Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তিনটি অণুগল্প

প্রদীপ ঘটক

 

ডায়েরি

অনির্বাণকে প্রথম দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে, শেষ বেঞ্চে।

একটা ডায়েরি, ডায়েরি ভরা কবিতার মেলা। আমি পড়তাম, শুনতাম। প্রেম-বিরহ-সমকাল, অদ্ভুত ধারালো ছিল কলম। তবে দুর্বোধ্য নয়।

একসময় ফেসবুকেও সেলেব হয়ে উঠেছিল অনির্বাণ। পেজের নাম ছিল ‘ডায়েরি’। তীক্ষ্ণ ভাষায় মজেছিল নেটিজেনরা। বইও বেরিয়েছিল কয়েকটা।

মজেছিল কবিতাও। ইনবক্স-কৃষ্ণচূড়াতলা-ভিক্টোরিয়া-নির্জন দুপুরে শহর কলকাতার গলি পেরিয়ে একসময় তারা এল এক ছাদের তলায়।

তারপর দিন কেটেছে। কয়েকদিন অনির ডায়েরি-র নোটি পাইনি।

আরও কয়েকদিন না পেয়ে ইনবক্সেই একদিন প্রশ্ন করলাম— কোথায় তুই? কোথায় তোর কবিতা?

ওপার থেকে উত্তর আসেনি।

ফেসবুকে আজকাল অনির্বাণের ‘ডায়েরি’ শূন্য হয়ে পড়ে আছে। শেষ কবিতা দুই বছর আগে।

সন্ধান করে একদিন পৌঁছে গেলাম ওর বাসায়। আনমনা অনির্বাণ টেবিলে। দুপাশে সারি সারি ডায়েরি।

সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম— কবিতা কই?

নির্লিপ্ত উত্তর দিল— পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে।

–তোর কবিতা কই?

অনি উত্তর দেয় না। অনেক প্রশ্ন করি, তবু উত্তর নেই।

অধৈর্য হয়ে ওর একটার পর একটা ডায়েরি নিয়ে ঘাঁটতে থাকি। কিন্তু একটা ডায়েরিতেও কবিতা নেই।

ডায়েরির পাতা জুড়ে শুধু সংসারের হিসাব।

 

ছুরি

–মা, দাদা কোথায়?

বিরক্ত মা বলে— জানি না যা। যে যমের দুয়ারে গেছে যাক্, আর যেন না ফেরে।

গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সোমার। দাদাই যে তার সব।

অ্যাবনর্মাল দাদা জন্মাবার পর বাবা-মা ভেঙে পড়ে। কত আশা ছিল বুড়ো বয়সে ছেলে রোজগার করে খাওয়াবে। কিন্তু…

তাই আরেকটা চেষ্টা। কিন্তু এবার মেয়ে। মাথায় বাজ পড়ে বাবা মায়ের। তারপর থেকেই মায়ের বিমাতৃসুলভ আচরণ। বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাবাও নৃশংস হয়ে উঠছে দিন দিন। মদ্যপ বাবাও মায়ের অনুগামী। সব অপরাধ ওই ভাই-বোনের।

দাদাই বুকে করে আগলে রাখে বোনকে। কিন্তু দাদা মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে, কখনও পাঁচ দিন, কখনও সাত দিন।

ফিরলেই মা বলে— আবার এলেন আমার হাড়-মাস এক করতে।

দাদা আড়ালে কাঁদে, সোমাও। সান্ত্বনা দেয়— দাঁড়া আমার কলেজে পড়া শেষ হোক। একটা কাজ জুটিয়ে তোকে নিয়ে চলে যাব।

আজ পনেরো দিন পেরিয়ে গেল। দাদা ফেরেনি। উৎকণ্ঠা পাথরের মত চেপে বসেছে সোমার বুকে।

আজ খেতে বসে মাকে দৃঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করে— মা, সত্যি করে বলো, দাদা কোথায়?

