সুরজিৎ দেবনাথ
একটা ট্রেন আর একটা প্ল্যাটফর্ম। আলাদা দুটো পৃথিবী। প্ল্যাটফর্মটি বিশেষভাবে সাজানো। মেঝেতে আঁকা পায়ের ছাপ। এখানেই এসে দাঁড়াবে পরিযায়ী শ্রমিকেরা। পরীক্ষা দেবে তাপমাত্রার। চারদিকে ছড়ানো সরকারি ব্যবস্থা, লোকজন। আয়োজন আর মাপা দূরত্ব।
ট্রেনের ভেতরে জীবন অন্য। দূরত্ব নেই। নেই ভয় বা আতঙ্ক। জয়পুর থেকে ফিরছে শৈলেন। নিজের বাড়িতে। রাত একটা।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে যায়। নিউ কোচবিহার। আলো ঝলমলে স্টেশন। উর্দিধারিতে ছয়ালাপ। বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে ওঠে শৈলেনের। কোনও এক বন্দি জীবনে ঢুকে পড়ছে একটা সুড়ঙ্গ পথ। প্রত্যেকবার ভাই আসে স্টেশনে, শৈলেনকে নিতে। এ বার কেউ নেই। যা আছে তা হল, স্টেশনের বাইরের ক্যাম্প থেকে একটা টিফিনের প্যাকেট। তারপর গ্রামের দিকে যাওয়া। প্রশাসননির্দিষ্ট একটা ছোট বাসে উঠে পড়ে শৈলেন। জেলাশহরের কাছেই একটা গ্রাম থানেশ্বর। থানেশ্বর হাট। বাসে উঠে গ্রামেরই কয়েকটি পরিচিত মুখ ও পরিবারের সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়।
রাতের অন্ধকারে স্কুলবাড়িটাকে জেলখানাই মনে হয়েছে শৈলেনের। দুজন সিভিক ভলান্টিয়ার মিলে জনা দশেকের দলটাকে স্কুলবাড়ির কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে গেছে। পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাইরে আসতে মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলার গরমের ছুটির আগে এক মাস সকালের স্কুলের কথা। এখন স্কুল পাঁচিল ঘেরা। অনেক গাছ মাঠের চারদিকে। আগে এসব ছিল না। ধু-ধু মাঠের মাঝখানে টিনের চৌ-চালা স্কুলঘর। বর্ষায় ফুটো চাল দিয়ে মাটির মেঝেতে পড়া জলে তৈরি হত ছোট পুকুর। পড়ার মাঝেই কত খেলা। হাঁটতে হাঁটতে শৈলেন স্কুলগেটের সামনে যায়। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তালাবন্ধ গেটের বাইরে শৈলেন দেখতে পেল ওর বউ আর ছেলে দাঁড়িয়ে।
দূর থেকে বউয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পায় ও। … দুপুরের খাবার আমি নিয়া আমু। ছেলে আর বউয়ের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে শৈলেন। তারপর অনেক দূর পর্যন্ত তাদের চলে যাওয়া দেখতে থাকে।
একটা বড় ফুটবল মাঠ, তার তিনদিকে দাঁড়িয়ে স্কুলবাড়ি। একদিকে প্রাইমারি, বাকি দুদিকে হাইস্কুল। এখানেই ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে শৈলেন। এই জেলখানার ভেতরেও অনেক মুক্তির স্মৃতি ভিড় করে আসে। ক্লাস এইটে প্রথম বিড়ির ধোঁয়া ওই পশ্চিমদিকের শিরীষগাছটার নীচে। বৃষ্টির দিনে স্কুল ছুটির পর জল ভর্তি মাঠে ফুটবল। টিফিন পিরিয়ডের মারামারি। সরস্বতী পুজোর রাত-জাগা প্যান্ডেল। কোনওরকমে মাধ্যমিকটা উতরানো। তারপর গ্রামের এক দাদার সঙ্গে পাড়ি রাজস্থানের জয়পুরে। রাজমিস্তিরির জোগাড়ের কাজ। সেই থেকে কুড়ি বছর। এখন সে হেডমিস্ত্রি। আট বছর আগে গ্রামেরই মেয়ে সবিতার সঙ্গে বিয়ে। ছয় বছরের ছেলে এখন শুভম। বিয়ের পর মাস দুয়েক বাড়িতে ছিল শৈলেন। তারপর থেকে বছরে এক কি দুবার বাড়ি আসা। ভোট থাকলে কোনও বছর দুবার। এভাবেই বয়ে যাচ্ছিল শৈলেন আর সবিতার সংসার। দূরগামী দুই নদী। যোগাযোগ বলতে মাঝে মোবাইল নামের একটি শাখানদী। সকালে অথবা গভীর রাতে কখনও বান এসেছে জীর্ণ নদীতে। কিছুক্ষণের জন্য।
