বিপুল দাস
পরিমল একটা বাইক কিনবে। পরিমল এখন সাইকেল চালায়। বাইক কিনবে বলে পরিমল টাকা জমাচ্ছে। যদিও দু’একজন তাকে বলেছে বাইকের জন্য ব্যাঙ্ক-লোন পাওয়া এখন জলভাত। লোন দেওয়ার জন্য ওরা হন্যে হয়ে লোক খুঁজে বেড়ায়। সে দিন আর নেই, ব্যাঙ্ক-লোন পেতে হাওয়াই চটির ফিতে পাল্টাতে হত। তারপর কত রকমের কাগজ জমা দিতে হত। সে বড় হ্যাপা ছিল। পরিমলের মতো মানুষ ও পথ মাড়াত না। হয় নিজের কড়ির জোর, নয়তো বেশি সুদে কারও কাছে হাত পাততে হত। তবু কেউ ব্যাঙ্কের দিকে যেত না। বড় বড় বিল্ডিং, ইংরেজিতে ছাপানো ফর্ম আর কাচঘেরা ঘর দেখে এক রকম ভয়ই পেত পরিমলের মতো মানুষজন। কিন্তু এখন আর অত ঝুট-ঝামেলা নেই। ওরাই সব করে দেবে। তুমি শুধু সইটি করবে। তবে হ্যাঁ, লোন শোধ করার মুরোদ তোমার আছে কিনা, সেটা ওরা বুঝে নেবে। ওদেরও সুদ খাওয়ার ব্যবসা, দানছত্র তো আর খুলে বসেনি।
পরিমল অনেক ভেবেছে। বউ-এর সঙ্গে ঘরে বসে শলা করেছে। তার মহাজন তারক ঘোষের সঙ্গে কথা বলেছে। শেষে ঠিক করেছে দেরি হয় হোক, লোনের জাঁতাকলে পড়বে না। গাঁটের কড়ি খসিয়েই বাইক কিনবে। প্রাণপণে টাকা জমাতে শুরু করেছিল। তখন কে জানত রাধামাধবের মনে কী ইচ্ছা রয়েছে।
পরিমলের দুধের ব্যবসা। ছোটখাট সাপ্লায়ার সে। খুব ভোরে উঠে বস্তি থেকে দুধ কালেকশন করে কুতুবপুরের মিষ্টির দোকানে পৌঁছে দিয়ে আসে। তার সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারের দু’পাশে দুধের ক্যান নাইলনের দড়ি দিয়ে পোক্ত করে বাঁধা থাকে। দুটো ভর্তি ক্যান নিয়ে বস্তি থেকে ফেরার সময় যেন সে সার্কাসের তারের ওপর দিয়ে সাইকেল চালায়। পথ বলতে ওই সরু পায়েচলা পথের ইশারা, কখনও গোরুর গাড়ি চলার লিক। যাওয়ার সময় তার থাকে জল কেটে যাওয়া ছিপের মতো গতি। কিন্তু আসার সময় ভারি বজরার চালে ফিরতে হয়। পেছনে ক্যারিয়ারের দু’পাশে ভারি দুধের ক্যান, সরু পথ, সোজা চালিয়ে যাওয়া ভারি নিষ্ঠার ব্যাপার। মন একটু এদিক সেদিক হলেই চাকা উঁচুনিচুতে পড়ে কেলেংকারি হয়ে যাবে। সাঁই সাঁই উড়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। তাছাড়া পেছনে অত বড় বড় দুধভরা দুটো ভারি ক্যান, জোরে চালানো অত সহজ নাকি। পিচ রাস্তায় এসেও সে ধীরে সুস্থেই চালায়। তখন সে বাইক কিনলে ক্যানদুটি কোথায়, কী ভাবে সেট করবে, সে বিষয়ে ভাবার একটু সময় পায়। আটটার ভেতরে দোকানে দুধ না পৌঁছলে তারক ঘোষ বড় আজে বাজে কথা বলে।
পরিমল বড় ভালোমানুষ। দীক্ষা নেবার পর গলায় তুলসীর মালা সব সময়ের জন্য পরে থাকে। কিছুদিন তিলকসেবাও করেছে। কিন্তু লোকজন বড় ডিস্টার্ব করে, ঠাকুরদেবতা মানে না, কী সব বলে। তিলকসেবা করতে পারে না বলে ঠাকুরের পায়ে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। অপরাধ নিও না প্রভু। তোমার নামে কুকথা সওয়া যায় না, তাই তিলকমাটির চিহ্ন আর দিই না। কিন্তু তুমি আমার অন্তরে আছ প্রভু। জয় রাধামাধব।
