অভিষেক ঝা
শিক্ষক, গল্পকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
একুশের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে যে বিপুল জয় তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল তাতে বাংলার মুসলমান ভোটের প্রায় পুরোটাই তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়া সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মুসলমান ভোট অবিজেপি দলগুলির মধ্যে ভাগাভাগি হলে বিজেপি যে পশ্চিমবাংলার ক্ষমতা দখলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেত তা বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ দেখলে খুব সহজে বোঝা যায়। বাংলার এই সুবিশাল জয়ই মমতা ব্যানার্জির ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছাকে আকাশকুসুম কল্পনা থেকে বাস্তবোচিত ভাবনার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ফলত তৃণমূল কংগ্রেস ভৌগোলিক ব্যপ্তি ও রাজনৈতিক কলেবরে না হলেও দলের কাজকর্মের অভিমুখ দিয়ে ‘সর্বভারতীয়’ গ্রহণযোগ্যতা পেতে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছে। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই ‘সর্বভারতীয়’ অভিমুখটি মূলত উত্তরভারত ও খানিক পশ্চিমভারত থেকেই জাত। উত্তরভারতীয় হিন্দু কৃষ্টিকেই ‘সর্বভারতীয়’ হিসেবে চালাবার চেষ্টা কংগ্রেস হাল্কাভাবে এবং বিজেপি তীব্রভাবে করে ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের একটি মডেল প্রতিষ্ঠা করেছে। বিজেপিকে গত লোকসভা নির্বাচনে পরাস্ত করতে মরিয়া রাহুল গান্ধিও এই মডেলটিকেই মান্যতা দিয়ে মন্দিরে যজ্ঞ করে পৈতা ধারণ করেন ও নিজের কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ বংশলতিকাকে বারংবার উল্লেখ করতে থাকেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিজেপির বিরুদ্ধে দিল্লিতে ধারাবাহিক রাজনৈতিক সাফল্যও ‘হনুমান চল্লিশা’র সোচ্চার উপস্থিতি ও দু হাজার কুড়ির দিল্লিতে মুসলিম গণহত্যার সময় পরিকল্পিত অনুপস্থিতি বাদ দিয়ে নয়। সুতরাং আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতির ভারতে দাঁড়িয়ে বিজেপি-বিরোধিতা মানেই হিন্দুত্ববাদ-বিরোধিতা নয়। হিন্দুত্ববাদের বিবিধ মডেল দিয়ে বিজেপিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে সরাতে চাওয়া এই ভারতের রাজনীতির নয়া অভিমুখ। অতএব সংসদীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বিজেপি-নির্ভরতা ক্রমশ কমতে থাকবে। মমতা ব্যানার্জি মরিয়া হয়ে উঠেছেন এই মডেলকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য।
তৃণমূল কংগ্রেস খুব ভালো করেই এই ব্যাপারে সচেতন যে একজন ভারতীয় মুসলমানের মুসলমান হিসেবে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ভোটের ফলাফলে নির্ণায়ক হওয়ার ক্ষমতা রাখলেও, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সেই ক্ষমতা রাখে না। সেই প্রেক্ষিতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি-বিরোধী হিন্দু ভোটকে নিজের ভোটবাক্সে টেনে আনা। এমনকি নয়া হিন্দুত্ববাদী মডেলের ফলে বিজেপির একচেটিয়া হিন্দু ভোটব্যাঙ্কেও ফাটল ধরতে পারে। এবং ভারতীয় মুসলমানের সামনে অবিজেপি, ক্ষমতায় আসার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে এমন দলকেই বেছে নেওয়ার অসহায়তা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। সুতরাং সেই মডেল তৈরি করতে জোর দেওয়া হচ্ছে যেখানে মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকে ফ্রিজের মাংসের জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে না, যখনতখন রাস্তায় কানধরে উঠবস করিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো হবে না, মুসলমান মেয়েদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার হুমকি প্রকাশ্য রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে দেওয়া হবে না। এই মডেল শুধু একটা কাজই করবে— হিন্দুত্ববাদের স্বাভাবিকায়ন। তাই পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় জন্মাষ্টমীর পূজা হচ্ছে, জনপ্রকল্পের নাম ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ রাখা নিয়ে শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয়, তৃণমূলপন্থী বাঙালি লিবারেলদেরও তেমন কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, ঈদের বাজারে র্যাফ নামিয়ে মুসলমানকে পেটালেও সেটাকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন হিসেবে দেখা হচ্ছে না, এবং বাবুল সুপ্রিয়ের মতো গণহত্যায় সরাসরি মদত দেওয়া, ইসলামবিদ্বেষী, প্রবল হিন্দুত্ববাদী একজন বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিলে সেটাকে দেখানোর চেষ্টা চলছে শুধুই একজন ব্যক্তিগত মুনাফাবাজ লোকের ধান্দা হিসেবে।
এই সমস্ত কিছু হচ্ছে এবং তেমন কোনও সোচ্চার প্রতিবাদ পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশের অবিজেপি রাজনৈতিক সচেতন মানুষরা করছেন না। ফলত তৃণমূলের হিন্দুত্ববাদের এই মডেল অবিজেপি সরাসরি রাজনীতিতে না জড়িয়ে থাকা বাঙালির কাছে নিশ্চিতভাবেই খানিক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। এই মডেলের সুপ্ত সুরটি একজন মুসলমানকে কতটা বিপন্নতা দিতে পারে, সে বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণতর বলে মনে করানো হচ্ছে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরকে। তাই বিজেপিকে সরাতে গিয়ে খানিক হিন্দুত্ববাদী হওয়াকে বকলমে মান্যতা দিয়েই চলছে অবিজেপি রাজনীতি সচেতন মানুষজন যাদের সিংহভাগই ধর্মসূত্রে হিন্দু। এটাই আজকের ভারতের অবিজেপি ভারতীয় সংস্কৃতির মূল হিন্দুত্ববাদী সুরটিকে প্রকট করে তুলছে যার ওপর নির্ভর কেন্দ্রের ক্ষমতা দখলের কথা ভাবছে তৃণমূল কংগ্রেস। এটাই সেই মডেল যার ওপর নির্ভর করে ভারতীয় মুসলমানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়াকে একটা স্বাভাবিক পরিণতি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে তাই অবিজেপি ভারত মানেই ফ্যাসিবাদমুক্ত ভারত নয়।