Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লজ্জায় ভেঙে পড়েছে বামিয়ানের বুদ্ধ

লজ্জায় ভেঙে পড়েছে বামিয়ানের বুদ্ধ -- মোহসেন মকমলবাফ

মোহসেন মকমলবাফ

 

ক্ষুধাশিল্পের দেশ আফগানিস্তান। আজ প্রায় দু-দশক পরে আফগানিস্তান আরেকবার সংবাদ শিরোনামে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের মাটি থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে মাৎসন্যায়। এই সুযোগে আমরা ফিরে পড়লাম চিত্রনির্মাতা মোহসেন মকমলবাফ-এর অভিজ্ঞতা-প্রসূত পুরনো একটি লেখাকে। কেমন ছিল কুড়ি বছর আগের আফগানিস্তান ও তার নাগরিকরা? মকমলবাফের মর্মস্পর্শী লেখনীটিকে বাংলায় তর্জমা করেছিলেন লেখক পরিমল ভট্টাচার্য, যা তাঁর 'যন্ত্রণার উত্তরাধিকার' গ্রন্থে (প্রকাশক: অবভাস) সঙ্কলিত হয়েছিল ২০১০ সালে৷ চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে পরিমলবাবুর সহৃদয় অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত হল সেই লেখা।

২০০৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম আমি। সেখানে আমার পরের ছবির বিষয় জানতে চাওয়া হল। যখন বললাম ‘আফগানিস্তান’, তার পরেই প্রশ্ন এল— ‘আফগানিস্তান কী?’

কেন এমন হয়? কেন একটা দেশ এমন অচল হয় যে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার অপর একটি দেশ কখনো এর নামই শোনেনি? কারণটা পরিষ্কার। পৃথিবীতে আফগানিস্তানের কোনো সদর্থক ভূমিকা নেই। কোনো একটি বস্তু কিংবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অথবা কোনো শিল্পকর্মের জন্য অর্জিত সম্মানের সঙ্গে নাম জড়িয়ে নেই এই দেশটির।

আমেরিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টা আলাদা। এখানে আফগানিস্তানকে একটি নির্দিষ্ট দেশ হিসেবেই দেখা হয়। এই নির্দিষ্টতারও অবশ্য কোনো সদর্থক দিক নেই। যারা আফগানিস্তানের নামটি চিনতে পারে, তারা তৎক্ষনাৎ দেশটিকে জড়িয়ে নেয় তালিবান, ইসলামি মৌলবাদ ও রাশিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষ আর গৃহযুদ্ধের সঙ্গে।

মন গড়া এই ছবিগুলিতে শান্তি, সুস্থিরতা কিংবা উন্নয়নের কোনো জায়গা নেই। তাই কোনো পর্যটক এই দেশে ভ্রমণ করার কথা স্বপ্নেও ভাবে না, কোনো ব্যবসায়ী এখানে মুনাফা করার কথা আশা করে না কখনো।

তাহলে দেশটা বিস্তৃতির আঁধারে থেকে যাবে না কেন? এর কুখ্যাতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শিগগিরই কেউ অভিধানে লিখতে পারে যে ‘আফগানিস্তান হল একটি মাদক-প্রস্তুতকারী দেশ যেখানে রুক্ষ, মারমুখী মৌলবাদীরা থাকে আর তারা তাদের নারীদের নিচ্ছিদ্র বোরখায় ঢেকে রাখে।’

এর সঙ্গে যোগ হবে বামিয়ানে পৃথিবীর উচ্চতম বুদ্ধমূর্তির ধ্বংস, যা সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তুলেছে। শিল্প-সংস্কৃতির ধারক-বাহকেরা মূর্তিটির জন্য সমবেদনায় মুখর হয়েছেন। কিন্তু একমাত্র জাতিপুঞ্জের হাইকমিশনার ওগাতো ছাড়া আর কেউ কেন দুর্ভিক্ষে মৃত ১০ লক্ষ আফগানিস্তানির জন্য দুঃখপ্রকাশ করেননি? এই মৃত্যুর কারণ নিয়ে কেন কেউ কোনো কথা বলেন না? কেন সবাই বুদ্ধমূর্তির ধ্বংস নিয়ে প্রতিবাদে মুখর, অথচ আফগানিস্তানে ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত্যু নিয়ে একটিও শব্দ খরচ করেন না? আজকের পৃথিবীতে কি একটি মূর্তি মানুষের চেয়েও দামি?

