সদানন্দ সিংহ
ত্রিপুরার আগরতলার বাসিন্দা সদানন্দ সিংহ ঈশানকোণ ওয়েবপত্রিকার সম্পাদক, বিশিষ্ট গল্পকার ও অনুবাদক। তাঁর হাত ধরে মেইতেই ভাষার বহু গল্প ও কবিতা বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পৌঁছেছে। প্রাণোচ্ছল সদানন্দ একশো বছরের পরমায়ু আকাঙ্খা করেন।
মণিপুর ভারতবর্ষের একটি প্রত্যন্ত প্রদেশ। মণিপুর নামের সঙ্গে পরিচিতি কম-বেশি সকলের কাছে আছে। সেটা হয় মহাভারতের কাহিনির জন্যে না হয় মণিপুরি নাচের জন্য। সাহিত্যের জন্যে তো নয়ই। কিন্তু কতজনই বা খবর রাখেন মণিপুরি সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা তথা বাঙালিদের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক একসময় তৈরী হয়েছিল? মণিপুরি সংস্কৃতির পেছনে বাঙালিদের যে একটা অবদান আছে? কতজনই বা খবর রাখেন মণিপুরি ভাষার প্রচলিত অন্যতম লিপি হচ্ছে বাংলা লিপি আর মণিপুরি নাচকে সমগ্র ভারতবাসীদের কাছে পরিচিত করিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করার আগে আমি মণিপুরি সংস্কৃতির পেছনে বাঙালিদের অবদান সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। কেননা সাহিত্য যেহেতু সংস্কৃতিরই অঙ্গ।
বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলায় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম মণিপুরি নাচ দেখে অভিভূত হন। সেখান থেকে তিনি আগরতলায় এসে ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য বাহাদুরকে অনুরোধ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের নাচ শেখানোর জন্যে একজন মণিপুরি নর্তককে পাঠাতে। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ত্রিপুরার মহারাজা আগরতলা থেকে বুদ্ধিমন্ত সিংহ এবং একজন মৃদঙ্গবাদককে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন। এইভাবেই শুরু হয়েছিল মণিপুরি নাচের জয়যাত্রা। পরে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরি নাচকে শান্তিনিকেতনের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শান্তিনিকেতনই হয়তো প্রথম মহাবিদ্যালয় যেখানে কোনও নাচকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি না মণিপুরি নাচ সম্বন্ধে আগ্রহী হতেন তাহলে মণিপুরি নৃত্যের যে খ্যাতি আজ বর্তমান তা এ অবস্থায় থাকত কিনা সন্দেহের বিষয়।
মণিপুরি নৃত্যের দুটো দিক আছে। একটি হল সম্পূর্ণভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম থেকে উদ্ভূত নাচ যার গানগুলি সবই জয়দেব, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস এবং বিদ্যাপতির পদাবলী কীর্তন। এর মধ্যে আছে রাস জাগোই অর্থাৎ রাস নৃত্য, কৃষ্ণলীলা, রাখাল নৃত্য, খুবাক ঈশৈ ইত্যাদি। আরেকটি হল মণিপুরিদের নিজস্ব লৌকিক দেবদেবী এবং লোককাহিনি ভিত্তিক নাচ। যেমন মাইবী জাগোই, লাই হারাওবা, থাব্ল চোংবা ইত্যাদি। এছাড়া আছে যুদ্ধ নৃত্য। মাইবী জাগোই এর মধ্যে প্রাচীনতম নাচ। মাইবী জাগোই নৃত্যে ব্যবহৃত মুদ্রাগুলি পৃথিবীর প্রাচীনতম নাচের মুদ্রাগুলির অন্যতম নিদর্শন বলে অনেকেই মনে করেন।
বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরে ঢুকেছিল দুক্ষেপে। প্রথমে নিম্বার্কপন্থী। পরে রামানন্দপন্থী। রামানন্দপন্থী বৈষ্ণবধর্ম প্রবেশ করেছিল পনেরোশ শতাব্দীতে রাজা ক্যাম্ব-এর আমলে। উনিই প্রথম মণিপুরে বিষ্ণুমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পূজারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ। নাম ভবানীনাথ ভট্টাচার্য। পরে সতেরোশ শতাব্দীতে সিলেট থেকে আগত বিষ্ণু গোস্বামী মণিপুরের মহারাজা চরাইরোংবাকে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করেন। চরাইরোংবার মৃত্যুর পর রাজা পামহৈবার আমলে (১৭০৯-১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে) সিলেট থেকে আগত শান্তদাস গোঁসাই রাজা পামহৈবাকে রামানন্দী ধর্মে দীক্ষিত করেন। রাজা পামহৈবা শান্তদাস গোঁসাইকে গুরুরূপে বরণ করেছিলেন। শান্তদাস গোঁসাই রাজা পামহৈবার নতুন নাম রাখেন ‘গরীব নিওয়াজ’ এবং ‘মৈতৈ লৈপাক’-এর নাম রাখেন ‘মণিপুর’। ‘মণিপুর’ নামের উৎপত্তি তখন থেকেই। পাশাপাশি রাজ্য বা দেশ যেমন ব্রহ্মদেশ বা শানদের ইতিহাস ইত্যাদি অনুসন্ধান করে আমরা বুঝতে পারি ‘মণিপুর’ নামক রাজ্য বা দেশের অস্তিত্ব এর আগে ছিল না। এইসময়েই রাজা গরীব নিওয়াজ শান্তদাস গোঁসাইয়ের প্রত্যক্ষ মদতে অরিবা ভাষায় লেখা একশোর ওপর প্রাচীন পুঁথি আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে দেন। তখন রাজার আদেশ অমান্য করার জন্যে লমহানবা নামে এক ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এই প্রাচীন পুঁথি সম্বন্ধে আমি পরে আসছি। বৈষ্ণবধর্ম ব্যাপকভাবে সাধারণ প্রজাদের মধ্যে প্রসার লাভ করে রাজা ভাগ্যচন্দ্র অর্থাৎ জয় সিংহের আমলে (১৭৬৩-১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে)। নরোত্তম ঠাকুর সেই সময় মণিপুরে এসেছিলেন। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের সময়েই মণিপুরি নাচের উদ্ভব হয়। ভাগ্যচন্দ্রের নেতৃত্বে মণিপুরে যে সাংস্কৃতিক চেতনার উদয় হয়েছিল তাকে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসাবে ধরা যায়। একটা সময় গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরিদের আচার-ব্যবহারকে আমূল পালটে দিয়েছিল। একটা সমগ্র জাতি আমিষভোজী থেকে নিরামিষভোজীতে পরিণত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সাহিত্যেও এর প্রভাব অপরিসীম।
মণিপুরি নাটক-থিয়েটার নিয়েও একটু আলোচনা করা যেতে পারে। মণিপুরি নাটক-থিয়েটারের ইতিহাস একশ বছরের ওপর। ব্রিটিশ রাজত্বে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে শ্রী গোবিন্দজী নাট মন্দিরে স্টেজ বানিয়ে প্রোসিনিয়ম থিয়েটার নামক একটি সংস্থা ‘প্রবাস মিলন’ নামক একটি নাটক প্রথম মঞ্চস্থ করে। ওটাই মণিপুরে মঞ্চস্থ করা প্রথম নাটক। আর ‘প্রবাস মিলন’ মঞ্চস্থ হয়েছিল সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায়। এর পরেও বাংলা