Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

খিদের হিসেব বলছে, ভারত ১০১-এ

উর্বা চৌধুরী

 



শিক্ষাকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

ভারতে না মেটা খিদে একটি বিকট সঙ্কটের চেহারা নিয়েছে, আর এই সঙ্কটে রাষ্ট্রের ভূমিকাই যে সবচেয়ে গর্হিত তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

অপর মানুষের ‘খিদে’-র বোধ যেহেতু চোখের সামনে ধরা দেয় না, তাই তার অস্তিত্ব বুঝতে কিছু ক্ষুধা সূচক নির্ধারিত হয়েছে। খিদে মাপতে ও তার বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতেই (ট্র্যাকিং) ফি-বছর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ভিত্তিতে তৈরি হয় বিভিন্ন দেশের তালিকা। মোট জনসংখ্যার শতকরা কত ভাগ অপুষ্টির শিকার, তীব্র অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের নিচে শতকরা কত ভাগ শিশুর স্বাভাবিক উচ্চতা সঙ্কটজনক রকমের কম (স্টান্টিং), দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের নিচে শতকরা কত ভাগ শিশুর উচ্চতার সাপেক্ষে স্বাভাবিক ওজন বিপজ্জনক রকমের কম (ওয়েস্ট), পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার শতকরা কত ভাগ— এই চারটি সূচকের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের নানা দেশের মানুষের পুষ্টিকর খাবার খেয়ে খিদে কতটা মিটছে বা মিটছে না, সেই সংক্রান্ত উপসংহারে পৌঁছানো হয়।

২০২১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক তালিকায় ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম দেশ ভারত। দশ বছর আগে, ২০১১ সালে, ১২২টি দেশের এই তালিকায় ভারতের স্থান ছিল ৬৭ নম্বরে, এবং ২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ৯৪ নম্বরে। ২০২১-এর সমীক্ষায় জানা গেছে যে, এ দেশের ১৫.৩ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। তীব্র অপুষ্টির কারণে ৩৪.৭ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর স্বাভাবিক উচ্চতা সঙ্কটজনক রকমের কম, দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির কারণে ১৭.৩ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর উচ্চতার সাপেক্ষে স্বাভাবিক ওজন বিপজ্জনক রকমের কম, এবং পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ৩.৪ শতাংশ।

শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, মায়ানমার ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশ এগিয়ে আছে ভারতের চেয়ে— তালিকায় শ্রীলঙ্কার ক্রম ৬৫, নেপালের ৭৬, বাংলাদেশের ৭৬, মায়ানমারের ৭১, এবং পাকিস্তানের ক্রম ৯২। তালিকায় ভারতের পর রয়েছে মাত্র ১৫টি দেশ।

এক্ষেত্রে দেখা গেছে মূলত, সরকারি গুদামে যথেষ্ট খাদ্য জমে থাকা সত্ত্বেও তা পৌঁছচ্ছে না দেশের মানুষের কাছে। এছাড়া এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পেশাগত ধরনের কারণে অপর্যাপ্ত ও ক্রমহ্রাসমান আয় দিয়ে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে প্রয়োজনীয় পরিমাণের ও গুণগত মানের খাদ্য খাওয়া দরকার তা তাঁরা কিনে উঠতে পারছেন না। না মেটা খিদের কারণে অপুষ্টির বাস্তবতার সঙ্গে আরেকটি কারণও জড়িয়ে থাকছে— গণবণ্টন বা রেশন ব্যবস্থা, স্কুল ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে মিড-ডে-মিল প্রকল্পে ব্যাপক অব্যবস্থা, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থবরাদ্দ ও জনবিরোধী নীতি।

