Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রং

রং -- রোদ্দুর মিত্র

রোদ্দুর মিত্র

 

কাঠফাটা রোদের মধ্যে ঠায় বসে আছে একটা দাঁড়কাক। অনেকক্ষণ ধরে জলের জন্যে হাপিত্যেশ করে মরছে সে। কখন টাইমকলে জল আসবে, কখন ভিড় জমবে, কখন ঘোষবাড়ির নতুন বউয়ের কেচ্ছা শুনতে শুনতে বালতির জল উপচে পড়বে— এ এক বিচিত্র অপেক্ষা। ঘরমুখো জলের বালতি-গামলা-ঘড়াগুলোকে একটা কর্কশ ভেংচি কেটে, টাইমকলের মাথায় এসে বসবে সেই দাঁড়কাক: পরিতৃপ্তির উচ্ছ্বাস লেগে থাকবে তার পালকে, তার উড়ানভঙ্গিতে। কলের মুখ থেকে ঝরে পড়া টুপটুপ জলের সে একমাত্র অধিকারী। কোনও নিষেধ নেই, বেড়াজালও নেই কোনও। তাই, ক্ষণে ক্ষণেই সে অধৈর্য হয়ে উঠছে। গলা বাড়িয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে কালো দেহটা আরও চকচক করছে রোদের তীব্রতায়। বসে বসে ঠোঁট ঘষছে গাছের ডালে, ডানায় বিরক্তি মিশিয়ে উড়ে যাচ্ছে দুর্গন্ধময় নর্দমার দিকে, মুখে করে পচামাংসের টুকরো নিয়ে ফিরে আসছে আবার।

এখন গ্রীষ্মকাল। আইসক্রিমের লাল রঙের গাড়িটা রোদে পুড়ছে সেই কখন থেকে। দেখা গেল, গামছা দিয়ে গা ডলতে ডলতে পুকুর থেকে উঠে আসছে ঢালাও আইসক্রিমের মালিক। অথচ সে চাইলেই দুটো একটা আইসক্রিম খেতে পারত, ঠান্ডা হত শরীর, তবু তাকে ডেকেছিল পুকুর, কচুরিপানার গন্ধে ম ম একটা পুকুর। যার তলায় তলিয়ে গিয়ে বোধহয় হাজার হাজার আইসক্রিমের আস্বাদ চেটেপুটে খাচ্ছিল লোকটা। ভক্ষণচিহ্ন হিসেবে বুকেপিঠে এখনও কিছু টোপাপানা লেগে রয়েছে। মাথার জল মুছতে মুছতেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই আইসক্রিম, আইসক্রিইইইইম!’, সঙ্গে ঘন্টাধ্বনি। কেউ কোনও উত্তর দেয় না। ঘন্টাধ্বনি পাতলা হতে হতে দাঁড়কাক অবধি ঠিক পৌঁছে যায়, তৎক্ষণাৎ সে ভীষণ চিৎকার করে ওঠে।

–আহ! অত ডাকাডাকির কী আছে? দেওয়ালে রং চাপাতে চাপাতে প্রশ্ন করল ভজা। ছেঁড়া গেঞ্জি, তাপ্পি মারা পায়জামা, ঘামে চুপসে যাওয়া ভাঙা ভাঙা দেহ, ঠোঁটের কোণায় একটা পোড়া বিড়ি আর কপালের ভাঁজে কত যেন প্রশ্ন।
–তুই বুঝতে পারছিস না, ছেলেপিলে না থাকলে বেঘোরে মারা পড়বি, সঙ্গে আমরাও। পাওয়ার বুঝিস না, পাওয়ার? পাওয়ার না দেখালে পাড়ার একটা দেওয়ালও আস্ত থাকবে? রুমালে ঘাম মুছতে মুছতে ভজার পাশে এসে দাঁড়ায় কয়েকটা ছাতা।
–সুবলদা, আমাকে কাজটা শান্তিতে করতে দাও না। পাজামার দড়ি কষে বাঁধার জন্যে দীর্ঘদেহী ভজা উঠে পড়ে। দেখো, এই দেওয়ালটা প্রায় ফিনিশ, বাকিগুলো বিকেলের মধ্যে সেরে দিচ্ছি।
–বিকেল? তায় এতগুলো দেওয়াল? তার-ফার কি একেবারেই কেটে গেল তোর? সুবলবাবু নাছোড়বান্দা, তবু ভজাকে টলিয়ে দিতে পারলেন না।
–ধুচ্ছাই! বললাম তো এখন পারব না। ঘ্যানঘ্যান করো কেন এত? রাত নেই, দিন নেই, চান-খাওয়া নেই, সবসময় তোমরা পেছনে লেগে আছ। আমায় কী ভাবো মাইরি, হ্যাঁ? বলতে বলতে কোমরের গামছাটা খুলে নিয়ে কলপাড়ে এসে বসল ভজা।
–মানুষ ভাবি বলেই তোর মাথার ছাদটা এই সুবল দত্তই টিকিয়ে রেখেছে। পার্টির আর কোনও মাল নিশ্চয় তোকে মাসে মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে যায় না। সুবল দত্তকে বাদ দিলে, আর সবাই তোকে পাগলাকুত্তা… এইসব এখন ছাড়। বিকেলের মধ্যে সবকটা দেওয়াল যেন আমাদের হয়ে গলা ফাটায়…

