সঞ্জীব দেবলস্কর
প্রাবন্ধিক, ভাষাতাত্ত্বিক, গল্পকার, কলামনিস্ট
জীতেন বেজবরুয়া, কবি নীলাভ সৌরভ এ রাজ্যে কোনও নামকরা কেউকেটা নন। কিন্তু এঁরাই এই বিভ্রান্ত সময়ে অসমে সুস্থ মানবিক চিন্তাধারার এক একজন প্রতিভূ, বিপন্ন সময়ে অসমের জাগ্রত বিবেক। এঁরা বাঙালি নন। একেবারে খিলঞ্জিয়া অসমিয়া। বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। বলতে পারেন সরকারি ভাষ্যমতে একশো শতাংশ ভারতীয়। প্রথমোক্ত লোকটি বড্ড বেয়াড়া। জাতীয়তাবাদী নন। এ আবার কেমন কথা? আজ গোটা অসম যেখানে উল্লাসে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছে এ অসমিয়ার ব্যাটারা কী বলছে! সরকারের পুলিশবাহিনি যাদের ওপর চড়াও হল তারা তো মুসলমান। এরা চিহ্নিত হয়েছে উৎখাতের জন্য। এদের ওপর সামান্য জোরজবরদস্তি নাহয় হলই বা। এসব ক্ষেত্রে গুলিগোলা হতেই পারে। এ নিয়ে এত গোঁসা করছে কেন রাগী ছোকরারা?
আরেক হতচ্ছাড়ার আস্পর্ধাও দেখুন, এসব দৃশ্যও কি ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে হয়? অস্বীকার করছি না বাবা— সরকারি ক্যামেরাম্যান রাগের মাথায় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যে ম্রিয়মান শত্রু কিংবা মরে যাওয়া ব্যক্তি— হোক না সে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী, জবরদখলকারীই— এর মৃতদেহের ওপর পদাঘাত আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। ওসব তালিবানি নৃশংসতার স্থান আমাদের ধর্মে নেই। (নেলি গহপুরের পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কী হবে, এতে রাজ্যের উন্নয়ন ব্যাহত হবে) সিপাঝাড়ের ঘটনাটা আচমকাই হয়ে গেছে। সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। পদাঘাত করনেওয়ালা লোকটিকে তো অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। এ নিয়ে এত শোরগোল তোলার সময় এটা নয়। আমাদের মাটি দখলমুক্ত করাটা খুব প্রয়োজন।
মাটি আমাদের মহামূল্যবান সম্পদ। এতদিন সহ্য হয়েছে, আর নয়। বিদেশিদের হাত থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেই। এরপর দেখা যাবে কী করা যায় এ জমিতে। কোনও বড় পুঁজিপতির হাতে হস্তান্তর না করা গেলেও অন্তত একটি মন্দির তো বানানো যায়, যা হয়ে উঠবে আমাদের জাতীয় স্বভিমানের স্মারক। শুনেছি প্রতি পাঁচ কিলোমিটার অন্তর অন্তর একটি মন্দির নির্মাণ করলে নাকি গোধন রক্ষা করার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে। গো-বধ, গোমাংস ভক্ষণ নিষেধ করে একটি আইনও হচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে প্রচুর মন্দির নির্মাণ করে রাখলে আমাদের ভিন্নধর্মী প্রতিবেশীরা সৌজন্যবশতও কোরবানি কমিয়ে আনবেন আশা করা যায়। কথাটা যখন বড় নেতার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় তখন এটা যে ঢঙের কিছু নয় তা মানতেই হবে। সিপাঝাড়ের বিতর্কিত জমিতেও নাকি একটা শিবমন্দির গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। সামাজিক মাধ্যমে এরকমও প্রচারও আছে ওখানে একটা প্রাচীন মন্দির ছিল একসময়।