ভাষায় অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বামাচরণ মুখোপাধ্যায় ‘বান্ধব নাট্যশালা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মণিপুরিতে প্রথম মৌলিক নাটক ‘নরসিংহ’ মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে। এইসব নাটক থিয়েটারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন চূঁড়াচান্দ মহারাজা। তবে মণিপুরি পালা ‘সুমাংলীলা’-র ইতিহাস অনেক পুরানো। মহারাজ চন্দ্রকীর্তির আমল (১৮৫০-১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ) থেকে এই সুমাংলীলা শুরু হয়েছিল। সুমাং মানে উঠোন। উঠোনের মাঝে এই পালাগুলি অনুষ্ঠিত হয় বলে এর নাম সুমাংলীলা। শুরু কাল থেকেই এই সুমাংলীলা মণিপুরিতে উপস্থাপিত হয়ে এসেছে। এখন মণিপুরের নাট্যকার কানাইলাল এবং রতন থিয়াম সমগ্র বিশ্বে একটি পরিচিত নাম। আর নাটক-থিয়েটারের স্থাপনা প্রসঙ্গে বাঙালিদের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এবার সাহিত্য প্রসঙ্গে আসা যাক। মণিপুরি সাহিত্যের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। অরিবা ভাষার কথা একটু আলোচনা করেছি। অরিবা হচ্ছে বর্তমান মণিপুরি ভাষার পূর্বসূরী।বর্তমান বাংলাভাষার সাথে চর্যাপদের ভাষার যে পার্থক্য অনেকটা সেইরকমই বর্তমান মণিপুরি ভাষার সাথে অরিবা ভাষার পার্থক্য। আর বেশিরভাগ অরিবা ভাষার লেখাগুলি প্রাচীন মণিপুরি হরফে লেখা। এই মণিপুরি হরফগুলি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এখন এই লিপি প্রায় অপ্রচলিত এবং অফিস-আদালত স্কুল-কলেজে ব্যবহৃত হয় না বলে কিছু সংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তি বাদে সাধারণ মানুষের কাছে এই লিপির বোধগম্যতা নেই। যদিও ইদানীং এই লিপি প্রচলন করার জন্যে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং বাংলা লিপির পাশাপাশি এই লিপির প্রচলন বেড়ে চলেছে।
খুব সম্ভবত মণিপুরি লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছিল সপ্তম শতাব্দী থেকে। সপ্তম শতাব্দীর এক তাম্র মুদ্রায় এই লিপির ব্যবহার প্রথম দেখা যায়। উনবিংশ শতাব্দী থেকে মণিপুরে মণিপুরি লিপির পাশাপাশি বাংলা ও অসমীয়া লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। আর ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আস্তে আস্তে মণিপুরি লিপির পরিবর্তে বাংলা লিপির ব্যবহার বাড়তে থাকে। তারপর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মণিপুরি লিপির ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
মণিপুরি লিপিতে অরিবা ভাষায় লেখা প্রাচীন পুঁথিগুলির দুটো দিক লক্ষ করার মতো। এক তারিখ বিহীন, দুই লেখকের নাম বিহীন। এতে মনে হয় একই পুঁথি হয়তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকেরা লিখে গেছেন। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীর আগেকার প্রাচীন সাহিত্যগুলির ক্রম বিভাগ অর্থাৎ কোন্টা আগে কোন্টা পরে তা নির্ণয় করা এক কঠিন ব্যাপার। যদিও R.K. Jhalajit Singh তাঁর ‘A History of Manipuri Literature’ গ্রন্থে বলেছেন অষ্টম শতাব্দী থেকে ১০৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মণিপুরি সাহিত্যকে প্রাচীন সাহিত্য এবং ১০৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রচিত সাহিত্যকে মধ্যযুগীয় বলে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে আছে– পইরৈতন খুন্থোকপা এবং নুমিৎ কাপ্পা। আর মধ্যযুগীয় সাহিত্যের মধ্যে আছে– খোমচোং নুপী নোঙ্গারোল, নুংবান পোম্বী লুওয়াবা, নউথিংখোং ফম্বন কাবা, চৈনারোল, পান্থৈবী খোঙ্গুন ইত্যাদিরা। অরিবা ভাষায় লেখা সংগৃহীত পুঁথিগুলির সংখ্যা তিন শতাধিক যেগুলি অগ্নিবিনাশ থেকে বেঁচে গিয়েছিল। তবে সবগুলিই সাহিত্য নয়। এগুলির মধ্যে আছে ইতিহাস-ভূগোল সম্বন্ধীয়, মন্ত্র, দেবদেবীর মহিমা, আইন সম্বন্ধীয়, জ্যোতিষ বা জ্যোতির্বিদ্যা সম্বন্ধীয়, বর্ণ-গোত্র সম্বন্ধীয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর রচিত লেখা। এরপর উনবিংশ শতাব্দীতে রচিত কাহিনিগুলিতে আধুনিকতার ছাপ দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে মণিপুরি সাহিত্যে নবযুগের সূচনা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে রচিত সাহিত্যগুলিতে যার লেখক-কবিরা হলেন অঙাংহল, চাউবা, ইরাবত, নবদ্বীপ এবং কমল। এই সময়ের ফসল হল মাধবী, লবঙ্গলতা এবং জাহেরা ইত্যাদি উপন্যাস। পরবর্তী সময়ে আসেন মীনকেতন, শীতলজিৎ, দোরেন্দ্রজিৎ প্রমুখ লেখক-কবিরা। এই সময়ের মধ্যে ‘খম্বা-থৈবী’-র প্রেমকাহিনি নিয়ে রচিত হয় মহাকাব্য যার লাইন সংখ্যা ৩৪ হাজার। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে রচিত সাহিত্যগুলিতেই ফুটে ওঠে প্রকৃত আধুনিকতার ছাপ। এই সময়ের কবি-লেখকরা হলেন হিজম গুন, নীলকান্ত, বিনোদিনী, প্রকাশ, কুঞ্জমোহন, নীলবীর প্রমুখ। পরে এঁদের সঙ্গে যোগ দেন শ্রী বীরেন, পাচা মৈতৈ, ইবোপিশক, ইবোমচা, মধুবীর, লাইশ্রম সমরেন্দ্র, পদ্মকুমার, আই এস কাংজম, ভুবনস্না, এলাংবম দীনমণি, সোনামণি, চিত্রেশ্বর শর্মা, বি এম মাইস্না, অরাম্বম বীরেন, শরৎ চন্দ্র আংথোম্বা, যুগেশ্বর, রাধেশ্যাম, সুন্দর, ক্ষেত্রবীর, প্রেমচান্দ, প্রিয়কুমার, কমল তোইজাম্ব, সুধীর নাওরেম্বম, লমাবম গজেন্দ্র, ব্রজগোপাল শর্মা এবং চোংথাম নবচন্দ্র। এইসময়কার মহিলা কবি-লেখকদের নাম– টি থোইবী, প্রমোদিনী পুণ্যবতী, রাধেস্না, সুবদনি, মেমা, চন্দ্রসখি, সত্যবতী, নি দেবী, বীণাপাণি, বিলাসিনী, দেবলা প্রমুখ। আর উত্তর আধুনিক বলে যেসব কবি-লেখকের নাম উল্লেখ করা হয় এরা হলেন– লন্চেন্বা মৈতৈ, মেমচৌবী, শরৎচান্দ থিয়াম, দিলীপ ময়েংবম, বীরেন্দ্রজিৎ নাওরেম, বরকন্যা, বি এস রাজকুমার সনামচা, রঘুবীর থিয়াম, রঘু লৈশাংথেম, জেন মোইরাংচা, ইলাবন্ত য়ুম্নাম।
মণিপুরি ভাষায় প্রথমদিকের লেখায় কিছু কিছু উপন্যাসে এক সময় বঙ্কিমচন্দ্র এবং শরৎচন্দ্রের প্রভাব লক্ষ করার মতো ছিল। পরবর্তীকালে কারও কারও লেখায় জীবনানন্দের প্রভাব স্বীকৃত হয়ে আছে। আর মণিপুরি সাহিত্যে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে। পাশাপাশি প্রাক বৈষ্ণব অর্থাৎ লৌকিক ধর্মের প্রভাবও মণিপুরি সাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকে এখনও বর্তমান এবং মণিপুরি সংস্কৃতি ও সাহিত্যে বৈষ্ণবধর্ম ও লৌকিকধর্মের প্রভাবের সংমিশ্রণ লক্ষ করার মতো।