ঠান্ডা জলে মুখ ধুয়ে ভজা সোজা দাঁড়াতে চায়, অথচ পারে না। পা টলে, মাথা টাল খায়, বুকটা হু হু করে— মরুভূমির বালি হয়ে উড়ে যায়— শরীরটা কেমন অবশ অবশ ঠেকছে— সামান্য কলটা পর্যন্ত বন্ধ করতে পারল না এখন। কলের পাশের একটা বাঁশের ভাঙা খুঁটিতে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায় ন্যাতানো ভজার পেল্লায় শরীরটা। গাছের ডালে বসা দাঁড়কাক, দারুণ গতিতে ছুটে এসে বসল কলের মাথায়। এই নিয়ে চারবার। প্রাণ ভরে জল খায় সে। দাঁড়কাকের এই তেষ্টা নিবারণের অমলিন দৃশ্য দেখে তার ঠাহর করতে অসুবিধে হয় যে, এ আদৌ ভজার পৃথিবী তো? তাহলে জল খাওয়ার আগে কেউ দাঁড়কাকটাকে বাধা দিয়ে জানতে চাইল না কেন তার ধর্ম কী, বর্ণই বা কী… দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ভজা ঠায় তাকিয়ে, ঘন কালো ডানায় দেখতে পায় রং, কত রং, সুখের রং, শান্তির রং, আরও কত রং…

 

কাল রাতে এক ঠোঙা মুড়ি চেবাতে চেবাতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছিল ভজার। চুপিসারে ঘুমের মধ্যে খুশি তার চুলে বিলি কেটে দিয়েছিল। নতুন ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিল, ও হরি! গায়ে আমার দুধে-আলতা রং দিলেন কেন? লোকে যে আপনাকে কানা বলবে গা!

শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে উঠেছিল ভজা। বলেছিল, বললেই বা! আমি তো জানি, আমার খুশি কত্ত ফর্সা!

ভজার হাসি আরও বেড়ে গিয়েছিল। এই তো কমাস হল ওদের বিয়ে হয়েছে। খুশি এখনও ভজাকে, ভজার কথাবার্তা, চলন-গমন কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারেনি— না পারাটাই স্বাভাবিক। তাই কিছুটা অবুঝের মতো, ভজার মন রাখতেই, খুশিও খানিক থমকে থমকে হাসছিল। তার স্বামী নাকি শিল্পী। ছবি আঁকে। সাদা-কালো, রঙিন রঙিন সব ছবি। বেশ নামডাকও ছিল। খুশির সহজ সহজ মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না, সব শিল্পীই কি তাহলে বাচ্চাদের আঁকা শিখিয়ে, রক্তদান শিবিরের পোস্টার এঁকে, আর ভোটের আগে দেওয়াল লিখে পেট চালায়? তাই হবে হয়ত।

ভজা দেখেছিল, টালির চালে লকলক করে বেড়ে উঠেছে লাউগাছ। খুশি দেখেছিল, লাউডগার আড়াল আবডাল ছুঁয়ে আসা প্রথম রোদের আলোয় ভজার মুখখানা। আর আমরা দেখেছিলাম, ভজা আবার ছবি আঁকার তোড়জোড় শুরু করেছে। বাঁচার ইচ্ছেটা পায়ের নখ অবধি চাগাড় দিয়ে উঠেছিল। মাটির অন্দর থেকে শোনা যাচ্ছিল সেই ডাক।

–কে রে? কে ওখানে? কোন শালা এত রাতে ঝাঁট জ্বালায়?

ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ভজার। বোধহয় ভয় পেয়েছিল খুব। বিশাল দেহটা কুঁকড়ে গিয়েছিল স্বপ্নের তোড়ে। আসলে একটা মিশকালো বেড়াল ভাতের হাঁড়ির মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। ফ্যানের হাওয়ায়, ফুরফুরে লেজে তখনও লেগে রয়েছে দু-এক কণা ভাত।

দুপুরবেলায় বাড়ি ফিরে ভজা ভূতগ্রস্তের মতো ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে খিদে পেয়েছিল প্রচণ্ড, তবু কেমন করে যেন অনুভূতিগুলো সব নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। ভজা টের পায়। এই যে হাঁড়িতে তিনদিনের বাসিভাতের শেষদানাটাও কাল রাতে বিড়ালে খেয়ে গেল, তা কি এমনি এমনি? সবাই মিলে ছক কষেছে ভজাকে মারবে বলে। পৃথিবীর আরও অনেক ভজা, সব্বাই মরে যাবে একসঙ্গে। ভজা টের পায়। পাগলাকুত্তাদের যেমন পিটিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মুখ থেঁতলে জিভ ছিঁড়ে গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয়…

এখন গ্রীষ্মকাল। শীতের চাদর সরে যেতেই গুটি গুটি পায়ে চলে আসে ডাবওয়ালা— ডাব লাগবে ডাআআআআব, ডাব লাগবে… ওঁর সঙ্গে গ্রীষ্মদুপুরের অদ্ভুত সখ্যতা। কেউ কি ওঁকে শুধুমাত্র এইসময়ের জন্যেই নিয়োগ করে? বিনিময়ে সে কী পায়? আস্ত একটা নারকেলগাছ? নারকেলগাছ দিয়ে আজকাল কিছু হয় নাকি। টাকা লাগে, পাওয়ার লাগে, পাওয়ার! সুবলদা যেমন বলে, গলার শিরা ফুলিয়ে ফুলিয়ে, আগুনে চোখ দুটো দিয়ে।

গরম হাওয়ার মধ্যে শরীরটা সেঁকে নিয়ে ভজা পাশ ফিরে শোয়। ঘুম যেন এমনি এমনি ভেঙে যায়। আবার। কাল রাতের মতো। ঘুম কেন ভেঙে গেল তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল…

সুবলদাকে তখন কথা বলা উচিত হয়নি। পার্টিতে একটাই তো ভালো লোক। খুশি মারা গেলে সুবলদাই তো আগলে রাখল, মাথায় নতুন টালি দিল, মাসে মাসে পাঁচশোটা টাকা, তার ওপর বলেছে এবারের ভোটে জিতে এলে নাকি একটা আঁকার স্কুল খুলে দেবে— মানুষটা খোদার সমান। যেভাবেই হোক, বিকেলে সবকটা দেওয়াল ফিনিশ করতে হবে। তারপর ভজা ছবি আঁকবে।

শেষ যেদিন খুশির দুঃখে কেঁদেছিল, কান্নার আঠায় ভজা যেন আজীবনের জন্যে দেওয়ালের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল, মানুষ থেকে হয়েছিল ইট। এখন আর কান্না পায় না, খুশির মরামুখটা মনেও পড়ে না।

–এ ভজা, ভজা! আরে ওই ভজার বাচ্চা! সুবলদা ডাকছে। বিকেলের মধ্যে সব কাজ সাল্টাতে হবে।
–এই ভজা! সাঁটিয়ে ঘুম দিচ্ছ নাকি চাঁদু?
–আরে আসছি রে ভাই, আসছি। চিল্লিয়ে তো পাড়া জাগিয়ে দিবি! মুখে বিড়ি গুঁজে ভজা খাটের তলায় মুখ ঢোকায়, মোটা তুলিটা শালা গেল কই! এখানেই তো রাখলাম…
–হারামিটা বহুত বাড় খাচ্ছে তো। লেট হচ্ছে তো নাকি আমাদের…, পার্টির দুজন ছেলে বেড়া ঠেলে ঢুকতে গিয়েই বাড়ির সামনের শিউলিগাছের ডালে ঠোক্কর খায়। তখন চোখ ডলতে ডলতে বেরোচ্ছে ভজা, থলে ভর্তি রঙের কৌটো, তিন চারটে তুলি, ঠোঁটের কোণায় আধপোড়া বিড়ি, স্বগতোক্তির ঢঙে বলল,
–বেশ হয়েছে!

 

বিকেলের পর থেকে প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। প্রায় চারটে দেওয়ালের কাজ শেষ করার পরে ভজার মুখে হাসি ফুটেছে। নাহ! তাহলে একেবারেই ফুরিয়ে যায়নি ভজন বিশ্বাস। সেই জোর আছে বৈকি! পাঁচ নম্বর দেওয়ালের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ভজা বলল, সুবলদা, এটা ওদের দেওয়াল না? লিখে দিলাম তো, গোল বাঁধবে না তো?

