প্রবুদ্ধ বাগচী
রং কোম্পানির লম্বা চওড়া ছেলেটা বাইরের ঘরে বসেই প্রথম প্রশ্ন করল, বাড়িটা কত স্কোয়ার ফুট হবে?
দেবতোষ এক কথায় এর জবাব দিতে পারলেন না। ছোট্ট দোতলা বাড়িটা একেবারে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দুবার একটু একটু করে অফিস থেকে লোন নিয়ে করতে হয়েছিল। প্রথমে একতলার দুটো শোয়ার ঘর, খাওয়ার জায়গা, রান্নাঘর, বাথরুম। পরে নিচের এই বাইরের ঘরটা, ওপরে একটা ঘর, লাগোয়া বাথরুম। স্কোয়ার ফুটের হিসেব দেবতোষের মনে নেই। তবে বাড়ির প্ল্যান, মিউনিসিপ্যালিটির কাগজপত্র খুঁজলে নিশ্চয়ই তার হদিশ পাওয়া যাবে। সেই কথাটাই ছেলেটাকে বললেন দেবতোষ।
ছেলেটা তবু যেন একটু উদ্ধত টাইপের। দেবতোষের কথা শুনে বলে বসল, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন কাকু, অনেকেই মিউনিসিপ্যালিটিতে অ্যাকচুয়াল স্কোয়ার ফুটে রেজিস্ট্রেশন করায় না! আমরা সব জায়গায় দেখছি তো!
দেবতোষ কথাটা শুনে বেশ আহত বোধ করলেন। সাধারণত কোম্পানির সেলসের ছেলেরা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে না। এই ছেলেটা যেন কেমনতর। পাশের ঘর থেকে সুপ্রীতি ততক্ষণে এই ঘরে এসে পড়েছেন। কথাটা তিনিও খেয়াল করেছেন। সুপ্রীতিই বরং দেবতোষের হয়ে ছেলেটাকে একটু কড়াভাবে বললেন, তা তোমরা তো বাপু আমাদের মুখের কথায় কাজ করবে না— নিজেরা মেপেজুপেই নেবে! তাহলে আর অন্যের কথা শোনাচ্ছ কেন?
দেবতোষও মনে মনে কথাটা পছন্দ করলেন। সুপ্রীতির কথা শুনে ছেলেটা বোধ হয় কিছুটা সামলে নিল। কিছুটা নরম হয়ে বলল, সে তো আমাদের মাপজোক করে নিতেই হবে, কাকিমা। জানেন তো আমাদের রেট ঠিক হয় স্কোয়ার ফিটে আর তাই ওটা জানা থাকলে আমাদের এস্টিমেট দিতে একটু সুবিধে হয় আর কি!
দেবতোষ বললেন, তুমি বরং সব মাপজোক করে তারপরই হিসেব দাও।
ছেলেটা ততক্ষণে উঠে পড়েছে। কাধের ব্যাগ থেকে বার করেছে লম্বা মাপের ফিতে।
আধঘণ্টা ধরে একতলা দোতলার সব ঘর জানলা দরজা মাপামাপি করে আবার নীচের ঘরে এসে সোফায় বসল ছেলেটা। ব্যাগ থেকে ক্যালকুলেটর বার করে হাতের প্যাডটায় নানা হিসেবপত্র করে কাগজটা এগিয়ে দিল দেবতোষের দিকে।
–বাবা, এ তো বেশ অনেক! কাগজের দিকে তাকিয়ে দেবতোষ না বলে পারল না। সত্যিই টাকার অঙ্কটা বেশ বড়।
ছেলেটা বলল, না কাকু, এটাই আমাদের স্ট্যান্ডার্ড রেট। রঙের যা দাম জানেন তো? এই রেটে আমরা যে কোয়ালিটি দেব তার থেকেও ভালো চাইলে পার স্কোয়ার ফিট অন্তত আট টাকা বেশি পড়বে।
সুপ্রীতি পাশ থেকে বলল, বলো কী গো?
পেশাদার হাসি হেসে ছেলেটা বলে, আমরা কিছু বেশি বলিনি কাকিমা। আপনি অন্য কোম্পানিকে দিয়ে অ্যাসেস করিয়ে দেখুন, এর থেকে কমে হবে না! আর আমাদের কোম্পানির রঙের কোয়ালিটি আর লঞ্জিভিটি নিয়ে আর আমি কী বলব— দেশসুদ্ধু লোক জানে। একবার করালে হেসেখেলে দশ বারো বছর চলে যাবে।
দেবতোষ বলেন, সবই তো বুঝলাম ভাই, কিন্তু আমার পকেটের দিকটাও তো দেখতে হবে! চাকরি শেষ হয়ে আসছে। তা তোমাদের কিছু রিবেট টিবেট নেই?