আমি গোটা আফগানিস্তান চষে বেরিয়েছি। এই দেশে জীবনের রূঢ় বাস্তব প্রত্যক্ষ করেছি আমি। ছবি-করিয়ে হিসেবে আমি ১৩ বছরের ব্যবধানে আফগানিস্তানের ওপর দুটি কাহিনিচিত্র বানিয়েছি (দ্য সাইক্লিস্ট, ১৯৮৮; এবং কান্দাহার, ২০০১)। এই ছবিদুটির জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে আমি বিভিন্ন বই এবং নথিপত্র মিলিয়ে প্রায় ১০,০০০ পাতা পড়েছি। স্বভাবতই বাদবাদি পৃথিবীর চেয়ে আমার চোখে আফগানিস্তানের ছবিটা ভিন্ন। আমার কাছে ছবিটা অনেক জটিল এবং মর্মান্তিক। কিন্তু তবুও এই ছবির ভেতর রয়েছে যে মানুষের ছবি, তা অনেক ধারালো হলেও কিন্তু সদর্থক এবং শান্তিকামী। এই ছবিটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে। বিস্মৃতি কিংবা অবদমন নয়।

***

 

একটি দেশ যখন সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে, তখন সেটা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। মিডিয়া মারফৎ একটি দেশের যে ছবি বিশ্বের দরবারে পৌঁছয়, তা আসলে বাদবাকি পৃথিবীর মানুষের কিছু বাছাই করা কাল্পনিক ধারণার সমষ্টি। পৃথিবীর কোনো দেশ যদি একখণ্ড জমির জন্য লোলুপ হয়, তাহলে প্রথমেই মিডিয়া মারফৎ জমি তৈরি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আজকের আফগানিস্তান সম্পর্কে আমি যা বুঝেছি তা হল, এখানে একমাত্র আফিমের বীজ ছাড়া অন্যের লালসা উস্কে দেবার মতো আর কিছুই নেই। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি। সেজন্য বিশ্বের সংবাদে আফগানিস্তানের প্রায় কোনো স্থানই নেই। এদেশের সমস্যার সমাধান তাই দূর অস্ত।

কুয়েতের মতো আফগানিস্তানেরও যদি তেলের খনি আর তেল থেকে বাড়তি আয় থাকত, তাহলে আমেরিকা তিনদিনেই দেশটাকে ইরাক থেকে ছিনিয়ে নিত। সেক্ষেত্রে আমেরিকান সৈন্য পোষার খরচটাও ওই বাড়তি আয়ের থেকেই আসত। যতকাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবং কমিউনিস্ট শাসনে নিষ্পেষিত হবার জন্য আফগানিস্তান পশ্চিমি দুনিয়ায় মিডিয়ার নজর কেড়েছে। সোভিয়েতরা তো কবেই চলে গিয়েছে এবং নিজেরাও খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গিয়েছে। তাহলে কেন মানবাধিকারের ধ্বজাধারী আমেরিকা এখানে এক কোটি নারীর শিক্ষা ও সামাজিক সক্ষমতা, কিংবা প্রাণঘাতী দারিদ্র‍্য আর দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে কিছু করে না?

এর উত্তর হল, নজর কাড়ার মতো আফগানিস্তানের কিছুই যে নেই। আফগানিস্তান একজন সুন্দরী নারী নয় যে পুরুষের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দেবে। দুঃখের বিষয়, আজ তাকে দেখতে এক বুড়ির মতো। আজ যদি তার কাছে কেউ আসে, তাকে এই রুগ্ন বুড়ির চিকিৎসার ব্যয়ভার বইতে হবে।

***

 

গত দু-দশকে আফগানিস্তানের বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোনো পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা যায়নি। সেজন্য সব তথ্য আর সংখ্যাই হল আপেক্ষিক ও আনুমানিক। যাই হোক, পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে জনসংখ্যা ছিল দু-কোটি। সোভিয়েত অনুপ্রবেশের পরে বিগত ২০ বছরে প্রায় ২৫ লক্ষ আফগানিস্তানি খুন হয়েছে ও মারা গিয়েছে। এই মৃত্যুর কারণ হল সেনা আক্রমণ, দুর্ভিক্ষ ও চিকিৎসার অভাব। অন্যভাবে বললে, প্রতি বছর ১২৫,০০০ জন মারা গিয়েছে, দিনে ৩৪০ জন, ঘণ্টায় ১৪ জন। অথবা, প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন মানুষ এখানে হয় খুন হয়েছে অথবা এই ট্র‍্যাজেডির শিকার হয়েছে। এ হল এমন এক পৃথিবী যেখানে কয়েক মাস আগে একটি হতভাগ্য রাশিয়ান সাবমেরিনের কর্মীদের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর খবর সারা বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে উপগ্রহ মারফৎ সম্প্রচারিত হয়েছে। অথচ বিগত ২০ বছর ধরে প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন আফগানিস্তানির মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা কেউ বলে না এখানে৷

আফগান উদ্বাস্তুদের ব্যাপারটা আরও ট্র‍্যাজিক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাকিস্তান ও ইরানে ৬৩ লক্ষের মতো আফগান উদ্বাস্তু রয়েছে৷ এই সংখ্যাটাকে যদি বছর, দিন, ঘণ্টা ও মিনিট দিয়ে ভাগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে বিগত ২০ বছরে প্রতি মিনিটে একজন আফগানিস্তানবাসী উদ্বাস্তু হয়েছে। এই পরিসংখ্যানে অবশ্য গৃহযুদ্ধের চাপে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে পলায়মান উদ্বাস্তুদের ধরা হয়নি।