উত্তর দেওয়ার বদলে মা গরম তরকারির বাটি ছুড়ে দেয় সোমার দিকে।

আর সহ্য হয়নি সোমার। টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে সোজা চালিয়ে দেয় মায়ের গলায়।

মায়ের দেহটা টানতে টানতে নিয়ে যায় বাড়ির পিছনে। শীতের রাত। ডোবার জল, পাড়ের গাছে এক অদ্ভুত শীতলতা। মানকচুর পাতা থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে শিশির।

সোমা ধাপা চালায় মাটিতে শরীরের সব শক্তি জড়ো করে। কয়েকবার ধাপা চালাতেই বেরিয়ে পড়ে একটা হাত। যে হাতে সে বহুবছর রাখি বেঁধে এসেছে।

এতক্ষণে ডুকরে ওঠে সোমা।

গভীর রাতে মদ্যপ বাবা বাড়ি ফেরে। জিজ্ঞাসা করে— তোর মা কোথায়?

সোমার হাতে আবার ছুরি উঠে আসে।

 

ভিনগ্রহের গপ্পো

চুলের মুঠি ধরে সপাটে একটা চড় মেরে অফিসার বললেন— এটা দেখেছিস?

সূরজ নিজেকে সামলে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে দেখল পকেটের স্টিকারটা— অনিল খন্না।

–আমার ভয়ে অপরাধীরা কাঁপে। যা জিজ্ঞাসা করব সঠিক উত্তর দিবি।

মাথার কাছে ঝুলন্ত বাল্বটা দুলছে। চেয়ারে লেপ্টে বাঁধা সূরজ। খালি গায়ে অজস্র কালশিটে। ঠোঁটের এককোণে রক্ত নেমে আসছে।

–কতদিন চালাচ্ছিস এসব?

হাঁফাচ্ছে সূরজ। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। বিস্ফারিত ভয়ার্ত চোখে বলল— প্রায় তিন বছর।

–কতগুলো খদ্দের জুটিয়েছিলি?
–প্রায় তিনশো…
–সব্বাই ইনবক্সে আসত?
–না, তবে প্রায়জনই আসত।
–ছবিগুলো কার?
–জানি না। তবে অ্যাকাউন্টটার নাম ছিল আয়েশা…
–আর নেকেডগুলো?
–নেট থেকে।
–মিট করেছিস কারও সঙ্গে?
–মিট করলে তো ধরা পড়ে যেতাম।
–কেউ মিট করতে চাইলে?
–ইগনোর করতাম।
–কেন করতিস এসব? জানতিস না এটা ক্রাইম?

সূরজ মাথা নামায়। লম্বা চুল ঝুলে পড়ে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল জিনসের প্যান্টে পড়ে।

–কী রে? উত্তর দিচ্ছিস না? চুপ কেন? জানতিস না?
–হ্যাঁ স্যর, জানি।
–তাহলে?

সূরজ অসহায় চোখে অফিসারের দিকে তাকায়।

–কী আনন্দ পেতিস দেখে?
–তার বেশি আর তো কিছু পাওয়ার ছিল না।
–তাহলে? কেন করতিস এসব?

সূরজ আবার মুখ নামায়। অফিসার চুলের মুঠি ধরে তুলে আবার সজোরে চড়— উত্তর দে। জানিস কত বড় শাস্তি হতে পারে তোর?

সূরজ ভিরমি খায়। তারপর চিৎকার করে বলে— কী করব? আমি স্বাভাবিক নই। সমাজ মেনে নেবে না, অপরাধ ভাববে, টিটকারি দেবে, কিন্তু আমি কী করব? আমি তো প্রকাশ্যে বলতেই পারি না, আমি ছেলেদের পছন্দ করি, কী করতাম, কী করতাম বলে দিন প্লিইইইজ, মারুন মারুন, মেরে ফেলুন, এ জীবন রাখতে চাই না।

–তোর মত তো অনেক আছে, তাদের খোঁজ।
–পাইনি, যাদের পেয়েছি পছন্দ হয়নি। যাদের পছন্দ তারা ঘৃণা করে।

অফিসার কোমরের বেল্ট ধরে প্যান্টটা একটু তুলে নেন। একটা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন— তুই টপ না বটম?

মাথা নামিয়ে সূরজ বলে— বটম।

অফিসার নিজের চেয়ারে ফিরে যান। কিছু লেখালেখি করেন। ফিরে এসে বলেন— আজ তোকে আমার কোয়ার্টারে নিয়ে যাব। আমি একাই থাকি।