ছেলেটা ব্যাগ থেকে আরেকটা ছাপা কাগজ বার করে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই দেখুন আমাদের কোম্পানির ছাপানো ফিক্সড রেট কার্ড।
দেবতোষ ওটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতেই ছেলেটা বলে, তবে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে আমার একটা ইন্সেন্টিভ পাওনা হয়— আপনারা যদি পুরো ডিলটায় রাজি হন তাহলে সেটা থেকে আমি ফাইভ পারসেন্ট ছেড়ে দিতে পারি। আর রিকোয়েস্ট করবেন না, রাখতে পারব না। বুঝতেই পারছেন কমপিটিটিভ মার্কেট।
ছেলেটার কথাবার্তা এখন কিছুটা নরম হয়েছে। দেবতোষ ভেবে দেখলেন কাজটা করাতে গেলে একটা রফায় আসতেই হবে। উনি বললেন, তা এখন আমায় কী করতে হবে?
ভেরি সিম্পল, ছেলেটা বলে ওঠে, আমাদের ছাপানো কন্সেন্ট লেটারে আপনি একটা সাইন করবেন আর সামান্য একটা বুকিং ফি— তিনশো, পাঁচশো যা এখন আপনার পক্ষে সম্ভব হয়— আমায় দেবেন।
সুপ্রীতি আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কাজ কবে থেকে শুরু হবে?
সেলসের ছেলেটা বলল, কাল পরশু আপনাদের ফোন করে আমাদের কালার এক্সপার্টরা আসবেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আপনারা কোন ঘরে কোথায় কী কালার করাবেন, চয়েস করে নেবেন। তার পর ওঁরাই সব ঠিক করবেন। আমার কাজ আজকেই শেষ।
সুপ্রীতি বললেন, শুধু আমরা বললেই হবে না, আমার দুই ছেলেমেয়েরও একটা মতামত আছে। তারা যখন থাকবে তখন আপনাদের লোককে আসতে হবে।
–নিশ্চয়ই! আপনারা যখন বলবেন তখনই ওঁরা আসবেন। ছেলেটা বলে। আফটার অল বাড়িটা আপনার, পেমেন্ট করবেন আপনি।
ফর্মে সইসাবুদ করে দেবতোষ ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেন। আরেকটু পরে সন্ধেবেলায় ছেলেমেয়ে বাড়িতে ফিরলে দেবতোষ-সুপ্রীতি ওদের বললেন ব্যাপারটা। তারপর শমীক আর শ্রীলেখাকে জিজ্ঞেস করলেন, কবে তোরা দুজনে থাকতে পারবি বল তো?
ঠিক হল একদিন বাদে শনিবার সকালে ওরা দুজনেই থাকবে, সুতরাং রং কোম্পানির লোককে ওইদিনই আসতে বলা হোক।
নির্দিষ্ট সময়েই এসে পড়ল ছেলেটা। বয়স বেশি নয়। সঙ্গে একটা ঢাউস অ্যালবাম। তাতে নানারকম রঙের স্যাম্পল ছাপানো। আছে নানারকমের ডিজাইন।
দেবতোষ আর সুপ্রীতি বললেন, শুধু আমাদের ঘরের চয়েসটা আমরা করব। বাকিটা তোরা ভাইবোনে ঠিক কর।
কথায় বলা যত সহজ বাছাটা অত সহজ নয়। কোন রঙের সঙ্গে কোন রং ম্যাচ করবে সেটা কোম্পানির অভিজ্ঞ লোকেরা যেভাবে বোঝে, বাকিরা তেমন জানে না। ফলে ওই ছেলেটার পরামর্শ নিয়ে তার সঙ্গে নিজেদের পছন্দ মিলিয়ে গোটা বাড়িটার রঙের প্ল্যান করতে বেশ সময় লাগল। আবারও একটা ছাপানো কাগজে সব লিখে নিয়ে দেবতোষকে সই করিয়ে নিল ছেলেটা। ও বেরিয়ে যাওয়ার মুখে দেবতোষ জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের কাজ কবে থেকে শুরু হবে?
ছেলেটা বলল, পরশু থেকে। কতদিন কীভাবে চলবে সে ব্যাপারে কাল আমাদের সুপারভাইজার আপনাদের সঙ্গে কথা বলে নেবে। কোনও টেনশন নেবেন না, এখন সব দায়িত্ব কোম্পানির। ছেলেটা চলে গেল। সুপ্রীতির তবু উদ্বেগ গেল না। বললেন, বাড়িতে মিস্ত্রি খাটানো মানে এক বাড়তি ঝামেলা। সব জিনিসপত্র এদিক ওদিক করা— কীভাবে যে কী হবে কে জানে!
শ্রীলেখা বলল, মায়ের সবেতেই দুশ্চিন্তা! ওরা তো বলেই গেল ওরাই সব করে দেবে।
–ওরকম ওরা বলে! সুপ্রীতির চিন্তার তবু অবসান হয় না।
দেবতোষ বললেন, রং করাও রং করাও বলে তুমিই তো এতদিন কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিলে… এখন পিছিয়ে এলে চলবে কেন?