অনুবাদ সাহিত্যে কিন্তু মণিপুরি সাহিত্য একেবারে পিছিয়ে নেই। বেশিরভাগ বই অনুবাদ করা হয়েছে ইংরেজী, হিন্দি এবং বাংলা থেকে। বাংলা থেকে মণিপুরিতে অনুদিত বইয়ের সংখ্যা অনেক। সেগুলির মধ্যে শরৎচন্দ্রের বেশিরভাগ উপন্যাস এবং ছোটগল্প, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, মালিনী এবং দুখণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরাম দাসের মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতা, তরুণ ভাদুড়ীর সন্ধ্যাদীপের শিখা, বাদল সরকারের এবং ইন্দ্রজিৎ, আধুনিক বাংলা কবিতার নির্বাচিত সংকলনের অনুবাদ, জীবনানন্দের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা, কালকূটের শাম্ব, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ ও বীরাঙ্গনা কাব্য, যাযাবরের দৃষ্টিপাত, তসলিমা নাসরিনের লজ্জা, ফেরা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ফুল ফুটুক না ফুটুক, নীহারঞ্জন গুপ্তের কালো ভ্রমর ইত্যাদির নাম করা যায়। এছাড়াও বাংলা নাটক পাগলিনী ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এবং পার্থ পরাজয় ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরিতে অনুবাদ করা হয়েছিল।
অন্যদিকে মণিপুরি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা বইয়ের সংখ্যা কয়েক বছর আগেও ছিল মাত্র কয়েকটা। এক খৈরুদ্দিন চৌধুরী দ্বারা অনুদিত নির্বাচিত মণিপুরি কবিতার সংকলন যেটা প্রকাশিত হয়েছিল শিলচর থেকে, দুই রাজকুমার কমলজিৎ সিংহ দ্বারা অনুদিত ত্রিপুরা বিজয় যেটা প্রকাশিত হয়েছিল আগরতলা থেকে। ত্রিপুরা বিজয় হল মণিপুর রাজ কর্তৃক ত্রিপুরা বিজয়ের ঐতিহাসিক বিবরণ। ইদানীং গম্ভিনী সিংহ দ্বারা অনুদিত আরও দুটো গল্প এবং কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক মণিপুরি গল্প-কবিতার অনুবাদ ছাপা হচ্ছে। সাহিত্য একাদেমির তত্ত্বাবধানেও মণিপুরি গল্প-কবিতার অনুবাদের কাজ চলছে।
একটা সময় ছিল যখন অনেকেই মনে করতেন অনুবাদের কাজটা বুঝি খুবই সহজ। কারণ অনুবাদের কাজটাকে এরা translation work বলে মনে করতেন। এজন্যে অনুবাদের কাজটাকে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। আগের সেই ধারণাটা কিন্তু এখন নেই। অনুবাদের ওপর এখন সেমিনার, ওয়ার্কশপ হচ্ছে। এমন কি শুধুমাত্র অনুবাদ নিয়ে পত্রিকা বের হচ্ছে। বস্তুতপক্ষে একজন অনুবাদকের কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন। ভাষার উৎপত্তিস্থল যদি একই হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কাজটার একটু সুবিধা হয়। আর যদি আলাদা হয় তখন অনুবাদকের কাজটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই এক ভাষার শব্দের প্রতিশব্দ অন্য ভাষায় পাওয়া যায় না। কিন্তু মূল ভাষার বক্তব্য এবং নান্দনিক দিকটিও তো অনুবাদককে ঠিক রাখতে হবে। সেজন্যে এখন অনেকেই translation-এর পরিবর্তে transformation হিসেবে অনুবাদের কাজ করে থাকেন।
মণিপুরি ভাষার উৎপত্তিস্থল যেহেতু টিবেটো বার্মান গ্রুপ থেকে সেহেতু বাংলার সঙ্গে মণিপুরি ভাষার পার্থক্যও অনেক। মণিপুরি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে কবিতার অনুবাদ গল্পের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন। কবিতার পরিধির যেহেতু কোনও সীমা নেই, কালের গণ্ডিতে যেহেতু তাকে বাধা যায় না সেহেতু একটা কবিতায় অতীত ইতিহাস, বর্তমান ঘটনা, ঐতিহাসিক চরিত্র থেকে শুরু করে নামী-অনামী পথঘাটের নাম সহ কত কিছুই যে আসতে পারে তা বলে শেষ করা যায় না। তাই কোনও কোনও কবিতায় অনুবাদের সময় প্রতিশব্দ খোঁজার পাশাপাশি একটা জাতির স্থান-কালের ইতিহাসকে পরিচিতি করানোর মতো একটা ব্যাপারও আছে যাতে মনে হয়েছে যিনি অনুবাদটি পড়বেন তিনি হয়তো প্রতিশব্দ-ভাবশব্দের এবং অপরিচিত শব্দের ভারে পদে পদে অনেকসময় হোঁচট খেতে পারেন। তাঁর কাছে কবিতার মাধুর্য আস্বাদন করা হয়তো এক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ কোনও একটি কবিতা কোনও একটা জাতির ওপর যে আবেগ, যে ভাব, যে অর্থ তৈরী করে সেটা অনুদিত হলে সেই কবিতা অন্য জাতির ওপর সেই আবেগ, অর্থ, ভাব তৈরী নাও করতে পারে। যেমন প্রাগবৈষ্ণব মণিপুরি পণ্ডিত খোংনাংথাবা, লাঙ্গল লুখোই বা কনকথেংগ্রার ওপর রচিত কবিতা মণিপুরে যে আবেগ তৈরী করবে তা বাংলায় অনুদিত হলে সেই ধরনের আবেগ মোটেই তৈরী করবে না। তাই আমার মনে হয়েছে কোনও লেখকের গল্পের সমগ্র বই বা কোনও কবির কাব্যগ্রন্থের সমগ্র কবিতা অনুবাদ না করে নির্বাচিত গল্প-কবিতার অনুবাদ করলেই বোধহয় ভালো হয়। এভাবেই কোনও ভাষার ভালো সাহিত্য অন্য ভাষার পাঠকদের কাছে তুলে দেওয়া যায়। উপন্যাসের কথা অবশ্য আলাদা।
তবে যত কঠিনই হোক, অনুবাদ কিন্তু জরুরি। অনুবাদের মাধ্যমেই ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, জার্মান, গ্রীক, স্পেনীয় ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যকে আমরা জানতে পেরেছি। এর মাধ্যমেই লাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা বা চিনের সাহিত্যকে জানতে পেরেছি। কিন্তু কতজন আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যে প্রচলিত অন্য ভাষার সাহিত্য সম্বন্ধে জানি? সেখানকার সাহিত্যের রূপরেখা, গতিপথ, অভিমান, সেখানকার লোকদের জীবনধারা, চিন্তাধারা ইত্যাদি অনেককিছুই সঠিকভাবে আমরা জানি না। জানার চেষ্টারও হয়তো একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। অদূর ভবিষ্যতেও তা কতটুকু পূরণ হবে জানি না। তবে একটা উদ্যোগ থাকা দরকার। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার লোকের বড় অভাব।
(ঈশানকোণ ওয়েব পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত, এবং সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশিত)