জুবি সাহা
বামপন্থী গণ-আন্দোলনের কর্মী, ‘অধিকার’ সংগঠনের সদস্য
চিত্র ১:
আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম ঘেঁষা দেশ ক্যামেরুন। সাম্প্রতিক খবরে দেখা যাচ্ছে আড়াই কোটি জনবসতির এই দেশের সাধারণ মানুষ হঠাৎ খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। কোথাও তাঁরা পুলিশকে চ্যাংদোলা করে ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়ে ঘুরছেন আবার কোথাও পুলিশকে ট্রাকের সামনে দেখতে পেলেই চাকার নীচে ফেলে দিচ্ছেন। মজার ব্যাপার তাঁরা এই জাতীয় কাজ গোপনে করছেন না, রীতিমতো উৎসবের আনন্দে সমবেতভাবে হাততালি দিতে দিতে এই কাজগুলো করছেন এবং সেই ভিডিও নিজেরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন। মানবাধিকার কর্মী ক্রিস্টোফার বলছেন, পুলিশের ঘুষ নেওয়া, অকারণ নির্যাতন-দমন পীড়ন এবং কার্যক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তা চরম পর্যায়ে পৌঁছনোর জন্যই জনগণ এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
চিত্র ২:
দিনকতক আগে মাঝরাতে ভাঙড়ে সব্জি কিনতে গিয়ে পুলিশের তোলাবাজির খপ্পরে পড়েন সব্জিবিক্রেতা, তেইশ বছরের যুবক মহম্মদ আলাউদ্দিন। চোদ্দ হাজার টাকা দিতে না পেরে প্রাণ ভয়ে পালাতে গিয়ে পচা খালে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর। উর্দিধারীদের রাতজাগা পরিশ্রমের এই ফসলের সঙ্গে নেতার, নেতার সঙ্গে মন্ত্রীর, মন্ত্রীর সঙ্গে কোনও কেন্দ্রের নিবিড় যোগাযোগ থাকে, আর এই সব যোগাযোগ একসঙ্গে গিঁট লেগে ফাঁস হয়ে ঝুলছে জনসাধারণের গলায় (‘বেকারের চিঠি’)!
চিত্র ৩:
স্থানীয় তোলাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বেনিয়া-বৌ গ্রামের অধিবাসী অশোকনগর থানার ক্যাম্প-ইন-চার্জ সুরাফ হোসেনকে উলঙ্গ করে কুরবানির দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে পেটাতে পেটাতে, তাঁর স্ত্রী তানিয়া পারভিনের গর্ভস্থ সন্তানকে নষ্ট করে এবং তাঁদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের একইভাবে অত্যাচার করে গ্রেপ্তার করেছে সোনারপুর থানার পুলিশ। মারতে মারতে পুলিশ বলেছে “মোল্লার বাচ্চা, তোর পুলিশের চাকরি কী করে থাকে দেখে নেব।” সুরাফ হোসেনকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
চিত্র ৪:
বেতন সংস্কার এবং স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রথমে সবাইকে দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গে বদলি এবং এই বেআইনি বদলির বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে মাঝরাতে শিক্ষিকাদের ঘরে ঢুকে বাথরুমের দরজা ভেঙে লালবাজারে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরেও শিক্ষামন্ত্রীর দেখা না পেয়ে যখন তাঁরা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে যান, তখন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তাঁরা সবাই হয়ে যান ‘বিজেপির ক্যাডার।’ আজও ওই শিক্ষিকারা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, যদিও বদলির অর্ডারের ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট, তা সত্ত্বেও শিক্ষক ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক, শিক্ষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা মইদুল ইসলামকে পুলিশ ১৫০ ঘন্টার ওপরে গৃহবন্দি করে রেখেছে।
চিত্র ৫:
রাজারহাট থানার চাঁদপুর পঞ্চায়েতে দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে সঞ্জয় হুলপাত্র রেশন কার্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করায় তাঁকে পুলিশ থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধোর করে এবং কাস্টডিতে থাকাকালীন রক্তবমি করতে করতে সে মারা যায়।
চিত্র ৬:
স্টাফ স্পেশাল নয়, সবার জন্য লোকাল ট্রেন চালু হোক— এই দাবিতে সোনারপুর, ক্যানিং, চম্পাহাটি, শান্তিপুর, দত্তপুকুর, দমদম ক্যান্টনমেন্ট, সাঁকরাইলে ট্রেন অবরোধ করেছেন সাধারণ রেলযাত্রীরা। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টে মামলা দেওয়া হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
চিত্র ৭:
ট্রেনে কোনও হকারি চলবে না— সরকারি এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন বৈঁচি স্টেশনের রেল হকাররা। জামিন অযোগ্য ধারার মামলা মাথায় নিয়ে তাঁদেরকে এক সপ্তাহের হাজতবাস করতে হয়েছে।
চিত্র ৮:
হাসনাবাদ, কুলতলিতে ইয়াস ঝড়ের ক্ষতিপূরণ এবং জীবন-জীবিকায় সরকারি সহায়তা এবং সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে যথাক্রমে পিপলস ব্রিগেড এবং এপিডিআর-এর উদ্যোগে আন্দোলন করেছেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়েছে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টে।
চিত্র ৯:
স্কুল কলেজ খোলার দাবিতে বাঁকুড়ায় বিক্ষোভ দেখান AIDSO ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা। অস্ত্র আইনে মামলা দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং ছয় দিন জেলে কাটিয়ে তাঁদের জামিন হয়। তাঁদের মুক্তির দাবিতে মিছিল হয় কলকাতায়। সেখানেও লালবাজার থানার পুলিশ লাঠিচার্জ করে গ্রেফতার করে আন্দোলকারীদের।
চিত্র ১০:
একই দাবিতে ‘আনলক ক্যাম্পাস’ স্লোগান সামনে রেখে রাস্তায় নামেন RSF ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা। তাঁদেরকেও একই কায়দায় গ্রেপ্তার করে লালবাজার থানা।
চিত্র ১১:
দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ধর্মতলায় গান্ধিমূর্তির নীচে অবস্থানে বসার সিদ্ধান্ত নেন বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী সহ ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের রাজ্য নেতৃত্ব। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের গ্রেফতার করে লালবাজার থানা।
চিত্র ১২:
ভাঙড়, ক্যানিং, দেগঙ্গা, হাড়োয়া, বসিরহাট, মিনাখাঁ, আমডাঙ্গা, অশোকনগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় আগুন জ্বলেছে ২ মে-র রাত থেকে। কোথাও জেসিবি দিয়ে ঘর ভাঙা হয়েছে, কোথাও বাড়ির চালডাল থেকে হাঁড়ি কড়াই সব লুঠ করে নিয়ে গেছে সদ্য বিজয়ী বাহিনী। বোমার আঘাতে জ্ঞান হারিয়েছে শিশুরা, শ্লীলতাহানির বাঁধ ভেঙেছে, সরকারকে ভোট না দিয়ে সরকারি রাস্তায় চলাচলের অধিকার হারিয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছতে পারেননি অনেকে। বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে পুলিশের সামনে। নির্দিষ্ট FIR সহ প্রশাসনের সব দপ্তরে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
চিত্র ১৩:
লকডাউনে কাজ হারিয়ে দেগঙ্গায় নিজের জমিতে চাষ করছিলেন অভিবাসী শ্রমিক হাসানুজ্জামান। ৩ মে সকালে নিজের জমিতেই তৃণমূল দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হন তিনি। এলাকায় পুলিশ ক্যাম্প বসে। আসামিরা রোজ বাড়ি এসে খাওয়াদাওয়া করলেও পুলিশ তা দেখতে পায় না। গ্রামবাসীরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে তিনবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। একবার গ্রামবাসীদের ওপর গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায় আসামিরা।
যাদের প্রতি যা বলার:
সচেতন নাগরিকদের প্রতি:
গণআন্দোলনের ইতিহাসে আপনারা বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করা কোনও নির্বাচনী প্রকল্প নয়। যে কোনও প্রকার অগণতন্ত্র ফ্যাসিবাদকে জায়গা করে দেয়। প্রশাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা সাম্প্রদায়িকতা রোখার জন্য ও গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য অপরিহার্য। বিজেপি আসেনি, তাই রাজ্য সরকারের যে কোনও অন্যায় দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকব— এরকম আচরণ সচেতন নাগরিকত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
সরকারের প্রতি:
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি-বিরোধী মুখোশ সামনে রেখে আপনারা যেভাবে আরএসএস-এর প্রোপাগান্ডাকে বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন করছেন এবং বেআইনি শাসন কায়েম করছেন, তাতে বাংলার মানুষ খুব বেশিদিন আপনাদের সহ্য করবেন, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই।
সংবাদমাধ্যমের প্রতি:
সমাজে আপনাদের ভূমিকাটা ঠিক আর পাঁচটা পণ্য বিক্রির মতো নয়। আপনাদের একপাক্ষিকতা বেশি দিন চলতে পারে না। আপনারা যত বেশি অন্যায় চেপে যাবেন, জনমানসে আপনাদের পক্ষপাতিত্ব তত উন্মোচিত হবে। এমন অনেক স্বাধীন নিরপেক্ষ গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভেরা এবং দানিশ সিদ্দিকীর মতো অকুতোভয় সাংবাদিকরা আছেন— যাঁরা সত্যানুসন্ধানের কাজটা নিরন্তর করে যাবেন।
পুলিশের প্রতি:
আপনাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই এমন অনেকে আছেন যাঁরা সংবিধানের প্রতি, আইন রক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ। ‘পুলিশ মাত্রেই ঘুষখোর’— এই বহুল প্রচারিত কথাটা শুনতে নিশ্চয়ই আপনাদের সবার ভালো লাগে না। পুলিশ কনস্টেবল থেকে শুরু করে IPS— যাঁরা ভারতবর্ষের মতো বিরাট এই দেশে আইন রক্ষা করতে দায়বদ্ধ হয়েছেন— আপনাদের ওপরের চিত্রগুলোর দিকে একটু চোখ রাখতে বলব, আর সবশেষে বলব একবার প্রথম চিত্রটা খেয়াল করে নেবেন।