২.
সুপ্রীতির যাবতীয় আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণিত করে আজই দোতলার ঘর আর বাথরুমের রং শেষ করে দিল মিস্ত্রিরা। বাড়ির একটা লোককেও সামান্য কোনও ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ঘরের জিনিসপত্র ওরা নিজেরাই সরিয়েছে, সেগুলোকে প্লাস্টিক শিটে জড়িয়েছে। আবার নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সেরে যেখানকার জিনিস সেখানে সাজিয়ে দিয়েছে। সব গুছিয়ে দেওয়ার পর ঘরটাকে যেন আজ একেবারে অন্যরকম লাগছে। যে সুপ্রীতি কাজ আরম্ভ হওয়ার আগে এত ভয় পাচ্ছিলেন, নতুন রং করা ঘরটায় দাঁড়িয়ে তিনি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই ঘরটা শমীকই ব্যবহার করে। ও নিশ্চয়ই দেখলে খুশি হবে। মাঝে কটা দিন ও নিচের ঘরে শুচ্ছিল। আজ অবশ্য এখনও কলেজ থেকে ফেরেনি। সুপ্রীতি ভাবলেন, ছেলে ফিরলে ওঁর এই ভালো লাগার কথাটা ওকে বলবেন। সত্যি দারুণ সুন্দর লাগছে। মনে পড়ে গেল, রং কোম্পানির ছেলেটা বলেছিল, আপাতত আর দশ বছরের মধ্যে রং করতে হবে না। ঠিক ঠিক চাকরি-বাকরি পেয়ে গেলে বছর পাঁচেকের মধ্যেই ছেলের বিয়ে দিতে পারবেন সুপ্রীতি। এই জেল্লা ওঠা ঘরটায় তখন বউ নিয়েই থাকতে পারবে ও। কথাটা ভেবে নিজের মনে যেন একটা অদ্ভুত শান্তি বোধ করলেন সুপ্রীতি।
কলেজ থেকে ফিরে শমীক উঠে এল দোতলায়। পেছনে পেছনে দেবতোষ। দুজনেই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারদিক দেখছিলেন।
দেবতোষ বললেন, এদের কাজ বড় ভালো। কী বলিস?
শমীক বলল, কিন্তু এই বাঁ দিকের দেওয়ালটায় আমার একটা ডিজাইন করানোর ইচ্ছে ছিল… ওরা ফ্যান্টাস্টিক সব ডিজাইন দেখাচ্ছিল সেদিন…
দেবতোষ বলেন, আবার ডিজাইন কী হবে? এই তো রং করেই খাসা লাগছে!
শমীক বলে, তুমি তো ওরকম বলবেই! এখন সবাই ঘরের একটা সাইডে ডিজাইন করে।
–যত গুড় ঢালবে তত মিষ্টি হবে! সারা বাড়ি রং করতে বাজেট ফেল হয়ে গেল তার ওপর আবার বাড়তি! দেবতোষ কিছুতেই ছেলের কথায় সায় দিতে পারেন না।
–তোমার তো পয়সা খরচ করতে গেলেই গায়ে লাগে! শমীক দপ করে রেগে ওঠে।
দেবতোষের মাথার ভিতরেও ঝলকে ওঠে ক্ষোভ। এইরকম কথা বলতে পারল ছেলেটা! নিজে তো এক পয়সা রোজগার করে না, এখনও বাবার থেকে হাতখরচা চাইতে হয়। সে আবার খরচ নিয়ে বাবাকে কথা শোনায় কী করে? আসলে আজকাল এদের সব কিছুতেই বাড়তি কিছু চাই, অল্পে মন ভরে না! বাড়ি রং করার জন্য এত ঝকমারি আগে হয়েছে নাকি? প্রথম যখন এ বাড়ি তৈরি হয় তখন তো প্রথমে চুনকাম আর এলা করেই উঠে এসেছিল নতুন বাড়িতে। পরে লোকাল মিস্ত্রি ডেকে রং করা হল, সেও তো অনেকটা পর, হাতে কিছু টাকা জমলে। ওসব ডিজাইন ফিজাইনের কথা তো কোনও কালে ওরা ভাবেনি।
দেবতোষ ভেবেছিল ছেলের কথায় ঝাঁপিয়ে আসা রাগটাকে কিছুটা সামলে নিতে পারবে। পারল না। বেশ বিরক্তি উগরে দিয়ে বলল, তুই যখন রোজগার করবি, তখন ওইসব ডিজাইন করাস! আমার দ্বারা আর সম্ভব নয়।
শমীক চুপ করে কথাটা শুনল। তারপর ঘরের এক কোণে সরে গিয়ে বলল, ওই একই কথা শুনছি চিরকাল!
