অরূপ রায় চৌধুরী
দ্বিতীয় দিন
দাঁড়িয়ে ও বসে আঁকার দিন শেষ হলে এখন শুয়ে আছি। শুয়ে থাকি আপাতত। রাত সোহাগী, শব্দহীন লাশের মতো। মাথা ও শরীর দোলে নিজের খেয়ালে। জানালার লোলুপ পিঁপড়েরা— মার্কিন সেনা, রুট মার্চ করে। খোঁজ নেয়— চিঠি এল কিনা। ঠিকানায় কর্নেলের নাম না থাকলেও চিঠি আসে না। জানলার দিকে তাকিয়ে, দায়হীন, একা একা ইকির মিকির খেলি। ক্রমশ আঙুল বেঁকে আসে। আমার দিকেই কি আঙুল তোলে?
শুয়ে ছবি আঁকা ভুলে গেছি অনেক দিন। কারণ তুলিগুলো কবে থেকে যেন ইন্দ্রলুপ্ত ধারণ করে অনুপম খেরের মতো দেখতে হয়ে গেছে। আপাতত অভিনয়ে মত্ত। জানি, অভিনেতারা ছবি আঁকেন না। তবে একথাও ঠিক নয় যে ছবি যারা আঁকছেন বা আঁকবেন, তাদের ঝাঁকড়া বা বাবরি থাকাটা জরুরি। অনেক পাতলা চুল, কমান্ডার-ছাট মানুষ দিব্বি কেতায় মোটা তুলি চালিয়েছে। সবাইকে হুসেন বা রামকিঙ্কর হতে হবে, তার কোনও দিব্বি নেই। শুধু তুলিতে শ্যাম্পু করার পরিসর জীবনে বাদ দেওয়া মুশকিল। অনুপম অথবা অনুপমারা যেন মনে রাখে। জ্বর এলে সম্ভবত লিঙ্গজ্ঞান টনটনে হয়। অন্ধকার ভালো লাগে। অন্ধকারে সংলাপ যদিও পদবাচ্য, ছবি আঁকেনি কেউ।
তৃতীয় দিন
তারপর উত্তাপের উপত্যকা জুড়ে খবরের কাগজগুলো ক্রমশ বৈধব্য বেশ ধারণ করলে পড়ে থাকে অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেক। ম্যানড্রেক হতে না চাইলেও অরণ্যদেব বা বচ্চন হয়ে ওঠা হয়নি যে, সেটা মেনে নিলে কষ্ট কম। তবে একথাও মানতে হবে যে দখলদারি বাড়ার কারণে অরণ্যের পরিমাপ ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে। শিল্পের পূর্বশর্ত যদি অহৈতুকী হয়, তাহলে অরণ্যদেব সেই দলে পড়েননি— ভেবে অস্বস্তি যতটুকু, ঝেড়ে ফেলার চেষ্টায় আছি আপাতত। কারণ শুধুমাত্র সরলরেখা দিয়ে বিশেষ ছবি আঁকা যায় না।
প্যান্ডেলে পেরেক ঠোকার বিরতিহীন শব্দে আনচান লাগে, অথচ দুপুরবেলায় এই প্যান্ডেলেই সবাই দ্বিপ্রাহরিক ছুটিতে গেলে কে যেন মাথায় গামছা জড়িয়ে একলা বাঁশি বাজায়। লোকটার কি ভুঁড়ি আছে? ছাগল-দাড়ি? খড়ের উপর প্রতিমার গায়ে কি মাটি পড়ল? টপটপ করে জল গড়াচ্ছে, শুয়ে আছি। চারতলার জানলা দিয়ে প্যান্ডেলের টপ ভিউতে শুধু লাল নীল পাড়ে বাঁধা বাঁশের কৌণিক বিন্যাস এবং অবশ্যই সরলরৈখিক।
শুয়ে থাকি, অহেতুক এবং জানি অবদমন জারিত হলে নাকি সৃষ্টি হতে পারে। যে কারও গলা টিপে ধরতে পারি, দমনকে অহর্নিশ জারি রাখতে। জারণ প্রক্রিয়ায় অনুঘটকের ভূমিকা যে আমার পড়া হয়ে ওঠেনি, সেটা তোমার জানা ছিল না। ছেঁড়া ছেঁড়া গল্পেরা উড়ে আসে, কখনও কখনও উড়ে এসে জুড়ে বসে। তোমাকে মনে পড়ছে জর্জ। হাঁটু দিয়ে একটা পুলিশ, একজন সাদা পুলিশ তোমার গলা চেপে ধরেছে, চাপ দিচ্ছে, মস্করা করছে তোমার সঙ্গে। তোমার দুটো চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। একটা জলের ধারা পাশ দিয়ে। সম্ভবত প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছ। সিনেমার মতো। না, সিনেমার মতো বিক্রয়যোগ্য, শিল্পসম্মত ভায়োলেন্স নয়। চমকে দেওয়া উচ্চকিত আবহ নেই। তাই ক্ষণিকের জন্য স্নায়ুর অসারতার ফুরসত নেই। এতটাই ওভার-এক্সপোজড্ যে, কোন হিংস্রতার চালু দৃশ্যপটের ধারনার সঙ্গে মিলছে না। সাদামাটা অতি দীর্ঘায়ত মৃত্যুর দৃশ্য। যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে করতে চকিতে শিউড়ে ওঠার ক্লাইম্যাক্স প্রায় নেই। ঠিক তখনই কে যেন থার্মোমিটার গুঁজে দেয় বগলে। চোখ বুজে থাকি। রক্ত আর রক্ত। রেললাইন জুড়ে রুটি ছড়িয়ে আছে। অনেকটা রাস্তা, রাস্তা নয়, রেললাইন হেঁটে এসে ওরা লাইনে বসেছিল। খাবে বলে। তোমার অপরিণত যোনিপথ ভেঙে চুঁইয়ে নামছে রক্ত। ভিজে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে মেঝে, পিচরাস্তা ও মাটি। আসিফা।
