Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আরজিকর একসঙ্গে অনেককটা শিক্ষা দিয়ে গেল

শুভার্থ মুখার্জ্জী

 



ছাত্র, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বরাবরই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এটা স্কুলজীবনের বেসিক শিক্ষা। যেটা কলেজজীবনে এসে শেখার কথা, সেটা হল সম্মান-ভালোবাসার আগে ‘পারস্পরিক’ নামের একটা প্রিফিক্স। একতরফা নয়। আরজিকর মেডিকেল কলেজের মাননীয় প্রিন্সিপাল মহাশয় নিজে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত অর্থোপেডিক্স শিক্ষক-চিকিৎসক, খালপাড়ের অ্যালুমনি। পুজোর ঠিক আগে অনেকে ফেসবুকে স্টেটাস দিচ্ছিলেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে স্যার তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে জঘন্য দুর্বব্যহার করছেন, ফেল করিয়ে দেওয়ার থ্রেট দিচ্ছেন, দেখে নেব, ‘বেহেঞ্চোদ’-সহ আরও সুন্দর সব নামে ভূষিত করছেন নিজের ছাত্রদের। ওরা এসেছিল স্রেফ একটা প্রশ্নের জবাব চাইতে, কোনও অশ্লীল ভাষাপ্রয়োগ, বলপ্রয়োগ কিছুই করা হয়নি। কারণ শিক্ষকের ভুলটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া ছাত্রছাত্রীর দায়িত্ব। কলেজে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই প্রাপ্তবয়স্ক, কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক সেই বোধ তাদের যথেষ্ট। ভুলটাকে ভুল আর ঠিককে ঠিক বলার মতো সততা রাখা উচিত, এটা আর বুঝিয়ে বলার মতো বয়স এটা নয়।

প্রশ্ন করা যায়, আঙুল তোলা যায়, রুখে দাঁড়ানো যায়। সে তিনি সিকিউরিটি গার্ড-অফিসার হন, হস্টেল সুপার হন, প্রিন্সিপাল হন চাইকি আরও বড় কোনও আমলা-মন্ত্রী হন। আঠেরো বছর বয়স মানে না মানা। দুনিয়াটাকে সত্য-মিথ্যার কষ্টিপাথরে ঘষে পরীক্ষা করে নেওয়ার এটাই সময়। তারুণ্যের সততা আর আত্মত্যাগের এই স্পৃহা এই বাংলায় নতুন কিছু নয়। ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী-প্রীতিলতা এমন শয়েশয়ে নিদর্শন দেখানো যায়। নির্ভীক-সাহসী ও উদ্যমী হওয়াটাই একজন কলেজপড়ুয়া ছাত্র তথা ভবিষ্যতের দেশগড়ার কারিগরের কাছে আশা করা যায়। তার উপরে এরা আবার ডাক্তার হবে, তাই দায়িত্বটা আরও খানিকটা বেড়ে যায়।

কিন্তু বিগত কয়েক দশকে সুবিধাবাদী চিন্তাভাবনা গ্রাস করতে শুরু করেছে নয়া প্রজন্মকে। সমাজে, বাড়িতে, বন্ধুরা পারিপার্শ্বিক সব জায়গা শেখায় চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। কলেজজীবনে সাতে পাঁচে থাকবি না। দেশদুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও সব্বার আগে ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিনিক্সের মতো উঠে আসবে তোর ক্যারিয়ার। সবার থেকে, সব্বাইকে ছাড়িয়ে উঠতে হবে। বন্ধু নয়, কাঁধে উল্টে পড়ে রাত জেগে আড্ডা নয়, বিতর্ক নয়, বন্ধুরা সবাই মিলে হাসির হররায় ভেসে পড়া মানে সময় নষ্ট। আজকাল আবার চলছে ‘ওয়ার্ক কালচার’। সব্বাই কম্পিটিটর। ইঁদুর দৌড়ে সামিল হও।

এই হতাশার সময়েও কারা যেন জোট বাঁধে, লড়ে যায়, কুড়িদিন টানা ভুখা পেটে থাকে। খালি পেটেই শুধু জল খেয়ে কুড়িদিন! ভাবতেই কেমন মাথার পাশের শিরাগুলো ঝিনঝিন করে ওঠে না? সেই অনশনের কলেজ এখনও আওয়াজ তোলে— প্রিন্সিপাল গদি ছাড়ো!

বলা থাকুক, আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল অগণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল গঠনের বিরুদ্ধে, হাউসস্টাফশিপের কাউন্সেলিং-এ স্বচ্ছতার দাবিতে। এখন আন্দোলনের মূল স্লোগান একটাই— স্বৈরাচারী প্রিন্সিপাল গদি ছাড়ো।

নব্বইয়ের দশক মানে টিনার দশক। টিনা— দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ। যা চলছে মেনে নাও, বিকল্প নেই। গত কয়েক বছরে নয়া উদারবাদ বা নিওলিবারালিজম মেডিকেল কলেজগুলোকে রেহাই দিয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই। পড়াশুনোর খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। বেশ কয়েকটা মেডিকেল কলেজেই শুরু হয়েছে ‘ডিসিপ্লিন’-এর কড়াকড়ি। সন্ধে হলে ক্যাম্পাসে এদিক ওদিক ঘোরা যাবে না। কলেজের ছেলে-মেয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে প্রেম করলে সিকিউরিটি গার্ড আসবে। ক্যাম্পাসে বেড়েছে নীলজামা প্রাইভেট সিকিউরিটির নজরদারি। প্রত্যেকটা কোণ মুড়ে ফেলা হচ্ছে সিসিটিভিতে। ডাক্তারদের স্বার্থে সুরক্ষা অবশ্যপ্রয়োজনীয়, কিন্তু সেই ইন্সট্রুমেন্টগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহার হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে। এমনকি হস্টেলগুলোকেও বেশ কিছু জায়গায় এমনভাবে বানানো হচ্ছে, ছাত্রাবাস না জেলখানা বোঝা দায়। পাঁচতলা-ছয়তলা লম্বা ঝাঁচকচকে হস্টেলে সিনিয়রদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা, কথা বলা নিষিদ্ধ। ফ্লোরে, চত্বরে থাকছে সিসিটিভি। রাত বারোটা বাজলে গেট বন্ধ। চাবি সিকিউরিটির কাছে বন্ধক রাখা। কেউ ঢুকতে বেরোতে পারবে না, প্রিন্সিপালের ‘অর্ডার’। রাতে একসঙ্গে চা খেতে যাওয়া, বন্ধুরা মিলে রাতের শহরে অকারণে ঘোরা, ফাঁকা রাস্তায় কুকুরের দলকে চমৎকৃত করে সমস্বরে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে ওঠা— ছাত্রজীবনে এই শিক্ষাগুলোও দরকার রে ভাই! সামাজিক হওয়ার শিক্ষা গ্যানং-গ্রে-কেডিটি বা ম্যারো-প্রেপলেডার দেয় না যে! ডিসিপ্লিনের নামে সিস্টেম বাঁধা খচ্চরে পরিণত করছে তোদের একথা আর কবে বুঝবি!

তবে আরজিকর পেরেছে। খালপাড় আশা জোগাচ্ছে‌। বেশ কয়েকটা হাতে লেখা পোস্টার দেখলাম— ‘ছাত্রছাত্রীদের অবাধ বিচরণকে রুদ্ধ করা যাবে না’। সত্যিই তো, স্বাধীন দেশে আমার হাতে শেকল আর ঘাড়ে বকলস পরাবে কোন্ হিটলারের বাচ্চা!