এবার দপ করে জ্বলে উঠলেন দেবতোষ। চিরকাল মানে? কী বলতে চাইছিস কী? শমীক চুপ করে রইল। দেবতোষ বলেই চললেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করতে অতগুলো টাকা খরচ করতে হল— মাসে মাসেও এখন কম যাচ্ছে না— সে খবর রাখিস? কে জোগাচ্ছে সেগুলো? আমার কি দেশে জমিজিরেত আছে? সব তো এই চাকরির টাকাতেই করে এলাম এতকাল…
আরও অনেক কথা মুখের মধ্যে বুড়বুড়িয়ে উঠছিল দেবতোষের। সবটা আর বললেন না। কিন্তু মেজাজটা কেমন যেন বিস্বাদ হয়ে গেল এই সন্ধের মুখটায়। ঘরের টিউবলাইটগুলোর আলো ঠিকরে পড়েছে নতুন রং করা দেওয়ালে। তবু দেবতোষের কাছে যেন সবটাই মনে হল ফ্যাকাশে। শমীক ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। বোধহয় বাবার সঙ্গে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। দেবতোষও কি ইচ্ছুক নাকি? মোটেও না। কিন্তু ওইসব কথাবার্তাগুলো আজকাল নিতে পারে না ও। বোধহয় বয়স হচ্ছে বলেই। শরীরের সঙ্গে মনও তো বুড়ো হয়, সব ধকল সইতে পারে না। হঠাৎ ফাঁকা ঘরটার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেবতোষের মনে হল, এটা একটা অজানা জায়গা— এ কোথায় এসে পড়ল ও! বড় বেমানান লাগছে নিজেকে এই ঝকমকে দেওয়ালগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে। কোথায় যেন একটা অসোয়াস্তি ভিতরে ভিতরে গ্রাস করছে দেবতোষকে। ঘরের মধ্যে দম আটকে আসছে যেন, বুকের ভিতর থেকে উঠে আসছে একটা চাপ ব্যথা। দ্রুত পায়ে দেবতোষ ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা ছাদে এসে দাঁড়ালেন।
৩.
তিনদিন পর, একতলার পুব দিকের ঘরটা যেদিন ফিনিশিং হল, শ্রীলেখা কলেজে গেল না। এই ঘরটা ওর দখলে। ঘরের জিনিসপত্র এদিক ওদিক হওয়ার পর সব যথাস্থানে সাজিয়ে না রাখলে ওর স্বস্তি নেই। সুপ্রীতি একবার বলার চেষ্টা করেছিলেন, তোর চিন্তা কী? ওরাই সব গুছিয়ে দেবে, কিচ্ছু এদিক ওদিক হবে না।
শ্রীলেখা তাতে রাজি নয়। বলল, আমার কতরকম দরকারি জিনিস আছে জানো, একটা এদিক ওদিক হয়ে গেলে…
সুপ্রীতি বললেন, দেখছিস তো ওরা কেমন যত্ন করে গুছিয়ে কাজ করছে। কোথাও কিছু এদিক ওদিক হয়েছে কি?
–না, মা। ওদের অত বিশ্বাস করা ঠিক নয়। আমার কলেজের সব দরকারি নোট, আমার কালেকশনের অত সিডি… ওসব তুমি বুঝবে না।
সুপ্রীতি আর কথা বাড়ালেন না।
সন্ধে উতরে গেল ঘরের কাজ শেষ হতে হতে। সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়ে মিস্তিরিরা ফিরে গেলে সুপ্রীতি ঘরে এলেন। এই ঘরের আলোটাও নতুন। আরও উজ্জ্বল। ঘরটাকে আশ্চর্য সুন্দর লাগছিল সুপ্রীতির। মিউজিক সিস্টেমের পাশের র্যাকটায় শ্রীলেখা নিজের সিডিগুলো গুছিয়ে রাখছিল পরপর। ও আসলে একটু খুঁতখুঁতে। ঠিক নিজের মতন যতক্ষণ না সাজিয়ে নিতে পারছে ততক্ষণ ওর কিছুতেই পছন্দ হবে না। সুপ্রীতি নিজের ভালোলাগাটাকে একটু ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই মেয়েকে মুগ্ধ গলায় বললেন, তোর ঘরটা একেবারে চেনাই যাচ্ছে না! নতুন যখন বাড়ি হয়, তখনও এত ঝকঝকে ছিল না, কী বল?
শ্রীলেখা খুব নিস্পৃহ গলায় বলল, সে কি আর আমার মনে আছে? আমি তো তখন ছোট ছিলাম।
সুপ্রীতি বললেন, তা অবশ্য ঠিক। তবে এখন তো দেখছিস, তোর ভালো লাগছে না?
শ্রীলেখা কিছু বলল না দেখে সুপ্রীতি আবার বললেন, কী রে কিছু বলছিস না যে! তোর বাবা এতগুলো টাকা খরচ করল…
শ্রীলেখার হাতে একটা হিন্দি ফিল্মের গানের সিডি। ওটাকে ঠক করে র্যাকের ওপর রেখে ও বলল, এত পয়সা এখন খরচ না করলেই পারতে।
সুপ্রীতি হঠাৎই খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। বললেন, মানে?
