Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো — একটি সহজ পাঠ [২]

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ভাষা ও চিন্তা প্রসঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ

বস্তুবাদী চিন্তা যতটা এগিয়েছিল, তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-৮৩) এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-৯৫)। সমকালীন বিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ গড়ে তুলতে গিয়ে, তাঁরা চিন্তা এবং চেতনার উৎপত্তি ও ভূমিকা নিয়ে আরও কিছু নতুন কথা শোনালেন। একদিকে মানুষের চেতনার জগতের সমস্ত বাস্তব প্রক্রিয়ার উৎপত্তি হয় বস্তু থেকে, অর্থাৎ, বস্তুর বিকাশের মধ্যে দিয়ে এক অত্যন্ত উন্নত স্তরে এসে এক বিশেষ বস্তুসমাবেশের মাধ্যমে, কেন না, মস্তিষ্কও আসলে বস্তুরই বিকাশের এক সর্বোন্নত ও জটিলতম রূপ। আবার মানুষ যা চিন্তা করে, অর্থাৎ, তার ভাবজগতের সেই উপাদানগুলিও বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তি মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই জন্ম লাভ করে। অপরদিকে এই চিন্তা করার ক্ষমতার একটা আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য আছে, বাস্তব পরিসীমার মধ্যেই স্বকীয়তা আছে। শারীরসংস্থানগত গঠন চিন্তা করার শারীরিক ভিত্তি বা অবকাঠামো হিসাবে কাজ করলেও তার দ্বারাই চিন্তার ভাবগত উপাদানগুলি নির্ণীত হয় না। সেগুলির আধার হচ্ছে ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিবেশ। ভাববাদী দার্শনিকরা ভুল করেন চিন্তাশক্তির এই আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যকে চূড়ান্ত স্বাতন্ত্র্য ও বস্তুনিরপেক্ষতার দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে। আর এযাবত বস্তুবাদীদের ভুল হয়েছে মন ও চিন্তাক্ষমতার এই আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যকেও অস্বীকার করার মধ্যে। এই দুটো ভুলকেই অতিক্রম করে প্রশ্নটার বিচার করতে হবে।

মার্ক্স তাঁর পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের এক ভূমিকায় হেগেলের ভাববাদের সঙ্গে তাঁর বস্তুবাদী চিন্তার পার্থক্যের জায়গাটা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেই বলেছেন,

হেগেলের তত্ত্ব অনুযায়ী মানব-মস্তিষ্কের জীবন প্রক্রিয়াকে, অর্থাৎ, মানুষের চিন্তার প্রক্রিয়াকে, ‘ধ্যানধারণা’ নাম দিয়ে তাকে এমনকি রূপান্তরিত করা হয়েছে অনন্যনির্ভর স্বাধীন একটা বিষয়ে; এ তত্ত্বে ‘ধ্যানধারণা’-ই হল বস্তুজগতের সৃষ্টিকর্তা, আর বস্তুজগত ‘ধ্যানধারণা’-র বাহ্য ইন্দ্রিয়গোচর আকার মাত্র। কিন্তু আমার কাছে এর বিপরীতে ধ্যানধারণা মানুষের মনে প্রতিফলিত ও চিন্তার অবয়বে রূপান্তরিত বস্তুজগত ছাড়া আর কিছু নয়।[1]

ফ্রেডরিক এঙ্গেল্‌স বানর-সদৃশ প্রাণী থেকে মানুষের বিবর্তনের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো, দুই হাত দিয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ কাজ বা শ্রম সাধন এবং তারই পরিণামে এবং/অথবা প্রয়োজনে ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে কিছু মূল্যবান মতামত রেখেছিলেন।[2] অন্যত্র তিনি দেখিয়েছেন:

হাজার হাজার বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে যখন পা আর হাত আলাদা হল এবং ঋজু ভঙ্গি পাকা হল, মানুষ বানরদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে গেল; তার ভিত্তিতেই উদ্ভূত হল তাঁর অর্থবহ বাক্‌শক্তি এবং মস্তিষ্কের বিপুল বিকাশ ঘটল, যা তাকে বানরদের থেকে অনেক দূরে এনে ফেলেছে।[3]

