়, তবু, শিক্ষক আন্দোলনের জন-বিচ্ছিন্নতার দায় শিক্ষকেরাও কি এড়াতে পারেন? প্রতিরোধের লড়াইতে হতাশার সত্যি কি কোনও স্থান আছে?
শিক্ষক নিয়োগের অভাবে ধুঁকতে থাকা হাজার হাজার স্কুল, শিক্ষক নিয়োগের চাকরিতে দুর্নীতির অভিযোগ, পার্শ্বশিক্ষক, মাদ্রাসা শিক্ষক, শিক্ষাসহায়িকাদের চূড়ান্ত বেতন-বৈষম্য নিয়ে যে কটি শিক্ষক আন্দোলন বিগত দশকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল— সবকটিকে মাটিতে আছড়ে ফেলার যাবতীয় আয়োজন ছিল। রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে শিক্ষক আন্দোলনকে ‘খেলো’ করার অভিসন্ধি ছিল। সেইসঙ্গে শিক্ষক আন্দোলনের নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবও কম ছিল না সে আন্দোলনে!
রোগ হাতের বাইরে চলে গেলে, হাতুড়ে ডাক্তারবাবুরা রুগীকে বড় হাসপাতালে রেফার করেন বলে একটা অভিযোগ আছে। সেসময় না ডাক্তার, না রুগীর বাড়ির লোকজনের হাতে অবশিষ্ট কিছু থাকে। রোগগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থার হাল সেদিকেই গড়াচ্ছে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলি মুখিয়ে আছে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা মৃত ঘোষণার অপেক্ষায়। এই ‘প্রায় হাতের বাইরে চলে যাওয়া সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা’-কে যথার্থ শিক্ষক আন্দোলনই বিশল্যকরণী এনে দিতে পারে। তার জন্য, প্রকাশ্যে বিষ পান করার আবশ্যকতা নেই। বরং যা আছে— শিক্ষক আন্দোলনকে জন-আন্দোলন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।
শিক্ষকের মানসিক দৃঢ়তা, দূরদর্শিতাই পারে, শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের ঘোষিত অশ্লীল, অবমাননাকর, তুঘলকি আক্রমণের শিক্ষকোচিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। মানুষের স্বার্থে, শিশুদের শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নে, শিক্ষকের বেতন চাকরির সুরক্ষার ন্যায্য দাবীতে শিক্ষক আন্দোলনকে শাণিত করার ভাবনা যতদিন শিক্ষকসমাজে তৈরি হবে না, ততদিন এভাবেই, অমর্যাদার হানাদারি নেমে আসবে সমাজ গড়ার কারিগরের মাথায়। ভূলুণ্ঠিত হবে শিক্ষা।