Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডারউইনের ডায়েরি— গ্যালাপাগোসে কয়েকদিন

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

 

১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্লাইমাউথ থেকে জাহাজ এইচ এম এস বিগল যাত্রা শুরু করে। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল অক্ষরেখার বিশদ পরিমাপ করা এবং নানা স্থানে ভূ-তাত্ত্বিক, জীববিজ্ঞান ও নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা করা। দক্ষিণ আমেরিকার শেষতম বিন্দু তিয়েরা দেল ফুয়েগো অবধি যাবে এ জাহাজ। ২২ বছর বয়সী উৎসাহী যুবক চার্লস ডারউইন জুড়ে গেলেন্ এই অভিযানের সঙ্গে, যা তাঁর জীবনের প্রথম সমুদ্রযাত্রা। বিগলের যাত্রার প্রস্তাবিত সময়সীমা ছিল দু বছর, কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর পরে বিগল ঘরে ফেরে। যাত্রাপথের জায়গায় জায়গায় জীববৈচিত্র নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ ও নোটস ডারউইন লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন তাঁর জার্নালে। বস্তুত, এই জার্নাল বা নোটবুক-ই ভবিষ্যতে আক্ষরিক অর্থে ডারউইনের যুগান্তকারী তত্ত্ব বিবর্তনবাদের ভিত্তি নির্মাণ করে দিল। নিজের অজ্ঞাতেই বাইবেল-কথিত সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধিতা করে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন ডারউইন। সেদিক থেকে দেখলে, সভ্যতার দিশা চিরতরে বদলে দিয়েছিল এইচ এম এস বিগলের এই সমুদ্রযাত্রা।

ডারউইনের অসম্পাদিত মূল ডায়রি ও নোটবুক অবলম্বনে ‘ডারউইনের ডায়েরি’ বইটি রচনা করেছেন দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য। লেখকপ্রদত্ত বিস্তারিত টীকা ও ব্যাখা বইটির মূল্য বাড়িয়েছে। এমন একটি অমূল্য সম্পদকে সম্ভবত প্রথমবার বাংলাভাষার পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ধন্যবাদার্হ হয়ে রইলেন লেখক ও প্রকাশক। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর হুইলার্স বিভাগে প্রকাশিত হল বইটির নির্বাচিত অংশ।

ডারউইনের ডায়েরি
লেখক – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
প্রকাশক – জয়ঢাক
প্রকাশকাল – এপ্রিল ২০২১
মূল্য – ৩০০ টাকা

২৩-২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৫

উপসাগর পেরিয়ে চার্লস দ্বীপে (এখনকার নাম আইলা ফ্লোরেনা— গ্রন্থকার) এসে নোঙর করা হয়েছে। বছর পাঁচ-ছয় যাবত এখানে একটা ছোটো জনবসতি গড়ে উঠেছে। মিস্টার লসন নামে একজন ইংরেজ (নিকোলাস ও’ লসন। ইকোয়েডর সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন সেখানে— গ্রন্থকার) এখন তার গভর্নর হিসেবে কাজ করছেন। সকালে একটা তিমিশিকারী জাহাজ পরিদর্শনের জন্য জেটিতে এসেছিলেন। আমাদের দেখতে পেয়ে সঙ্গে করে বসতিতে নিয়ে এলেন।

২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৩৫

বসতিটা উপকূল থেকে প্রায় সাড়ে চার মাইল ভেতরে, দ্বীপের একেবারে মাঝখানটায় গড়ে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় হাজার ফুট উঁচুতে। দ্বীপে আসবার পথে প্রথমে পড়ল চ্যাথাম দ্বীপের মত পাতাঝরা ঝোপঝাড় ঢাকা একটা এলাকা। শুকনো আগ্নেয় মাটিতে গিরগিটি জাতীয় প্রাণী ছাড়া আর বিশেষ কোনো জীবজন্তু নেই।

