পীযূষ দত্ত
বাংলা সাহিত্যের ছাত্র
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের পাঠক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প ‘দ্রৌপদী’। ‘দ্রৌপদী’ বাতিলের কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, সেখানে হিন্দু ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে, ‘দ্রৌপদী’ নাম ব্যবহার করে হিন্দু পুরাণকে অপমান করা হয়েছে। এই ‘অবমাননা’ এবং ‘অপমান’-এর ফাঁক থেকে বুঝে নেওয়া দরকার ‘দ্রৌপদী’-কে নিয়ে এই অস্বস্তির কারণ কী।
মহাশ্বেতা দেবীর কলম ফুঁড়ে যে মেয়েটির জন্ম তাঁর নাম দ্রৌপদী অথবা দোপদী মেঝেন। ১৯৭১-এর পশ্চিমবঙ্গ হল এ গল্পের প্রেক্ষাপট। ১৯৬৭-তে নকশালবাড়ি থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দোপদী এবং দুলন মেঝেন ছিল সেই আন্দোলনের-ই অংশ। যাঁদের নাম জড়িয়ে ছিল সে এলাকার দাপুটে জমিদার, সূর্য সাহু খুনের মামলায়। এ গল্পকে মহাশ্বতা দেবী স্রেফ দুই গেরিলা যোদ্ধার জীবনযাপন এবং রোমহর্ষক বীরের কাহিনিতে আটকে না রেখে, লেখার বিষয়বস্তুকে আরও খানিকটা বৃহত্তর ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
দ্রৌপদী বারবার নিয়ে আসছে সমাজের বাবু শ্রেণি বনাম নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ। তাদের মধ্যেকার সংগ্রাম। যে দেশের সংবিধান অনুযায়ী সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতিকে সমমর্যাদা দেওয়ার কথা, সে দেশে দোপদীদের মতো হাজার হাজার সাঁওতাল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা সরকারের ‘বাবু’-‘বিবি’রা বোঝেন না, বুঝতেও চান না। বরঞ্চ খানিক অবজ্ঞার ছলে, মশকরার ছলে তা ফুৎকার করেন।
দেশের বাবুগণের এই করুণ দশা দ্রৌপদী গল্পে এঁকে তুলেছেন মহাশ্বেতা:
এই ‘মা-হো’ শব্দটির মানে কী? এটি কি আদিবাসী ভাষায় উগ্রপন্থী স্লোগান? এর মানে কী তা ভেবে শান্তিরক্ষক দপ্তর বহু চিন্তা করেও হালে পানি পান না। আদিবাসী বিশেষজ্ঞ দুই মক্কেলকে কলকাতা থেকে উড়িয়ে আনা হয় এবং তাঁরা হফম্যান জেফার, গোল্ডডেন পামার প্রমুখ মহাশয় রচিত অভিধানে গলদঘর্ম হতে থাকেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এই বাবু-বিবিদের ৮০-৯০ ভাগ অংশই উচ্চবর্ণের। ফলত, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এই যে বাবু-সংস্কৃতির দাপট তা কিন্তু এককথায় প্রশাসনে উচ্চবর্ণীয় সংস্কৃতির রমরমাকেই বোঝায়। এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এই উচ্চবর্ণীয় সংস্কৃতির দাপটের কারণ খুঁজতে গেলে আসে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন। প্রশাসনের উচ্চপদের দখল রয়ে গেছে সেই উচ্চবর্ণের হাতেই। আর এর ফলেই, প্রশাসনে থাকা মানুষের কাছে এই জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি হিব্রু সমান। এই জনগোষ্ঠীর মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই উচ্চবর্ণের ভাষা। মোদির এই ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান ইন্ডিয়া’-র তত্ত্বের পেছনেও রয়েছে এমনই এক ভাবনা। আরেসেসের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের ভয়াবহ মতাদর্শ। এই ‘ওয়াননেস’-এর নামেই আসল হিসাবটা গোলমাল করে দেওয়া হচ্ছে। যে দেশে এত সংখ্যক মানুষ তাঁদের ভিন্নরকম ভাষা, সংস্কৃতি, সে দেশে এই ঐক্য কখনও হিন্দি বা কলকাতার বাবুদের বাংলা আরোপ করে আসতে পারে না।
