Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো — একটি সহজ পাঠ

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

[পর্ব – এক]

উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের শ্রেণিবিভাগ ও বৈজ্ঞানিক নামকরণ করতে গিয়ে কার্ল লিনি (১৭০৭-৭৮) মানুষের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন বেশ গুরুগম্ভীর একটি পরিচিতি— হোমো স্যাপিয়েন্স, যার অর্থ, চিন্তাশীল মানব। এই পরিচয় জ্ঞাপনের মধ্যে নিজেদের প্রতি একটু পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পেলেও তিনি যে কোনও মিথ্যা প্রজাতি-অহম দেখাননি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চিন্তাভাবনা তো মানুষ করেই। এই চিন্তার মাধ্যমেই ফ্রান্সের রেনেশাঁসকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রনে দকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) তাঁর নিজের অস্তিত্বের পক্ষে একটা যুক্তি খাড়া করেছিলেন, যা ইতিহাসে আজ অবধি প্রবাদপ্রতিম হয়ে আছে: Cogito ergo sum (অর্থাৎ, I think, therefore I exist)! যুক্তিটি আমরাও যার যার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি। তবে নিজেকে চিন্তাশীল বলে দাবি করলেও এই চিন্তা করার ক্ষমতাটা মানুষ কেমন করে অর্জন করল তা সে অত সহজে জানতে পারেনি। এই সবে একটু একটু করে জানতে শুরু করেছে।

মানুষ কীভাবে চিন্তা করতে পারে, অর্থাৎ, চিন্তা করার বাস্তব ভিত্তি, শারীরিক অবকাঠামো (physical substratum) বা মস্তিষ্কগত ভিত্তি কী, স্নায়ুতন্ত্রের ভূমিকা এতে কী, বিভিন্ন ইন্দ্রিয়, শ্রবণযন্ত্র ও বাক্‌যন্ত্রই বা কী ধরনের ভূমিকা পালন করে, ভাষার সঙ্গে চিন্তার সম্পর্ক কী— আজকের দিনে এই প্রশ্নগুলি খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। শুধু বিমূর্ত তাত্ত্বিক বা নিতান্ত বৈদ্যায়তনিক অর্থে নয়, ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও।

কয়েকটি এমন ব্যবহারিক উপলক্ষ উল্লেখ করা যাক।

এক, চিন্তা ও চেতনার প্রশ্নটিকে ঘিরে অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদ আবার নতুন করে মাথা তোলার চেষ্টা করছে, চেতনাকে বস্তুনিরপেক্ষ বস্তুবহির্ভূত স্বয়ম্ভূ সত্তা হিসাবে তুলে ধরার নানারকম অপপ্রয়াস শুধু ধর্মবিশ্বাসীদের তরফে নয়, এমনকি বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রচারের মঞ্চ থেকেও উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী ও যুক্তিবাদী শিবিরের পক্ষ থেকে বিষয়টায় নজর দেওয়া দরকার হয়ে পড়েছে।

দুই, অন্য দিকে, শিশুদের ভাষা আয়ত্ত করার প্রক্রিয়া, প্রথাগত ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি, শিশু বয়সে স্কুলে একাধিক ভাষা শেখানো উচিত কিনা, উন্নত চিন্তার জন্য উন্নত ভাষা শিক্ষা জরুরি কিনা, অন্য ভাষা একসঙ্গে শিখলে মাতৃভাষা শিক্ষা এবং মাতৃভাষায় শিক্ষা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিনা, ইত্যাদি নিয়েও বহু প্রশ্ন কৌতূহল এবং বিভ্রান্তি রয়েছে।

তিন, তাছাড়া মানুষের মানসিক নানারকম সমস্যা ও ব্যাধি সম্পর্কে জানতে হলে মনকে জানতে হবে, মনের গতিপ্রকৃতি জানতে হবে। তার জন্য মানুষের চিন্তা করার প্রক্রিয়াকেও বুঝতে হবে। আমরা যাকে মানুষের মন বা মানসিক জগত বলি, ব্যক্তি মানুষের জীবনে তা কীভাবে গড়ে ওঠে বুঝতে হবে। শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে মনোবিদ্যার প্রয়োগ এখন নানা কারণে জরুরি হয়ে উঠছে।