দুপুরের পর কোয়ারেন্টাইনে আর সময় কাটতে চায় না। ঘুমের অভ্যাসও নেই। বারোটা বেড, মাথার ওপর চারটে ফ্যান। টিনের চালা থেকে গমগম শব্দে গরম হাওয়া নেমে আসে। ঘরের প্রায় সবার হাতে মোবাইল। মিশ্র স্বর সারা ঘরময়। শৈলেন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। স্কুলঘরের পাশেই শিরীষ গাছের নীচে গিয়ে বসে। গাছের গুঁড়িটায় হেলান দিয়ে শৈলেন মায়ের ছোঁয়া টের পায় যেন। কখন যে চোখ জুড়ে এসেছিল! অনেকদিন পর এমন ঘুম।
বিকেলের আলো নরম হয়ে শুয়ে আছে মাঠে। স্কুলের গেট খোলার আওয়াজ। জনা পাঁচেকের একটা দল ঢুকছে। একজনের হাতে সম্ভবত চায়ের কেটলি। গাছতলা থেকে উঠে শৈলেন গুটি গুটি পায়ে স্কুলঘরের দিকে এগিয়ে যায়। লোকগুলো বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ায়। সকলের মুখই মাস্কে ঢাকা। ওদের মধ্যে একজন পকেট থেকে একটা থার্মাল গান বের করে। উঁচু গলায় বলে, একজন করে বাইরে এসে দাঁড়াও। তাপমাত্রা মাপা হবে।
তাপ মাপা হলে চা আর ছোট একটা বিস্কুটের প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে হাতে। তা নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকেরা। শৈলেন দূর থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখছিল। এবার সে এগিয়ে যায় তাপ মাপার জন্য। দলের একজনের পোশাক আর হাবেভাবে বোঝা গেল ইনি বিশেষ কেউ। বাকিরা অনুগামী। শৈলেন একটু এগিয়ে গিয়ে চিনতে পারে লোকটিকে। স্কুলের সহপাঠী, প্রসেনজিৎ। পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান।
থার্মাল গান হাতে ছেলেটা শৈলেনের কপালে যন্ত্রটা তাক করে ডাক্তারের ভঙ্গিতে বলে, জ্বর নেই। যাও। প্রসেনজিতের সঙ্গে আলাপ করার এটাই সুযোগ। শৈলেন কথা বলে। …কেমন আছিস ভাই। প্রসেনজিৎ ভারি সুরে কথা ভাসিয়ে দেয়, আর আছি! এখন দিন রাত সব এক।
তবে যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুড়িয়ে জানতে চায়, অসুবিধা হচ্ছে না তো? শৈলেন সংক্ষেপে না বলে। তারপরই অবশ্য জুড়ে দেয় তার সমস্যার কথা। …কী কইরা যে দিন চলব! সব ছাইড়া চইল্যা আইলাম।
দলবল নিয়ে রওনা হওয়ার আগে প্রসেনজিৎ বলে যায়, অফিসে আসিস, কিছু একটা ব্যবস্থা হইয়্যা যাইব।
ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এল। হাইস্কুলের বিল্ডিংয়ের মাথায় একটা আলো। নীল-সাদা রঙের বাড়িটা যেন একটা গম্ভীর ফ্যাকাসে মানুষ। ক্রমশ রাত ছড়িয়ে পড়ে স্কুলচত্বর জুড়ে। পাঁচিলের জন্য দূরের বাড়িতে জ্বলে থাকা আলোও দৃশ্যমান নয়। রাতের খাবার আসে। খিচুড়ি আর ডিমের অমলেট। কিছুক্ষণ স্কুলের বারান্দায় পায়চারি করার পর বিছানায় যায় শৈলেন। ছোট মোবাইলটার দিকে তাকায় একবার। বহুক্ষণ স্তব্ধ যন্ত্রটা। ফোনটা বালিশের নীচে রেখে চোখ বোজে সে।
সকালের চা, টিফিন তখনও আসেনি। সাত-আটজনের একটা দল বারান্দায় দাঁড়িয়ে হল্লা করছে। আসুক আইজ টিফিন দিতে, আটকামু সব কয়ডারে।
–এক সপ্তাহ হইয়া গেল এখনও আমাগো টেস্ট হইল না।
–বাড়ি যাম কী কইরা? বাড়ির লোকেরে রোগ বিলাইতে?