চতুর্থ দিন
অসুখ সময়ের যাপন ঘিরে আছে। মন ও শরীর, বোঝাবুঝি ও বন্ধুতা, সিলিং ফ্যান ও জানালায় ঝুল জমে আছে। সর্বত্র অসুখের কালছাপ। এক শালিক দেখা সময়। সমস্ত অ্যান্টিবায়োটিকে সাদা কালো ফিলটার ব্যবহার করা হয় বলে কোনও প্রকার রামধনুর ছবি তোলা যায়নি, কারণ রং ছাড়া রামধনুর ফটো তোলার সাহস বিশেষ কেউ দেখায় না আজকাল। কালো পিঁপড়েরা আসে সুড়সুড়ি দিতে। ওরা এক্সপোজার, কন্ট্রাস্ট আর স্যাচুরেশন নিয়ে কথা বলে। পরনিন্দা করতে ইচ্ছে করে তখন, অথচ জুতসই জোটে না কেউ। ভয় পায় বন্ধুরাও, কাছে আসে না, সংক্রমণের ভয়। আমিও মনে মনে। ভয় পেলে মানুষ একা হয়, একলা হলে ভয় পায়, তখন বন্ধু-ফন্ধু সব বাজে বাকোয়াস মনে হয়। শালা, সব চুদির ভাই!
পঞ্চম দিন
শুধু বীথি আসে, মাঝেমাঝে। আমি তো আর রবিবাবুর স্নেহধন্য অমল নই, তাই জানালায় সুধা অথবা ফুল নিয়ে কেউ আসেনি কখনও। প্যারাসিটামল খেয়ে আনচান শরীরটায় যখন ঘাম দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বর ছাড়ে, অবসন্ন লাগে, ঘুম ঘুম, চোখের আলো নিভে যাওয়া ঘোর। ঠিক তখন। বীথি আসে। মাস্ক পরে। এবং গাঢ় সালোয়ারে। ভালো করে চেনা যায় না। স্যানিটাইজার আর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে হাতলভাঙা চেয়ারটায় বসে। আমি বিস্বাদ মুখে, কিছু না খেয়েও টুথ পিক দিয়ে দাঁত খুটি। জানালায় একটা একটা করে তারা খসে তখন। বুকের জানালায়, আগুন নিভে গেল। অভিযোগের ফিতে কাগজটায় একমনে টিক দিতে থাকে। চিবুকে পেন ঠেকিয়ে ভাবে, আড়চোখে তাকায়। ও জেনে গেছে যে আমার নাম ভাস্কর নয়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে না আমার— ভালোবাসার কাছে। শুধু জ্বর আসে, চোখ জ্বালা করে। তখন মুঠি শক্ত করতে ইচ্ছে করে খুব।
শেষ দিন
মেয়ে মাথায় জলপট্টি দিলে শুধু আরাম আরাম। বৃষ্টি নামলে ভিজে হাওয়ার ঝাপটা আসে। ইচ্ছে হয়, ঝাণ্ডাটা আবার কাঁধে তুলে নেই। মেঘের মাস্কে মুখ ঢেকে মেঘনাদ হই। ফিরে যাই সেইসব অলৌকিক যাত্রাপথের দৃশ্যকল্পের কাছে। আল্ট্রা মেরিন ব্যাকড্রপে গাঢ় সবুজ মাঠ। ডান পায়ের চেটোয় বল, কোমরের ঝটিতি ভাঁজে ছোট ইনসাইড করতে গিয়েও আউটসাইড। কেটে যাওয়া ডিফেন্স তছনছ করে দৌড়। বুটের ডগার আলতো চিপ— বল পৌঁছে যাচ্ছে ঠিকানায়। ফিরতি পথে আমাদের নিজস্ব শহর, হারিয়ে যাওয়া ডবল ডেকার, না সেজে ওঠা নদী ও ধেন্নোর সরবত। বরফকুচির উপর থেকে গড়িয়ে নামছে অভিযাত্রী সিরাপের ফোঁটা, স্লো মোশনে, চোখে সানগ্লাস, শৃঙ্গ জয় করে। চেনা অচেনা সবাই চেঁচিয়ে বলছি— “আর চিন্তা নেই। ভ্যাকসিন বা স্বপ্নদোষ নয়, তাজা স্বপ্ন পৌঁছে দেব ঠিক দরজায়।” চোখ বুঝে আসে, করজোড়ে প্রার্থনায় লিপ্ত হই। হে আল্লা, জ্বর যেন এখুনি না নামে ঠাকুর। উত্তাপের অহঙ্কারটুকু যেন থাকে। আর ঠিক তখন মাকে মনে পড়ে। এক যে কোন বিকেলে, চাঁদ ওঠার একটু আগে, ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর পুড়তে পুড়তে গরম লাগছিল খুব।