মানেটা খুব সহজ, মা। শ্রীলেখা বলতে থাকে, বাবার পেছনে লেগে লেগে তুমি এই বাড়ি রং করার খরচাটা করালে। খুব কি এমন দরকার ছিল এটা?
–তার মানে? কী বলতে চাইছিস তুই? আচমকা এই আক্রমণের সামনে বিহ্বল হয়ে পড়েন সুপ্রীতি।
শ্রীলেখা বলে, ঠিকই বলেছি। দাদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পেছনে মাসে মাসে তোমরা অনেক খরচ করছ জানি। আমার কলেজে আর ক টাকা ফি লাগে? কিন্তু তোমরাই যে বলো আমার বিয়ের জন্য নাকি কিছু গয়না গড়িয়ে রাখা দরকার… কটা গয়না গড়িয়েছ এতদিনে?
সুপ্রীতি কিছু জবাব দেওয়ার আগেই শ্রীলেখা আবার বলে ওঠে, রং করে বাড়ি না সাজিয়ে এই টাকায় আমার কিছু ভবিষ্যৎ করতে পারতে না!
এইবার সুপ্রীতি নিজেকে একটু গুছিয়ে নেন। বলেন, তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না, এটা তোর মাথায় ঢোকাল কে শুনি?
–আমার বিয়ের ব্যাপারে তো তোমরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলো। তাছাড়া আগামী বছর শুভর চাকরিটা পাকা হয়ে গেলে ওদের বাড়ি থেকে চাপ দেবে, বুঝেছ!
–চাপ দেওয়াদেওয়ির কী আছে? শুভর সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যাপারটা আমরা যখন মেনেই নিয়েছি তখন ভাবনাটা আমাদেরই ভাবতে দে!
–সে তোমরা ভাবো। কিন্তু শুভর সঙ্গে আমার ভালোবাসা করে বিয়ে হচ্ছে বলে আমায় ন্যাড়া হাতে বিদেয় করবে, তা হবে না।
–তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল, শ্রীলেখা? কোন মা বাবা তার মেয়েকে ফাঁকা হাতে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে চায় বল তো?
–কিন্তু মা, একটা কথা বলো তো— আমার বিয়ের কথা উঠলেই তোমার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে না? তুমি বলো না, কী করে যে কী হবে… তোর বাবার চাকরি ফুরিয়ে আসছে…
–হ্যাঁ বলি, যা সত্যি তাই বলি। সত্যিই তো মানুষটার আর বছর দুয়েক চাকরি আছে।
–তাই যদি মনে হয়, তাহলে এই বাড়ি রং করে এতগুলো টাকা এখন খরচ না করলেই কি হত না? দাদা তো শুনি পাশ করে বেরোলেই শাঁসালো চাকরি পাবে… দাদাই না হয় খরচটা করত!
–কিন্তু তুই কি বলিস এটা দরকার ছিল না? বাড়িতে বিয়েথা লাগলেও তো লোকে বাড়িঘর রং করায়…
–যখন লাগত, তখনই না হয় করাতে! শ্রীলেখা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
সুপ্রীতি এবার পালটা বলেন, দ্যাখ, তোদের মত না নিয়ে কিন্তু আমরা কিছু করিনি। তুই আর শমীক দুজনেই তো সেদিন রাজি হয়েছিলি! এখন উলটে আমায় দোষ দিচ্ছিস কেন?
শ্রীলেখা বলে, রাজি না ছাই! সব ঠিক করে তোমরা মত চাইতে এসেছিলে, মা। তাছাড়া দাদার মত দেওয়ার বড় কারণ এটাই যে বাবার পকেটের ওপর দিয়ে এইসব খরচাপাতিগুলো হয়ে গেলে ওর দায় কিছুটা কমে যায়।
–ছিঃ, তুই নিজের দাদা সম্বন্ধে এইরকম ভাবিস!
–আমি তো এসব কথা বলতে চাইনি। তুমিই কথা বাড়াচ্ছ।
–থাক তাহলে! তোর মুখে মুখ লাগিয়ে তর্ক করার আর আমার ইচ্ছে নেই।
সুপ্রীতি রেগে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। শ্রীলেখা তখনও র্যাকের সামনেটায় দাঁড়িয়ে। খোলা জানলা দিয়ে বাদামী রঙের একটা মথ উড়ে এল ঘরের মধ্যে। বোধহয় উজ্জ্বল আলোর টানেই হবে।
৪.
গোটা বাড়ি রং শেষ হল আজ। সব গুছিয়ে-গাছিয়ে মিস্ত্রিরা চলে গিয়েছিল বিকেলের মুখে। ওরা সব সাজিয়ে দিয়েই গিয়েছিল তবু নিজেদের মতো একটু এদিক ওদিক করে নিতে হল দেবতোষ আর সুপ্রীতিকে। ছেলেমেয়ে তখনও বাড়ি ফেরেনি। দেবতোষ আজ ছুটিই নিয়ে নিয়েছেন। সন্ধের মুখে রং কোম্পানির একটা ছেলে পেমেন্ট নিতে এল। এইবার ফাইনাল বিল মেটাতে হবে। দেবতোষ বিল হাতে পেয়ে দেখলেন হিসেব বেশ কিছুটা ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেবতোষ ছেলেটাকে একবার বলার চেষ্টা করলেন এই বাড়তি বিলটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
এই ছেলেটি অবশ্য খুব ভদ্র। খুব বিনীতভাবে বলল, দেখুন স্যার, আমাদের এস্টিমেট যে বেসিসে করা হয় তাতে এটুকু ফারাক হতেই পারে।
–কেন? দেবতোষ পালটা প্রশ্ন করেন।
–ব্যাপারটা কী জানেন, আমরা বাইরে থেকে স্কোয়ার ফুট মেপে এস্টিমেট করি। এইবার ধরুন স্যার, আপনার দেওয়ালে বা সিলিং-এ কোথাও ড্যাম্প আছে বা প্যারিস চটে গেছে— ওই জায়গাগুলো রিপেয়ারিং না করে তো আর রং ধরানো যায় না! ছেলেটা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে।
–আমারও কি তাই হয়েছে নাকি?
হাতের ফাইলের ভেতর থেকে একটা কাগজ বার করে ছেলেটা বলল, আমাদের টেকনিকাল সুপারভাইজার রিপোর্ট দিয়েছেন আপনার গোটা বাড়িতে এইরকম বারোটা প্যাচ আপ করতে হয়েছে। আপনি রিপোর্টটা দেখতে পারেন স্যার। তাছাড়া ফাইনাল রিসিটের সঙ্গে আপনি এর কপিও পাবেন।
দেবতোষ বলেন, থাক আর রিপোর্ট দেখে লাভ নেই। বাড়তি কিছু গচ্চা যাচ্ছে, বুঝতেই পারছি!
ছেলেটা খুব পেশাদার ভঙ্গিতে হাসে। বলে, গচ্চা কেন বলছেন স্যার? এই সুযোগে আপনার ড্যামেজগুলো রিপেয়ারিং হয়ে গেল প্লাস আমাদের কোম্পানির রঙের গ্যারান্টি পাচ্ছেন!
দেবতোষ কথার জবাব না দিয়ে চেকটা সই করে ছেলেটার হাতে দেয়।
রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে কথাটা তুলল শমীক। গত কয়েকটা দিন এই জায়গাটাও এলোমেলো হয়েছিল বলে সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়াই যায়নি। আজ আবার সব আগের মতো। নতুন রঙের পর ডাইনিং স্পেসটা যেন একদম অন্যরকম লাগছে। যেন মনেই হয় না নিজেদের পুরনো বাড়ির সেই একই জায়গায় ওরা বসে আছে চারজন। শমীক আসলে ঠিক এই কথাটাই বলে ফেলল।
–মনেই হচ্ছে না, নিজেদের বাড়িতে বসে ডিনার খাচ্ছি!
বাকি তিনজনকে নিরুত্তর দেখে শমীকই আবার বলে উঠল, বুঝলে বাবা, ওয়েস্টার্ন সাইডের দেওয়ালটায় যদি একটা কনট্রাস্ট শেডিং করে নিতে আর ইন্টিরিয়র ডেকরেটারকে ডেকে ছোটখাট দু-একটা ইনস্টলেশন— মাঝারি একটা অ্যাকোয়ারিয়াম, একটা গোল্ডেন লাফিং বুদ্ধা, টেবিলের ওপরে ঝোলানো একটা শেডওয়ালা ডিমার দেওয়া হালকা লাইট… ওফ একেবারে মনে হত হোটেলের ডাইনিং লাউঞ্জ!
দেবতোষ রুটির একটা টুকরো ছিঁড়ে মুখে পুরে বলল, বাড়িকে হোটেলের মত লাগলে সেটা কি খুব ভালো!
–না, মানে… সে কথা নয়… আমি আসলে বিউটিফিকেশনের কথাটাই বলছিলাম। শমীক একটু আমতা আমতা করে বলে।
দেবতোষ আরেকটু সময় নিয়ে বলে, এইটায় কি ঠিক বিউটিফিকেশন হয়নি বলে মনে হচ্ছে?
–না, তা নয়। আমি বলছি, মোর বেটার, মোর এক্সকুইজিট! শমীকের কথায় যেন কোথাও একটা অতৃপ্তির ছোঁয়াচ।
এবার সুপ্রীতি কথা বলে ওঠেন। তা সব চুকেবুকে যাওয়ার পর তোর এইরকম মনে হচ্ছে কেন রে? আরও ভালো করলে হত, অমুকটা লাগালে হত…
শমীক এবার একটু উগ্রভাবে বলে, মনে হতেই পারে! আগে মনে হয়নি, এখন মনে হচ্ছে… এতে অন্যায় কী আছে?