সাম্প্রতিক উচ্ছেদ মামলায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন, তাঁরা যে এ দেশেরই সন্তান, ধর্ম আলাদা হলেও এঁরা বাংলা বুলি বলেন, এঁরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন— একতরফা প্রচারের হাওয়ায় এসব কথা অনেকের ভাবনা থেকে উবে গেছে। ধর্মীয় উন্মাদনা এবং হিংসার এমনই ক্ষমতা, মানুষের মনের ভেতর মানবিকতাকে ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়। এখন বড় করে দেখানো হচ্ছে ওই উচ্ছেদ অভিযানে আটজন পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। প্রচার হচ্ছে দশ হাজার মানুষ মারমুখো মানুষ পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু আহত পুলিশের সংখ্যা যে সে অনুপাতের সঙ্গে ঠিক মিলছে না। রাইফেল হাতে পুলিশ দু-দুজন প্রতিবাদীকে ধরাশায়ী করে দেওয়ার পরও দশ হাজার অস্ত্রধারী প্রতিবাদী (পড়ুন আক্রমণকারী) যে সংযমের পরিচয় দিয়েছেন এটা মোটেও সামান্য ব্যাপার নয়।
আজকাল অসমে মুসলমানদের আর এত সাহস কোথায়, আগ বাড়িয়ে পুলিশের গায়ে হাত তুলবে? কবেই বা খুব সাহস দেখিয়ে পার পেয়েছে ওরা? সারা ভারতবর্ষেই মুসলমানরা যে মার খাচ্ছে এটা বললে অনেকে গোঁসা করতে পারেন, আমার হুঁকো-কলকেও বন্ধ হতে পারে এসব বললে। ইদানিং প্রায়ই শোনা যায় এনকাউন্টারে পুলিশের গুলিতে মানুষ (দুষ্কৃতকারী) ঘায়েল হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন। এদের মধ্যে মুসলমানও আছেন। এসব খবর নিরক্ষর, অশিক্ষিত, চরুয়া চাষাভুষার কানেও যায়, টিভির পর্দায়ও প্রদর্শিত হয়। এমতাবস্থায় বিগত কয়েক মাস থেকে শুরু হয়েছে উচ্ছেদের নয়া কার্যক্রম। একজন ব্যঙ্গ করে বলেছেন উচ্ছেদ-নির্ভর উন্নয়নের জোয়ার এসেছে রাজ্যে। সত্রের জমি, অভয়ারণ্যের জমি, প্রাচীন অর্বাচীন মন্দিরের জমি নাকি বেদখল হয়ে গেছে। কারা করেছে? সেই একই উত্তর, বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। মানুষের মুখের লাগামও নেই, সরাসরিই বলা হয় মুসলমানদের নাম, যাদের জন্য রাজ্যটি কাশ্মির হতে চলেছে ইত্যাদি। কথাগুলো মানুষ আপ্তবাক্য হিসেবেই ধরেন। আর ধরবেনই বা না কেন? এত প্রচার, সামাজিক মাধ্যম, টিভির চ্যানেল আর সভাসমিতিতে ছোট বড়, মাঝারি নেতাদের এত ভাষণ। তদুপরি ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে যখন সমাজের বেসরকারি প্রহরীদের ওপর রাজ্যের জনবিন্যাস রক্ষা করা, কাশ্মির হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার দায়িত্ব অর্পণ হয়, তখন রাজ্যের ভবিষ্যৎ যে কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
চারিদিকের হালচাল দেখে মনে হয় অসমে বুঝি আর কোনও সমস্যাই নেই। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা নিয়ে বিশেষ কিছুই করার নেই। ধর্মীয় সংখ্যালঘু এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানই এ সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত শক্তি এদিকেই প্রয়োগ করাই আশু কর্তব্য। কিন্তু দুর্জনেরা বলে এই যে ক-দিন আগে কাছাড়-মিজোরাম সীমান্তে মিজো হানাদাররা অসমের জমি দখল করতঃ অনুপ্রবেশ করে আমাদের ছয়জন পুলিশকেই গুলি করে উড়িয়ে দিল, বোমা মেরে সীমান্ত এলাকায় একটি বাংলা ইশকুলই গুড়িয়ে দিল, আগুন লাগিয়ে দিল নিরীহ বাঙালি এবং জনজাতির ঘরে। সেদিন পুলিশকে সামান্য শক্তি প্রদর্শন করার হুকুমটিও দেওয়া হল না কেন? তদুপরি মিজোরাম সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্যেও অনুপ্রবেশকারীর ভূত ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাঙালি এলাকায় জুলুমবাজি করে আক্রান্তদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে নিষ্কৃতি পেতেও চান। এমনি করে আবার নতুন করে হিংসার বিস্তৃতি ঘটছে মিজোরাম থেকে, মণিপুর, মেঘালয় থেকে মধ্য অসম পেরিয়ে নাগাল্যান্ড সীমান্ত অবধি। উচ্ছেদের রাজনীতি যে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে মাথাচাড়া দেবে এর ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর হঠাৎ মণিপুরের কাছাড় সংলগ্ন জিরিবাম জেলায় (২৩ ডিসেম্বর, ২০২০) অনেকগুলো গ্রামের নামকরণ পালটে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আতঙ্কিত হয়েছিলেন এলাকার জনগণ। দুর্গাপুর, মধুপুর, কালিনগর, বাবুপাড়া— স্থাননামগুলো পরিবর্তনের একটাই উদ্দেশ্য— ওখানকার বাঙালি যারা প্রাক-ঔপনিবেশিক কাল থেকে বংশানুক্রমিকভাবে বসবাস করে আসছেন, এদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযুক্ত করে উচ্ছেদ করা। এখানে মা দুর্গা, মা কালীকেও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। এরা বাঙালি দেবতা নাকি? বিষয়টি স্থানীয় জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে এনেছেন, তবে ওদিক থেকে এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়ার খবর নেই।
অবশ্য মেঘালয়ে বাঙালিদের ওপর জুলুমবাজি কম বেশি অব্যাহত রয়েছে। বরাকের বাঙালিদের সড়কপথে এ রাজ্যের ওপর দিয়ে গৌহাটি তো যেতেই হবে, এ অবস্থায় সরকারি মদতপুষ্ট ছাত্র, যুবনেতারা যাত্রীদের নাগরিকত্বের প্রমাণ তো চেয়ে হেনস্থা করবেনই। কে কী বলবে? এরা যে ২০১৬ সালে গঠিত ভারতীয় জনতা পার্টির মদতপুষ্ট ‘নর্থ ইস্ট ডিমোক্রেটিক অ্যলায়েন্সের’ গর্বিত সদস্য, আর এ সংস্থার নেতৃত্ব অসমে। এ সব কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় উত্তর-পূর্ব ভারতের বুঝি একটি চিরস্থায়ী জতুগৃহ হয়ে ওঠাই ভবিতব্য!
সাম্প্রতিক দরং জেলার সিপাঝাড় সার্কেলের গরুখুঁটির ধলপুরগ্রাম তো উচ্ছেদ অভিযানকে (২৩ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্র করে হয়ে উঠেছিল রণক্ষেত্র। বধ্যভূমিতে লুটিয়ে পড়েছিল দুই প্রতিবাদকারী সাদ্দাম হোসেন আর শেখ ফরিদের মৃতদেহ। রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষকেন্দ্র থেকে শুনিয়ে দেওয়া হল, এ উচ্ছেদ অভিযান থেকে সরকারের সরে আসার প্রশ্নই নেই। সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে একটু মৌখিক দুঃখপ্রকাশ, ক্ষতিপুরণের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদির একটা পর্ব থাকে। অসম রাজ্য এদিকে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। ওসবেরও বালাই নেই আজ।
কে না জানে অসমে ব্রহ্মপুত্র নদী মাঝে মাঝে অজগর সাপের মতো গা নাড়াচড়া দেয়, আর দুই তীরের মাটি ধ্বসে পড়ে মিলিয়ে যায় নদীগর্ভে, বিপন্ন মানুষ যেদিকে পারে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়, নতুন করে ঘর বাঁধে মুক্ত জমিতে, পলির আচ্ছাদনে জেগে ওঠা উর্বর জমিতে ফলায় সোনার ফসল, যা খেয়ে বাবুমশাইরা দেশ জাতি ভাষা ধর্ম এবং গোধন রক্ষার কাজে কালাতিপাত করেন।
বলছিলাম জীতেন বেজবরুয়া্র কথা। এ নৃশংস অত্যাচার দেখে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়াটি শুনে নিই:
