সুমন কল্যাণ মৌলিক
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী
অনলাইন শিক্ষাকে পাঠদানের একমাত্র উপায় ঠাউরে এবং নাম কা ওয়াস্তে বাড়িতে অ্যাক্টিভিটি টাস্ক পাঠিয়ে যে শিক্ষা গত ১৮ মাস ধরে এদেশে চালানো হল (সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম রয়েছে) তার ফলাফল কী দাঁড়াল? বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে শুধু ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার নয়, কোনও রাজ্য সরকারই তৃণমূল স্তরে করা সমীক্ষাগুলির ফলাফলকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। তবুও আশার কথা হল এই অতিমারি সময়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে জয় করে শিক্ষার হাল-হকিকত নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন যা আমাদের এই মুহূর্তে শিক্ষার হালটা বুঝতে সাহায্য করবে।
এক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার Locked Out: Emergency Response on Social Education শীর্ষক প্রতিবেদনটির কথা। দেশের ১৫টি রাজ্যের গ্রামীণ এলাকা ও শহরের বিভিন্ন বস্তি অঞ্চলে সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে করা এই সমীক্ষায় যুক্ত ছিলেন জঁ দ্রেজ সহ ৪ জন বিশেষজ্ঞের এক সমন্বয়কারী টিম। এই প্রতিবেদন থেকে যে সমস্ত তথ্যগুলি উঠে এসেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুদের সাক্ষরতার হার ৯১ শতাংশ থেকে কমে গ্রামের ক্ষেত্রে হয়েছে ৬৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৪ শতাংশ।
- স্মার্টফোনের আবশ্যিকতার ফলে নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারছে শহরে ২৪ শতাংশ এবং গ্রামে ৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী।
- অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রী (গ্রামে প্রায় ৬০ শতাংশ) দীর্ঘ সময় কোনও শিক্ষকের মুখ দেখেনি।
- গ্রামে ৩৭ শতাংশ ও শহরে ১৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
- গ্রামের ১৪ শতাংশ ও শহরে ২০ শতাংশ শিশু মিড ডে মিল বা টাকা কিছুই পাচ্ছে না।
- গ্রামের ৯৭ শতাংশ এবং শহরে ৯০ শতাংশ অভিভাবক চাইছেন অবিলম্বে বিদ্যালয় খোলা হোক।
- ১০-১৪ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বিনা পারিশ্রমিকে গার্হস্থ্য শ্রমে যুক্ত হয়েছে, ৮ শতাংশ পারিশ্রমিক সহ কাজ করছে।
- প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রী একটি-দুটির বেশি শব্দ বানান করে পড়তে পারছে না।
- দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছিল যে শিশু সে এখন সব ভুলে প্রথম শ্রেণির পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন বিদ্যালয় খুললে তার পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার কথা।
দ্বিতীয় যে রিপোর্টটি উল্লেখযোগ্য তা হল আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনের Loss of Learning during the pandemic শীর্ষক এক অনুসন্ধান। দেশের ৫টি রাজ্যে (ছত্তিশগড়, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরাখণ্ড) ৪৪টি জেলার ছাত্রছাত্রীদের ওপর করা এই সমীক্ষার ভরকেন্দ্রে রয়েছে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক শ্রেণিগুলি (প্রথম থেকে ষষ্ঠ)। সমীক্ষকরা দেখতে চেয়েছিলেন ভাষাশিক্ষা ও গণিতের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা এতদিন যা শিখেছিল তা আদৌ মনে রেখেছে না কি ভুলে গেছে!
ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রেণি ধরে ধরে ছবি দেখে মনের ভাব প্রকাশ, বই দেখে পড়া, সাধারণ বাক্য লেখার মতো বিষয়গুলি যাচাই করা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণির ৯২ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণির ৮৯ শতাংশ, চতুর্থ শ্রেণির ৯০ শতাংশ, পঞ্চম শ্রেণির ৯৫ শতাংশ ও ষষ্ঠ শ্রেণির ৯৬ শতাংশ ভাষার ক্ষেত্রে এই প্রাথমিক ধারণাগুলি ভুলে গেছে।
গণিতের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছিল এক ও দু অঙ্কের সংখ্যা চেনা, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের মতো সাধারণ বিষয়। দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণির ৬৭ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ শতাংশ, চতুর্থ শ্রেণির ৮৫ শতাংশ, পঞ্চম শ্রেণির ৮৯ শতাংশ ও ষষ্ঠ শ্রেণির ৮৯ শতাংশ গণিতের এই প্রাথমিক বিষয়গুলি ভুলে গেছে।
তৃতীয় রিপোর্টটি হল Annual Status of Education Report — 2020। এই রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘প্রথম’ যারা গত ১৫ বছর ধরে গ্রামভারতের শিক্ষার অবস্থা নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে। অতিমারি পরিস্থিতিতে ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত এলাকায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে—
- ২০১৮ সালে গ্রামভারতে ৬-১০ বছরের শিশুদের মধ্যে যেখানে ১.৮ শতাংশ শিশু স্কুলে নাম নথিভুক্ত করেনি সেখানে ২০২০ সালে সংখ্যাটা ৫.৩ শতাংশ।
- ২০ শতাংশ গ্রামীণ শিশুদের কাছে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক পৌঁছায়নি।
- গ্রামভারতে ৭০ শতাংশ শিশু সামান্য পড়াশোনা করতে পেরেছে, অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে পেরেছে মাত্র ১১ শতাংশ।
- স্কুল থেকে কোনও পাঠ বা অ্যাক্টিভিটি টাস্ক পেয়েছে ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই টাস্কের ৭৫ শতাংশ পৌঁছেছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে।
- ১৫-১৬ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলে নথিভুক্তির পরিমাণ বেড়েছে। তবে মনে করা হচ্ছে এর বড় কারণ বেসরকারি স্কুলে পড়ার মত আর্থিক সঙ্গতি হ্রাস।
- ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী বই থেকে পড়েছে, ২০ শতাংশ টিভিতে সম্প্রসারিত ক্লাস দেখেছে।
- গ্রামভারতে ৬১.৮ শতাংশ শিক্ষার্থীদের বাড়িতে অন্তত একটা করে ফোন আছে। ১১ শতাংশ বাড়িতে লকডাউনের সময় বাড়িতে ফোন কেনা হয়েছে যার মধ্যে ৮০ শতাংশ স্মার্টফোন।
উপরিউক্ত খণ্ডচিত্রগুলি জোড়া দিলে যে ছবিটা পাওয়া যায় তা ভয়ঙ্কর কিন্তু অনিবার্য। অর্থাৎ এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কোভিড অতিমারির কারণে সবচেয়ে বেশিদিন স্কুল বন্ধ রয়েছে ভারতে। ২০২১ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে পৃথিবীর ১৭৫টি দেশে স্কুল পুরোমাত্রায় খুলে গেছে। ফ্রান্স, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, জাপান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে অতিমারির প্রথম ঢেউয়ের সময়েও (২০২০) স্কুল বন্ধ রাখা হয়নি। যদিবা করাও হয়, তো সামান্য কয়েক দিনের জন্য। মনে রাখতে হবে, এর মধ্যে কিন্তু প্রাথমিক স্কুলও রয়েছে। ইউনেস্কোর বক্তব্য, এক মাস স্কুল বন্ধ থাকার অর্থ দুই মাসের পড়াশোনা বন্ধ। তার মানে গত ১৭ মাস স্কুল বন্ধ থাকার অর্থ শিক্ষার্থীদের ৩৪ মাস পড়াশোনা নষ্ট হয়েছে। শিক্ষার এই অন্তর্জলী যাত্রার ছবি ফুটে উঠেছে ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ২৪ কোটি ৭০ লক্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং প্রাক-প্রাথমিক ও অঙ্গনওয়াড়ি শিশুদের ২ কোটি ৮০ লক্ষের মধ্যে এই দীর্ঘকালীন স্কুল বন্ধের (জঁ দ্রেজ তাদের প্রতিবেদনে এই অবস্থাকে শিক্ষার লকআউট আখ্যা দিয়েছেন) নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর ইতিমধ্যেই কোভিড অতিমারিজনিত শিক্ষা বিপর্যয়ের কারণে ৬০ লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে গেছে।
সমীক্ষা যে শিক্ষার ধ্বংসাত্মক চিত্র উপস্থিত করেছে তা হত না যদি অতিমারি সময়পর্বে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি অনলাইন শিক্ষাকে একমাত্র উপায় না ঠাউরে কিছু বিকল্পের সন্ধান করত। অতিমারির প্রথম বছরে এই ধরনের কিছু উদ্যোগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘DIKSHA’ (Digital infrastructure for knowledge sharing)। এছাড়া ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও প্রযোজিত ‘মনদর্পণ’। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যস্তরের কিছু উদ্যোগের কথা এখানে উল্লেখ করছি। যেমন, ছত্তিশগড় সরকারের ‘Education at your doorstep’ প্রকল্প, মধ্যপ্রদেশ সরকারের ‘রেডিও স্কুল’। কর্নাটক সরকার ‘বিদ্যাঙ্গম সরকার’ বলে একটা প্রকল্প চালু করে যেখানে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দুটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার প্রকল্প চালু করে। পরে ‘Teacher on Call’ ধরনের একটা প্রোগ্রাম শুরু হয় যা এখনও চালু আছে। কিন্তু সমস্যা হল এই প্রোগ্রামগুলো শুরু হলেও ধারাবাহিকতা থাকেনি, কিছুদিন চলার পরে সেগুলো হয় বন্ধ হয়ে যায় বা স্তিমিত হয়ে আসে। বরং প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য হলেও কিছু সচেতন সংগঠন বা মানুষ এই অতিমারিকালে পাঠশালা ধরনের ক্লাস চালু করেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তাদের এই প্রচেষ্টা অবশ্যই কুর্নিশযোগ্য। কিন্তু সরকার স্কুল বন্ধ করে ও অনলাইন শিক্ষা এবং বাড়িতে অ্যাক্টিভিটি টাস্ক পাঠানোর মধ্যেই তার দায় সেরেছে মূলত।
এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে কালক্ষেপ না করে আমাদের এই মুহূর্তেই স্কুল চালু করতে হবে। এছাড়া আর কোনও উপায় অবশিষ্ট নেই। স্কুল খোলার সময় কয়েকটি বিষয় আমাদের বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে।
প্রথমত কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা দরকার। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের কোভিড ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার হিসাবে বিবেচনা করে তাদের টিকাকরণ সম্পূর্ণ করা দরকার। একটি সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী অবশ্য সরকারি স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে ৯০ শতাংশের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এছাড়া স্কুল চলাকালীন হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, স্যানিটাইজ করা এবং প্রয়োজনে অল্টারনেটিভ দিনগুলিতে আলাদা আলাদা শ্রেণির ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত যেভাবে মিডিয়ার কল্যাণে ও সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে কোভিড সংক্রান্ত ‘আতঙ্ক’ নির্মাণ (বিশেষ করে কোনওরকম পরীক্ষা ছাড়াই থার্ড ওয়েভ আসছে এবং তাতে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে— এই প্রচার) করা হয়েছে তাতে অভিভাবকদের একটা বড় অংশ আতঙ্কিত। এই অবস্থায় তারা যাতে বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের পাঠায় সেইরকম আস্থাবর্ধক প্রচার করতে হবে।
তৃতীয়ত দীর্ঘকাল ধরে স্কুল বন্ধ থাকার ফলে স্কুলের পরিকাঠামোর (বিশেষ করে সরকারি স্কুলে) ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই সরকারগুলিকে অতিরিক্ত ব্যয়বরাদ্দ দিয়ে স্কুলকে ব্যবহারযোগ্য করতে হবে।
চতুর্থত পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে সিলেবাস ও শিক্ষাবর্ষ— দুটোই নতুন করে সাজাতে হবে। যেমন যাদের শিক্ষাবর্ষ ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা তাদের শিক্ষাবর্ষ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়াতে হবে। সিলেবাসের দৈর্ঘ্য এই বছরের জন্য কমাতে হবে। স্কুল চালু হওয়ার পর গত বছরে শিক্ষার্থী যে শ্রেণিতে ছিল তার সিলেবাসের সংক্ষিপ্তসার এই সময়ে অন্তত দুটো মডিউলের মধ্যে পড়াতে হবে।
পঞ্চমত দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে কয়েক লক্ষ শিশু সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে গেছে। কেউ হয়ত পেটের দায়ে কোনও পেশায় যুক্ত হয়েছে। তাদের পুনরায় শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ যা সরকার, স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিতে হবে।
ষষ্ঠত শিক্ষার্থীরা বহুদিন স্কুলে যেতে পারেনি। ফলে তাদের মধ্যে স্কুল সম্পর্কে একটা বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও পড়েছে। এই ব্যাপারটা শিক্ষকদের সংবেদনশীলভাবে দেখতে হবে।
ক্ষতি অনেক হয়েছে, এর অনেকটাই হয়তো পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু এখনই স্কুল খোলা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারলে সুফল আসবেই।