তারপর যত উঁচুর দিকে উঠছিলাম, ততই গাছপালার ভিড় বেড়ে উঠছিল। দখিনা বাণিজ্যবায়ুর ঠান্ডা ছোঁয়ায় ভারি আরাম ঠেকছিল শরীরে। জমিও ক্রমশই বসন্তের ইংল্যান্ডের মত সবুজ হয়ে উঠছিল। বসতি এলাকায় পৌঁছে দেখি, সেখানে অনেকটা এলাকা সাফ করে তাতে কলা আর মিষ্টি আলুর চাষ হয়েছে। খেতখামারের ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘরগুলো দেখলে হঠাৎ করে মনে হবে, চিলির কোনো ‘পুয়েবলো’-তে এসে হাজির হয়েছি। ব্রাজিল ছাড়বার পর থেকে এমন সুন্দর কোনো ক্রান্তীয় ল্যান্ডস্কেপ আমাদের চোখে পড়েনি এতদিন। শুধু এখানে ও-এলাকার মত বড়ো বড়ো অপূর্ব সুন্দর গাছপালা কিছু নেই।

তবে তাতে আমাদের কোনও আক্ষেপ ছিল না। পেরু আর উত্তর চিলির দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর ফের একবার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কালো কাদা, গাছের গায়ে মসের আস্তর আমাদের চোখে ভারি শান্তির প্রলেপ দিচ্ছিল।

সম্ভবত বছরের এই সময়টা খানিক অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলেই সে-জায়গাটা অত স্বভাব-বহির্ভূতভাবে সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছিল আমাদের চোখে। তার একটা প্রমাণ হল, এত সবুজের ছড়াছড়ির মধ্যে কীটপতঙ্গের অভাব। স্বভাবত সবুজ কোনো জায়গায় এটা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ।

বসতির জনসংখ্যা বড়োজোর দু-তিনশো হবে। তাদের প্রায় সবাই অ-শ্বেতাঙ্গ। প্রায় সকলেই ইকোয়েডরের কুইটো বা গুইয়াকুল জাতীয় বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজনৈতিক অপরাধের সাজা পেয়ে নির্বাসনে এসেছে এখানে।

তবে লোকজন দেখলাম মোটেই আনন্দে নেই। চিলির মতই এখানেও তাদের প্রধান অভিযোগ, নগদ টাকাপয়সার অভাব। তবে অভাবটা আমার মনে হয় শুধু নগদের নয়। তাদের উৎপাদন করা জিনিসপত্র বিক্রি করবার মত কোনো বাজার যে এখানে নেই, সেটাও একটা বড় কারণ। তবে এ-অভিযোগ আস্তে আস্তে কমে আসবে। এ-বছরেই অন্তত ষাট-সত্তরটা তিমিশিকারী জাহাজ এখানে নোঙর করেছে রসদ কেনবার জন্য। সেটা আরো বাড়বে।

এখানকার আসল সমস্যাটা হল জলের অভাব। সরু সরু জলধারাগুলো খুব কম জায়গাতেই সমুদ্রকূল অবধি গিয়ে পৌঁছোয়। আগ্নেয় পাথরের ঝাঁঝরা ত্বক আকাশ থেকে ঝরা সামান্য বৃষ্টির জলের বেশির ভাগটাই শুষে নেয়, কিন্তু তা আর ফেরৎ দেয় না।

দ্বীপের জলের উৎস বলতে গুটিকয় ঝরনা আর পুকুর৷ ওর মধ্যে কেবল তিনচারটে উৎসেই সারাবছর জল থাকে৷ প্রশান্ত মহাসাগরের আর দশটা দ্বীপের মতই এই দ্বীপটাও সম্ভবত বারংবার খরা আর অনাবৃষ্টির কবলে পড়ে। সব মিলিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের জীবন অনেকটা রবিনসন ক্রুসোর জীবনের মত করেই কাটে।

এদের ঘরবাড়ি খুব সরল গড়নের। কাঠের খুঁটির ওপরে ঘাসপাতার ছাউনি দিয়ে গড়া। জঙ্গলে বুনোশুয়োর আর ছাগল মেলে। তাই শিকার করে লোকজনের অনেকটা সময় কাটে৷ চাষবাস বিশেষ নেই৷ মাংস বলতে প্রধানত কচ্ছপ।

দুদিন শিকার করলে পাঁচদিন ধরে খাবার মত কচ্ছপের মাংস জড়ো করা যায় এখানে। তবে হ্যাঁ৷ এখনো কচ্ছপের সংখ্যা এখানে অনেক হলেও আগের চাইতে তা বেশ খানিক কমেছে। কয়েক বছর আগে একটা জাহাজ এখানে এসে নোঙর করে এক বেলায় দুশোটা কচ্ছপ মেরে নিয়ে গিয়েছিল৷ এখন যেখানে এদের বসতি, আগে সেখানটায় অসংখ্য কচ্ছপের আস্তানা ছিল।