২০২১ সালের প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশ্ব ক্ষুধা সূচক নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এনডিএ সরকার। যদিও তা ধোপে টেঁকেনি— দ্য হিন্দু থেকে শুরু করে একাধিক সংবাদ প্রকাশক পদ্ধতিগত দিক ও সে সংক্রান্ত বিসম্বাদের কথা উল্লেখ করেছে, আবার গত ২ নভেম্বর দ্য প্রিন্ট প্রকাশ করেছে এমন একটি নিবন্ধ যেখানে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক তালিকা ছাড়াও এদেশে অপুষ্টির ভয়াবহতাকে চেনানোর অন্যান্য উপায়গুলিও ঢাকতে পারছে না এই সঙ্কটের বাস্তবতাকে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক তালিকার চারটি সূচক অপুষ্টি চিহ্নিতকরণের সবকটি তলকে ঈঙ্গিত করেনি— পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর তীব্র অপুষ্টির কারণে সঙ্কটজনক রকমের কম উচ্চতা (স্টান্টিং), দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির কারণে সেই শিশুদের উচ্চতার সাপেক্ষে বিপজ্জনক রকমের কম ওজন (ওয়েস্ট), ওই বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার— এই দিকগুলি জড়িয়ে থাকলেও উল্লেখ নেই, এদেশে পরিপোষকের অভাবে বাড়তে থাকা অপুষ্টি বা অপুষ্টিকর খাবারের কারণে বাড়তে থাকা জীবনযাত্রা সম্বন্ধীয় ব্যাধির প্রকোপের দিকটি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের ন্যাশানাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, গুজরাট ও বিহারে ৪০ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম। একই প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে, সমীক্ষা হওয়া ১৭টি রাজ্যের মধ্যে ১১টিতে স্টান্টিং-এর হার বেড়েছে, যা কিনা তীব্র অপুষ্টির বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করে, আবার ১৩টি রাজ্যে বেড়েছে ওয়েস্টিং-এর হার, যা কি না ইঙ্গিত করে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির বাস্তবতাকে। একই সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, এই অপুষ্টির কারণে শরীর ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো ব্যাধির সঙ্গে লড়তে না পারায় শিশুমৃত্যুর পরিমাণ বাড়ছে।

 

এই ভয়াবহ পরিসংখ্যানের পিছনে আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের যে কীর্তিগুলি রয়েছে সেগুলির একটির ওপর জোর দিতে চাইব। সবচেয়ে সহজে চোখে দেখা যায় বা সবচেয়ে দ্রুত কানে শোনা যায় যে কীর্তি, তা হল, সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলগুলিতে মিড-ডে-মিল বণ্টনের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নিল শাসকেরা!

অতিমারি পর্যায়ে মিড-ডে-মিলের অধিকারটি কি আদৌ সুনিশ্চিত হল? বিশ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে যে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ কুকড মিড-ডে-মিল প্রোগ্রাম বাবদ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলের বাচ্চারা সরকারের কাছ থেকে প্রত্যেক মাসে দুই কেজি চাল, দুই কেজি আলু, বা এক কেজি আলু ও এক কেজি ছোলা, আড়াইশো মুসুর ডাল, গত সাত মাস সোয়াবিন বড়ি, চিনি, একটি সাবান পেয়েছে। অতিমারির আগেও মিড-ডে-মিলের খাবার ছিল শিশুর শারীরিক বিকাশের প্রশ্নে নিঃসন্দেহে অপর্যাপ্ত। এ নিয়ে বহুবার বহু ধরনের দাবি উঠেছে। তবু মিড-ডে-মিলে আলুর তরকারি, আলু-মটরের তরকারি, মুসুর ডাল, আলু-সোয়াবিন বড়ির তরকারি, নানা সবজি, সপ্তাহে একদিন বা দুদিন ডিম, খিচুড়ি ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছিল লকডাউনের আগে, যখন স্কুল খোলা ছিল। এসবের খরচ ছাড়াও মাসিক হিসাবে স্কুলপিছু জ্বালানি ও চাল আলাদা দেওয়া হত দপ্তর থেকে। লকডাউন পর্যায়ে জ্বালানির খরচ দিতে হচ্ছিল না সরকারকে। জ্বালানির খরচটুকু যোগ করে সরকার বাচ্চাদের মধ্যে বণ্টিত কাঁচা খাবারের পরিমাণ বাড়াবে, এটাই তো ছিল স্বাভাবিক। না, তা হয়নি। আজ অবধি সেই খরচ তো করা হলই না, উপরন্তু, মটর-সবজি-সোয়াবিন বড়ি-ডিমের খরচটুকুও বুঝে পেল না বাচ্চারা। আমরাও জানলাম না কোথায় গেল সেই খরচ।