চার, সমাজে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বুদ্ধি ও মননগত যে স্তর পার্থক্য দেখা যায়, তার স্বরূপ ও কারণ বুঝবার জন্যও চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে ওঠার জৈব-সামাজিক ধারাটিকে অনুধাবন করা প্রয়োজন। সাধারণভাবে বহু মানুষের মনেই সমাজে যে দুটি ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান, অর্থাৎ, প্রতিভা ও ধীশক্তি দৈব আশীর্বাদধন্য ক্ষমতা কিংবা জিনবাহিত বংশগত ধারায় প্রাপ্ত জন্মগত গুণ— তার নিরাকরণ করতে হলেও একদিকে চিন্তাপ্রক্রিয়ার শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তিভূমিকে বোঝা প্রয়োজন, অপর দিকে শিশু বয়স থেকে ব্যক্তিবিশেষের মননজগৎ কীভাবে গড়ে ওঠে ও পরিপুষ্ট হয় তা জানা দরকার।

পাঁচ, যাঁরা দর্শনের চর্চা করেন, তাঁরা জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায়, অর্থাৎ, মানুষ তার চারপাশের দুনিয়া সম্পর্কে জানছে কেমন করে, যা জানছে তার সঠিকতা নিরূপণ করছে কীভাবে— এই সব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলেও মন চিন্তা ভাষা সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য হন। একই সঙ্গে ধারণা, বিশ্বাস, জ্ঞান, যুক্তিতর্ক, ইত্যাদি গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভাবতে গেলেও মন ও চিন্তার সক্রিয়তা বিচার্য।

ছয়, সর্বোপরি, এই জাতীয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে অসংখ্য বিভ্রান্তি সমাজে ছড়িয়ে রয়েছে, তাকে কাটাতে হলেও চিন্তা ও ভাষার প্রশ্নটিকে সঠিকভাবে অধ্যয়ন ও অনুধাবন করা প্রয়োজন।

বর্তমান প্রবন্ধ তারই একটা সামান্য উদ্যোগ। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে এখানে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা উত্থাপন করা না হলেও এগুলিকে সামনে রেখেই ভাষা ও চিন্তা সংক্রান্ত এই নিবন্ধের অবতারণা।

 

প্রাথমিক কথা

মূল আলোচনায় ঢোকার আগে কয়েকটি কথা আমি গোড়াতে বলে নেওয়া প্রয়োজন বোধ করছি। যেমন— ভাষার সঙ্গে যে চিন্তা করার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে, এটা প্রায় সকলেই জানেন এবং কম বেশি মেনেও নেন। সাধারণভাবে বলা হয়, ভাষা চিন্তার বাহন। ভাষার অবলম্বন ছাড়া আমরা নিজেরাও কিছু চিন্তা করতে পারি না, আবার ভাষার সাহায্য ব্যতিরেকে অন্যকেও কিছুই বোঝাতে পারি না। এই বিষয়টা নিয়ে মানুষ সুদূর অতীত কাল থেকেই ভাবনাচিন্তা করেছে। চিনে কংফুজি (খ্রিঃপূঃ ৫৫১-৪৭৯), গ্রিসে সোক্রাতেস (খ্রিঃপূঃ ৪৬৯-৩৯৯), ভাষা এবং চিন্তার সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছেন। প্রাচীন ভারতে পাণিনি (খ্রিঃপূঃ ৮ম-৫ম শতাব্দ) যেভাবে ভাষার সংগঠন বা বিন্যাস নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, বৈদিক কথ্য ভাষাকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ দাঁড় করিয়েছেন, তার মধ্যে ভাষার মাধ্যমে চিন্তাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার বিস্তর ভাবনা ছিল। যদিও তখন চিন্তার সঙ্গে ভাষার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটি কোনও দেশেই মানুষ ধরতে পারেনি। অনেকে আবার মনে করতেন, ভাষা থেকে চিন্তাকে পৃথক করা সম্ভব। আমাদের দেশে কোনও কোনও পণ্ডিত এমনও মনে করতেন যে যথার্থ জ্ঞান একমাত্র ভাষাহীন চিন্তা, অর্থাৎ, নিস্তব্ধ ধ্যানের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। তাঁদের মতে, সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন ভাষার মাধ্যমে আদপেই সম্ভব নয়। কেন না, ভাষা জ্ঞাতব্য বিষয়কে সঙ্কুচিত করে দেয়, ভাষার দ্বারা প্রকাশিতব্য এক সঙ্কীর্ণ সীমার মধ্যে বেঁধে দেয়। তাই দুনিয়ার চরম তত্ত্ব, পরম সত্তার জ্ঞান হচ্ছে অনির্বচনীয়, বাক্যের দ্বারা প্রকাশের অতীত। আমরা পরে দেখতে পাব, আধুনিক বিজ্ঞান এটা সংশয়াতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে ভাষা ছাড়া চিন্তার বা চিন্তা ছাড়া ভাষার কোনও অস্তিত্বই নেই। দুটো একেবারে অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং, জ্ঞান, চিন্তা এবং ভাষাও পরস্পর নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কে বাঁধা।

দ্বিতীয়ত, বহু কাল পর্যন্ত মানুষ তার সচেতন কাজকর্ম, চিন্তা ভাবনা আবেগ অনুভূতির ব্যাখ্যা করবার জন্য খুঁজত একটা সত্তা— কে চিন্তা করায়, কে এই সব অনুভূতির জন্ম দেয়। এক সময় এসে সে এর জন্য দায়ী করেছিল তার শরীরের ভেতরে অবস্থিত অনুরূপ এক সত্তাকে, তথাকথিত এক সূক্ষ্মশরীরকে— যার নাম সে দিয়েছিল আত্মা। আত্মাই সব কিছুর কারক। তারা মনে করত, আত্মা যতক্ষণ দেহের মধ্যে আছে, ততক্ষণই একটা লোক সুস্থভাবে চলাফেরা কাজকর্ম করতে পারে। আত্মা তার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে সে ঘুমিয়ে পড়ে, অসুস্থ হয়ে পড়ে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সক্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। আত্মা একেবারে ফিরে না এলে সে মরে যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি। বিনা প্রমাণে তারা এই ধারণা গ্রহণ করেছিল, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। স্বপ্ন দেখে দেখে এবং একে অপরের চোখের তারায় পরস্পরের ক্ষুদ্র প্রতিবিম্ব দেখে তবেই তারা নিশ্চিত হয়েছিল, প্রত্যেকের শরীরের ভেতরে এরকম একটা করে সূক্ষ্মশরীর আছে।

এখন আমরা যেসব লক্ষণকে মানসিক রোগ বলে মনে করি, প্রাচীন কালে লোকে সেসব ঘটনাকে আত্মাসম্বন্ধীয় বিপর্যয় বলে মনে করত। তারা ভাবত, রোগীর নিজস্ব আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে এবং অন্য একটা দুষ্ট আত্মা সেখানে এসে বাসা বেঁধেছে। পাগলামি, ভর হওয়া, হিস্টিরিয়া, ভূতে পাওয়া— সব কিছুকেই তারা এইভাবে ব্যাখ্যা করত বা বুঝত। ওঝা গুণিনদের চিকিৎসাপদ্ধতিও ছিল এই বিশ্বাসনির্ভর। তারা লঙ্কার ধোঁয়া দিয়ে, ঝাঁটাপেটা করে, অর্থাৎ রোগীর উপর দৈহিক পীড়ন করেই সেই দুষ্ট আত্মাকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করত। তাদের ধারণা ছিল, এসব করলে স্থূল শরীরের যেমন কষ্ট হয়, নিশ্চয়ই সেই সূক্ষ্ম শরীরেরও তেমনই কষ্টানুভূতি হতে থাকে। তবে এই সব নিদানে দুষ্ট আত্মা পালাক বা না পালাক, তার ঠেলায় রোগীর প্রাণ অনেক সময় পালিয়ে যেত।

এই আত্মার ধারণা পরবর্তীকালে মন ও প্রাণের ধারণার সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায়। বিশ্বের অনেক ভাষাতেই এর রেশ এখনও অনেকটা থেকে গেছে। আমরা অনেক সময় বলি, “মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ করতে হবে”; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) গান লিখেছেন, “আমার পরান যাহা চায়”, কিংবা, “প্রাণ চায় চক্ষু না চায়”; ইত্যাদি। এখানে প্রাণকে মনের সঙ্গে একার্থক করে দেখানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, “গ্রাম থেকে শহরে এলে তার আত্মা ছটফট করতে থাকে”; দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সম্পর্ক বোঝাতে অনেক সময় “হরিহর আত্মা” অথবা “একাত্ম” শব্দবন্ধগুলি ব্যবহৃত হয়। এসব ক্ষেত্রে আত্মা আর মনকে সমার্থক ধরে নেওয়া হয়েছে। আবার “আত্মাহুতি”, “আত্মোৎসর্গ”, “ওনার আত্মা দেহত্যাগ করেছে”— ইত্যাদি বলার সময় আত্মা দিয়ে প্রাণ বোঝানো হয়েছে।