দেবতোষ বলে, অন্যায় বা আপত্তি নয়, আসলে ব্যাপারটা সাধ্যের। আমার যেটুকু ক্যাপাসিটি আমায় তো সেইটুকুই ভাবতে হবে।
সুপ্রীতি তার সঙ্গে যোগ করেন, তাছাড়া কোথায় কীরকম কী করা হবে না হবে সে তো তোরাই ঠিক করেছিলি!
–মা, শোনো, তুমি ওই তোরাই কথাটা বলবে না, ঝাঁঝিয়ে ওঠে শ্রীলেখা, আমি তেমন কোনও কমেন্ট করিনি, দাদা যা ঠিক করেছিল আমি সবটাই মেনে নিয়েছি।
শমীক বোধহয় পালটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই শ্রীলেখা আবার বলে উঠল, তাছাড়া টু স্পিক দ্য ট্রুথ, এই বাড়ি রং করানোর ব্যাপারটা আমার কাছে এখন ওয়েস্টেজ বলে মনে হয়েছে! বাবার ওপর আননেসেসারি প্রেশার পড়েছে, বাজেটও ছাড়িয়ে গেছে, তাই না বাবা?
শ্রীলেখার প্রশ্নে দেবতোষ নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।
–ওয়েস্টেজ অফ মানি! শমীক এবার ফুঁসে ওঠে, একটা স্যাঁতানো রংচটা বাড়িকে রং করা মানে ওয়েস্টেজ? রংটা মেন্টেন্যান্সের পার্ট! সত্যি কী যে তোর বুদ্ধি?
–দ্যাখ দাদা, ওসব বুদ্ধি-ফুদ্ধি নিয়ে আমায় পারসোন্যাল অ্যাটাক করবি না! এটা কোনও কমপিটিটিভ একজাম নয়— ফ্যামিলি ডিসিশন। আমি এখনও মনে করি এটা আনটাইমলি অ্যান্ড রং ডিসিশন! শ্রীলেখা একেবারে তেতে ওঠে।
শমীক বলে, ওয়েস্টেজ কি ওয়েস্টেজ নয় সেটা বাবা বুঝবে, তোর এ নিয়ে এত কনসার্ন কেন? টাকা তো তুই খরচ করিসনি!
–তুইও কিন্তু করিসনি দাদা! শ্রীলেখা যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল জবাব দেওয়ার। কাজেই এখানে এটা করলে ভালো হত, ওখানে ওটা করলে বেটার হত এইসব তোরও বলা সাজে কি?
–বাবা, তোমার আদুরে মেয়ে কিন্তু গ্র্যাজুয়ালি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে! শমীক দেবতোষকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে ওঠে।
সুপ্রীতি মাঝখান থেকে বলে ওঠেন, আরে রাত দুপুরে তোরা কী শুরু করলি বল তো?
শ্রীলেখা চেঁচায়, মা, তুমি আর বেশি সালিশি কোরো না! আমায় বলতে দাও। বাবার খরচ আমাদের কনসার্ন নয় কেন? বাবার ঘাড়ে এখনও কিছু দায়দায়িত্ব আছে, চাকরি বেশিদিন নেই… এগুলো ভাবতে হবে না! শুধু বাড়ির এখানে ওই রং লাগাব, ওখানে ইন্টিরিয়র করলে ভালো হত এইসব ভাবলে চলবে?
শমীক পালটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, বাবার দায়িত্ব নিয়ে মেয়ের মাথাব্যথা! হুঁ, সব বুঝি, বুঝলি?
–কী বুঝলি রে দাদা এর মধ্যে? আমি কি কিছু অন্যায় বলেছি নাকি? রং করা রং করা নিয়ে বাবাকে এতটা ব্যস্ত না করলেই হত না! এতগুলো টাকা খরচ হল…
–ছাড় ছাড়, ওসব কথা। স্বার্থ! স্বার্থ! স্রেফ নিজের স্বার্থ!
–ও তোর কোনও স্বার্থ নেই বুঝি?
পারস্পরিক বিতণ্ডায় পরিবেশটা ক্রমশ তেতো হতে থাকে। সুপ্রীতি এইবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বেশ চেঁচিয়েই বলেন, তোরা থামবি!