দ্বিজপদ ঘোষের ছোটমেয়ে মিনতিকে বিয়ে করার দিন দুয়েক বাদেই সে বড় লজ্জায় পড়ে গেল। স্নান সেরে উঠে মিনতি এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী যেন খুঁজছে। পরিমল ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কী খুঁজছে তার নতুন বউ? আয়না, চিরুনি, ক্রিম, পাউডার– সবই তো ঘরে আছে। বিয়ের আগে লিস্টি ধরে সব কিনেছে সে। মায় বোরোলীন। দু’হাত প্রণামের ভঙ্গিতে জড়ো করে কী খোঁজে মিনতি। কেবল দু’দিন হল তার এখানে। কোথায় কী থাকে, সব ঠিকঠাক ঠাহর করে উঠতে পারেনি এখনও। পরিমল বুঝতে পারছিল না এখন ঠিক কোন জিনিসটা চাই তার। থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসই করল।
–কী গো, কী খুঁজছ তুমি? আমাকে বলো, আমি এনে দিচ্ছি। তোমার এখনও সব সড়গড় হয়নি…
–ঠাকুরঘরটা কোথায়? স্নান সেরে উঠেছি, একটু জলবাতাসা দেব। ছোটবেলা থেকে দিয়ে আসছি।
থমকে গেল পরিমল। সেরেছে, ঠাকুরঘর বলে সে তো আলাদা কিছু রাখেনি। ছোটভাই নির্মল আর সে, এই তো দু’জনের সংসার তাদের। নির্মল ভেটাগুড়ি প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। প্রত্যেক শনিবার সন্ধেবেলা আসে, আর সোমবার ভোরে চলে যায়। তার তো ঠাকুদেবতার কোনও বালাই-ই নেই। পরিমল সকালবিকেল ঠাকুরের নাম মনে মনে স্মরণ করে। ব্যস্, আলাদা করে ঠাকুরের পাট বসানোর কথা কোনও দিন ভাবেইনি।
–ঠাকুরঘর তো আমাদের নেই মিনতি। চিন্তা কোরো না, নির্মলকে বলে দেব, ভেটাগুড়ির ওদিকে কাঠা শস্তা। একটা ময়ূরের নক্শা-তোলা কাঠের সিংহাসন এনে দেবে।
–কোনও ঘরে ঠাকুরের কোনও ক্যালেন্ডারও দেখছি না… রাধামাধব না হোক, যে কোনও ঠাকুর…
খুব বিপদে পড়লে মানুষের মুখের অবস্থা যেমন হয়, পরিমল দেখল মিনতির মুখ তেমনই দেখাচ্ছে। ঠাকুরপ্রণাম করবে বলে হাতদুটো জড়ো করে বুকের কাছে ধরেছিল, এখন সেই প্রণাম সে কোথায় অর্পণ করবে বুঝতে না পেরে কেমন অসহায় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এঘর সেঘর।
সেই যে বাতিক হল পরিমলের ক্যালেন্ডার জোগাড় করার, ফলে তার ঘরে ক্যালেন্ডারে বোঝাই হয়ে গেল। নির্মলও এনে দিতে লাগল। কিন্তু সব ঠাকুরদেবতার। কোনও দেবতা আর বাকি রইল না। তার ভেতর থেকে বেছে বেছে রাধামাধবেরগুলো মিনতি সরিয়ে রাখল। পরিমল বলেছে সামনের মাসে বারান্দার একটা সাইড বেড়া দিয়ে ঘিরে দেবে। ওখানেই যেন মিনতি আসন পাতে।
তার বর লোকটা খারাপ নয়– মিনতি ভেবে দেখেছে। বেশ নরমসরম। রাধামাধবের দুটো ছবি চুমকি, জরি দিয়ে বাঁধিয়ে এনে দিয়েছে। ছবিদুটো খুব সুন্দর। রাধামাধবের মাথার পেছনে আলোর চাক্কিটা মনে হয় সত্যি বনবন করে ঘুরছে। তার কথায় সামনের বছর মায়াপুরে যেতে রাজি হয়েছে, দীক্ষাও নেবে বলেছে। তার যাতে কষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সব সময় লক্ষ রাখে। কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে রান্নাঘরে দিয়ে যায়। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে মিনতি একটু অবাকই হয়। দিনের পরিমল আর রাতের পরিমল যেন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। দিনের নরমসরম মানুষটা রাতে কেমন পালটে যায়, মিনতিকে যেন আস্ত গিলে খেতে চায়। মিনতির ভরাট শরীর নিয়ে তার আদিখ্যেতার যেন আর শেষ হয় না। ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু তখন যেন পরিমলের কোনও হুঁশ থাকে না। কী যে করে, কখনও তাকে জোরে ব্যথা দিয়েও কেমন করে যেন হাসে। তখন তাকে কেমন অচেনা মনে হয় মিনতির।
আর একটা ব্যাপারও ইদানীং লক্ষ করেছে মিনতি। নির্মলের স্কুল ছুটি থাকলে পরিমল সারাদিন বাড়িতে থাকে আজকাল। এমন কী ছুটি না থাকলেও হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি চলে আসে। প্রথম দু’চারদিন খুব খুশি হয়েছিল মিনতি। ঘর বন্ধ করে দুপুরেই তাকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে পরিমল। যেন দিনে ডাকাতি করতে আসে। আর, সেই দিনগুলোতে সত্যিই ডাকাত হয়ে ওঠে পরিমল। তাকে নিয়ে কী যে করবে, ভেবেই পায় না। কখনও একটু খারাপও লাগে। স্বার্থপরের মতো পরিমল শুধু নিজের সুখটুকুই বুঝে নেয়।
এ রকম সময়েই একদিন ক্লান্ত পরিমল হঠাৎ তার দিকে ফিরে জানতে চেয়েছিল নির্মল কখনও দুপুরে বাড়িতে আসে কিনা। তারপর আরও ক’দিন একথা সেকথার মাঝে জানতে চেয়েছে নির্মলের আসার খবর। মিনতি বুঝতে পেরেছে লোকটার মাথায় সন্দেহের পোকা ঢুকেছে। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী বউ হলে বোধহয় সবারই এ রকম হয়। হেসে পরিমলের কথা উড়িয়ে দিয়েছে মিনতি। তবু দেখল শনি, রবিতে তো সে সকালের সাপ্লাই দিয়ে আসার পর ঘর থেকে বেরোচ্ছেই না, অন্যান্য দিনেও হঠাৎ দুপুরে বাড়ি চলে আসছে। উঠোনে পা দিয়ে কেমন যেন বোকার মতো হাসে। ঘরে ঢুকে ফালতু জিনিসপত্র হাটকায়। মনে মনে হাসে মিনতি। সে তো জানে পরিমল কী খুঁজতে এসেছে।
মাস ছয়েক বাদে ওরা দু’জন একসঙ্গে মায়াপুর ঘুরে এল। তার পনেরো দিন বাদেই মিনতিদের বংশের গুরুদেবের কাছে দু’জনেই দীক্ষা নিল। দীক্ষা নেবার পর পেঁয়াজ আর মাংস ছাড়া পরিমল আর কিছু ছাড়তে পারল না। কিন্তু আজকাল একটা বাইকের চিন্তা তাকে বড় অন্যমনস্ক করে রাখছে। এমন কী স্বপ্নেও দেখছে দু’হাতে হ্যান্ডেল খামচে ধরে আছে, নরম গদির ওপর বসে পক্ষীরাজের মত উড়ে যাচ্ছে কুতুবপুর, ময়নাডাঙা, ঘোষপুকুর, তালহাটি। ঘুমের ভেতরেও পরিমল টের পায় তার পুরুষাঙ্গ ভয়ঙ্কর ভাবে জেগে উঠছে। স্বপ্নে সব উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। লাল রং-এর বাইকটা হঠাৎ মিনতি হয়ে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে তার মহাজন তারক ঘোষের কথাটা মনে পড়ে। আপন মনেই হাসে পরিমল। মহাজন চোখ টিপে বলে ছিল– তোর চড়ার শখ এখনও মিটল না?
ভেটাগুড়ি থেকে নির্মল যেদিন শিশুকাঠের ময়ূরের ডিজাইন-তোলা সিংহাসন নিয়ে এল, পরিমল বাড়িতে ছিল না। আরও কিছু দুধ জোগাড়ের কাজে বস্তিতে গিয়েছিল। তারক ঘোষের কাছে কিছু টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছিল বারান্দা ঘিরে মিনতির জন্য ঠাকুরঘর বানাবে বলে। ভেবেছিল নির্মলকে নিয়ে নিজেরাই বেড়া দিয়ে ঘিরে নেবে। এমন বড় কাজ কিছু নয়। এটুকু কাজের জন্য মিস্ত্রি ডেকে পয়সা খরচ করার কোনও মানে হয় না। তার এখন টাকা জমানোর সময়।
দুপুর গড়িয়ে বাড়ি ফিরে দেখল নির্মল আর মিনতি মিলে বেড়া সেট করে ফেলেছে। আর সেখানে নতুন পালিশ-করা শিশুকাঠের সিংহাসন থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। তাহলে নির্মল আজ স্কুলে যায়নি। কেন, আজ তো কোনও ছুটি নেই। আজ শনিবার, সন্ধেবেলার বাসে তার আসার কথা। সে তো ক্যালেন্ডার দেখে হিসেব কষে রাখে ছুটির দিনগুলো।
সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল পরিমল। দেখল মিনতি আর নির্মল তাকাতাকি করছে আর হাসছে। নির্মল আবার শোলার কদম, চাঁদমালা আর গাঁদাফুলের মালাও এনেছে। নিশ্চয় তার বাঁধিয়ে এনে দেওয়া সেই চুমকি-বসানো রাধামাধবকেই আসনে বসাবে মিনতি। আজকেই কি? না বোধহয়। পঞ্জিকা দেখে নিশ্চয় ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করবে মিনতি।
–স্কুলে যাসনি আজ? তোর আজ সন্ধেবেলা আসার কথা না?
–ছুটি হয়ে গেল রোলকল করে। ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা জলে ডুবে মারা গেছে। কন্ডোলেন্স করে ছুটি হয়ে গেল। ফার্নিচারের দোকানগুলো দেখতে দেখতে এটা পছন্দ হয়ে গেল। বউদি একটা আসনের কথা বলছিল…
–বউদি তোকে ঠাকুরের আসন কিনতে বলেছে? তুমি ওকে বলেছ নাকি?
–না না, বউদি বলেনি। তোমরাই তো বলাবলি কর মাঝে মাঝে। আমি ভাবলাম একটা সারপ্রাইজ দেব তোমাদের। দু’কিস্তিতে শোধ দেব। ও তুমি ভেবো না। ভালো হয়েছে না?
মিনতির দিকে তাকিয়ে পরিমল দেখল মিনতিও যেন কেমন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখ সরিয়ে নিল পরিমল। তার অস্বস্তি হচ্ছিল।
সেদিন রাতেই। পরিমল প্রথমে বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল ও কিছু নয়, কিংবা হয়তো এ রকমই হয়। কিন্তু মিনতি কিছুক্ষণ বাদে তার হাত ঠেলে সরিয়ে দিল। একটু অবাক হল পরিমল। মিনতি কখনও এ রকম করে না। পরিমলের সব আবদার সে হাসিমুখে মেনে নেয়। আজ এ রকম করছে কেন। এর সঙ্গে নির্মলের এনে দেওয়া শিশুকাঠের সিংহাসনের কোনও চোরা-সম্পর্ক নেই তো।
–কী হল তোমার, মিনু?
–ভালো লাগছে না আমার। ভয় করছে।
–সে কী, ভয়ের কী হল আবার। আমি কি বাঘ, না ভালুক।
–তুমি কি অস্বাভাবিক কিছু টের পেলে? এক জায়গায় একটা দলা মতো…
–হ্যাঁ, তাই তো মনে হল। ঠিকই বলেছ তুমি। কী হয়েছে তাতে? টানফান লেগেছে হয়ত কখনও, ফুলে আছে। ভারি কিছু টানতে তোমাকে কতদিন নিষেধ করেছি।
কিচ্ছু বোঝো না তুমি। ভালোবাসার শুধু একটাই মানে বোঝো তোমরা। ওটা ভালো লক্ষণ নয়। আমার ছোটমাসি, মা– প্রথমে বুঝতে পারেনি। তোমার মতই ভেবেছে– ও কিছু নয়। মাসিকে তাও শেষ অবস্থায় কলকাতায় নিয়েছিল। কোনও লাভ হয়নি। আর মাকে তো কোনও চিকিৎসাই করায়নি বাবা। পাড়ার হোমিওপ্যাথিকে দিকে দেখাত।
মুখে– ভ্যাট, তোমার ওসব হতেই পারে না, বলল বটে পরিমল, কিন্তু তার বুকের ভেতর দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। পরিমল শুনেছে মিনতির মা আর মাসির ক্যান্সার হয়েছিল। ব্যস্, মুখে একটু চুকচুক করেছে। ওই পর্যন্ত। আর কোনও খবর নেয়নি। এবার কি তার ঘাড়ের ওপরেই ঝকঝকে খাঁড়াটা ঝুলছে। রাধামাধব, মিনতির সন্দেহ যেন ভুল হয়। মিনতির বুকের দলা কমিয়ে দাও ঠাকুর।
–শোনো, তুমি কাল একটা কাজ করবে। সকালে সাপ্লাই দিয়ে ফেরার পথে একেবার কুতুবপুরের বাইপাসের মোড়ে যাবে। ওখানে সাহা মেডিক্যালে গিয়ে খোঁজ নেবে মেয়েলি অসুখের ডাক্তার কখন বসেন। একবারে নাম লিখিয়ে আসবে। ভিজিট টিজিট সব ভালো করে সব শুনে আসবে।
অন্ধকারে পরিমলের মুখ দেখতে পেল না মিনতি।
কুতুবপুরের ডাক্তার সব শুনে ঘসঘস করে প্রেসক্রিপশন লিখলেন। কতগুলো টেস্ট নাকি করতে হবে। যেগুলো এখানে হবে না। শিলিগুড়ি যেতে হবে। ওখানেই একজন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে দিলেন। তিনিই ভালো করে পরীক্ষা করে যা করার করবেন। নামও লিখে দিলেন সেই ডাক্তারবাবুর। তারপর একদিন সুন্দর সকালে ওরা দুজন ভ্যানে বাইপাসের মোড়ে গিয়ে সেখান থেকে শিলিগুড়ির বাস ধরল।
–শুনছ, তোমার সঙ্গে আমাকেও কি ডাক্তারের চেম্বারের ভেতরে যেতে দেবে?
ওরা দু’জন চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছিল। একা কোনও মহিলা পেশেন্ট ঢুকলে ভারি নীল পর্দার ফাঁক দিয়ে পরিমল দু’একবার উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করেছে। কিছুই বোঝা যায় না। খুব অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল পরিমল। আবার এসে মিনতির পাশে বসছিল। মিনতি জানে তার অসুখের কথা ভেবে পরিমলের এই চঞ্চলতা নয়। মিনতি একা ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকবে কিনা, ডাক্তার ফাঁকা ঘরে তার বুক পরীক্ষা করবে কিনা– সেটাই পরিমলের দুশ্চিন্তার কারণ। ঠিকই ভেবেছে সে। থাকতে না পেরে পরিমল জিজ্ঞেসই করল মিনতিকে।
–নিশ্চয় তুমিও যাবে। যারা একা ঢুকছে, সবাই তো আর আমার মতো নয়। কত রকম অসুখবিসুখ, সন্দেহ, রিপোট দেখানো, ওষুধ পালটানো নিয়ে লোকজন আসে। আমার মতো ঘটনা হলে ডাক্তারবাবুই বলে দেয় সঙ্গে বাড়ির লোক যেন থাকে। তুমি অত চিন্তা কোরো না।
–না, মানে, সেদিন শুনলাম সাহা মেডিক্যালে এক ডাক্তার নাকি কী অসভ্যতা করেছে। পরদিনই পালিয়ে গেছে। অবশ্য সবাই তো আর সমান নয়। দেখা যাক। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তো আছিই।
একুশ, মিনতি ঘোষ। লাফ দিয়ে আগেই উঠে দাঁড়াল পরিমল। মিনতি ধীরে সুস্থে উঠল। ভারি নীল পর্দা সরিয়ে দু’জন একসঙ্গে ভেতরে ঢুকল। ব্যাগ খুলে আগের প্রেস্ক্রিপশন টেবিলে রাখল মিনতি। ওখনেই সব লেখা আছে। তার বুকের কথা। তার বুকের ভেতরের কথা। ডক্টর তলাপাত্র, বয়স্ক মানুষ, ভারি চশমা– ওদের দু’জনকে একবার দেখলেন। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটিকে কী যেন বললেন। পরিমল বুঝতে পারল না অস্পষ্ট কথা। মেয়েটি মিনতিকে ইশারা করল পাশে সবুজ পর্দাঘেরা জায়গাটায় যেতে। পরিমলের দিকে একবার তাকিয়ে মিনতি উঠে গেল সেখানে। পরিমল লক্ষ করল মেয়েটিও মিনতির সঙ্গে গেল। হয়ে গেছে স্যার– একটু বাদেই এসে ডাক্তারবাবুকে বললে ডাক্তারবাবু পর্দাঘেরা ঘরে ঢুকলেন।
এক মিনিটেই পরিমল অধৈর্য হয়ে উঠছিল। এত সময় লাগার কী আছে, সে বুঝতে পারছিল না। তখনই ডাক্তার তলাপাত্র বেরিয়ে এলেন। মিনতি বের হল আরও দু’মিনিট বাদে।
ওরা দু’জন বসে আছে ডাক্তারবাবুর উল্টোদিকের চেয়ারে। মিনতির সঙ্গে কথা বলছিলেন ডাক্তারবাবু। পরিমলের খুব খারাপ লাগছিল ডাক্তার কেমন নির্বিকার মুখে মিনতির সঙ্গে তার মাসিকের কথা, পায়খান-পেচ্ছাপের কথা জিজ্ঞেস করছে। তার নিজেরই লজ্জা করছিল। মিনতিও তার মা, মাসির কথা বলেছে।
–কী করেন আপনি?
পরিমল প্রথমে বুঝতে পারেনি ডাক্তারবাবু তাকেই জিজ্ঞেস করেছে। চুপ করে ছিল। পাশ থেকে মিনতি আস্তে করে টিপুনি দিলে সে দেখল ডাক্তারবাবু ভারি চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
–আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার দুধের বিজিনেস। কুতুবপুরে সব সাপ্লাই আমার।
–আয়রনিক্যাল। পাশেই দাঁড়ানো মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে খুব হালকা একটু হাসি বেরিয়ে এল ডাক্তারবাবুর ঠোঁট বেয়ে। এ কথার মানে ওরা কেউ বুঝল না।
–এত দিন কী করছিলেন। শিখা, ওদের এই টেস্টগুলোর কথা বুঝিয়ে দাও। রিপোর্ট নিয়ে যত কুইক সম্ভব আসতে বলে দাও। যান আপনারা ওর সঙ্গে। সব বুঝিয়ে দেবে।
চার’শ টাকা ভিজিট নাম লেখানোর সময় কাউন্টারেই জমা দিয়েছিল ওরা। শিখা– বাদামিশাড়ি, বাদামি ব্লাউজপরা মেয়েটা বলে দিল ম্যামোগ্রাফির কথা। অন্যান্য টেস্টের কথা। পরিমল লক্ষ করে দেখল আরও ক’জন মেয়ে একই রকম শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে ওপরে তাকিয়ে দেখল লেখা আছে ডক্টর পি তলাপাত্র, অঙ্কোলজিস্ট। সে একবার ভাবল মিনতিকে জিজ্ঞেস করবে অঙ্কোলজিস্ট মানে কী। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ভয় করল তার।
দিন চারেক বাদে সব রিপোর্ট নিয়ে পরিমল একাই গিয়েছিল ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। এমন কী, সে মিনতিকেও জানায়নি রিপোর্ট দেখাতে যাওয়ার কথা। ফিরছিল যখন, তখন সে মিনতির ব্রেস্ট ক্যান্সার অনেকটা ছড়িয়ে পড়ার কথা জানতে পেরে গেছে। ডাক্তারবাবু জানতে চেয়েছেন সে মুম্বাই গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবে কিনা।
পরদিন খুব ভোরে দুধ নিয়ে ফেরার সময় সে হেলাবটতলায় সাইকেল থামিয়ে গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। দড়ির বাঁধন খুলে ভরা ক্যানদুটো নামিয়ে আনল। একে একে দুটো ক্যানেরই সম্পূর্ণ দুধ গড়িয়ে দিল মাটির ওপরে। বৈশাখের গরম মাটি শুষে নিচ্ছিল ভরাট ক্যান খালি-হওয়া সতেজ দুধ। জয় রাধে, জয় রাধে– দুধের দুটি ধারার দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলছিল পরিমল।