স্বভাবতই, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এই আত্মা ধারণার ভিত্তিহীনতা এবং অপ্রাসঙ্গিকতা বুঝতে না পেরেছে, ততদিন মন ও চিন্তার প্রক্রিয়াকে বোঝার মতো বাস্তব জ্ঞানগত পরিবেশ তৈরি হয়নি। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দ থেকেই মানুষ বিজ্ঞানের নানা শাখা থেকে আহরিত জ্ঞানের আলোকে একদিকে মন ও প্রাণের বিভিন্নতা ও অপরদিকে এই দুই সত্তার সঙ্কেত হিসাবে আত্মার ধারণার অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় চিন্তায় আত্মার ধারণা এখনও জমিয়ে বসে থাকলেও জ্ঞানবিজ্ঞানের এলাকায় তার অস্তিত্ব বিপন্ন।

তৃতীয়ত, ওপরে বর্ণিত ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই মানুষ মনে করত, মনের অস্তিত্ব হৃৎপিণ্ডে, বুকের ভেতরে। বাংলা ভাষায় আমরা এখনও মন বোঝাতে হৃদয়, হৃদ্‌মাঝারে, অন্তর, মর্ম, ইত্যাদি শব্দমালা ব্যবহার করি। গান গাই, “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে”, কিংবা “অন্তর মম বিকশিত কর”, ইত্যাদি। ব্যথা বেদনা ভয় বিক্ষোভের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে ফেলি— “বুকে ব্যথা লেগেছে”, “বুকের মধ্যে অনেক অভিমান জমে আছে”, “হৃদয় যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল”, “কলজেটা দুঃখে ফেটে যাচ্ছে”, “ভয়ে বুক কেঁপে উঠল”, “গর্বে বুক ফুলে উঠেছে”, ইত্যাদি।

আর ইংরেজিতে heart শব্দটা যে হৃদয় ও হৃৎপিণ্ড— উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়, তা সকলেই জানেন। তাছাড়া “আন্তরিকভাবে” বোঝাতে heart and soul, “আন্তরিক অভিনন্দন” জানাতে heartfelt greetings, ইত্যাদিতে মনের সঙ্গে আত্মাকে একার্থক করে দেওয়া হয়। আবার, ঘনিষ্ঠ বন্ধু বোঝাতে soul-mate, একঘেয়ে বোঝানোর জন্য soul-destroying, নীচ প্রকৃতির অর্থে soulless, ইত্যাদির ব্যবহার তো আছেই। এই সব জায়গায় আত্মা দিয়ে মন এবং চরিত্রকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্য দিকে, spirit শব্দটা দিয়ে একই সঙ্গে আত্মা/প্রেতাত্মাও বোঝায়, উদ্দীপনাও বোঝায়। এর থেকেই নিষ্পন্ন শব্দ inspiration দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত (প্রাণ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করুন) হওয়া বোঝায়, তেমনই expiration-এর দ্বারা মৃত্যু বিজ্ঞাপিত হয়।

অন্যান্য ভাষাতেও এরকম বিচিত্র ব্যবহার দেখতে পাওয়া যাবে। এই আলোচনা থেকে এটা খানিকটা পরিষ্কার হয়ে আসে যে যতদিন পর্যন্ত মানুষ ভাষার সঙ্গে চিন্তার সম্পর্ক এবং মস্তিষ্কের সঙ্গে মনের সম্পর্ক ধরতে পারেনি, ততদিন সে একদিকে হৃৎপিণ্ড, কলজে, বুক, ইত্যাদি দিয়ে মনের অবস্থান বুঝিয়েছে; অপরদিকে আত্মার ধারণা দিয়ে মনের কাজকর্ম ও বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করে গেছে।

কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দের গোড়া থেকে, যখন থেকে শারীরতত্ত্ব বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও পরীক্ষানিরীক্ষার পথ বেয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের মতো একটি মিতবিজ্ঞান (exact science) হিসাবে গড়ে উঠল, গঠনতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে শরীরের এক একটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনের সঙ্গে তাদের আলাদা আলাদা বিশেষ বিশেষ কার্যকলাপ কীভাবে জড়িত তা জানা গেল, তখন থেকেই দেহের সমস্ত বাহ্যিক ক্রিয়ার সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের ভূমিকা ধরা পড়তে থাকে। তখন থেকেই মানুষ মস্তিষ্কের সাথে মনের এবং চিন্তার সম্পর্ক বুঝতে শুরু করল। চিন্তা করো, ভাবো— এই সব বোঝাতে “মাথা খাটাও”, “মাথা ঘামাও”, “মাথায় কী পোরা আছে”— ইত্যাদি লব্জ নিত্যদিনের কথায় আসতে দেখা গেল। এই সময় থেকেই এক দল বিজ্ঞানী মন ও চিন্তার সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক আরও সুনির্দিষ্টভাবে অনুধাবন করতে সচেষ্ট হলেন। প্রাণরসায়নের ব্যাপক অগ্রগতির মধ্য দিয়ে স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের অনেক অনুপুঙ্খ ধীরে ধীরে জানা গেল। মস্তিষ্কের শবব্যবচ্ছেদ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে নানারকম রোগীর মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা থেকে এই জ্ঞান আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি, মস্তিষ্কে নানা ধরনের ভৌত বা রাসায়নিক সন্ধক (probe) ঢুকিয়ে এক একরকম আচরণের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কোন কোন অঞ্চল কতটা এবং কীভাবে উদ্দীপিত হয়, আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে দেখেও অনেক তথ্য জানা গেছে। এইভাবে বিগত দেড়শো বছরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এই ক্ষেত্রে জ্ঞানের যে বিপুল সঞ্চয় জমা হয়েছে, তার আলোকে— সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা না হলেও— ভাষা চিন্তা মন ও মস্তিষ্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলির সঙ্গে জড়িত অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেছে।

 

দর্শনের আলোকে

বিজ্ঞানের কাছে উত্তর পাওয়ার অনেক কাল আগে থেকেই দর্শনশাস্ত্র এইসব প্রশ্নে ঢোকার চেষ্টা করেছে, কিছু বলার চেষ্টা করেছে। জ্ঞানতত্ত্ব (epistemology বা theory of knowledge) দর্শনের একটা প্রধান স্তম্ভ। মানুষ কীভাবে জানতে পারে— এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর সঙ্গে জড়িত আর একটা জরুরি প্রশ্ন হল, মানুষের চিন্তার উৎপত্তি কী করে হল।

একটা সময় পর্যন্ত দুনিয়ার বেশিরভাগ পণ্ডিত ব্যক্তি উত্তরে বলতেন, চিন্তা করা মানুষের একটা আদি মৌলিক ও ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ব্যক্তিমানুষের চিন্তার যে আধার— চেতনা বা চৈতন্য— তা আসলে কোনও বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যের গোড়ায় রয়েছে এক আদি চৈতন্য বা পরমাত্মা; ব্যষ্টিচেতনা তারই অংশবিশেষ। ভারতের মাটিতে শঙ্কর (৭৮৮-৮২০) প্রবর্তিত অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন আবার (শূদ্র বাদে) জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনও ভেদ রাখেনি। উপনিষদের রচয়িতারা এই নিরাকার ও নিরাধার আদি চৈতন্যস্বরূপেরই নাম দিয়েছিলেন ব্রহ্ম (সংস্কৃত ভাষায়: ব্রহ্মণ্‌ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে বৃহঃ + মন > বৃহৎ মন থেকে)। দর্শনের এই ধারাকে সাধারণত বলা হয় ভাববাদ, যাদের মতে এইরকম কোনও এক চেতন সত্তা থেকে জড় বস্তুজগতের সৃষ্টি হয়েছে। চেতনা তাই বস্তুনির্ভর নয়। বরং বস্তুর অস্তিত্বই চেতনাশ্রিত।