আমি এমন কোনো দেশের নাম মনে করতে পারি না যেখানে অস্বাভাবিক মৃত্যু আর প্রচরণের কারণে যথাক্রমে জনসংখ্যার ১০ ৩০ শতাংশ মানুষ কমে গিয়েছে। অথচ সেই দেশটাই কিনা গোটা বিশ্বের কাছে এতটা অবহেলা পেয়ে এসেছে। মৃত আর উদ্বাস্তু মিলিয়ে সংখ্যাটা প্যালেস্টাইনের সর্বমোট জনসংখ্যার সমান। কিন্তু এমনকি ইরানের মানুষের আফগানিস্তানের জন্য সমবেদনা প্যালেস্টাইন কিংবা বসনিয়ার ১০ শতাংশও নয়। অথচ আমাদের ভাষা এক, দুই দেশের সীমানা এক।

দোঘারুন সীমান্তে সেনাচৌকি পেরিয়ে আফগানিস্তানে ঢোকার সময় পর্যটকদের জন্য একটি সতর্কবানী দেখেছিলাম। বলছে— ‘প্রতি ২৪ ঘণ্টায় সাতজন আফগান মাইনের ওপর পা দিয়ে ফেলে। সাবধান, আজ কিংবা কাল ওদের একজন হবেন না।’

রেডক্রশের একটি শিবিরে গিয়ে আমি আরও গুরুতর তথ্য পাই। কানাডা থেকে একটি দল এসেছিল মাইনগুলো অকেজো করতে। কাজটা এতটাই বিপুল আর ব্যপ্ত যে শীঘ্রই ওরা হতোদ্যম হয়ে ফিরে যায়। ওদের হিসেব অনুযায়ী আগামী ৫০ বছর আফগানিস্তানের মানুষকে দলবদ্ধভাবে মাইনের ওপর পা রাখতে হবে, তবেই দেশের জমি বিপন্মুক্ত ও বাসযোগ্য হবে। তার কারণ, প্রতিটি দল ও গোষ্ঠী সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীনভাবে কোনোরকম মানচিত্র ছাড়াই একে অপরের বিরুদ্ধে মাইন পুঁতেছে। সৈন্যরা যেভাবে যুদ্ধের সময় মাইন পোঁতে ও যুদ্ধ মিটে গেলে তুলে নেয়, সেভাবে নয়। এছাড়া প্রবল বৃষ্টিপাত হলে মাইনগুলো সরে যায়, নিরাপদ রাস্তাও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

আফগানিস্তানে বেঁচে থাকার পরিবেশ যে কতখানি বিপজ্জনক, এই পরিসংখ্যানগুলো থেকে সেটা স্পষ্ট৷ সেজন্য এখানকার মানুষ অবিরাম দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ তারা মনে করে এখানকার পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। অনাহার আর মৃত্যুর ভয় সব সময়েই রয়েছে। মানুষ ছেড়ে চলে যাবে না কেন? যে দেশে ৩০ শতাংশ মানুষ উদ্বাস্তু হয়, সেদেশের ভবিষ্যৎ খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। যে ৭০ শতাংশ থেকে যায়, তার মধ্যে ১০ শতাংশ মারা যায় আর বাদবাকি ৬০ শতাংশ সীমান্ত পার হতে পারে না বলে থেকে যায়। যদিও-বা পারে, প্রতিবেশী দেশগুলো আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

***

 

আমি হেরাত শহরের আশেপাশে ২০,০০০ পুরুষ, নারী ও শিশুকে অনাহারে মারা যেতে দেখেছি৷ মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল ওরা, চলচ্ছক্তিহীন, অবশ্যম্ভাবী পরিণতির অপেক্ষায়। এ হল সাম্প্রতিক দুর্ভিক্ষের ফল। সেইদিনই জাতিপুঞ্জের উদ্বাস্তু বিভাগের হাইকমিশনার, জাপানের সাদাকো ওগাতো এই মানুষগুলিকে দেখতে আসেন। সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। তিনমাস পরে ইরানের রেডিও মারফৎ জানতে পারি, শ্রীমতী ওগাতো বলেছেন সারা আফগানিস্তানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা ১০ লক্ষ।

এসবের থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে: বামিয়ানের বুদ্ধ কেউ ধ্বংস করেনি, লজ্জায় নিজেই ভেঙে পড়েছে মূর্তিটা। আফগানিস্তানের প্রতি বিশ্বের অবজ্ঞার জন্য লজ্জা। এই মহত্ব কোনো কাজেই এল না, এটা বুঝতে পেরে ভেঙে পড়েছে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি।


*বানান অপরিবর্তিত