দুজন সিভিক পুলিশ আর একটা ছেলে সকালের টিফিন দিতে মেন গেট খুলে এগিয়ে আসছে। ওদের দেখতেই বারান্দায় দাঁড়ানো দলটা আরও হইচই শুরু করে দিল। ওদের মধ্যে দুজন দৌড়ে গিয়ে সেন্টারের ফ্যান লাইট ভাঙতে শুরু করল। সিভিক ভলান্টিয়াররা দূর থেকে ওদের শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু শ্রমিকরা থামার পাত্র নয়। তারা বলতে থাকে, আমাগো এখনি টেস্ট করাইতে হইব। রাতের খাবার চাই।
সিভিকরা উত্তর দেয়, আমাদের বলে কী হবে বলেন? আমরা সাহেবদের জানাচ্ছি…। এর পরেও হই-হট্টগোল চলে বেশ কিছুক্ষণ। ঘণ্টাখানেক পরে সেন্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় সাদা রঙের দুটো গাড়ি। বিডিও সাহেব একজন পুলিশ অফিসার আর কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে সেন্টারের ভেতর হাজির। ওদের দেখে হইচই আবার শুরু হল। কয়েকজন খুব হম্বিতম্বি দেখাতে লাগল। পুলিশ আফিসারটি তখন আরও গলা চড়িয়ে বললেন, সাহেবের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলো। বিডিও ভদ্রলোক অল্পবয়সী, ছোটখাটো চেহারা। আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা কী বলছ আমরা সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের হাতেও সব কিছু নেই। ইচ্ছে থাকলেও, চাইলেই সব কিছু করতে পারব না। তোমাদের সকলের টেস্ট করানো সম্ভব নয়। যদি কারও শরীরে খারাপ লক্ষণ দেখা দেয় তাদেরই টেস্ট করা হবে। আমরা মেডিক্যাল টিমকে তোমাদের ভালো করে পরীক্ষা করার কথা বলে দিচ্ছি। অসুবিধা হবে না।
–স্যার আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা যদি একটু করেন। রাতে বাড়ি থেকে খাবার পাঠানো খুব সমস্যা।
–দেখো, আমাদের সরকারি কোনও নির্দেশ নেই ব্লক থেকে খাবারের ব্যবস্থা করার। তবে আমি পঞ্চায়েতকে বলছি যদি কিছু একটা করা যায়। তোমরা গোলমাল কোরো না।
পুলিশ অফিসার যাওয়ার আগে হুমকির সুরে বলে যান, শোনো, আর যেন ফ্যান লাইট ভাঙার ঘটনা না ঘটে। এরপর ঝামেলা করলে ডাণ্ডা মেরে সোজা করে দিয়ে যাব।
বেলা বারোটা নাগাদ একটা মেডিক্যাল টিম এসে সকলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করল। দশ দিন হয়ে গেছে এমন সাতজনকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হল সার্টিফিকেট সহ। শৈলেনেরও আজ কোয়ারেন্টাইন দশার শেষ। ভাই ব্রজেন বাইক নিয়ে এসেছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তবে গ্রামে ঢুকতেই কয়েকজন রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ক-জন কথাও বলল কিন্তু একটা দূরত্ব রেখে। কিশোরবেলায় পক্স হওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল শৈলেনের। মা ছাড়া আর কেউ ঘরে ঢুকত না। সেরে যাওয়ার পরও স্কুলের বন্ধুরা কয়েক দিন দূরে দূরে থাকত। তারা পক্সের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখতে চাইত। ঘরে ঢোকার মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল শৈলেনের ছেলে শুভম। ছেলেকে আদর করতেও দ্বিধা কাজ করল। আলতো করে মাথায় হাত দিয়ে ঘরে ঢুকে যায় শৈলেন। বউ সবিতা একটা গামছা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কাপড়-জামা ছাইড়া স্নান কইরা আসো।
দুপুরের খাবারের পর বিছানায় এল শৈলেন। চিত হয়ে শুয়ে ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মনে হল কত দিন পর এভাবে বিছানায় আসা! অনেকদিন পর এমন আরামের শোওয়া। চোখ লেগে এসেছিল। সবিতা ঘরে ঢুকতেই সজাগ হয়ে যায়। খাট থেকে দূরে দাঁড়িয়ে বলল, আইজ তো তোমার সাত দিন, আরও এক সপ্তাহ যাক তারপর বাবুরে নিয়া একলগে শুমু। শৈলেনের বুকে একটা পাথর নড়ে ওঠার শব্দ হয়। সবিতা সে শব্দ শুনতে পায় না। শৈলেন শুধু ঘর থেকে সবিতার বেরিয়ে যাওয়া দেখতে পায়।
ঘুম ভাঙল। কিন্তু কোথায় ঘুমিয়েছিল শৈলেন কাল রাতে? এটা কি জয়পুরের সেই ঘর নাকি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার! কোনও ফারাক অনুভব হয় না। সকালের চা আর টিফিন খেয়ে শৈলেন বাজারের দিকে রওনা হল। বাড়ির জন্য বাজার করতে যাওয়ার উত্তেজনা তার হাঁটায় স্পষ্ট। চিংড়িমাছ আর পাঁঠার মাংস কিনবে বলে মনস্থির করে শৈলেন। ছেলেটা চিংড়ি পছন্দ করে। ভাই ব্রজেন আর ওর বউ-ছেলেকে বলে এসেছে দুপুরে খাওয়ার জন্য।
বাজার করতে শৈলেনের বেশি সময় লাগল না। আংশিক সময়ের লকডাউন চলছে। গ্রামে তার প্রভাব খুব বেশি নেই। তবে বাজারে লোকজন কম। আজ হাটবার তাই কিছু মাছ আর সব্জি আমদানি হয়েছে। বাজার লাগোয়া পার্টি অফিসের সামনে বাইক আর সাইকেলের লাইন তেমন নেই। ভেতরে টিভি চলছে। প্রসেনজিৎ দেখা করতে বলেছিল। উপ-প্রধানের অফিস ঘরের দিকে যায় শৈলেন। অফিসেই ছিল প্রসেনজিৎ। ফোনে কথা বলছে কারও সঙ্গে। শৈলেনকে দেখে ইশারায় বসতে বলে সে।
ফোন রেখে প্রসেনজিৎ ঘাড় দুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, কাজ করবি বলছিলি তো? কাজ একটা আছে। একটু অন্যরকম। ভয় পাবি না তো?
–কী কাজ বল।
–দুইবেলা সেন্টারে গিয়ে তাপ মেপে আসবি। আমরা গ্লাভস, মাস্ক, স্যানিটাইজার, থার্মাল গান সব ব্যবস্থা করে দেব। তুই খালি ভেতরে ঢুকে কাজটা করে দিবি। আধঘণ্টার কাজ। পারবি না?
–পারব।
–শোন, পয়সাকড়ি আমরা বিশেষ কিছু দিতে পারব না। তবে কিছু আমদানি হয়ে যাবে তোর।
–কীভাবে?
প্রসেনজিৎ এ বার মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে নিচু স্বরে বলল, রিস্ক নিয়ে একটা কাজ করবি তার জন্য মাথা পিছু বিশ-পঞ্চাশ টাকা তুই চাইতেই পারিস।
–ওরা কি দেবে?
–কেন দেবে না! এটা তো মানবিকতার ব্যাপার। তুই কাল থেকে লেগে পর। কমবেশি কিছু তো হবেই।
পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে শৈলেন বাজারের থলি হাতে হাঁটতে থাকে। রোদ্দুরের তাপ আজ বেশ প্রখর। একটা কাজ জুটে যাওয়ায় একটু হালকা বোধ হচ্ছে শৈলেনের। আবার একটু হতাশও বটে। হাজিরা সিস্টেম হলে ভালো হত। মর্জিমতো কে কী দেবে তার কোনও ঠিক নেই। সবটাই অনিশ্চিত। এ সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শৈলেন বাড়ি পৌঁছয়। বাজারের ব্যাগ সবিতার হাতে দিয়ে বলে, মাছ আর মাংস ধুইয়া রাখ। আমি হাত-পায়ে জল দিয়া রান্নাঘরে যাইতাছি।
সবিতা ফুঁসে ওঠে। তুমি রান্না করবা নাকি?
–হ্, ক্যান কী অসুবিধা!
–না তোমার আজ করতে হইব না। আইজকা ব্রজেনরা খাইব। বাচ্চা লইয়া। তুমি তো আছই, আর এক দিন কইরো।
শৈলেন আর কথা বাড়ায় না। মেনে নেয় এই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার পরিস্থিতি ।
খুব ভোরে শৈলেনের ঘুম ভেঙে গেল আজ। তার পর বেশ কিছুক্ষণ জেগে বিছানায়। নানারকম ভাবনার ঘুরপাক। আজ কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের প্রথম দিন। নিভৃত আবাসের আবাসিক নয়, স্বেচ্ছাসেবক স্বাস্থ্যকর্মী হয়ে কাজ করবে সে। একটু উদ্বেগ আছে, তবে ভয় পাচ্ছে না শৈলেন। স্ত্রী সবিতাকে বলেনি এই কাজের কথা। কিছুটা অভিমানে। তবে এই ভাবনাটাকে বেশিক্ষণ আমল দিল না শৈলেন। উঠে পড়ে গা ঝাড়া দিয়ে। স্নান করে নেয় পুকুরে। ঘরের বাইরে দরজার কোণে দাঁড়িয়ে সবিতা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে, সক্কাল সক্কাল স্নান করলা আইজ!
–হুঁ, একটু বাজারের দিকে যামু।
–চা হইয়া গেছে, খাইয়া যাইও।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে সবিতা এক বাটি মুড়ি আর চা বিছানার ওপর রেখে গেল। চা মুড়ি শেষ করে শৈলেন ঘরের কাঠের খুঁটিতে ঝোলানো বাবা-মায়ের ছবিটাতে মাথা ঠেকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এক ঝটকায় বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে উঠোনে। তারপর রাস্তায়। একবার রাস্তায় উঠে পড়লে বাড়ি ও সংসার যে কোথায় উধাও হয়ে যায়! রাস্তাটাই তখন আকাশ। উড়ে বেড়ানোর অনন্ত পথ। টিঁকে থাকার আশ্রয়। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে ছাতা আছে। কিন্তু শৈলেন ছাতা খোলেনি। ঝিরঝিরে বৃষ্টির ছাঁট চোখে মুখে গলায় মিশে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত আরাম আর আদর চুঁইয়ে পড়ছে সারা শরীর বেয়ে। ছোটবেলায় মায়ের কাছে স্নানের কথা মনে পড়ে। ভিজতে ভিজতে পঞ্চায়েতের গেটের সামনে আসে সে। বাইরে লোকজন বিশেষ নেই। প্রধানের ঘরের দরজায় উঁকি দিতেই ভেতরটা দেখতে পেল শৈলেন। প্রসেনজিৎ বাইরে বেরিয়ে আসে। একটু ইশারায় শৈলেনকে আড়ালে ডেকে নেয়। বলে, বাইরে অপেক্ষা কর। হেলথের লোক আসবে। কীভাবে কাজ করতে হবে সব বুঝিয়ে দেবে। টেনশন করার কিছু নেই।
–ঠিক আছে, বলে শৈলেন চলে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রসেনজিৎ শৈলেনের কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে বলে, কাজ শেষে ওদের কাছ থেকে তোর পাওনাটা চেয়ে নিস। লজ্জার কিছু নেই। মুখ খুলতে হবে বাবু…। প্রসেনজিতের চোখে শৈলেন অন্যরকম হাসির খেলা দেখতে পায়।
শৈলেন এখন শুধু কোয়ারেন্টাইন সেন্টারেই নয়, গ্রামে গ্রামে ঘুরে জ্বরের রুগীদের তাপ মাপে, ওষুধের প্যকেট বুঝিয়ে দেয়। ওর নাম লোকের মুখে মুখে। ব্লকের মিটিং-এ বিডিও সাহেব শৈলেনের নাম করে বলেছেন সকলকে তার মতো দরদ দিয়ে কাজ করতে হবে।
শৈলেনের হাতে ঝুলছে বড় একটা লাউ। এই বাড়ি ওই বাড়ি থেকে আজকাল প্রায়ই এমন জুটে যায়। উঠোনে ঢুকে শৈলেন ডাক ছাড়ে, দ্যাখো কত বড় লাউ! চিংড়িও আনছি। শুভম ছুটে এসে লাউটাকে জড়িয়ে ধরে। কত বড়! রান্নাঘর থেকে সবিতা বেরিয়ে এসে ঝাঁঝ ছড়িয়ে বলে, তুমি জ্বর মাপনের কাম করো? বাড়ি বাড়ি যাও?
–হ্যাঁ যাই তো। কাম নাই, খাওন জুটব কই থিকা?
–আর কোনও কাম নাই দ্যাশে!
–জ্বর মাপনের কাম আমার ভালো লাগে। অর্ধেক জীবন তো কাইটা গেল কুলিগিরি কইরা।
সবিতা বলে, তুমি পাইছ কী? এই কাম করলে বাড়ি থাকতে হইব না।
–থাকুম না।
ছেলে শুভম শৈলেনকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে বাবা তুমি কই থাকবা? শৈলেন ছেলের মাথায় হাত বোলায় আর তাকিয়ে থাকে ঘরের দাওয়ায় পড়ে থাকা লাউ-চিংড়ি আর জ্বলতে থাকা উনুনের দিকে।
দিন যায় আর শৈলেনের কাজও বাড়তে থাকে। সারাদিনই কাজের চক্করে কাটে। কোনও দিন বাড়িও ফেরা হয় না। ব্লক হাসপাতাল, সেফ হোম, বা পঞ্চায়েতেই রাত কাটে। এই কাজ শৈলেনের নেশার মতো লাগে। প্রতিদিন কত মানুষের মুখোমুখি! তার মতই এই মানুষগুলো বাইরে থেকে নিজের মাটিতে ফিরে এসেছে। জয়পুর থেকে আসা লোকের সঙ্গে তার কথা জমে ওঠে। কুড়ি বছরের সম্পর্ক, ভোলা যায়! কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, শৈলেনদা কবে ফিরবা জয়পুর? শৈলেন উত্তর দেয়, যামু না আর। এইখানেই থাকমু।
এই কাজে শৈলেন একটা আশার আলো খোঁজার চেষ্টা করে। বিএমওএইচ স্যারের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। দেখা হলেই শৈলেন বলে, স্যার আমার কাজটা পাকা কইরা দ্যান। সাহেব বলেন, সব কি আমার হাতে শৈলেন! ভালো করে কাজ করে যাও। সুযোগ এলে অবশ্যই চেষ্টা করব। শৈলেন অপেক্ষা করে ভালো কিছুর জন্য।
অনেকদিন পর শৈলেন বারান্দায় বসে অপরিচিত উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যস্ততাহীন আশ্বিনের সকাল। হালকা ঠান্ডা আর মৃদু হাওয়া। চারপাশে রোদ থইথই করছে। শ্রমিকদের ট্রেন আসা প্রায় বন্ধ। বাড়ি বাড়ি জ্বরের রুগীও তেমন আর নেই। হেলথ্ সেন্টার বা পঞ্চায়েত থেকে আর ফোন আসে না। একবার ব্লক হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবর করবে বলে শৈলেন মনস্থির করে। চারদিকে পুজোর মরসুম। বাজারে দোকানে ভিড়। এত সুন্দর নরম ফুরফুরে উৎসবের আবহেও শৈলেনের কেমন দমবন্ধ লাগে। বেলা বারোটায় ব্লক হাসপাতাল যেন নিঝুম। উৎসবের আমেজে রোগ-ব্যাধিও যেন পালিয়েছে। গাছতলায় তিন-চারটে অ্যাম্বুলেন্স বিশ্রাম নিচ্ছে। ডাক্তারের চিহ্ন লাগানো দুটো গাড়িও আছে। একজন নার্স ইন্ডোর থেকে বেরিয়ে কোয়ার্টারের পথে। ক্যান্টিনের ভেতর একবার উঁকি দেয় শৈলেন। রান্নার মাসি টুলে বসে ঝিমোচ্ছিলেন। শৈলেনকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, খাইবা নাকি? শৈলেন কোনও উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে যায়। বিএমওএইচ স্যার অফিসে একাই বসে ছিলেন। শৈলেন অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢোকে। ভেতরে ঢুকতেই সাহেব কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। মনে হল শৈলেন কী বলতে চায় তা তিনি কিছুটা অনুমান করতে পেরেছেন।
–স্যার আমাগো কাজকর্ম কি সব বন্ধ হইয়া গেল?