দেবতোষ কিছু বলছিলেন না। নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছিলেন। খাওয়া শেষ করে একইরকমভাবে চুপ করে উঠে এসে বেসিনের সামনে দাঁড়ালেন। সুপ্রীতির ধমক খেয়ে ভাই বোনে দুজনেই একটু থমকে গিয়েছিল। সুপ্রীতি সেই সুযোগে আবার জোর দিয়ে বলে উঠলেন, মা বাবা হিসেবে আমাদের দায়দায়িত্ব আমাদেরই বুঝে নিতে দাও! এখন দয়া করে খাওয়া শেষ করে উদ্ধার করো… ঘড়ির কাঁটা অনেকদূর এগোল।
মায়ের পর পর দুবারের ধমকে শমীক আর শ্রীলেখা আর কথা বাড়াল না ঠিকই তবে হাতের গ্লাসটা ঠকাস করে কাচের টেবিলে ঠুকে শমীক জানান দিল তার এখনও কিছু বলার আছে। আর, শ্রীলেখা চেয়ারটাকে এত জোরে ঠেলে উঠে দাঁড়াল যে তার একটা পায়া ঘষটে গেল সদ্য রং করা দেওয়ালে। হালকা বাদামী রঙের একটা দাগ ধরল। দেবতোষ দেখলেন। তার পর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
৫.
সদ্য করা ঘরের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে আজ একটা পিঙ্ক রঙের মশারি খাটিয়েছেন সুপ্রীতি। মশারির ভেতর ঢুকে চুপ করে শুয়েছিলেন দেবতোষ। ঘুম আসছিল না। হাতের কাজ সেরে সুপ্রীতি তখনও ঘরে আসেননি। প্রতিদিনই আগে বিছানায় ঢোকেন দেবতোষ। তারপর সুপ্রীতি। শোওয়ার আগে মুখে একটু ক্রিম মাখা ওর বহুদিনের অভ্যাস। তারপর বড় আলো নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে মশারির মধ্যে ঢোকেন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। আলো নিভিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে সাড়াশব্দ না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
দেবতোষ কথাটা শুনলেও কিছু বললেন না। ওর ভালো লাগছিল না। কিন্তু সুপ্রীতি বোধহয় দেবতোষের থেকে কিছু আশা করছিলেন।
দেবতোষ খুব নিচু স্বরে জবাব দিলেন, না। কেন?
–এখনও জিগ্যেস করছ কেন? সুপ্রীতির গলায় উষ্মা ঝরে পড়ে, শুনলে না এতক্ষণ?
একটু সময় নিয়ে দেবতোষ বললেন, ছাড়ো… ওসব। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, এখন ওদের সঙ্গে আমাদের মিলবে কী করে?
–হ্যাঁ বড়ই তো? এখনও তো কারও এক পয়সা রোজগারের মুরোদ নেই। একজন বাবার অনেক পয়সা দেখছে। অন্যজনের গা পুড়ে যাচ্ছে বাবার খরচ দেখে!
–কী করবে বলো? দুজনে দুরকম।
–দুজনেই সমান স্বার্থপর, বুঝলে!
–ছিঃ, সুপ্রীতি নিজের ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে ওরকম বলে!
–কী বলব তাহলে? তুমি কেন আরও খরচ করলে না তা নিয়ে ছেলে গজরায় তো মেয়ে ভাবে বোধহয়…
–থাক না ওসব কথা। দেবতোষ প্রসঙ্গ থেকে পাশ ফিরতে চায়।
–তুমি বুঝতে পারছ না, মেয়ের আমায় দায়ী করার সে কী ভঙ্গি! তোমায় তো আগের দিনই বললাম। তুমি কিছুই বললে না!
–কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়া মেয়েকে কী বলব বলো তো?
–তাহলে কি যত দোষ আমার?
–তা বলেছি কি? চুপ করো সুপ্রীতি, শান্ত হও। যা হওয়ার হয়ে গেছে।
–আমরা তিল তিল করে এই বাড়িটাকে বানিয়েছি, আজ যদি সেটাকেই একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিই তাতে দোষ কোথায় বলো তো!
–তুমি ভুল করছ, দোষের কোনও ব্যাপার নেই। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
–ভালো আর কী? একজন তোমায় দোষ দিচ্ছে, আরেকজন আমায়!
পাখার হাওয়ায় মশারির সিলিংটা ফুলে ফুলে উঠছিল। অভিমানের মতো। আর বাইরের জানলা দিয়ে রাতের হালকা হাওয়া একটু একটু ঢুকে আসছিল ঘরের ভিতর। রাত গাঢ় হচ্ছিল মশারির ভেতর। সুপ্রীতি এতক্ষণ পর আর চোখের জল সামলাতে পারল না। নিঃশব্দ। তবু দেবতোষ টের পেলেন একটা কিছু ঘটছে। অন্ধকারে দুটো জোনাকি ঢুকে পড়েছে ঘরে। মশারির চালে ও দুটো ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেবতোষ খুব নিচু গলায় বললেন, শুয়ে পড়ো।
সব রং কি পাল্টানো যায়? ওর মনের ভিতর প্রশ্নটা বুড়বুড়ি কেটেই মিলিয়ে গেল। দেবতোষ পাশ ফিরে শুলেন।
জোনাকি দুটো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল অন্ধকার নেমে আসা সদ্য রং করা উজ্জ্বল ঘরটায়।