মার্ক্স এবং এঙ্গেলস যান্ত্রিক বস্তুবাদীদের তুলনায় অগ্রসর হয়ে গোড়াতেই একটা কথা চমৎকারভাবে ধরেছিলেন। মন বা চেতনা বস্তুনির্ভর হলেও কোনও বস্তুগত সত্তা (material entity) নয়: মন হল একটা ক্রিয়াত্মক সত্তা (functional entity)। এ হচ্ছে জীবন বা গতির মতো। গতি বস্তুরই ধর্ম, বস্তুর গতি ছাড়া নির্বস্তু গতি, নিছকই গতি, বলে কিছু হয় না। গতিশীল বস্তুকে দেখেই কেবলমাত্র গতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলেও গতি নামক কোনও বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে ছুঁয়ে ধাক্কা দিয়ে জলে ভিজিয়ে দেখা যায় না। গতি একটি ক্রিয়াত্মক সত্তা। জীবনও তাই। সজীব বস্তুর অস্তিত্ব ক্রিয়াকলাপ দেখেই জীবন সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। গাছটা বড় হচ্ছে, ফুল ফুটছে, ফল পাকছে; কুকুরটা ছোটাছুটি করছে, ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে— আমরা এইসব দেখে শুনে বুঝতে পারি, গাছটার ভেতরে প্রাণ আছে, কুকুরটা জীবন্ত। এইরকম জীবন্ত উদ্ভিদ বা প্রাণী বাদ দিয়ে কেবলই জীবন স্বতন্ত্রভাবে দেখতে চাইলেও দেখা যায় না। চিন্তা বা চেতনাও যে এইরকম একটি ক্রিয়াত্মক সত্তা সেই ধারণাটা ভাষায় না বললেও আভাসে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একেবারে গোড়াতেই:

Consciousness can never be anything else than conscious being, and the being of men is their actual life-process.[4]

অর্থাৎ, চেতন সত্তা সচেতন অস্তিত্ব ছাড়া অন্য কোনওভাবেই ব্যক্ত হতে পারে না, আর মানুষের অস্তিত্ব মানে হল তার জীবনযাপন প্রণালী। অন্য কথায়, মানুষের চেতনাকে দেখতে হবে তার সচেতন অস্তিত্ব ও আচরণের মধ্যে।

মানুষ তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে ভাষার সাহায্যে। কারণ, মানুষ তার হোমো গণভুক্ত আদি প্রজাতিগুলির সময়কাল থেকেই প্রথমে গোষ্ঠীবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হয়ে বিকশিত হয়েছে। আর এই সামাজিক জীবনযাত্রায় সমাজবদ্ধ থাকার প্রয়োজনে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ তথা তথ্য আদানপ্রদানের প্রক্রিয়া ও প্রয়োজন থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ভাষার বিকাশ ঘটেছে। এই ভাষাই হল চিন্তার ধারক ও বাহক। ভাববাদীদের উদ্দেশে একটু শ্লেষ করেই তাঁরা বলেছেন:

The “mind” is from the outset afflicted with the curse of being “burdened” with matter, which here makes its appearance in the form of agitated layers of air, sounds, in short, language. Language is as old as consciousness, language, like consciousness, only arises from need, the necessity of intercourse with other men.[5]

মার্ক্স আরও দেখিয়েছেন, একটা মৌমাছি আর একজন মানব স্থপতির কাজের মধ্যে মূল পার্থক্য নির্ধারিত হয় মানুষের বিমূর্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অগ্রিম চিন্তা করার ক্ষমতার দ্বারা।[6]

চিন্তা, চেতনা— এগুলো তাহলে কী? এঙ্গেল্‌স উত্তর দিয়েছেন,

… আমাদের চেতনা ও চিন্তা, তাদের যতই বস্তু ঊর্ধ্ব মনে হোক না কেন, একটি বাস্তব, শারীরিক অঙ্গ, মস্তিষ্কের উপজ। চিন্তা থেকে বস্তু আসেনি, বস্তুরই এক সর্বোচ্চ বিকশিত উপজ হচ্ছে চিন্তা।[7]