এর বিপরীত ধারাও বহু প্রাচীনকাল থেকেই দর্শনে বিদ্যমান। তার সাধারণ নাম বস্তুবাদ। বস্তুত, যত প্রাচীনতর দর্শন, ততই তার বস্তুবাদের দিকে প্রবণতা। এমনকি যখন হয়ত বস্তু ধারণা আসেনি, তখনও বাস্তব জগতের কিছু না কিছু উপাদানকে নিয়ে তার কারবার, প্রকৃতির উপরেই তার নির্ভরতা। শুরুতে সে নেহাতই প্রকৃতিবাদ। তারপর ভাববাদের বিপরীতে দর্শনের মঞ্চে বস্তুবাদ হিসাবে আবির্ভূত হয়ে এসে তার বক্তব্য হল: বস্তুর আগে চেতনা নয়, বস্তুর উপর নির্ভর করে বস্তুর নানা রকম ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া গুণাগুণ থেকেই চেতনার উৎপত্তি হয়েছে। বহু দিন পর্যন্ত বস্তুবাদীরা চেতনার উদ্ভব সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলতে পারতেন না। তাঁরা বড় জোর বলতেন, বিশেষ বিশেষ বস্তুর বিশেষ ধরনের সমাবেশ হলেই চিন্তা বা চেতনা জন্ম নেয়। কেন না, এর বেশি বলার মতো নির্দিষ্ট জ্ঞান তখনও কারও হাতে ছিল না। যে যেটুকু বলতেন, তা স্রেফ দার্শনিক অবস্থানের ভিত্তিতেই।

যেমন, আমাদের দেশে চার্বাক বা বৃহস্পতি গোষ্ঠীর দার্শনিকরা মনে করতেন, মানবদেহ ছাড়া চেতনার কোনও নিরবলম্ব অস্তিত্ব নেই। কারণ, ঘুমন্ত, জখম, বেহুঁশ বা মৃত মানুষকে কখনও চিন্তা করতে দেখা যায় না। এঁদের তাই বেদান্তপন্থীরা বলতেন দেহাত্মবাদী। বস্তুবাদী দর্শন প্রাচীন বিশ্বে এককালে কমবেশি সর্বত্রই প্রচলিত ছিল। কিন্তু ভারতে এর খুব বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছিল। চার্বাক বা বৃহস্পতি মত ছাড়াও বৈদিক-ঔপনিষদিক ধারাতেও এর নানা দিক নিয়ে চর্চা হয়েছে। সাংখ্য দর্শনে মনকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হিসাবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজের যোগফলই হল মন। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বরুণপুত্র ভৃগু “তপস্যা” করে জানতে পেরেছিলেন, অন্ন (অর্থাৎ, বস্তু) থেকেই যথাক্রমে প্রাণ, মন, বিজ্ঞান ও আনন্দের (অর্থাৎ, ব্রহ্মোপলব্ধির) জন্ম হয়। তাই জ্ঞানলাভ শেষে তিনি “হা-বু অন্ন” (অনেকটা “হুররে অন্ন” বলে চেঁচানোর মতো) বলে সমবেত সঙ্গীত শুরু করেছিলেন।

আর ছান্দোগ্য উপনিষদে বস্তুনিরপেক্ষ চিন্তার অনস্তিত্ব এবং অসম্ভাব্যতা বোঝানোর জন্য একটা চমকপ্রদ পরীক্ষার কাহিনি সন্নিবেশিত হয়েছে।

গল্পটা সংক্ষেপে এইরকম:

আরুণির পুত্র শ্বেতকেতু বারো বছর গুরুগৃহে বিদ্যালাভ করে বাড়ি ফিরেছে। পিতা তার বিদ্যার পরীক্ষা নিয়ে খুশি হতে পারলেন না। তিনি বুঝলেন, পুত্র এখনও মূল তত্ত্বই শেখেনি। ভাবলেন, মূল তত্ত্বটি সরাসরি না শিখিয়ে দিয়ে একটা পরীক্ষার মধ্যমে হাতেকলমে শিখতে সাহায্য করবেন। পুত্রকে আরুণি পনেরো দিন না খেয়ে থাকতে বললেন। সেই উপবাসের পরে এক দিন তিনি ক্ষুধায় জর্জর পুত্রকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলেন। কিন্তু শ্বেতকেতু বলতে লাগল, সে কিছুই মনে করতে পারছে না। আরুণি বললেন, “বেশ, এখন যাও। আগামী পনেরো দিন তুমি ভালো করে খাওয়াদাওয়া করো। যা মন চায়, যত ইচ্ছে খাও। তারপর এসো।” ছেলে খেয়েদেয়ে শক্তি ফিরে পেয়ে আবার যখন পিতার কাছে এল, তিনি তাকে যে প্রশ্নই করেন, সে যত দুরূহই হোক, শ্বেতকেতু সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হল। শুধু তাই নয়, সে তখন এও বুঝল, খাদ্যের সঙ্গে স্মৃতিশক্তির কী তন্নিষ্ঠ সম্পর্ক। এই কাহিনি সম্পর্কে জার্মানির প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ হ্বালটার রুবেন মন্তব্য করেছিলেন: আড়াই হাজার বছর আগেকার বিশ্বে বস্তুবাদী চিন্তাকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করে দেখানোর এরকম আর দ্বিতীয় কোনও নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রিস, চিন, মিশর, ব্যাবিলন— কোথাও নয়।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইউরোপে এরকম একটা চিন্তা উত্থাপন করার মতো বিদ্বান ব্যক্তির আগমনের জন্য রেনেশাঁস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৫৭৫ সালে স্পেন দেশের একজন চিকিৎসক, জুয়ান হুয়ার্তে (১৫২৯-৮৮), একখানা বই প্রকাশ করলেন: Examen de ingenios para las sciencias , অর্থাৎ, “বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিবৃত্তি বিষয়ক অনুসন্ধান”। তাতে তিনি দাবি করলেন, স্মৃতি যুক্তি ইত্যাদি জটিল চিন্তন ক্রিয়ার জন্য শারীরতাত্ত্বিক উপাদানগুলি এতই জরুরি যে স্বয়ং যিশুকেও ভালোভাবে যুক্তিতর্ক করার জন্য পেট পুরে যথেষ্ট ভালোমন্দ খেতে হত। বলা বাহুল্য যে ডাক্তার সাহেব তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে বাইবেলের বিভিন্ন কাহিনি উল্লেখ করলেও, বইটি বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই রোমান চার্চ একে “ঈশ্বর বিরোধী” আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তবে বইটি সেকালে এত প্রভাব ফেলেছিল যে চার্চের ভ্রূকুটি সত্ত্বেও মাত্র পঁচিশ বছরের মধ্যে এর ষাটটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

যাই হোক, প্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনগুলি মন ও চেতনাকে দেহ নির্ভর ও বস্তুভিত্তিক বলতে পারলেও এর উৎপত্তি সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনি। পারার কথাও নয়। কেন না সেদিনকার জ্ঞানের সীমায় প্রয়োজনীয় যথেষ্ট তথ্য ছিল না। আধুনিককালে, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দে ইউরোপে যে বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশ ঘটল, বেকনকে অনুসরণ করে ইংল্যান্ডে বা দকার্তকে সূত্র ধরে ফ্রান্সে— তাতে বস্তুর ক্রমবিকাশ ও ক্রমবর্ধমান জটিল রূপ অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তাশক্তি স্ফূরণের কথা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা শুরু হল যে চিন্তার কোনও অলৌকিক, অতীন্দ্রিয়, বস্তুবহির্ভূত, বস্তুনিরপেক্ষ, অতিপ্রাকৃতিক ভিত্তি নেই। সেদিনকার মাপকাঠিতে এটা যে একটা বিরাট অগ্রগতি, তা অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে কোনও কোনও বস্তুবাদী দার্শনিক আবার মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকেই প্রায় অস্বীকার করে বসলেন। তাঁদের মতে, আজ (সেদিন) না হলেও অচিরেই পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্রের সূত্র দিয়েই মনের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ ব্যাখ্যা করা একদিন সম্ভব হবে। লিভার থেকে যেমন পিত্তরস বেরোয়, তাঁদের বক্তব্য ছিল, মস্তিষ্ক থেকেও তেমনই চিন্তার নিঃসরণ হয়! এরই ভিত্তিতে, তাঁদের মতে, হাতি ঘোড়া বেড়াল কুকুর বাঘ সিংহ বানর গরিলা শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি প্রাণীর মধ্যে বুদ্ধির যতটা অগ্রগতি ঘটেছে, মানুষের চিন্তাশক্তি তার থেকে কয়েক ধাপ বেশি বিকশিত হয়েছে। তফাতটা ততটা গুণে নয় যতটা মাত্রায়।

এই আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভাববাদী দর্শনে মন বা চেতনাকে স্বয়ম্ভূ স্বাধীন সত্তা হিসাবে ধরে নিয়ে এবং বস্তুবাদী দর্শনে মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকেই কার্যত অস্বীকার করে, উভয় ক্ষেত্রেই এত কাল মন ও চিন্তার উৎপত্তি ও বিকাশের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হত।

 

[ক্রমশ]