অনশন শুরুর প্রথম কয়েকটা দিন গেছি আরজিকর। গত পরশু গেছি, ট্রমাকেয়ারের সামনে ভবিষ্যতের ডাক্তাররা তাঁদের প্রতিরোধের কাহিনি শোনচ্ছেন রোগীপরিজনদের। পরিচিত কয়েকজন দাদা, স্কুলের জুনিয়ররা আছে ওখানে। আরও নিয়মিত যাওয়া উচিত ছিল, যাওয়া হয়নি ব্যক্তিগত কিছু কারণে। কাল গণকনভেনশনেও যেতে পারব না হয়তো, ক্ষমা করে দিস ভাই, বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।

যে প্রিন্সিপাল ছাত্রছাত্রীদের মা-বোনের নামে অশ্লীল গালিগালাজ করে, শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নিজের সন্তানসম পড়ুয়াদের গায়ে বুটজুতো দিয়ে মাড়িয়ে যায়, সামান্য পান থেকে চুন খসলে কেরিয়ার শেষ করে দেওয়ার হুমকি দেয়, চূড়ান্ত দুর্ব্যবহারকারী এহেন মানুষটার পাশেও এসে দাঁড়িয়েছে কয়েকটা পদলেহনকারী, অবশ্যই হাতেগোনা। যেসব মেডিকেল স্টুডেন্টরা এখনও ‘নিরপেক্ষ’ আছিস, এখনও খালপাড়ের পাশে দাঁড়াসনি এসে একবারও, নিদেনপক্ষে সোশাল মিডিয়াতেও লিখলে কলেজের বাকিরা কী ভাববে আর হোয়াটঅ্যাবাউট্রিতে মজে আছিস মনে মনে, আরজিকর-এর ভুখা পেটের উপর বসানো মাথাগুলো, তাদের শুকনো মুখগুলো একবার দ্যাখ। দীর্ঘদিন অন্যায় চলতে চলতে কোণঠাসা হয়ে পড়া নিরুপায় মুখ এগুলো! কোনও রং দেখে না, রাজনীতি-দল-পার্টি দেখে অনশনে নামেনি এরা! ব্যক্তিগত স্বার্থ তো চুলোয় যাক, যে সময়ে আমরা-তোরা অষ্টমীর দিন মণ্ডপে দাঁড়িয়ে গ্রুপফি তুলছি, এরা তারও আগের থেকে এখন অব্দি কিচ্ছুটি মুখে তোলেনি। জানি না এদের মা-বাবা মুখে কিছু নিয়েছে কিনা। সন্তান খায়নি বলে হয়তো ওঁদেরও গলা দিয়ে খাবার নামেনি।

খালপাড় দেখাচ্ছে রোখ কাকে বলে। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের প্রথমদিন থেকে দেখে আসছি মেডিকেল কলেজগুলোর কালচার প্রচণ্ড এলিট। সেই ব্যারিয়ার ভেঙে আগুনের আঁচ নিচ্ছে খালুরা। একবার এসে গা সেঁকে যা ভাই। বিশ্বাস কর, হতাশ হবি না।

আন্দোলনের তাৎক্ষণিক ফল কী হবে, সেটা সামনের দিনে দেখা যাবে। তবে এই লড়াই অনেককিছু শিক্ষা দিয়ে গেল।

পুনশ্চ: নিচের ছবিটা আরজিকর মেডিকেল কলেজের দেওয়াল। এখন কলেজের সবকটি দেওয়ালে এরকম ছবি-লেখা আর মেঝেয় গ্রাফিতি দেখা যাবে। এর আগে একবার দেয়ালে লেখার জন্যে কথা শুনতে হয়েছিল, নাকি কলেজের সুন্দর দেয়ালে এভাবে নোংরাভাবে লেখা উচিত নয়। সেই অতি ভদ্র পাবলিকদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলি— “ল্যাংটোর দেশে অতিরিক্ত ভদ্রতা পাপ।” দিন দিন অটোক্রেটিক হয়ে ওঠা অথরিটির অর্ডারের সঙ্গে কথায় কথায় ‘ইয়েসস্যার ইয়েসম্যাম’ বলা পরিষ্কার নির্বুদ্ধিতা নয় তাঁবেদারি!