এখনও যা আছে তাতে মিস্টার লসনের অনুমান আরো কুড়ি বছর ওই খেয়েই হেসেখেলে কেটে যাবে দ্বীপের বাসিন্দাদের। ভদ্রলোক জানালেন, কাছেই জেমস দ্বীপে (জেমস কথাটা এখনও ব্যবহার করা হয়। ওর স্প্যানিশ বিকল্প নাম হল স্যান্টিয়াগো — গ্রন্থকার) একটা নুনের খনি আছে৷ তাই সেখানে তিনি একটা দল পাঠিয়েছেন কচ্ছপের মাংস নুনে জারিয়ে আনবার জন্য।

তার দরকারও আছে৷ কারণ কচ্ছপগুলো আয়তনে বিশাল। কখনো কখনো একেকটার থেকে প্রায় দুশো পাউন্ডের বেশি মাংসও পাওয়া যায়৷ তিনি নাকি একবার একটা কচ্ছপ পেয়েছিলেন যেটাকে মাটি থেকে তুলতে ছজন জোয়ান হাঁফিয়ে গিয়েছিল। দুজন মানুষ মিলে জোর লাগিয়েও নাকি সেটাকে চিৎ করতে পারেনি৷ কাজেই সে-মাংস একবারে খাওয়া যায় না৷ জমিয়ে রাখতে হয়। তাই নুনে জারানো।

এই বিরাট প্রাণীগুলো বয়েসেও বেশ প্রাচীন। ১৮৩০-এ একটা কচ্ছপ মিলেছিল, যেটাকে নৌকোয় তুলতে ছ’জন মানুষ লেগেছিল। দেখা গিয়েছিল সেটার খোলের গায়ে বেশ কয়েকটা তারিখ খুদে রাখা আছে। তার মধ্যে একটা তারিখ হল ১৭৮৬।

সে-সময় সেটা ধরা পড়েও প্রাণ হারায়নি কেন সে-বিষয়েও একটা ব্যাখ্যা দিলেন মিস্টার লসন।

বলেন, সে-সময় তিমিশিকারী জাহাজ থেকে পাড়ে শিকারে আসবার যে নৌকো আসত, তাতে দুজন করে লোক থাকত। সম্ভবত কচ্ছপটা সে-সময়েও এতটাই বড়ো ছিল যে দুজন মানুষ মিলে তাকে নৌকোয় তুলতে পারেনি।

 

২৬-২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৫

দ্বীপ থেকে খুঁজেপেতে গাছপালা, পোকামাকড়, সরীসৃপের নমুনা জোগাড় করেছি মন দিয়ে।

এই দ্বীপমালার বিচিত্র জীবজগতের উৎস ঠিক কোন এলাকার জীবমণ্ডলে রয়েছে সেটা পরে তুলনা করে দেখতে হবে। ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয় কাজ হবে একটা।

দ্বীপটার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা প্রায় ২০০০ ফিট খাড়াই। তার মাথার দিকটা ঘাস আর গুল্মে ছাওয়া। জায়গাটার চেহারা দেখলেই মালুম পড়ে একসময় ওখানে একটা জ্বালামুখ ছিল।

দ্বীপটা বেজায় ছোটো, কিন্তু তাও খুঁজেপেতে দেখেছি এতে উনচল্লিশটা শঙ্কু আকারের টিলা রয়েছে। প্রত্যেকটার মাথাতেই মোটামুটি একটা করে গোলাকার ঢালু গর্ত।

যে লাভাস্রোতে এই দ্বীপের নিচের এলাকাটা তৈরি, তা এইসব জ্বালামুখ থেকে বহুকাল আগেই বয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে তা মসৃণ হয়েছে, গড়ে উঠেছে উর্বর মাটি, সৃষ্টি করেছে গাছগাছালির।

এ-লাভাদের বেশির ভাগটাই সমুদ্রের তলা থেকে উঠে আসা বলে আমার অনুমান।

এইখানটায় ডারউইনের ডায়েরি থামিয়ে একটা অন্য প্রসঙ্গে খানিক বলে নেয়া যাক:

গ্যালাপাগোস ছাড়বার চার মাস পরে সিডনি থেকে হেন্সলোকে লেখা এক চিঠিতে ডারউইন বলেছিলেন, “গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে খুব খেটেছি আমি। যে যে গাছে ফুল দেখতে পেয়েছি তার সবগুলোর নমুনা সংগ্র‍হ করেছি। সে-সময়টায় ওখানে ফুল ফোটবার ঋতু, কাজেই মনে হয় বেশির ভাগ উদ্ভিদেরই ফুলের নমুনা জোগাড় করা গিয়েছে৷ আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে যে এই উদ্ভিদদের আদি বাসস্থান আমেরিকাই, নাকি অন্য কোথাও। এখানকার পাখপাখালিদেরও আমি বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি৷ আমার সন্দেহ ওখানেও কিছু অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে।” এর পরবর্তীকালে ১৮৩৬ এর মাঝামাঝি নাগাদ ডারউইন যখন পাখিদের ওপরে তাঁর নোটগুলি তৈরি করছেন তখন তিনি লিখছেন: “থেনকা (মাইমাস থেনকা)— এই পাখিগুলোর সঙ্গে চিলির  থেনকা-দের গভীর মিল। ছটফটে, কৌতূহলী, দারুণ জোরে ছোটে, লোকজনের ঘরবাড়িতে ঢুকে ঝুলিয়ে রাখা কচ্ছপের মাংস ঠুকরে খেয়ে পালায়, মোটামুটি ভালো গান গায়, সাদাসিধে খোলামেলা বাসা বাঁধে, ভারী পোষমানা জাতের। তবে আমার কেমন যেন মনে হয়েছে এদের ডাক চিলির থেনকাদের চাইতে খানিক আলাদা। চারটে বড়ো দ্বীপ থেকে আমি এদের নমুনা জোগাড় করেছি। চ্যাথাম আর আলবেমার্ল থেকে যে নমুনা পেয়েছি সেগুলো মোটামুটি একইরকম, কিন্তু অন্য দুটো দ্বীপের নমুনাগুলোতে বেশ কিছু তফাৎ রয়েছে। একেকটা জাতের নমুনা কেবল এক একটা দ্বীপেই মেলে। অন্যত্র নয়।

একটা আকর্ষণীয় উদাহরণ দিই, স্প্যানিয়ার্ডরা কিন্তু কোনো কাছিমের আকৃতি, আঁশ, আকার এইসব দেখেই বলে দিতে পারে সেটা কোন দ্বীপ থেকে আনা। পাখিদের ক্ষেত্রেও তাই। যে দ্বীপগুলো থেকে পাখিদের নমুনা আমি নিয়েছি সেগুলো সব কাছাকাছি ছড়ানো। প্রত্যেকটাতেই জীবজন্তুর সংখ্যা সীমিত। অথচ সেই কাছাকাছি দ্বীপগুলোতেই প্রায় সদৃশ পাখিদের চেহারায় এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে সামান্য বদল দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এরা আলাদা আলাদা প্রজাতি নয়৷ এরা আসলে একটাই প্রজাতির পাখি, শুধু তাদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক কিছু আলাদা আলাদা শারীরিক বিশিষ্টতা দেখা দিচ্ছে (পরে ইংল্যান্ডে ফেরবার পর এই ভুল ভেঙেছিল তাঁর। ভাঙিয়েছিলেন এক পক্ষিতত্ত্ববিদ। তবে সে-কথা যথাসময়ে হবে— গ্রন্থকার)।

Testudo Abingdonii, Galapagos Islands

মূল ভূখণ্ডে এমন উদাহরণ এই মুহূর্তে একটাই মনে পড়ছে আমার, সেটা হল, পূর্ব আর পশ্চিম ফকল্যান্ড দ্বীপে নেকড়ের মত দেখতে খ্যাঁকশেয়াল। যদি আমার এই অনুমানটায় একটুও সত্যতা থাকে তাহলে কিন্তু এই দ্বীপপুঞ্জের জীবজগতকে আরো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করাটা জরুরি হয়ে পড়বে।


*বানান অপরিবর্তিত। ছবিগুলি মূল বই থেকে গৃহীত