–হ্যাঁ তেমনই তো মনে হচ্ছে। সাহেবের উত্তরেও একটু অসহায়তা।
শৈলেন আর কথা বাড়ায় না। স্যার আসি, বলে বেরিয়ে যায়। সে আসে হাসপাতালের গেটের সামনে। সামনে বড় রাস্তা। তবুও মনে হয় সে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে আসেনি। হাঁটছে হাসপাতালের ভেতরের রাস্তা ধরে। বসে আছে গাছতলায়। সব কেমন ফাঁকা লাগে। শূন্য মনে হয়। এরকম একবার হয়েছিল ক্লাস এইটে ফেল করার পর। রেজাল্ট দেওয়া সেই ক্লাসঘর, স্কুলের মাঠ আর মনখারাপ করা জলপাইগাছটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মার্কশিট নিয়ে অনেকক্ষণ ওই গাছটার নীচে বসেছিল। এখন শৈলেন কোথায় যাবে! প্রসেনজিতের কাছে গেলে কেমন হয়? বড় রাস্তায় উঠে শৈলেন একবার হাসপাতালের গেটের দিকে তাকায়, তারপর হাঁটতে থাকে বাজারের দিকে।
স্ট্যান্ড থেকে একটা অটোতে ওঠে শৈলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অটো ভর্তি। সকলেই যেন বেশ মজায় রয়েছে। যাত্রীদের কথাবার্তায় বোঝা যায় এরা সবাই টাউনে যাচ্ছে পূজার কেনাকাটা করতে। মেয়ে-পুরুষ আর কচিকাঁচায় অটো সরগরম। অটোচালক হাঁক দেয়, পঞ্চায়েত অফিস…। শৈলেনের ঘোর কাটে। একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। দশ টাকার একটা নোট ড্রাইভারের হাতে দিয়ে নেমে পড়ে সে।
প্রসেনজিৎ অফিসেই ছিল। ভেতরে একজনের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে কন্ট্রাক্টর বা ওই ধরনের কেউ। লোকটা খুব বোঝানোর চেষ্টা করছে। প্রসেনজিৎও সোজা-সাপ্টা জবাব দেয়। …এখন ফান্ডের খুব ক্রাইসিস। আপনি পরে যোগাযোগ করবেন।
এ সব টুকরো টুকরো কথা কানে আসে। মাথার ভিতরে ফাঁকা ভাবটা যায় না শৈলেনের। কী বলবে প্রসেনজিৎকে? কিছুই মাথায় আসছে না। সব যেন তালগোল পাকানো। লোকটা বেরিয়ে যাবার পর শৈলেন ধীর পায়ে ভেতরে ঢোকে। প্রসেনজিৎ-ই প্রথম মুখ খোলে।
–বল কী খবর?
–আমাগো কাজ কি আর থাকব না?
–কী যে বলি তোকে! টেবিলের ওপর পড়ে থাকা পেপারওয়েটটা ঘোরাতে থাকে প্রসেনজিৎ।… এখন তো তেমন ট্রেনও আসছে না। গ্রামেও তেমন জ্বরের কেস নেই। তুই অন্য কাজ খোঁজ।
শৈলেনের মুখে কোনও কথা নেই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রসেনজিৎ বলে, চা খাবি নাকি! সে কথার কোনও উত্তর না দিয়ে শৈলেন বলে, আমার যে এই কাজটা করতে ভালো লাগতেছিল। কোনও ব্যবস্থাই কি হইব না?