প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে মিড-ডে-মিলের ফাঁকির ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আরও মারাত্মক বঞ্চনার ঘটনা। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের পর এ রাজ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে মিড-ডে-মিলের খদ্যসামগ্রী বণ্টনও বন্ধ হয়। এর অর্থ হল সদ্যোজাত থেকে ছয় বছর বয়সি বাচ্চাদের খাবার বন্ধ হয়েছে, বন্ধ হয়েছে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের খাদ্যসামগ্রী বণ্টন। গর্ভবতীর শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গর্ভের সন্তান এবং ছয় বছর বয়স অবধি বাচ্চাদের শরীরের টিঁকে থাকার অনেকটাই নির্ভর করে এই মিড-ডে-মিলের উপর।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গত বিধানসভা নির্বাচনের আগের মাস, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ২০২১ থেকে শুরু করে মে ২০২১, নির্বাচন শেষ হওয়া ইস্তক নির্দিষ্টভাবে চার মাসের জন্য মিড-ডে-মিল বাবদ বাচ্চা পিছু মাসিক ১০০ টাকার কিছু বেশি খরচ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নির্বাচন মেটার পর, জুন ২০২১ থেকে বাচ্চা পিছু মাসিক ৭৭ টাকায় নামিয়ে আনল মিড-ডে-মিলের খাদ্যসামগ্রীর খরচ। নির্বাচনের পর ফের ছোলা কখনও বন্ধ হয়, কখনও এক কেজি ছোলা দিলে এক কেজি আলু কমিয়ে দেওয়া শুরু হয়, চিনির পরিমাণ অর্ধেক করে ৫০০ গ্রাম থেকে ২৫০ গ্রাম করা হয়। সোয়াবিন বড়ি কমিয়ে অর্ধেক করে— ২০০ গ্রাম থেকে ১০০ গ্রাম দেওয়া হল দুই মাস, ফের আগস্ট মাস থেকে বন্ধ করা হল সোয়াবিন বড়িও।

সরকার জানে না, কেন ভারত ২০২১ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচক তালিকায় ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১ নম্বরে। সরকার জানে না, কীভাবে এদেশে বাচ্চারা অপুষ্টিতে মারা পড়ছে। সরকার জানে না, কেন ন্যাশানাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-র প্রতিবেদন জানাচ্ছে ১১টি রাজ্যে বাড়ছে শিশুর দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি, আর ১৩টিতে বাড়ছে তীব্র অপুষ্টি! সরকার না জানলেও খালি চোখে দেখা যাচ্ছে যে, শিশুদের প্রাপ্য খাবারে সরকারি ফাঁকিবাজি চলছে মাসের পর মাস, বণ্টিত খাবারে পরিপোষকের ঘাটতি রয়েছে, রয়েছে প্রোটিন জাতীয় খাবারের ঘাটতি, রয়েছে শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধক শক্তি নষ্ট করে দেওয়ার ফিকির।

রাষ্ট্র যে সরকারের সাহায্যে অপার অমানবিক কাণ্ড করে চলেছে— সে কথা সত্য, তবে আমরাও যে তেমন করে মাথা ঘামাইনি, ঘামাই না, সে কথাও বাদ রাখা কাজের কথা হবে না। আমরা সুযোগ মতো ত্রাণের কাজে হাত লাগিয়েছি, দানের কাজে হাত লাগিয়েছি, যা ভারতকে খিদের হিসাবের খাতায় ১০১-এর উপরে তুলতে পারেনি, পারে না। মাসের পর মাস শিশুরা খাবারের মতো বেঁচে থাকার প্রাথমিক উপাদান পাচ্ছে না, অপুষ্ট শরীর বয়ে চলেছে, বয়ে চলেছে ব্যাধি, বইতে না পারলে মরেও যাচ্ছে। প্রকট, নিরবচ্ছিন্ন গণ-আন্দোলন ছাড়া এই অচলায়াতনকে ধ্বস্ত করা যায় না, এই অনাচারকে ঠেকানো যায় না, সরকারকে দিয়ে সকলের খিদে মেটানোর মতো ব্যাপক কাজকে সুনিশ্চিত করানো যায় না। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা তো দূরের কথা, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে সাড়া পড়ে যাওয়ার মতো করে নাগাড়ে এই অধর্ম রুখতে মুখও খুলিনি। আমাদের এই আপাত অপারগতার ছবি, সম্ভবত আমাদের নির্লিপ্তির বাস্তবতার ছবিকেই ফুটিয়ে তুলল। শিশুদের প্রতি এই লাঞ্ছনার ক্ষেত্রে ভারতের এই আস্ত ছবিটাই দলিল হয়ে থাকবে, কিছুই বাদ পড়বে না।