Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যাত্রাপথ কিংবা কোভিড-১৯

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়

 

I have no ideas what’s awaiting me or what will happen when this all ends. For the moment I know this: there are sick people and they need curing.

Albert Camus, The Plague

‘প্লেগ’ পড়েছিলাম ট্যুরিস্টের চোখ নিয়ে। ওই আতঙ্ক, যা আমার মনে, সেটা ছিল প্রতিফলিত অনুভব। যেমন, মা বাবা কিংবা অন্য বড়দের কাছে শুনতাম, জলবসন্ত, কলেরার মহামারির কথা। ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা সেসব বর্ণনা। শরৎচন্দ্রেও পড়েছি। কিন্তু এসবই ছিল, সেই যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় লেখা ইন্দিরা গান্ধির অবস্থার মতো। আকাশপথে যেতে যেতে বন্যা দেখা আর কী! কচুরিপানা, শবদেহ ভেসে-যাওয়া জল পায়ের পাতাটুকুও ছুঁতে পারবে না।

আমি বড় হতে হতে কলেরা থেমে গেল। জলবসন্ত মুছে গেল। ফি-বছর প্রতিষেধক ছুঁচ ফোটানোর ট্রমাও রইল না আর‌! তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াচ্ছে? বইয়ে পড়ব মহামারির মৃত্যুমিছিল কেমন হয়, এডওয়ার্ড মুংখের ছবিতে স্প্যানিশ ফ্লুর সময়টাকে দেখব। তারপর জীবন চলবে মাখনের মতো মসৃণ। নিশ্চিন্ত। নিরাপদ।

২০১৯-এর মাঝামাঝি শুনতে পাচ্ছি, কী যেন একটা বিদেশি অসুখ আমদানি হতে চলেছে। গ্রাহ্য করিনি। অমন গেল-গেল রব তো কতবারই ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের, দারিদ্র্যরেখায় টানটান দাঁড়িয়ে থাকা আমরা ধুলোবালি আর নর্দমার জল খেতে খেতে প্রাণ মজবুত করি, আমাদের আবার কীসের চিন্তা! ২০২০-র জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, একটা ভয়, একটা হিম অনুভূতি বুঝি পা বেয়ে ওপরে উঠছে। ওষুধের দোকানে মাস্ক, স্যানিটাইজারের খোঁজ করছে পাব্লিক, এদিকে আমার একটা স্কেডিউলে সবে পাক ধরছে। কলকাতা থেকে ভায়া হায়দরাবাদ, দিল্লি। সেখান থেকে হৃষিকেশ। তারপর মুসৌরি। তারপর ব্যাক টু হায়দরাবাদ।

দমদম এয়ারপোর্টে ত্রস্ত, হতচকিত ভাব লক্ষ করলাম। কিন্তু তখনও সেভাবে তাড়া-খাওয়া অবস্থা গড়ে ওঠেনি। ও হ্যাঁ, দুখানা গয়না তখন আমার বাড়তি সাজসজ্জা। নাকেমুখে মুখোশ। হাতের মুঠোয় স্যানিটাইজারের শিশি। আমি আবারও পাত্তা দিচ্ছি না মোটে। ভাবছি, এটা একটা নতুন হুজুগ। অচিরেই কেটে যাবে। এমনিতেই দুয়েকটা বিশ্বস্ত অসুখ বেশ কয়েকবছর হল আমার সঙ্গে লিভ-ইন করছে, সেখানে এসব উটকো আপদ নিয়ে মাথা ঘামালে চলে নাকি? হায়দরাবাদ পৌঁছেই দিল্লি থেকে সাংবাদিক বন্ধুর আর্ত ফোন পেলাম। ‘এখানে আসাটা ক্যানসেল কর। দিল্লি ঘোর অসুস্থ।’ কী কাণ্ড! এখন একটু নড়েচড়ে বসা। ঠিক আছে, হৃষিকেশ আর মুসৌরি মন্দ কী! চট করে আলোচনা সেরে নিলাম আমরা, হিমালয় পাহাড়ে নিশ্চয়ই ভাইরাস ওড়াউড়ি করবে না। তবে, এবার দেরাদুন যাওয়ার সময় দেখব হায়দরাবাদ এয়ারপোর্ট খুব গম্ভীর। মাস্ক, স্যানিটাইজার যত্রতত্র। আমরাও সেসব প্রোটোকলে নিজেদের জড়িয়ে নিয়ে আকাশে ভাসলাম। সকলের তো এই অজানা অচেনা শত্রুকে বুঝে নিতেই সময় লাগবে। তাই একটু ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা, সর্বত্র। দেরাদুন থেকে হৃষিকেশ যাওয়ার পথে চটিওয়ালাতে আলুপরটা খেতে নামলাম। কোনও বিদেশিনীকে আশেপাশে দেখলেই দশহাত পিছিয়ে যাচ্ছি। বিদেশি অসুখ বলে কথা! যাক গে, মানে মানে হৃষিকেশ। চোখ জুড়িয়ে যায়। মন শুশ্রূষা পায়। কিন্তু তারপর? মুসৌরিও ক্যানসেল করে হায়দরাবাদ ফেরা। এবারের দৃশ্যপট তুমুল গম্ভীর। রাস্তায় সারাক্ষণ তাসের দেশের কোরিওগ্রাফির মতো কাঠ-কাঠ নড়াচড়া। কেউ হ্যাঁচ্চো দিলেই ভেবে নিচ্ছি, ওই ভূত বাপ রে! হায়দরাবাদ এসে সেই যে ফিজিক্যালি প্যান্ডেমিকের আঠায় আটকে গেলাম, আজও এখানে!

শুরু হল জরুরি অবস্থাকালীন, আনন্দের মুখে ঠোঙা পরিয়ে, সতর্ক যাপন। চাল আসছে অনলাইনে। শাকসবজি, এমনকি কালোজিরে পর্যন্ত, অনলাইনে। দোকান বাজার, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। হায়দরাবাদ এমনিতেই আমার কাছে প্রবাস। সব রং মুছে, সেই প্রবাসের গায়ে আলকাতরার পোঁচ পড়ে গেল যেন! কয়েকদিন পর লকডাউন হালকা হয়ে এল যখন, সাহসে ভর করে বিকেলের ঝোঁকে দুখানা মাস্ক সম্বল, পথে নামলাম। চারপাশে সারিসারি বাড়ি, অন্ধকার। দরজায় অজস্র ‘টু লেট’ লটকে রয়েছে। ছেলেমেয়েরা, যারা এখানে চাকরির উদ্দেশ্য নিয়ে পড়েছিল, তারা ঘরে পালিয়েছে। কেমন মৃতনগরীর চেহারা। সত্যি বলছি, গা ছমছম করে উঠেছিল। পথ থেকে ছিটকে ফিরে এসেছিলাম।

আমি আত্মকেন্দ্রিক। আমি খুঁতখুঁত করছি, আমার লেখাপড়ার, সাধের রাইটিং ব্যুরোটা পাচ্ছি না, রেফারেন্স বইগুলোতে চোখ বোলাতে পারছি না, আমার আদরের বারান্দাবাগান শুকিয়ে গেল! ঠিক তখনই একে একে উবে যাচ্ছে প্রাণ, গ্রাস করছে অভাব, চলে যাচ্ছে চাকরি, যারা অসুস্থদের চিকিৎসা, সেবায় আছে, তাদের ভাগ্যে জুটছে লাঞ্ছনা। কলকাতা তার ভৌগোলিক দুরত্ব ছাপিয়ে আরও অনেক দূরের এখন। ভুরু কুঁচকে দূর থেকে দেখতে চাইব, আর ঝপাং করে কোলাপসিবল গেট নেমে যাবে, একেকজন মানুষ আর আমার মাঝখানে। কোভিডের কোপে একের পর এক চলে যাবেন আমার প্রিয়জন, গুরুজন, স্নেহভাজন…

আমার ট্রিপ এখন তমসামাখা সূড়ঙ্গপথে। ভাইরাস ভনভন করছে। সীমানা চেপে এসে দমবন্ধ করে দিচ্ছে। হেঁচকি তুলছে মৃত ও মৃতপ্রায় মানুষজন। কেউ এখন পা রাখে না এ বাড়িতে। আমরাও যাই না আর কোথাও। অদৃশ্য মাকড়শার জাল ঝোলে। আর্তনাদ ও উদ্বেগের গন্ধ, স্যানিটাইজারের শিশি উপুড় করেও ঢেকে ফেলা যায় না। আমি নিশ্চিত জানি, নিকট কেন সুদূর ভবিষ্যতেও রক্তদাগ দেখতে পাব আমার আনাচেকানাচে।

মন, ভ্রমণরত। সে অবিরাম কলকাতা যায় আর দেখে, কী বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটে গেছে ইতোমধ্যে। স্থাবর ও অস্থাবর। স্থাবর, সামলে ওঠা যাবে হয়তো কখনও, কিন্তু অস্থাবর? হিম হয়ে ঝরে গেল যারা, নিঃশব্দ, কেউ দেখল না জানল না শেষ সময়ের মুখশ্রীটুকু কেমন ছিল! এই ক্ষতচিহ্ন জীবনভোর বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে তো…

আরও একটা কথা না বললেই নয়! মহামারিকালে, আমার লেখাপত্র থেকে নান্দনিকতার আঁশটুকুও উঠে গিয়ে অসুখ, ওষুধ ও অনিশ্চয়তার গন্ধ লেগে গেছে কেমন!

 

কোভিড-১৯

একে একে নাম ডাকা হয়ে গেলে আকাশের দিকে রওনা দিচ্ছে বেঞ্চিতে বসে-থাকা একেকজন।ওপাশে পড়ন্ত নাভিশ্বাস।
এপাশে কান্নার আঁশ।
কেউ ভয় পাবে কিনা ভাবছে।
‘আজ সাতমাস দাঁতে কিছু কাটিনি…’
বানিয়ে বলছে কেউ-কেউ!
কেউ জানাচ্ছে, পাসিং ফেজ এটা।
মাঝখানে, কৃষি বিল,
মৃত শ্রমিকের কিছু হাওয়াই চপ্পল,
আর বোকাবজ্জাতের হাসি।
মাঝখানে মায়ার ধুলো উঠছে খুব।
আবছা অঞ্চল জুড়ে
কারা ছুটোছুটি করে,
চিত্রপরিচালক,ডাক্তার,
কিংবা রাজনীতির লোকেদের মতো মুখচোখ!

আমাকে উড়ে যেতে তুমি
না দিও, লক্ষ্মীটি