–কী করে হইব বল! যে ক-জন অস্থায়ী কর্মী তাদের মাইনে দিতেই নাজেহাল।
অফিস থেকে বেরিয়ে শৈলেন আকাশপাতাল কত কিছু যেন ভাবছিল। কিন্তু কিছুই মাথায় এল না, জয়পুরের ইট-কাঠ-পাথর ভর্তি জীবনটা ছাড়া। হাসপাতাল, কোয়ারেন্টাইন সেন্টার, থার্মাল গান, ওষুধের ব্যাগ, মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটে যাওয়া, এ সব যেন মুহূর্তে মুছে যাচ্ছে জীবন থেকে। পঞ্চায়েতে অফিসের উল্টো দিকে কমলের দোকানে ঢোকে শৈলেন। এখান থেকেই ট্রেনের টিকিট কাটে সবাই। শৈলেন জিজ্ঞেস করে, জয়পুরের টিকিট আছে কি না দেখো তো? কমল উত্তর দেয়, এখন টিকিট চাইলেই পাইবা। কোন তারিখের টিকিট লাগব কও।
এরই মধ্যে দুজন ছেলে এসে দোকানে ঢুকল। তারাও টিকিট কাটবে। এদের মধ্যে একজন শৈলেনকে উদ্দেশ্য করে বলে, কী গো শৈলেনদা, এই যে সেদিন কইলা আর জয়পুর যাইবা না। আবার টিকিট কাটো ক্যান? এই কথার কোনও উত্তর না দিয়ে শৈলেন টিকিট নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়। দোকানের ভেতর মৃদু গুঞ্জন শৈলেনের কানে এসেও পৌঁছয়। বাজারের ভেতরের বড় শিরীষগাছটার নীচে পরেশের চায়ের দোকানে এসে বসে শৈলেন। এক কাপ চা খাওয়ার পর আজ আর বিড়ি না, একটা সিগারেট কিনে ফেলে সে। বাঁশের মাচায় বসে আয়েশি ভঙ্গিতে টান দিতে থাকে।
–কী গো শৈলেন আর কত দিন আছ এই দ্যাশে? চা-দোকানি পরেশের উৎসাহ শৈলেন বুঝতে পারে কিন্তু বিশেষ গা করে না। সিগারেটে বড় করে একটা টান দিয়ে ঘন ধোঁয়া ছড়ায়। পরেশ উনুনে কাঠ গোঁজে আর মিহি কিছু কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়। … কমলের দোকানে তো দ্যাখতাছি ট্রেনের টিকেট কাটনের লাইন। কী করব পোলাপাইন! কাজ নাই কাম নাই। এইহ্যানে আছেডা কী? চায়ের দোকানের পয়সা মিটিয়ে শৈলেন বাড়ির রাস্তা ধরে। হাঁটতে থাকে ভাঙা-চোরা পথে। মাথার ভেতরে কত কিছু কিলবিল করে বেড়ায়। চোখের সামনে যেন ভাসে জয়পুর যাওয়ার ট্রেন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো। শুধু উঠে পড়ার অপেক্ষা।
বছর ঘুরে যায়। শৈলেনের ইটকাঠের জীবনে তেমন কোনও পরিবর্তন আসেনি। স্বাভাবিক নিয়মে এক-এক দিন শৈলেনের ফোন বেজে ওঠে। বাড়ির নম্বর। সবিতা নয়, ছেলে ফোনের অন্য প্রান্তে।
–বাবা এই বছর আমাগো গ্রামে অনেক মানুষের জ্বর। মাঝেমাঝেই বাঁশি-দেওয়া বড় গাড়ি আইস্যা লোক নিয়া যায়। তুমিও কি এইবার আসবা জ্বর মাপতে?
শৈলেন ছেলেকে বলে, সাবধানে থাকবা। পড়াশোনা কইরো ঠিক কইরা…। ফোন রেখে সিমেন্টর বস্তা মাথায় শৈলেন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে।