শিবাংশু দে
আমরা আগমার্কা প্রবাসী বাঙালি হলেও পিতামহের সময় পর্যন্ত আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আদত উত্তর কলকাতার লোক। অরিজিন্যালি হুগলি জেলার বদনগঞ্জ-কয়াপাটের লোক ছিলেন তাঁরা। কায়েতের জাতব্যবসার প্রয়োজনে মোকাম কলকাতায় এসেছিলেন প্রায় বিদ্যাসাগরের কালে। পিতামহ কলকাতা ত্যাগ করে চাকরি নিয়ে টাটাবাবার শহরে এসেছিলেন। তারও তো সেঞ্চুরি হয়ে গেল।
তো আমার পিতামহের থেকে সেকালের কলকাতার ঘটি কালচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা কিস্যাকাহিনি শুনতুম আমরা। কলকাতা শহরে পুজোর দিনে পুরুত হাইজ্যাক করার গপ্পো বহু পুরোনো। বাবাকে না পেয়ে অসহায় ছেলেকে গ্রেফতার করে এনে পুজো করানোর প্রথাটি প্রাচীন ট্র্যাডিশন। আদ্যিকালে ছাপা ‘পুরোহিত দর্পণ’ বিশেষ পাওয়া যেত না। হয় পুথি বা অন্য কোনও উপায়ে মন্ত্রাদি উদ্ধার করে দেবতাদের পুজোআচ্চা হত।
সেরকম কোনও পুজোপাশার যোগ পড়লে স্বাভাবিকভাবেই পুরুতমশাইরা ডিম্যান্ড-সাপ্লাইয়ের নিয়মে বাজার থেকে গায়েব হয়ে যেতেন। তাঁকে না পেয়ে পুজোওয়ালারা ধরে এনেছে তাঁর ছেলেকে। যার পুজোটুজো সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই। কিন্তু ‘আপৎকালে অর্ধং ত্যজতি’ নিয়ম মেনে না চললে কী করে চলবে? তাই পুরোহিতের পুত্রবর আসনে বসে অনুচ্চস্বরে যে মন্ত্রপাঠ শুরু করে তার বিশাল আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য আছে।
আম্রপল্লব দিয়ে জলসিঞ্চন করে নিরুপায় পুরোহিত বলতে থাকেন,
ওঁ ঘটায় নমো, পটায় নমো
আমি জানি না, বাবা জানে
তবু শালারা ধরে আনে…
যেরকম শোনা যায় ১৭৯০ সালে গুপ্তিপাড়ায় বারোয়ারি পুজোর সূত্রপাত হওয়ার পর ব্রাহ্মণ্যমতের নিগড়বদ্ধ পূজাপদ্ধতির দ্রুত তরলীকরণ হতে থাকে। এমনিতেই মূল দেবীপূজার শিকড় ছিল আর্যেতর সংস্কৃতির মাটিতে। সেই মতে প্রকৃতিই ছিলেন দেবতা। যে দেবতা সর্বতোভাবে শস্য ও কৃষির অধিষ্ঠাত্রী। দেবীর রূপ ছিল নিরাকার প্রতীক। কখনও তিনি বৃক্ষ, কখনও পাষাণ-খণ্ড, কখনও বা মৃত্তিকাস্তূপ। এদিক দিয়ে তাঁদের বৈদিক আর্যদের সঙ্গে মিল ছিল। কারণ সেকালের আর্যরাও নিরাকার দেবতার পূজা করতেন। প্রতীক ছিল মূলত অগ্নি ও যজ্ঞকুণ্ড। পুরাণযুগের প্রাথমিক অবস্থায় দৈবী প্রতীক হিসেবে ‘পূর্ণকুম্ভে’র প্রচলন হয়। মাটির ঘট জলপূর্ণ করে তার মধ্যে প্রকৃতি বা শস্যদেবীকে অবস্থান করতে অনুরোধ জানানো হত। কৃষি ও শস্য উৎপাদনের মূল উপাদান মাটি ও জল। অন্যদিকে ঘটের গোলাকার আকৃতি পূর্ণতার প্রতীক। ‘শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’র নিয়ন্তা দেবী শাকম্ভরী, যিনি কালক্রমে দুর্গারূপে বিবর্তিত হন, জলপূর্ণ ঘটের মাধ্যমে তাঁর পূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর্যসংস্কৃতির নির্দেশমতো ঘটের উপাদান হিসেবে গঙ্গামাটি ও গঙ্গাজলের ব্যবহারই প্রশস্ত মনে করা হত। ক্রমশ শুধু প্রকৃতিদেবী নয়, সমস্ত দেবতার পূজায় ঘট ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। দেবতাকে আবাহনের প্রথম স্তর তাঁকে ঘটের প্রতীকে স্থাপন করা। ‘পট’ বা দেবতার মনুষ্যোচিত রূপের বিগ্রহ কল্পনা আসে বহু পরে। বস্তুত মহাযানী সংস্কৃতির দেবদেবীদের রূপকল্পনা অনুসরণ করে আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে মূর্তিপূজার প্রচলন হয়েছিল। পটচিত্রের মাধ্যমে দেবীমূর্তির কল্পনা মূর্তিযুগের আগেই এসে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের জন্য ঘটে-পটে দেবতার পুজো করাই ছিল একমাত্র বিকল্প। পাষাণ-বিগ্রহের মাধ্যমে দেবতার পূজা ছিল রাজা-গজার ক্ষমতার সাম্রাজ্য। গরিব তার দিকে তাকিয়ে থাকত দূর থেকে। তার না ছিল ক্ষমতা, না দুঃসাহস।
পুরাণযুগে নতুন নতুন দেবদেবীর কল্পনা প্রায় আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের জন্য ব্যক্তিগত দেবতার উদভাবনা ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতির সামাজিক নীতির প্রাথমিকতা হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য তাঁদের নিজস্ব দেবতারা রচিত হতে থাকেন। ঋষি-কবিদের কল্পনা থেকে সূত্র নিয়ে ভাস্কররা নিত্য-নব দেবতার মূর্তি সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু এই সমস্ত দেবতারাই ক্ষমতাশালী, অর্থশালী, সংখ্যালঘু অভিজাতবর্গের অধিকার ক্ষেত্রের মধ্যে বসবাস করতেন। গরিব মানুষের দেবতা তা হলে কে হবেন? তখন দেবতার প্রতীক হিসেবে বহু বস্তুকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যেমন, ঘট, প্রতিমা, যজ্ঞবেদী, জল, যন্ত্র (গোপ্য চিহ্ন), চিত্র (পট), দর্পণ, মণ্ডল ও হৃদয়। উল্লেখ্য, স্বীকার করা হয়েছিল কোনও বস্তুগত প্রতীক জোগাড় না হলেও দেবতাকে হৃদয়ে স্থাপন করেও পূজা করা যেতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন ঘট, পট ও প্রতিমা।
ঘটের মাধ্যমে পুজো করতে গেলে গঙ্গামাটি ও গঙ্গাজল ছাড়া লাগে ধান্য শস্য। পঞ্চ বা সপ্তপল্লব। তা আম্রবৃক্ষের হলে প্রশস্ত। না হলে অশ্বত্থ, বট, পাকুড় বা যজ্ঞডুমুর হলেও চলে। মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটি বৃক্ষই গ্রামবাংলার কৃষিসমাজ ও তার যাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। পূজাঘটের উপর কদলীফল রাখা হয়। যে প্রথা থেকে ‘সর্বঘটে কাঁঠালি কলা’র প্রবাদটি এসেছে। কলাপ্রজনন সংস্কৃতির প্রতীক। মঙ্গলঘটে অবশ্য সশীর্ষ নারিকেল বা ডাব ব্যবহার করা হয়। ঘটের ‘ঘটনা’ হল তার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় প্রথাপ্রকরণই এদেশের কৃষিজাত সমাজের অনুষঙ্গ থেকে এসেছে। পুরাণযুগে অবশ্য ঘট বা কলস প্রকরণটিকে এত সরল রাখা হয়নি। আরও পরে মহানির্বাণতন্ত্রের সময়ে এসে তার আড়ম্বর বেশ বেড়ে যায়। এই তন্ত্রের পঞ্চম উল্লাসে বলা হয়েছে,
কলসস্থাপনং বক্ষ্যে চক্রানুষ্ঠানমেব চ
যেনানুষ্ঠেনমাত্রেণ দেবতা সুপ্রসীদতি।।
মন্ত্রসিদ্ধির্ভবেন্নূনমিচ্ছসিদ্ধিঃ প্রজয়তে।। ১৮০