অন্য ভাষায়,

The influences of the external world upon man express themselves in his brain, are reflected in it as feelings, thoughts, impulses, volitions, …[8]

কিন্তু মস্তিষ্কের দ্বারা বাস্তব জগতের এই প্রতিচিত্রণের প্রক্রিয়াটি একটা একতরফা ঘটনা নয় এবং মানবমস্তিষ্ক একটি নিষ্ক্রিয় জৈব দর্পণ মাত্র নয়। মানুষ প্রকৃতি ও বাইরের বস্তুজগতের সঙ্গে ঘাতপ্রতিঘাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে করতেই এবং বহির্জগতকে পরিবর্তিত করার মাধ্যমেই তাকে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করতে পারে:

দর্শনের মতোই প্রকৃতিবিজ্ঞান এযাবত মানুষের চিন্তার ওপর তাঁর কাজের প্রভাব সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে; তাদের কাছে একদিকে আছে প্রকৃতি, আর একদিকে আছে চিন্তার জগৎ। কিন্তু প্রকৃতি যেমন আছে তেমন নয়, তাকে পরিবর্তন করার ক্রিয়াই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে মানুষের চিন্তার উৎপত্তির ওপর। মানুষ এই প্রকৃতির পরিবর্তন যে অনুপাতে ঘটাতে পারে, সেই অনুযায়ীই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটেছে।[9]

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)-ও এঙ্গেল্‌সের এইসব বক্তব্যকেই আরও সম্প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়। অনেকেই জানেন, বিশ শতকের গোড়ায় বিজ্ঞানের দর্শনে প্রত্যক্ষবাদের ব্যাপক জোয়ার বইছিল, রাশিয়ার মাটিতে একদল মার্ক্সবাদী আর্নস্ট মাখ (১৮৩৮-১৯১৬)-এর মতো বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর সেই সব প্রত্যক্ষবাদী বক্তব্যকে খুব আধুনিক অগ্রসর বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ধারণা ভেবে মার্ক্সবাদের সঙ্গে মেলাতে চাইছিলেন। আজ শুনলে হয়ত অবাক লাগবে যে রিচার্ড আভেনারিউস (১৮৪৩-৯৬)-এর মতো কুশলী ভাববাদী দার্শনিকরা যখন চিন্তা করার হাতিয়ার হিসাবে মস্তিষ্কের ভূমিকা অস্বীকার করছিলেন, মাখ তাকে সমর্থন করে বসেন। আভেনারিউস তাঁর The Human Concept of the World বইতে বলেছিলেন, “The brain is not the habitation, the seat, the creator, it is not the instrument or organ, the supporter or substratum, etc., of thought;” মাখও উদ্ধৃতি সহকারে এই কথারই প্রতিধ্বনি তোলেন: “Thought is not an inhabitant, or commander, or the other half, or side, etc., nor is it a product or even a physiological function, or a state in general of the brain” তাঁর Analysis of Sensations বইতে।

লেনিন এই সমস্ত বক্তব্য তাঁর ১৯০৯ সালে প্রকাশিত Materialism and Empirio-Criticism বইতে তুলে ধরে সমালোচনা করে দেখান, (তাঁর কালের) সমসাময়িক বিজ্ঞান এই সব ধারণাকে সমর্থন করে না। এমনকি আভেনারিউসের এক ছাত্রই গুরুর বিরোধিতা করে লেখেন:

আভেনারিউস এক জীব-যন্ত্রবিদ্যার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু মস্তিষ্কের কাজ কারবার সত্যিকারের আবিষ্কারের দ্বারাই বোঝা যায়, উনি যেভাবে ভেবেছিলেন তাতে কিছুই জ্ঞান লাভ হয় না। তাঁর জীবযন্ত্রবিদ্যা কোনও রকম পর্যবেক্ষণের ওপর দাঁড়িয়ে নেই; এর বৈশিষ্ট্য হল এক গুচ্ছ ধারণার ছক-নির্মাণ, আর সেই সব ছকের মধ্যে কোনও তত্ত্বাভাসও নেই যার থেকে নতুন কিছু জানার দরজা খুলবে, তাঁর সবই হচ্ছে ছকে বাধা অনুমান, যা দেওয়াল হয়ে আমাদের দেখার চোখকে বাধা দেয়।[10]

সোজা কথায়, মস্তিষ্ককে চিন্তা করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলে চিন্তা চেতনার রহস্য উদ্ঘাটন করার আর কোনও উপায় থাকে না।

তবে লেনিন জানতেন, মস্তিষ্ক চিন্তার আধার বা হাতিয়ার— এটকু বললে চেতনার উৎপত্তি ও ক্রিয়াকলাপের কিছুই ব্যাখ্যা হয় না। এই ব্যাপারে তিনি প্রায় দেড় দশক আগে ইভান মিখাইলোভিচ সেচনভ (১৮২৯-১৯০৫)-এর মস্তিষ্ক সংক্রান্ত রচনা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে মার্ক্সবাদের বিচারপদ্ধতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছিলেন, যা এখানে স্মর্তব্য:

নিথরবাদী মনোবিদ আত্মার সম্পর্কে যুক্তিতর্ক তোলেন। এই পদ্ধতিটাই একেবারে অকাজের। আপনি মানসিক ক্রিয়াকলাপের কথা ব্যাখ্যা না করে আত্মা প্রসঙ্গ উত্থাপনই করতে পারেন না: এখানে কাজের কাজ করতে হলে আত্মার প্রকৃতি সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব এবং দার্শনিক কূটকচালি বাদ দিয়ে মানসিক ক্রিয়াকলাপের বিভিন্ন ঘটনাবলিকে বৈজ্ঞানিক বিচারের ওপর দাঁড় করাতে হবে। … একজন প্রকৃত মনোবিজ্ঞানী আত্মা সংক্রান্ত দার্শনিক ব্যাখ্যান বর্জন করে এসে সোজা মানসিক কার্যকলাপের বস্তুগত অবকাঠামো— স্নায়বিক প্রক্রিয়া— পর্যালোচনা করতে এগিয়ে গেছেন— এবং, ধরে নেওয়া যায়, এক বা একাধিক মানসিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন।[11]

অর্থাৎ, স্নায়ুশারীরতাত্ত্বিক আধারের সাহায্যে কিছু কিছু মনন-গত ঘটনাপুঞ্জ বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করে দেখাতে হবে।

পরবর্তীকালে তিনি মানুষের চিন্তার যে অন্যতম কার্যকলাপ— জ্ঞান অর্জন— তাকেও এই একই বস্তুবাদী পরিচিত্র দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জুরিখ ও বার্নের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে বসে দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কে পরিকল্পিত একটি মহাগ্রন্থের জন্য বিভিন্ন চিন্তাবিদের বক্তব্য থেকে নানারকম প্রয়োজনীয় নোট নিতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে তিনি একটি অসাধারণ মন্তব্য করেন:

Knowledge is the reflection of nature by man. But this is not a simple, not an immediate, not a complete reflection, but the process of a series of abstractions, the formation and development of concepts, laws, etc., and these concepts, laws, etc. (thought, science = “the logical Idea”) embrace conditionally, approximately, the universal law-governed character of eternally moving and developing nature. Here there are actually, objectively, three members: 1) nature; 2) human cognition = the human brain (as the highest product of this same nature), and 3) the form of reflection of nature in human cognition, and this form consists precisely of concepts, laws, categories, etc. Man cannot comprehend = reflect = mirror nature as a whole, in its completeness, its “immediate totality,” he can only eternally come closer to this, creating abstractions, concepts, laws, a scientific picture of the world, etc., etc.[12]

এই জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় মানুষ, বা তার মস্তিষ্ক বাইরের উদ্দীপনার শুধু নিষ্ক্রিয় গ্রাহক নয়, সেও এক দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে থাকে। নানা ঘাত সংঘাতের মধ্যে দিয়ে জগৎ সম্পর্কে সে যা ভাবছে তাকে ক্রমাগত সঠিকতর উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ করতে থাকে:

Cognition is the eternal, endless approximation of thought to the object. The reflection of nature in man’s thought must be understood not “lifelessly,” not “abstractly,” not devoid of movement, not without contradictions, but in the eternal process of movement, the arising of contradictions and their solution.[13]

মানুষ তাঁর চিন্তাপ্রক্রিয়ার দর্পণে প্রকৃতিকে নিষ্ক্রিয়ভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিফলিত করে না, তার মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে, একরকমের সচল প্রক্রিয়ায় থেকে জ্ঞেয় (বস্তু) ও জ্ঞাতা (মানবমস্তিষ্ক)-র মধ্যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় ও তার নিরসন হতে থাকে। এইভাবেই জ্ঞানন ক্রিয়া চলতে থাকে।

আর, আমার ধারণা, তিনি চিন্তা ও ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমান্তরাল বিকাশের প্রশ্নটিকেও the history of thought = the history of language[14]— এরকম একটা সংশয়বাচক ছোট মন্তব্যে উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন।

জোসেফ স্তালিন (১৮৭৮-১৯৫৩)-এরও ভাষা ও চিন্তার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, যেগুলির অনেক কিছুই আমাদের এই আলোচনায় খুবই প্রাসঙ্গিক:

অনেকে বলেন, ভাষায় ব্যক্ত না হয়েই মানুষের মনে চিন্তার উদ্গম হয়, ভাষাগত উপাদান, ভাষাগত খোলস ছাড়াই তা আসে, যেন একেবারে নগ্ন আকারে। এটা সম্পূর্ণ ভুল। মানুষের মনে যে কোনও সময়ে যা কিছু চিন্তা আসে, তা আসতে এবং থাকতে পারে একমাত্র ভাষাগত উপাদানের ওপর নির্ভর করে, ভাষাগত শব্দ ও পদের আধারে। ভাষাগত উপাদান থেকে মুক্ত, ভাষার “প্রাকৃতিক আধার” বর্জিত, শুদ্ধ চিন্তা, বলে কিছু হয় না। “ভাষা হচ্ছে চিন্তার প্রত্যক্ষ বাস্তব প্রকাশ” (মার্ক্স)। চিন্তার বাস্তবতা ভাষার মাধ্যমেই ব্যক্ত হয়। কেবলমাত্র ভাববাদীরাই ভাষার “প্রাকৃতিক আধার” থেকে বিচ্ছিন্ন চিন্তার কথা, ভাষাব্যতীত চিন্তার কথা বলতে পারে।[15]

অনেকে মনে করেন, মানবপ্রজাতিগুলি আগে ইশারা-ভাষা আয়ত্ত করেছিল, তার পর কোনও এক সময় থেকে তারা বাক্‌ভাষা ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। স্তালিন এই ধারণার সমালোচনা করে দেখান,

কথ্য ভাষা বা শব্দসমষ্টির ভাষাই চিরকাল মানবসমাজে ভাষা হিসাবে কাজ করেছে যা মানুষে মানুষে আলাপনের পর্যাপ্ত মাধ্যম ছিল। ইতিহাসে এমন একটাও এমনকি অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া মানবগোষ্ঠীর কথা জানা নেই, যাদের কথ্য ভাষা ছিল না। নৃজাতিবিদ্যায় এমন কোনও পশ্চাদপদ জনজাতির কথা জানা নেই, সে যতই আদিম হোক, বা এমনকি অস্ট্রেলিয়া বা তিয়েরা দেল ফ্যুয়েগার মতো অথবা আরও অনুন্নত হোক, যাদের কোনও কথ্য ভাষা ছিল না। মানবজাতির ইতিহাসে কথ্য ভাষাই সেই অন্যতম শক্তি যার সাহায্যে মানুষেরা পশুজগতের থেকে উঠে এসেছে, মানবগোষ্ঠীতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, চিন্তাক্ষমতার অধিকারী হয়েছে, সামাজিক উৎপাদন সংগঠিত করেছে, প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছে এবং আমাদের আজকের এই স্তরে এসে পৌঁছেছে।[16]

ইশারা বা সাঙ্কেতিক ভাষার সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য:

প্রসঙ্গত বলি, হতদরিদ্র অবস্থা ও সীমাবদ্ধতার কারণে তথাকথিত ইশারা-ভাষার গুরুত্ব নেই বললেই চলে। সঠিকভাবে বলতে গেলে, এ কোনও ভাষা নয়, কথ্য ভাষার বদলে ব্যবহার করার মতো কোনও ভাষিক বিকল্পও নয়, এ হল কথা বলার সময় মানুষ যখন হাত পা নেড়ে কোনও একটা জিনিসকে জোর দিতে চায় সেই মতো সহায়ক গৌণ উপায়। ইশারা-ভাষার সঙ্গে কথ্য ভাষার ততটাই তফাত, যতটা আদিম কাঠের লাঙলের ফলার সঙ্গে আধুনিক পাঁচ ফলা যুক্ত ক্যাটারপিলার ট্র্যাকটর বা ট্র্যাকটর রো ড্রিলের।[17]

স্তালিনের এই সমস্ত বক্তব্য নিয়ে অল্পবিস্তর দ্বিমত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। শুধু ইশারা-ভাষা নয়, দু-চার লক্ষ বছর বা আরও আগেকার কথ্য ভাষাও খুব সমৃদ্ধ ছিল বলে ধরা যায় না। তবে এই কথাটা মেনে নেওয়া যায় যে আদিম মানবপ্রজাতিগুলির জীবনে ইশারা-ভাষার উদ্ভব আগে হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষ তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার জোরে কথ্য ভাষা আয়ত্ত করে ফেলে এবং তারপর থেকে হাত পা নেড়ে দেখানো ইশারা বা সঙ্কেতগুলি কথ্য ভাষারই সহায়ক অনুষঙ্গ হিসাবে স্যাপিয়েন্স প্রজাতির উদ্ভব ও বিকাশ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত থেকে যায়।

স্বভাবতই সেদিন সোভিয়েত রাশিয়ায় যাঁরা মূক-বধিরদের শিক্ষাদানের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের একটা প্রশ্ন ছিল, কথ্য ভাষা ছাড়া যদি চিন্তা করা সম্ভব না হয়, তবে মূক ও বধিররা চিন্তা করে কীভাবে? স্তালিন এর উত্তরে যা বলেছিলেন, তা তাঁর আগেকার কথাকে অনেকটাই নাকচ করে দেয়:

“মূক-বধিরদের ক্ষেত্রে অবস্থাটা কী? তাদের কি চিন্তাশক্তি আছে? তাদের মাথায় কি চিন্তার উদয় হয়? হ্যাঁ, তাদের চিন্তাশক্তি আছে এবং তাদের মধ্যে চিন্তার উদয় হয়। স্পষ্টত, মূক-বধিররা যেহেতু কথা বলার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত, তাদের চিন্তা ভাষা-উপাদানকে আশ্রয় করে আসতে পারে না। তাহলে কি বলা যাবে, মূক-বধিরদের চিন্তা হচ্ছে নগ্ন এবং তারা “প্রকৃতির মান্য প্রক্রিয়া”-র বাইরে (এন ওয়াই মারের উক্তি অনুসারে)? না, অবশ্যই নয়। মূক-বধিরদের মধ্যে চিন্তার উদয় এবং চর্চা হয় বিমূর্ত ছবি, সংবেদন ও অবধারণের সাহায্যে, যা তারা দৃশ্য, স্পর্শ, স্বাদ ও গন্ধের মাধ্যমে বহির্জগতের বস্তুসমূহ ও তাদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে প্রতি দিন পেয়ে থাকে। এই ছবি, সংবেদন ও অবধারণের কথা না ধরলে চিন্তা বলে কিছু হবে না, তার অবলম্বনও কিছু থাকবে না। তা আসলে চিন্তাই নয়।”[18]

অর্থাৎ, শ্রবণ ছাড়া অন্যান্য অনুভূতিগুলিকে কাজে লাগিয়ে মূক ও বধিররা বহির্বাস্তব সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করার পর তাদের জন্য প্রচলিত সঙ্কেত-ভাষা (sign language)-র সাহায্যেই তারা চিন্তা করতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এই সঙ্কেত ভাষা তাদের ক্ষেত্রে কথ্য ভাষার বিকল্প একটা ধরন হিসাবেই কাজ করতে থাকে। এর সঙ্গে আদিম মানুষের ইশারা-ভাষাকে মিলিয়ে দেখা অবশ্য ঠিক হবে না। তাদেরটা ছিল অত্যল্প কয়েকটি কাজ এবং/অথবা তথ্যের সঙ্কেত। এবং সেই সঙ্কেতগুলি ছিল অচেতন, স্বতঃস্ফূর্ত ও বিশেষ বিশেষ ঘটনাপ্রসূত। আর আজকের দিনে মূক-বধিরদের সাঙ্কেতিক ভাষায় সাধারণভাবে প্রচলিত কথ্য ও লিখিত ভাষার সমস্ত শব্দেরই সমতুল্য সঙ্কেত তৈরি ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শুধু ব্যবহারের শারীরিক প্রক্রিয়াটা ভিন্ন। আর এই সঙ্কেতগুলি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা চিন্তা করে। তথাপি বধিরতা এবং বাক্‌শূন্যতা তাদের চিন্তাক্ষমতাকে মনে হয় খানিকটা ক্ষুণ্ণ করে দিতে পারে, বা তার বিকাশ কিছুটা ব্যাহত করে দেয়।

আমরা দেখতে পাব, আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মানুষের মন ও চিন্তা সংক্রান্ত গবেষণার মধ্য দিয়ে এযাবত যে সমস্ত তথ্য উঠে এসেছে, তাতে মার্ক্সবাদী দর্শনের প্রবক্তাদের এই সব বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণ অভ্রান্ত ও দিকনির্দেশক সত্য বলেই প্রতিভাত হয়েছে। অন্য ভাষায়, এই বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলির উত্তর একে একে পাওয়া যাচ্ছে।

 

[ক্রমশ]


[1] মার্ক্স ১৯৮১; ৬, ২৫-২৬।
[2] এঙ্গেলস ১৯৭৪, ১৭৪।
[3] পূর্বোক্ত, ৩৩-৩৪।
[4] মার্ক্স এবং এঙ্গেলস ১৯৭৬, ৪২। মার্ক্স এবং এঙ্গেল্‌স এখানে জার্মান das Bewusstsein শব্দটিকে দুভাগে ভেঙে (das bewusste Sein) এই ক্রিয়াত্মক সত্তার ধারণার আভাসটি দিতে চেয়েছেন।
[5] পূর্বোক্ত, ৪৯।
[6] মার্ক্স ১৯৭৭, ১৭৪।
[7] এঙ্গেলস ১৯৭৬, ২১।
[8] পূর্বোক্ত, ২৭।
[9] এঙ্গেলস ১৯৭৪, ২৩১; ইটালিক্স মূল-এর।
[10] সমস্ত উদ্ধৃতি উল্লেখিত, লেনিন ১৯৭৭, ৯৩।
[11] লেনিন ১৯৭৭, ১৪৪; মোটা হরফ বর্তমান লেখকের।
[12] লেনিন ১৯৬১, ১৮২।
[13] পূর্বোক্ত, ১৯৫; মোটা হরফ মূল-এর।
[14] পূর্বোক্ত, ৮৯।
[15] স্তালিন ১৯৭৬, ৩৭।
[16] পূর্বোক্ত, ৪৫।
[17] পূর্বোক্ত।
[18] পূর্বোক্ত, ৪৬।