–ওসব ছেলেরা দেখে নেবে। তুই চিন্তা করিস না। হাত চালা, হাত চালা…

সন্ধে নামার আগেই ঝড় উঠল পুব-পশ্চিম উজাড় করে। ভজা তখনও বাইরে। পাড়ার কলে বসে বসে তুলিগুলো ধুচ্ছিল সে। সব রং একসঙ্গে গুলিয়ে যাচ্ছিল কলপাড়ের চারপাশে। ভজার অন্তর্গত ধুলোবালি আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে, ঝড়ের নেশায় তারা উড়ে যাচ্ছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক রং থেকে অন্য রঙে…

ভজা ঘরে ঢুকে দেখল, জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে শিরীষগাছের পাতা। ভাঙা পাল্লাটার ভেঙে পড়বার উপক্রম। জানালার ছেঁড়া পর্দা, বহু সেলাইবিধ্বস্ত বিছানার চাদর, সস্তার সিঁদুরের কৌটো— ভজা আরও খানিক ওলটপালট করে দিল। তারপর ছড়িয়ে বসল মেঝেতে। ছড়িয়ে দিল আঁকার খাতা। ঝোড়ো হাওয়ার শরীরে বেঁধে নিল নিজেকে। তারপর ক্ষ্যাপার মতো রং দিতে শুরু করল খাতায়, রং মাখতে শুরু করল হাতে-পায়ে-বুকে-পিঠে… প্রচণ্ড কালো রং মেখে নিল সারা মুখে। সুবলদার মতো দেখাচ্ছে না এবারে? পাওয়ার চাই, পাওয়ার!

কত না রঙ মেখেছে এই দু হাত, তবু জীবন কোত্থাও পায়নি, কোনওদিন ভজাকে কেউ ডেকে জিজ্ঞেস করেনি, তুমি কি বাঁচতে চাও?

না না, খুশি ছিল তো, টালির চালে লাউগাছ ছিল। রঙে রঙে জীবনের সরল অথচ প্রগাঢ় মায়াময় ছবিটাকে প্রায় শেষ করেই এনেছিল সে, তারপর রং কেমন পাশবিক হয়ে উঠল, আর মানুষ হয়ে উঠল বিচিত্র সব রঙিন পশু। ভালোবাসা নেই, স্নেহ নেই, কিচ্ছু নেই। সবসময় শিরদাঁড়ায় ভয়, সুবলদা, পার্টি, পাঁচশো টাকা, আঁকার স্কুল… ভেতরে ভেতরে ভজাও আওড়াতে শুরু করল, আগে নিজেরটা বুঝি, তারপর মানুষ। ভজা মরে গেল। সেই শিল্পী ভজা, যাকে নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করত খুশি, সেই ভজা… বাইরে প্রলয় শুরু হয়েছে।

খুশিই তাহলে ঠিক চিনেছিল। ভজা আদপে কেউ না। শিল্পী-টিল্পী ওসব ভড়ং। সে শুধু বাচ্চাদের আঁকা শিখিয়ে, সুবলদার দয়াদাক্ষিণ্যে বাঁচতে বাঁচতে, ভয়ে ন্যুব্জ হতে হতে সত্যিই একদিন দেওয়াল লিখিয়ে হয়ে যাবে, হয়ে যাবে পোড়া-কালো ইট। আহ! আর তো ভালো লাগে না এ জীবন! দরজায় টোকা পড়ল ভজার।

–এই ভজা, ভজা! বাড়ি আছিস?
–লুকিয়ে আছিস কেন শালা? বেরিয়ে আয় শিগগির।
–এক থেকে দশ গুনব। না বেরোলে কিচাইন হয়ে যাবে।
–আমাদের দেওয়ালে রং লাগিয়েছিস বাঞ্চোত?
–কই ডাক এবার তোর সুবলদাকে। দেখি কত কষ!
–সুবলদার চোদ্দ গুষ্টিও তোকে পোঁচে না রে হারামি!
–শুয়োরের বাচ্চা, রং এবার গুঁজে দেব আচ্ছেসে!
–তারপর তোর সুবলদার পার্টিকে গুঁজব।
–এক… দুই… তিন…

মেঘের গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠে ভজা। পেট মোচড় দিয়ে বমি পায়, কান্না পায়, জট পাকিয়ে যায় তার অন্তরাত্মা। কী করবে ভজা? পারবে এই প্রলয়ের সঙ্গে লড়ে নিতে? একা একা!