আধমরা মিঞাটার ওপর ঝাপিয়ে পড়া ক্যামেরাম্যানকে দোষ দিয়ে কী লাভ? সে তো আমাদেরই প্রতিনিধি। কেবলমাত্র প্রতিনিধি নয়, সন্তান। এতদিন ধরে আমরা যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণাকে লালনপালন করে এসেছি সেটাই এখন ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে এ রূপ ধারণ করেছে। আধমরা মিঞার ওপর বীরের মতো শক্তিপ্রদর্শন করার পর্যায়ে এসেছে। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পুলিশের নিরাপত্তার ধেরাটোপের মধ্যে থেকে মিঞামানুষকে মারলে কেমন অনুভূতি হয় লোকটি বোধহয় তা-ই পরখ করে দেখেছে। আজকাল মিঞাকে মারপিট করলে কে আর খারাপ পায়? জাতির ঠিকাদারদের দেখেননি? মিঞা দেখলে কেমন ধর ধর মার মার শুরু করে। অসমের বিভিন্ন জায়গায় আজকাল তো হাজারটা অজুহাতে এই হতভাগা মিঞারা মারই খেয়ে থাকে, (কোথাও বা) কান ধরে হাঁটু গেড়ে বসে শাস্তি ভোগও করে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? সাম্প্রদায়িক বিষবাস্পের প্রভাবে হাড়ে হাড়ে বিষাক্ত আমরা আসলে (মুদ্রণের অযোগ্য শব্দ,)-এর(!) অসমিয়া জাতি, আর সেই ক্যামেরাম্যান হল আমাদের সুযোগ্য সন্তান।
রাগে দুঃখে ক্ষোভে ফেটে পড়া এ অসমিয়া ব্যক্তিটি শেষ মুহূর্তে ভাষার সংযম রাখতে পারেননি। (উত্তেজনার বশে ব্যবহৃত শব্দটি তাই অনুক্তই থাকুক)। আর মিঞা মুসলমানদের মর্মবেদনা কবিতার কলি হয়ে ফুটে উঠেছে এ অসমিয়া ভাষায়ই। মিষ্টি এ ভাষার একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। গভীর অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পাবেন একটি আলোর রেখা—
ক’ত একো হোয়া নাই
গড়ঁ মরা নাই, হাতি মরা নাই,
মানুষ মরা নাই,
মিঞা মরিছে, মিঞা মানুষ নহয়
…মিঞার কোনও রাষ্ট্র নাই
মিঞার দেশখন পৃথিবীর নাছিল
নাছিল ভারতর
নাছিল পাকিস্তানর
নাছিল অসমরমিঞাক মারি পেলাব পারি
জীব হত্যা মহাপাপ, মিঞা জীব নহয়
…বেঙ্গলি মানুষ, অসমিয়া মানুষ,
মিঞা বেঙ্গলি নহয়, অসমিয়া নহয়, হিন্দু নহয়
মিঞা অমানুষহাতি মরা নাই, গড়ঁ মরা নাই, মিঞা মরিছে,
মিঞা মানুষ নহয়,
মিঞার নামত গতিকে কবিতা হব নোয়ারে
এনেওই লিখি আছোঁ
অমানুষর দুটামান আখরকোনেও এনে আখর পঢি
খরচ নকরিব মূল্যবান সময়।(হরফ বাংলা ভাষা অসমিয়া, তবে বুঝতে খুব অসুবিধে হবে না। তবু বলে দিই গঁড় মানে গন্ডার। অসমে সাধারণত মুসলিমদের তুচ্ছার্থে মিঞা বলা হয়, যদিও আসলে শব্দটি সম্ভ্রমসূচক অর্থই বহন করে)
কবিতাটি লিখেছেন নীলাভ সৌরভ। তাঁকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
রাজ্যের সাম্প্রতিককালীন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে সর্বশেষ ঘটনার এ দুটো প্রতিক্রিয়া আমাদের দেখিয়ে দিল, আমরা যা ভাবছি, আমাদের যা ভাবানো হচ্ছে, যা দেখছি আর যা দেখানো হচ্ছে— এ-ই শেষ কথা নয়। ক্ষমতাবানের দাপট, আস্ফালন এবং ঘৃণা-বিদ্বেষের ডামাডোলে যে সত্যটি চাপা পড়েনি এখনও তা হল এ রাজ্যে উদারমনা প্রতিবাদী, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাননি। অসমিয়া মাত্রই হেংডাং নিয়ে সংখ্যালঘুর ওপর আস্ফালন করা মানুষ নন। সব অসমিয়া নাগরিকই ‘পাল’, ‘দাস’, ‘দত্ত’, ‘বিশ্বাস’ উপাধিধারী বাঙালি আর চাষি মজদুর মাঝি মিঞাদের শাসানি দেওয়ার দলে নয়। ‘মানুষ’ অসমে এখনও ‘মানুষের জন্য’। এখনও এখানে উচ্চারিত হয় ‘মানুষ যদি সে না হয় মানুষ, দানব কখনও বা হয় মানুষ।’ এ রাজ্যে এখনও স্বজাতি, স্বভাষীদের দৌরাত্ম্য দেখে লজ্জিত হওয়ার মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এই রাজ্যেই সৃষ্টি হয়েছে অনুপম গীত:
অ’ মোৰ আপোনার দেশ
অ’ মোৰ চিকুণী দেশ
এনেখন সুরলা, এনেখন সুফলা
এনেখন মরমর দেশ।(হরফ বাংলা ভাষা অসমিয়া)