তবে এটা আজ কাল বা ২০১৪-র ঘটনা নয়। সেটাই বোঝাচ্ছে দ্রৌপদী। একটা লম্বা সময় জুড়ে ঠিক এই কায়দায় বাবুদের বাংলা হোক বা হিন্দি-ইংরেজি, তাকে ক্রমাগত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জনগোষ্ঠীর ভাষার উপরে। এর ফলে এমন বহু জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে, গোন্ডির মতো বহু ভাষার লিপিই তৈরি হয়নি— তারা হারিয়ে গেছে। আর এখানেই ‘দ্রৌপদী’-র প্রাসঙ্গিকতা। দ্রৌপদী আসলে এই পার্থক্যগুলোকেই চিহ্নিত করে। প্রশাসনিক বাবুদের দোপদীদের মতো ‘ভয়ানক’ নকশালদের নিয়ে যে আতঙ্ক, খেয়াল করলে দেখব, তার অনেকটাই জড়িয়ে রয়েছে দোপদীদের ভাষার সঙ্গে, তার ভাষা না বুঝতে পারার সঙ্গে।
যে দেশে কোনও ‘জাতীয়’ ভাষা নেই বলে প্রচার চলে, সেই দেশেই সকলের চোখের আড়ালে ঠিক এই কায়দায় মেরে ফেলা হয় জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতিকে।
দ্রৌপদী বহন করছিল তাঁর তিনটি পরিচয়, ‘নারী’, ‘সাঁওতাল’ এবং ‘নকশাল’। একদিকে সাঁওতাল, যার ভাষা কেউ বোঝে না; তার ওপর নারী, যাকে পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখতে হয়; তার ওপর নকশাল। বাবুগণ এবং ভারতরাষ্ট্রের কাছে ‘বিপজ্জনক’ হওয়ার জন্য তাঁর এই তিনটি পরিচয়ই যথেষ্ট নয় কি? দ্রৌপদীর এই তিনটি পরিচয় আসলে, মহাশ্বেতার দ্রৌপদীকে, পুরাণকাহিনির দ্রৌপদীর থেকে আলাদা করে তোলে। দ্রৌপদী নমনীয় নয়, সে সমাজের অন্যায়কে শুধু ‘অন্যায়’ বলে থেমে থাকে না, সে তাকে আগাগোড়া পাল্টে ফেলবার চেষ্টা করে। খরার কালে, উচ্চবর্ণের টিউবওয়েল দখল করে, থানা আক্রমণ করে বন্দুক ছিনতাই করে। তাঁর আর বাদবাকি পুরুষ যোদ্ধাদের মতোই। দ্রৌপদীকে নিয়ে শাসকের ভীতির পিছনে রয়েছে তাঁর পরিচয়গুলো, এবং তাঁর ক্রমাগত সেই পরিচয়গুলোকে হাতিয়ার করেই সমাজিক বাঁধন ভাঙার স্পর্ধা। সে নারী, সে সাঁওতাল, সে নকশাল— তাঁর এই পরিচয়গুলি বাদে তাঁকে বোঝা সম্ভব নয়। পুরাণকাহিনির দ্রৌপদীর সঙ্গে, একইসঙ্গে যেমন মিল রেখে এগোবে গল্প, তেমনি সচেতনভাবে তাঁর পার্থক্যও দেখা যাবে। মহাভারতের দ্রৌপদীর ‘নারী’ পরিচয়ের নমনীয়াতাকে না ভাঙলে এই দ্রৌপদীর জন্ম হত না।
দ্রৌপদীর গ্রেফতারির পর তাকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করা হয়। তাঁর উলঙ্গ দেহের দগদগে ক্ষতচিহ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেন মহাশ্বেতা। তাঁর রক্তে ভেজা যোনি, আধখাওয়া স্তন। তবু সে মুখ খোলে না। সেনানায়কের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায় দ্রৌপদী। সে হাসে। দমবন্ধ করা হাসি। আর এখানেই আমাদের থামতে হবে, ফিরে যেতে হবে মহাভারতের দ্রৌপদী চরিত্রটির কাছে। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা হলে তাকে শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করতে আসে, তবে মহাশ্বেতার দ্রৌপদীর কোনও কৃষ্ণের প্রয়োজন পড়েনি। ‘পুরুষ নারীর রক্ষক’ এই ভাবনায় জোর আঘাত হানেন মহাশ্বেতা। দ্রৌপদী সেনানায়কের সামনে তাঁর ধর্ষিত দেহ নিয়েই দাঁড়ায়। তার হাসির থেকে ক্রোধ ফেটে পড়ে, তার হাসি অস্বস্তি বাড়ায় সেনানায়কের, কারণ তার সামনের নগ্ন দেহটা খালি দোপদীর ছিল না, ছিল হাজার হাজার দোপদী মেঝেনদের যারা প্রতিদিন ‘নারী’, ‘সাঁওতাল’ এবং ‘নকশাল’ এই পরিচয় নিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
‘দ্রৌপদী’ ছোটগল্পটি সমাজের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রাখে। প্রতিটি লাইন আমাদের আরেকবার করে দেশ, কাল, সময়, সমাজ, মানুষ, এই সবকিছুকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে, তবে সে ভাবনা কী এতই বিপজ্জনক?