ভজা বুঝি আগে থেকেই জেনেছিল এমনটা হবে। আজকেই হবে। গোল বেঁধেছে। সুবলদার ফোন সুইচড অফ। কোথায় ভালো মানুষ! কোথায় সেই প্রতিশ্রুতি! কোথায় গেল সুবলদার ছেলেরা! খোলস, শুধু খোলসেরা পায়চারি করছে পৃথিবী জুড়ে। ভজার ঘরের সামনে বিপক্ষ, ঘরের সামনে মাথায় ফেট্টিবাঁধা ছেলে, ওদের কাছে পিস্তল, হকি স্টিক, ওদের কাছে মৃত্যু, কিংবা ওরা নিজেরাই একেকটা মৃত্যু!

অনেক দিন পরে আজ খুশির জন্যে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভজার। সেইদিন রাগের মাথায় পেটে লাথিটা না মারলেই বুঝি বেঁচে যেত আজ। এই কদর্য স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরে সাঁতরে ঠিক একটা পাড়ের সন্ধান মিলে যেতই। একটা সম্বল, খুশির কালি কালি গায়ে দুধে-আলতা রং খুব মনে পড়েছে আজকে। ইঁদুরমারা বিষের শিশিটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!

–লাস্টবারের মতো বলছি ভজা, বেরিয়ে আয়।
–আট… নয়…
–খুব ভুল করছিস ভজা! আজ কিন্তু বাওয়াল হয়ে যাবে।
–সাড়ে নয়… আর দশ। এবার তুই খতম!

টালির চালে দুমদাম ইঁট পড়তে শুরু করল। টিনের দরজায় লাথির শব্দে শিউরে উঠল পাশের বাড়ির অনেকে। শিউলিগাছের ডালগুলো মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে দিল ওরা। কাঠের জানলার পাল্লা এক লাথিতে ভেঙে নিয়ে, সেটা দিয়েই চলল দরজায় আঘাত, পাতলা টিনের দরজার লাথি, সশব্দ হকি স্টিক, আরও ইট, আরও খিস্তি…

খানিক পরে, পরাজিতের মতো ঘরের ভেতর থেকে বেরোল ভজা। হাতে লাল-নীল রঙের কৌটো আর একগাদা তুলি। দরজা খোলার পর পরই বৃষ্টির তেজ বাড়তে শুরু করল। গোটা আকাশ যেন মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ল ভজার ঘরের ওপর। কোনও অপার মন্ত্রবলে ওদের পা টলে যায়, মন টলে যায়, হাত টলে যায়, ভজার গায়ে হাত দিতে কেউ সাহস পায় না।

আটটা ছেলে ভজার সামনে। ভজার মুখের দিকে তারা তাকিয়ে আছে অপার বিস্ময়ে, বায়োস্কোপের নলে চোখ রেখেছে যেন। আর ভজা তাদের চোখে, সমস্ত শরীরে ছিটিয়ে দিচ্ছে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ আরও কত কত রং। নাকের ডগায় তুলির আঁচড়ে ভজা বের করে নিয়ে আসছে তাদের ভেতরের পশুকে। বেরিয়ে পড়ছে রক্ত, ক্ষমতা, আকাঙ্খা, মৃত একেকটা সত্তা। বৃষ্টির ছাঁটে ধুয়ে গেল তাদের কোমরে গোঁজা রিভলভার, হকি স্টিক… ভজা আজকে ছবি আঁকবে ভালো মানুষের।

কে বলে ভজা ফুরিয়ে গেছে! ভজাদের ফুরিয়ে যেতে নেই। পাগলাকুত্তাকে বাগে আনা অতই সহজ সুবলদা?

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একটা ছায়া পথে নামল। সত্যিকারের ছায়া। ভয়ের আগল ভেঙে ছিটকে বেরোনো ভজা আজ স্বাধীন। সে সম্পূর্ণ স্বাধীন, সেই তৃষ্ণার্ত দাঁড়কাকটার মতো অদ্ভুত স্বাধীন!

কী মারাত্মক ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে আজ খুশিকে। ভ্রূণের গন্ধে মাতলামি করতে ইচ্ছে করছে। আর ভজা দেওয়াল লিখবে না। ভজা ছবি আঁকবে। ভালো মানুষের ছবি আঁকবে— পশু নয় যারা, যারা প্রাণোচ্ছল, খুশির মুখের মতো। বৃষ্টি পড়ছে, খুব বৃষ্টি পড়ছে…

অনেক রাতে ভজার রক্তাক্ত শরীরটাকে তুলে ধরার জন্যে কেউ এল না। মিশকালো বিড়াল গত তিনদিনের বাসি ভাতের হাঁড়ির মধ্যে গড়াগড়ি খেল মনের আনন্দে।