কলাং কলাং গৃহীত্বা তু দেবাণাং বিশ্বকর্মণা।
নির্মিতোহয়ং স বৈ যস্মাৎ কলসস্তেন কথ্যতে।।১৮১
ইত্যাদি।
অস্যার্থ, কলসস্থাপন ও মন্ত্র উচ্চারণ করলে ইচ্ছা সিদ্ধ হয় ও দেবতারা প্রীত হন। বিশ্বকর্মা এক একজন দেবতার থেকে কলা আহরণ করে কলস নির্মাণ করেছেন। তাই একে (পাত্রটিকে) কলস বলা হয়। কলসের বিস্তৃতি হবে দেড় হাত, উচ্চতা ষোলো আঙুল, কণ্ঠ চার আঙুল, মুখের বিস্তার ছয় আঙুল এবং তলদেশ পাঁচ আঙুল পরিমাণ। কলস নির্মাণের উপাদান হিসেবে সোনা, রূপা, তামা, কাঁসা, মাটি, পাষাণ বা কাচ ব্যবহার করা যায়। বস্তু উপাদানের ভিন্নতায় ভক্তের প্রত্যাশিত ফলও বদলে যায়। সোনার কলস ভোগদায়ক, রূপা মোক্ষদায়ক, তামা প্রীতিকর, কাঁসা পুষ্টিবর্ধক, কাচ বশীকরণকারক, পাষাণ স্তম্ভনোদ্দীপক এবং মাটির পাত্র ‘সুদৃশ্য ও সুপরিষ্কৃত’ হলে সর্বকার্যে প্রশস্ত। কলসের উপাদান হিসেবে মূল্যবান পদার্থের ব্যবহার, তার ‘পাইয়ে দেওয়ার’ ক্ষমতাকে কীভাবে প্রভাবিত করে এই বিধানগুলি তার প্রমাণ। অর্থাৎ ঘট বা কলসের মাধ্যমে পূজার ক্ষেত্রে দরিদ্র ইতর ও ধনী ক্ষমতাশালী জনগণের পুণ্যার্জনেও ফারাক পড়ত।
তন্ত্রজাত দেবী দুর্গাকে আর্য ব্রাহ্মণ্য মতে কীভাবে পূজা করা যায় তা নিয়ে বঙ্গদেশে অনেক পণ্ডিত চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন বালক, ভবদেব ভট্ট, শ্রীকর দত্ত প্রমুখ। কিন্তু এ বিষয়ে সব চেয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন। তিনি তিনটি প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, দুর্গোৎসবতত্ত্ব, দুর্গাপূজাতত্ত্ব এবং কৃত্যতত্ত্ব। তাঁর ঝোঁক ছিল তন্ত্রবিহিত পূজাপদ্ধতি প্রয়োগ করার। তাঁর প্রবর্তিত স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী ছয়টি কল্পের বিধান আছে। তাদের মধ্যে বঙ্গদেশে ষষ্ঠ্যাদি কল্পই জনপ্রিয়। এই কল্পে ষষ্ঠী তিথির থেকে শারদীয়া দেবীর পূজা আরম্ভ হয়। প্রথম দিনটি, অর্থাৎ ষষ্ঠীর দিন দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা হয় না। সেদিনটি রাখা থাকে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস অনুষ্ঠানের জন্য। সেদিন বিল্ববৃক্ষের শাখায় দেবীর বোধন হয়। বোধন অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ নবপত্রিকা।
নবপত্রিকা অনুষ্ঠানটি প্রাগৈতিহাসিক কৌমসমাজের শস্যদেবী বা পৃথিবীদেবীর উপাসনার ঐতিহ্য মনে করিয়ে দেয়। নয়টি উদ্ভিদ, যেমন কলাগাছ, কালো কচুগাছ, মানকচুগাছ, হলুদগাছ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম ও অশোকগাছের শাখা এবং ধানের শিষকে অপরাজিতার লতা ও হলুদ সুতো দিয়ে একত্র বেঁধে পূজা করা হয়। আদিযুগে উদ্ভিদগুলি নিজস্ব পরিচয়েই পূজিত হতো। পুরাণযুগে প্রতিটি উদ্ভিদকে বিভিন্ন দেবীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। গাছগুলি নয়জন দেবীর প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। যেমন, কলাগাছ— ব্রহ্মাণী, কালো কচুগাছ— কালী, হলুদগাছ— দুর্গা, জয়ন্তীগাছ— কার্তিকী, বেলগাছ— শিবা, ডালিমগাছ— রক্তদন্তিকা, অশোকগাছ— শোকরহিতা, মানকচুগাছ— চামুণ্ডা এবং ধানশিষ— লক্ষ্মী। লক্ষণীয়, প্রাচীনতর মার্কণ্ডেয়পুরাণ ও অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন কালিকাপুরাণ, দুই সঙ্কলনেই নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ আছে।
আর্যধর্মে দু ধরনের পূজাশৈলীর স্বীকৃতি আছে। বৈদিক এবং তান্ত্রিক। দেবীপূজার আদি ঐতিহ্য যেহেতু কৌম পরম্পরার অংশ ছিল, তাই এই পূজার রীতিপ্রকৃতি বিশেষভাবে তান্ত্রিক মতানুসারী। কিন্তু দুর্গার বর্তমান স্বরূপটি পুরাণ নির্ধারিত হওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মে তাঁর পূজাকে ‘বৈদিক’ হিসেবেও দাবি করা হয়। ঘটের মাধ্যমে দেবীর পূজা প্রকরণটির মধ্যে তান্ত্রিক ও বৈদিক উভয় মতেরই সমীকরণ ঘটেছিল। অবশ্য ঘটনা হল দুর্গাপূজা শুধুমাত্র একটি ‘পূজা’ নয়। এটি সামগ্রিকভাবে একটি উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। যার লোকপ্রিয় পরিচয় ‘দুর্গোৎসব’ হিসেবে।
দুর্গাপূজা যখন ‘দুর্গোৎসবে’ পরিণত হয়ে যায়, তখন মানুষের মধ্যে দেবীকে মানুষের কলেবরে রূপায়িত করে পূজা করার প্রবণতা বেড়ে ওঠে। যখন থেকে, মানে সেই পাঁচ-ছয় শতক থেকে, মহিষমর্দিনী বা বৃহত্তর অর্থে দেবী দুর্গার বিগ্রহ কল্পনা করা শুরু হয়। রাজশক্তির পোষকতায় নানা দেবালয়ে যখন দেবতাদের বিগ্রহ স্থাপন শুরু হয়েছিল, মহিষমর্দিনীও তাঁদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলেন। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাতেও রাজানুকূল্যে পাল-সেন যুগ পর্যন্ত ধাতু ও পাষাণে গড়া দেববিগ্রহ নির্মিত হত। কিন্তু জনসাধারণের পক্ষে সেই সব উপাদান ব্যবহার করে মূর্তি নির্মাণের চল ছিল না। সঙ্গতভাবেই আর্থিক কারণই ছিল মুখ্য। সাবেক মহিষমর্দিনী বা আধুনিক দুর্গামূর্তির নান্দনিক আড়ম্বর তাকে অন্য দেববিগ্রহের থেকে আলাদা করে দেয়। অন্যদিকে, কৌম সমাজের মানুষ এই দেবীকে প্রকৃতিদেবী হিসেবে দেখতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তাঁর মানবিক বিগ্রহের বদলে ঘট ও নৈসর্গিক প্রতীকের মাধ্যমে পূজা করা অর্থ সামর্থ্যহীন মানুষদের কাছে ছিল একমাত্র বিকল্প।
ঘটকেন্দ্রিক পূজাপদ্ধতি বজায় রেখেই, ক্রমশ বাংলা ও ওড়িশায় দেবতার পটচিত্র ‘বিগ্রহ’ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। মুঘল আমলে বঙ্গীয় ভূমিপতি শাসকদের দৌলতে, মহিষমর্দিনী থেকে ‘সপরিবার’ শারদীয় দুর্গার মৃন্ময় বিগ্রহ নির্মিত হওয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনও সাধারণ ভক্তের সেভাবে জাঁকজমক সহকারে ‘দুর্গাপূজা’ করার সঙ্গতি ছিল না। তাঁরা গৃহকোণে দেবীর নামে ঘটস্থাপন করে পটের মাধ্যমে পুজো করতেন। আঠেরো শতকের শেষ, উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধীরে ধীরে গৃহগত পূজার বদলে বারোয়ারি পরিসরেই স্বচ্ছন্দ হতে শুরু করেছিলেন। যদিও বহু ধনাঢ্য পরিবারে ‘নিজস্ব’ পূজা করার প্রথায় মন্দা আসেনি। যেগুলিকে সাধারণ লোক-উচ্চারণে ‘জাঁকের পুজো’ বলা হত।
বাংলার নগর অঞ্চলে, বর্ণাঢ্য পারিবারিক ও বারোয়ারি পুজোর জাঁক বেড়ে উঠলেও গ্রামীণ এলাকায় মূলত আর্থিক সামর্থ্যের অভাবেই এ জাতীয় পুজো সংস্কৃতি বেড়ে ওঠেনি। সেখানে ধনী না হলেও সীমাবদ্ধ সামর্থ্যের মানুষরা ঘট ও পটের মাধ্যমে দেবী আরাধনা করতেন। এই পরম্পরাটি বাংলার নানা জায়গায় এখনও প্রচলিত আছে। যদিও আর্থিক উপায়ের ‘টান’ এখন আর তেমন তাৎপর্য রাখে না। ব্যবহারিক কারণেই শুধুমাত্র ঘট ও পটের মাধ্যমে পূজা করার ঘটনা কমে আসছে। গ্রামীণ, পারিবারিক পূজা আয়োজনে সচরাচর মৃন্ময়ী রূপেই দেবীকে আরাধনা করা হয়। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। বেশ কিছুদিন ধরে বাংলার গ্রামীণ জীবনে ঘটে-পটে বাড়ির দুর্গাপুজো পরম্পরা প্রসঙ্গে বীরভূমের নানুরে হাটসেরান্দি গ্রামের নামটি উঠে আসছে। এই গ্রামটিকে বাংলায় ‘ঘটে-পটে’ পুজো আয়োজনের ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়। বর্তমানে সেটি একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আর্থিক সামর্থ্যের বিচারে এই মুহূর্তে গ্রামবাসীদের স্বচ্ছলতা অবশ্যই চোখে পড়ে। কিন্তু লোকবিশ্বাস অনুযায়ী দুশো বছর আগে এই গ্রামে মানুষজনের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। স্থানীয় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কর্তা গঙ্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের সাধ হয় দুর্গাপুজো করার। কিন্তু যথেষ্ট বিত্তসঞ্চয় ছিল না। তখন লোকমুখে একটি কিংবদন্তির জন্ম হয়। দেবী নাকি স্বয়ং এক বালিকার রূপ ধরে এসে চাটুজ্যেমশাইকে ঘটে-পটে পুজো করার নির্দেশ দেন। কারণ তাতে খরচ কম। চাটুজ্যেবাড়ি থেকেই প্রথম ঐ গ্রামে ঘটে-পটে পুজো শুরু হয়। ক্রমশ আরও চারটি পরিবার, ভট্টাচার্য, মজুমদার, মণ্ডল ও ঘোষরা পারিবারিক দুর্গাপুজো শুরু করেন। শরিকি বিবাদে পৃথগন্ন হওয়ায় পরিবারগুলির মোট পুজো বেড়ে আঠেরো-উনিশটি হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে চট্টোপাধ্যায় এবং মণ্ডল পরিবারের পুজোয় এখনও ঘটে-পটে পুজো হয়। অন্যান্য পুজোগুলিতে ঘট ও মৃন্ময়ী প্রতিমার মাধ্যমে দেবীকে আরাধনা করা হয়। সপ্তমীর দিন ভোরে সারি বেঁধে উনিশটি ‘কলাবৌ’ গ্রামের পুকুরে স্নান করিয়ে মিছিল করে গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাটসেরান্দি গ্রামটি বেশ প্রাচীন। বাংলা-শৈলীর বেশ কিছু মন্দির চোখে পড়ে এখানে। শহর-বাজারের দানবাকৃতি অপচয়ী দুর্গোৎসবের প্রেক্ষাপটে এই গ্রামের পূজা আয়োজন সন্ধিৎসু মানুষকে যেন টাইম-মেশিনে কৃষিমাত্রিক প্রাচীন বাংলার অনুভবের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বাংলার আদি কৌমসমাজের অধীশ্বরী, ঘটেশ্বরী ও পটেশ্বরীরূপে রচিত পারিবারিক দুর্গা মনে করিয়ে দেয়, অপচয় নয়, সমর্পণই বাঙালির সেরা পুজোর মূলধন।