চার নম্বর নিউজডেস্ক
অন্য এক শিক্ষার গল্প। অন্যরকম শিক্ষার গল্প। সত্যি কথায় বললে, হয়ত এমন বললেও অত্যুক্তি হবে না, প্রকৃত শিক্ষার গল্প। যে শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ, এন্ড্রুজ একসময় সিঁড়ি তৈরি করেছিলেন। ঠিক খোলা প্রান্তরে না হলেও সিলেবাসি কচকচি এবং যন্ত্রমানব বানানোর তুলনামূলক ধনী-কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে শিক্ষাকে সবহারাদের মাঝে এনে ফেলার আরেক উদ্যোগ। নেতৃত্বে মহম্মদ সাজিদ হোসেন।
২০১২। জার্মানি থেকে মেরি কুরি ফেলোশিপ নিয়ে মেটালারজিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গবেষণা শেষ করে দেশে ফেরেন ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার চিতরপুরের সাজিদ। চাকরি পান লোভনীয় ন্যাশনাল এরোস্পেস ল্যাবোরেটরি বা ন্যাল সংস্থায়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ততদিনে হাতের তালুর মতো জেনে গেছেন সাজিদ। অবশ্য তাতেই বা কী? সে তো অনেকেই জানে এতটা অভিজ্ঞতার পর! কিন্তু সাজিদ অন্য ধাতুতে গড়া। চিতরপুরের স্কুলে সহপাঠীদের কথা মনে করতে পারেন সাজিদ। শতাধিক ছাত্রের মধ্যে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক ছাত্রই পরবর্তীকালে কেরিয়ার তৈরি করেছে। যারা পারল না, অধিকাংশই তুলনামূলক অনগ্রসর ও দরিদ্র শ্রেণির। সাজিদ দেখলেন শিক্ষা মুষ্টিমেয় কিছু ওপরের হায়ারার্কির দখলে। শিক্ষাকে কোনওভাবেই সব শ্রেণি, সব অংশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছড়ানো সম্ভব হচ্ছে না হাজারটা সরকারি প্রকল্পের পরেও। তার একটাই কারণ— মানসিকতা। স্কুল, শিক্ষক, সমাজে প্রোথিত ধ্যানধারণা এইসব থেকে বের করানো যাচ্ছে না মানুষকে। আর তাই প্রকল্পের পর প্রকল্প নেওয়া হলেও ব্যর্থ হচ্ছে। ফ্রান্সের এক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে স্কলাশিয়ামের চিন্তার শুরুটা এভাবেই একদিন আসে সাজিদের মাথায়…
হ্যাঁ, স্কলাশিয়াম। স্কুল এবং জিমন্যাশিয়াম মিলেমিশে এমনই নাম। মূলত একটি শিক্ষার মডেল। কোথাও আস্ত একটি প্রতিষ্ঠান, আবার কোথাও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্কুলে অনুসরণ করা শিক্ষা চেতনা এই স্কলাশিয়াম। ছাত্রছাত্রীরা মূলত দরিদ্র শ্রেণির। স্কুল ফি ৫০০ টাকা, তবে যাঁরা তাও দিতে পারবেন না, তাঁদের দিতে বাধ্য করা হবে না কোনওভাবেই। ছেলেমেয়েদের দেখার চোখ তৈরি করা হয় এখানে। গাছ, সবজি চিনিয়ে তাঁদের পুষ্টিগত মূল্য বোঝানো হয়। শেখানো হয় জৈব কৃষি। শিক্ষক থেকে ছাত্রছাত্রীদের দিকে যাওয়ার একমুখী মডেল বদলে এখানে ছাত্রেরা নিজেরাই শিক্ষক, অন্যদিকে শিক্ষকেরা বন্ধু, খুব বেশি হলে ট্রেনার মাত্র, কিন্তু ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়ানো রাগী কোনও মানবশরীর নন। বিষয়বস্তুতে যদিও বড় হয়ে অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য সরকারি সিলেবাসগুলিকেই অনুসরণ করা হয়, যদিও তা প্রথাগত ক্লাসভিত্তিক না। এখানে শিক্ষা আনন্দ। বাস্তবের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে। ফলে, আদৌ ইউটোপিয়ান মডেল হিসেবেও হেসে উড়িয়ে দেওয়ার জায়গা নেই।
২০১৫ সালে ন্যাল-এর বাঁধা মাইনের নিরাপদ চাকরি ছেড়ে নিজের গ্রাম চিতরপুরে এসে সাজিদ এই স্কলাশিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুর হোঁচট, শিক্ষক ও অবিভাবকদের বোঝাতে সমস্যা, আর্থিক চিন্তা— এইসব পেরিয়ে সাজিদ স্বপ্নের সিঁড়িতে এখন অনেকটাই উপরে। তথ্য বলছে, প্রায় ৮৫টি গ্রামের ২৬৬১৮ জন ছাত্রছাত্রী এই শিক্ষার মডেলে অংশীদার হয়েছেন। ১২২টি স্কুলের ৬২১ জন শিক্ষককে এই মডেলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন ১৭৭ জন শিক্ষাবিদ।
ইতিহাস তৈরি করেছেন সাজিদ। ফলত, তারে জমিনের ফারিস্তা হয়ে পৌঁছে গিয়েছেন সাইকেল সারানো মিস্ত্রির মেয়ে ক্লাস টেনের শিখা কুমারীদের কাছে। ‘সাজিদ স্যার’ শিখাদের কাছে তখন খোদ ঈশ্বর। ব্যাটারি, ব্লেড, মোটর নিয়ে এসে টেবিলফ্যান তৈরি করে তারা কখনও মিটিয়ে দিচ্ছে যথার্থ পরিকাঠামো না থাকার খামতিগুলো। প্রচণ্ড গরমে ওদের বানানো পাখা শান্তি দিচ্ছে বাকিদের, স্বপ্ন দেখাচ্ছে খোদ সাজিদ স্যারকেই।
ছ বছরেই তাই স্বপ্নে থেমে থাকছেন না সাজিদ। অতিমারির দিনগুলোতে অনলাইনেই প্র্যাকটিকাল ক্লাস নিচ্ছেন তিনি। যুক্ত থেকেছেন গুমলা জেলার ডিস্ট্রিক্ত ইনোভেশন ল্যাবে। তাঁর স্কলাশিয়াম মডেল আসলে যে পুরোটাই প্র্যাকটিকাল ভিত্তিক, তাঁর যথার্থতা বজায় রাখতেই তৈরি করেছেন নতুন আরও এক মডেল— ইনোভেশন ল্যাবোরেটরি স্কুল, যার নাম দিয়েছেন মাউন্ট এভারেস্ট পাবলিক।
আর্থিক সমস্যা এবং সমাজের বহু অংশে ঢুকে থাকা গতানুগতিক শিক্ষা-ধারণার সঙ্গে এখনও লড়তে হচ্ছে সাজিদকে। শিখা কুমারীদের প্রিয় ‘সাজিদ স্যার’ এই লড়াইও জিতবেন, সন্দেহ নেই…