আশ্চর্য লাগে ভাবতে, যে রাজ্যের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় এমন সুরেলা গান, প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয় এত মাতৃবন্দনা, ভাষার জয়গান, যে রাজ্যের নিসর্গ এত মনোরম, অমর শিল্পী ভূপেন হাজারিকা যে ভূমিকে ‘মহামিলনের তীর্থ’ বলে বন্দনা করেছেন সে ভূমিতে কেন এত জাতিবিদ্বেষ, এত ঘৃণার রাজনীতি, এত গণহত্যার আয়োজন? স্বাধীনতা এবং দেশভাগের অব্যাহত পূর্ব এবং পরবর্তী কালে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় যত বাঙালি হত হয়েছে এপারে এবং ওপারে, স্বাধীনতার পরবর্তী দিনগুলোতে অসমে তার চাইতে অনেক বেশি বাঙালি নিহত হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে, এটা এ মুহূর্তে এক শ্রেণির বাঙালি বিলকুল ভুলে যেতে বসেছেন। এঁদের মনের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে তীব্র ধর্মীয় উন্মাদনা আর বিদ্বেষ। এঁরা স্বভাষী ভিন্নধর্মীয়দের ওপর অত্যাচারে প্রতিক্রিয়াহীন। এঁদের মুখে উচ্চারিত হয় ভাষার চাইতে ধর্ম বড়। এ সুযোগে ৯০ লক্ষ বাঙালির মধ্যে ১৯ লক্ষ বাঙালিকে প্রথম চোটেই নাগরিকপঞ্জির বাইরে রেখে দেওয়া হল, আর এরপর আবার ৮ লক্ষকে ডি-ভোটার তকমা দিয়ে বিপন্ন করে রাখার পরিকল্পনাও বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষাকে সরকারি ভাবে নস্যাৎ করার প্রয়াসও এঁদের চোখে পড়ছে না। সে সঙ্গে ক্ষুদ্র, মাঝারি জনজাতিদের বাঙালিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার নানা কৌশল, এবং বাঙালিদের নানা প্রলোভন দিয়ে ভাষিক অধিকার রক্ষার্থে এদের চলমান আন্দোলনকে ধ্বংস করার প্রয়াসও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই বাঙালিদের দিয়েই বাঙালির জনসংখ্যার তথ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি, বাঙালির ইতিহাসের ভ্রান্তপাঠ জনসমক্ষে প্রচারের সযত্নরচিত পরিকল্পনা রূপায়নের প্রয়াস বেশ এগিয়ে গেছে। এই ধর্মীয় বিভাজনই বাঙালির ওপর বারবার বর্বরোচিত আক্রমণে বাঙালিকে প্রতিবাদহীন করে রেখেছে। ২০১২ সালে (২০ জুলাই) কোকরাঝাড় দাঙ্গায় ৮০ জন বাঙালির হত্যা, তিনসুকিয়ার ধলা সদিয়ায় লাইন ধরে ৫ জনকে গুলি করে হত্যা (১ নভেম্বর ২০১৮), সিপাঝাড়ে উচ্ছেদের বাহানায় একেবারে তালিবানি কায়দায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক দূরত্ব থেকে গুলি করে হত্যা এবং এরপর মৃতদেহের ওপর পদাঘাত— এই বর্বরতা ক্রমে বাড়তে বাড়তে কোন দিকে যাবে কে জানে? আপাতত বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ (নব্য ধর্মীয় উন্মাদনায় দীক্ষিত বাঙালিও) সাম্প্রদায়িকতার খোয়ারিতে উচ্ছসিত। কিন্তু আজ না হোক কাল, কোনও একদিন এ আঘাত যে নিজের ওপর আসবে না, তা কে বলতে পারে? বিরোধীশূন্য দেশে/রাজ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে হতে চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে সমাজদেহে বিপর্যয় নামতে বাধ্য। কারণ ইংরেজিতে কথাটি আছে, ‘পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট, অ্যান্ড অ্যাবসলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি।‘
এ বর্বরতার বিরুদ্ধে অসম যদি না জাগে তবে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে খুব বেশিদিন লাগবে না।
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১