Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হিন্দুত্ব সন্ত্রাস ও ত্রাস— অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ

হিন্দুত্ব সন্ত্রাস ও ত্রাস: অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ -- শুভ প্রতিম

শুভ প্রতিম

 



সংঘর্ষ ও সহাবস্থান সম্পর্কিত ক্ষেত্রসমীক্ষা ও গবেষণা গোষ্ঠী ‘আমরা— এক সচেতন প্রয়াস’-এর সদস্য

 

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ওড়িশা পর্ব

জুলাই, ২০০৩-এ অঙ্গনা চ্যাটার্জির সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বজরং দলের রাজ্য আহ্বায়ক সুভাষ চৌহান বলেন, ‘দেশে গুজরাটের পরে ওড়িশা হল দ্বিতীয় হিন্দু রাজ্য’। গুজরাটে হিন্দুত্বের সফল অপারেশনের পরে ওড়িশা ছিল দ্বিতীয় লক্ষ্য। সারা ভারত খ্রিস্টান পরিষদের ওড়িশা পর্বের সভাপতি, রেভারেন্ড প্রাণ আর পারিচ্চা ২০০৬ সালে একবার বলেছিলেন, ‘সঙ্ঘ পরিবারের অত্যধিক নির্যাতনের জন্যে ওড়িশায় খ্রিস্টানরা ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে বেঁচে আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আক্রান্ত মানুষ যদি থানায় অভিযোগ জানাতে গেছে, তাদের অভিযোগ নেওয়া হয়নি। এর ফলে হিন্দু উগ্রপন্থীরা খুব খুব খুশি, কেননা পুলিশ, প্রশাসন ওদের হাতের মুঠোয়।’ এখানে ইন্ডিয়ান পিপলস ট্রাইবুন্যাল অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস-এর প্রদত্ত রিপোর্ট থেকে ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সালের কয়েকটি ঘটনা তথা ওড়িশায় ঘটে যাওয়া খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ব সন্ত্রাসের সালতামামির কিছু অংশ রাখা হল। উল্লেখ্য, ওড়িশায় মুসলিমদের ওপরও ব্যাপক সন্ত্রাস চলেছে।

 

ডিসেম্বর, ১৯৯৮

৫০০০ সঙ্ঘী উগ্রপন্থী গণপতি জেলার রানালি গ্রামের কাছে রামগিরি-উদয়গিরি নামে একটি খ্রিস্টান বসতিতে আক্রমণ করে। ৯২টি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়, আগুন লাগানো হয় গির্জায়, থানায়, সরকারি পরিবহণে। এর আগে উগ্রপন্থীরা জোর করে স্থানীয় জেলে ঢোকে, তারপর সেখানে থাকা দুই খ্রিস্টান কয়েদিকে পুড়িয়ে মারে।

 

জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, ১৯৯৯

গ্রাহাম স্টেইনস, ৫৮ বছর বয়সি অস্ট্রেলীয় সন্ন্যাসী। কেওঞ্ঝর জেলার মনোহরপুর গ্রামে তাঁকে, তাঁর ১০ বছরের এবং ৬ বছরের দুই ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিচারপতি ডি পি ওয়াধার নেতৃত্বাধীন এনকোয়ারি কমিটি দারা সিং ওরফে রবীন্দ্র পাল সিংকে অভিযুক্ত করে। দারা সিং ছিল বজরং দলের সংগঠক। কমিটি যদিও সঙ্ঘ পরিবারের অধীন উক্ত সংগঠনকে ছাড় দেয়। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জ্যাকলিন ম্যারি নামে এক ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীকে ময়ূরভঞ্জ জেলায় গণধর্ষণ করা হয়। এই বছর মার্চ মাসে রানালাই গ্রামে ১৫৭টি খ্রিস্টান বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। এই ঘটনায় ১২ জন ব্যক্তি জখম হয়।

হিন্দুত্ববাদীদের অভিযোগ ছিল খ্রিস্টানরা আদিবাসীদের ধর্মান্তরকরণ করছে। কিন্তু বাস্তবে পরিসংখ্যান কী বলছে? জনগণনার রিপোর্ট দেখাচ্ছে সারা ভারতে ১৯৭১-এ ২.৬০ শতাংশ, ১৯৮১-তে ২.৪৪ শতাংশ, ১৯৯১-এ ২.৩২ শতাংশ, ২০০১-এ ২.৩ শতাংশ, ২০১১-তে ২.৩ শতাংশ হল খ্রিস্টান জনসংখ্যার শতাংশ। ডাঃ রাম পুনিয়ানি ‘ধর্মান্তরকরণ একটি রাজনৈতিক অস্ত্র’ এই লেখাটিতে বলেছিলেন কীভাবে খ্রিস্টান জনসংখ্যা বৃদ্ধির মিথ্যা গল্প বলে সঙ্ঘ ওড়িশায় ত্রাস চালিয়েছে। আমরা জানি, ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’-এর মাধ্যমে আরএসএস কীভাবে আদিবাসীদের হিন্দু করেছে। বহু দশক ধরে খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সেবামূলক কাজের সঙ্গে আদিবাসীদের খ্রিস্টান করার প্রচেষ্টা ছিল, তা আমাদের জানা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এই প্রবণতা রুখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘ঘর ওয়াপসি’ বা ঘরে ফেরা প্রকল্প চালু করে, যা হল প্রধানত ধর্মান্তরকরণ। ২০১৪ সালে বীরভূম জেলার রামপুরহাটের ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন গ্রাম খরমাডাঙ্গায় এইরকম একটি ধর্মান্তরকরণের ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করা হয়। ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাস্তবতা ছিল আমরা কোনও খ্রিস্টান পরিবারের সাক্ষাৎকার নিতে পারিনি। তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন গ্রামছারা। যাঁরা ছিলেন তাঁরা মুখ খুলতে চাননি।

 

যখন বাবরি মসজিদ ‘শহিদ’ হল

একটু পিছনে ফেরা যাক। হিন্দুত্বের ইতিহাসে বাবরি মসজিদ ধ্বংস একটি বড় মাইলস্টোন। বস্তুত ভারতবর্ষে সর্বগ্রাসী হিন্দুত্বের প্রকাশ ১৯৯২-উত্তর পর্বে চরম আকার ধারণ করে। এখানে বাবরি মসজিদ ভাঙার কয়েকদিনের ঘটনা রাখা হচ্ছে, এটা বুঝতে যে সৌধ ধ্বংস একটি সুপরিকল্পিত প্রকল্প।

‘ক্রনোলজি সমঝিয়ে’। অধুনা ‘কুখ্যাত’ এই শব্দ দুটি বাবরি ভাঙার কদিন কী হল বুঝতে সহায়ক হবে। ১৯৯২-এর ডিসেম্বর মাসের তিন দিন, অযোধ্যার এই কালপঞ্জি আসলে স্বাধীন ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ অবয়বকে খান খান করে ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র ও ‘সাফল্যে’র কালো তিন দিন। হিন্দুত্ববাদী শক্তির দানবীয় আচরণ এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন প্রশাসন— সর্বত্র এই শক্তির ছদ্ম ও প্রকাশ্য উপস্থিতির নগ্ন প্রকাশ ছিল এই কদিন। দেখা যাক…

ডিসেম্বর ৫

সকাল ১১টা: পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে সন্ত ও মোহন্তদের মার্গদর্শক মণ্ডল, করসেবকদের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যে মিটিঙে করসেবা কীরকমভাবে হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, তবে সর্বজনসমক্ষে তা গোপন রাখা হয়।

দুপুর ১২টা ৩০: বিতর্কিত জমির কাছে গণপ্রচারব্যবস্থা থেকে ঘোষণা করা হয়, ‘প্রতিটি দল থেকে দুইজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক আসুন, গত দুই মাসে যে বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে তার রিহার্সাল দিতে হবে।’ ঘোষণায় এও জানানো হয়, ‘প্রতিটি দলের নেতারা জানেন কারা সেই স্বেচ্ছাসেবক এবং স্বেচ্ছাসেবকরাও জানেন কী বিষয়ে তাঁদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে।’

দুপুর ২টো: বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র রামশঙ্কর অগ্নিহোত্রী ঘোষণা করেন যে পরিকল্পনামাফিক বিতর্কিত ২.৭৭৪ একর জমিতে করসেবা হবে, কিন্তু এর প্রথম পর্বে রামচবুতরা খোদা হবে, করা হবে পরিষ্কার।

দুপুর ২টো ৩০-বিকেল ৫টা ৩০: ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক বিতর্কিত জমির কাছে একটি পাহাড়ি এলাকা, রামকথাকুঞ্জে অনুশীলন শুরু করে। এর মধ্যে ছিল মসজিদে চরা এবং গম্বুজ আকৃতির কাঠামো টেনে নামানো।

ডিসেম্বর ৬

সকাল ৮টা: শিবসেনা সংসদীয় দলের নেতা মরেশ্বর সাভে, বজরং দল প্রমুখ বিনয় কাটিহার এবং লালকৃষ্ণ আদবানি কাটিহারের বাসস্থানে মিলিত হন।

সকাল ৮টা ১৫: ২.৭৭৪ একর জুড়ে লোহার ব্যারিকেড ছিল, আরএসএস ক্যাডাররা তা এক মিটার বাড়িয়ে দেয়, ফলে বিতর্কিত এলাকা ছোট হয়ে যায়, পার্শ্ববর্তী এলাকা বেড়ে যায়।

সকাল ৯টা: আরও আরএসএস স্বেচ্ছাসেবক ২.৭৭৪ একরে আসতে থাকে, তারা প্যাক (প্রভিন্সিয়াল আর্মড কন্সটুবুলারি) জওয়ানদের সঙ্গে মিলে সুরক্ষার বলয় তৈরি করে।

সকাল ১০টা ১৫: আদবানি এবং মুরলী মনোহর জোশি পৌঁছন। একইসঙ্গে করসেবকদের উত্তজনা চরম সীমায় পৌঁছয়, তারা বেড়া ভেঙে বিতর্কিত এলাকায় ঢুকতে সচেষ্ট হয়।

১০টা ৩০-১১টা ৩০: দলে দলে করসেবকরা আসতে থাকে, বেড়া ভেঙে ফেলে।

১১টা ৩৫-১১টা ৫০: সন্ত ও মহন্তরা ২.৭৭৪ একরে যে মঞ্চ ছিল তাতে পূজাপাঠ শুরু করেন। করসেবকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তারা ২.৭৭৪ একরে ঢুকে পড়ে, একই সময়ে পাহারারত আরপিএফ জওয়ানদের ওপর ইটবৃষ্টি শুরু হয়।

১১টা ৫০: প্রথম একজন করসেবক বিতর্কিত সৌধের ডানদিকে চড়ে, উত্তেজিত জনতার গর্জন, ‘জয় শ্রীরাম’ শোনা যায়। ১১টা ৫১ থেকে আরও করসেবক সৌধের ওপরে চড়তে থাকে। সিআরপিএফ জওয়ানদের উদ্দেশ্যে পাথর ছোড়া হয়। তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

১২টা ১০: উমা ভারতী এবং কয়েকজনকে করসেবকদের নেমে আসতে বলতে শোনা যায়। করসেবকরা কোনও কেয়ার করে না।

১টা ৩০: র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের (র‍্যাফ) চার ব্যাটেলিয়ান ফৈজাবাদ থেকে অযোধ্যার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রাস্তা জুড়ে টায়ার পোড়ানো, করসেবকদের ইটবৃষ্টি সত্ত্বেও তারা সাকেত ডিগ্রি কলেজ পর্যন্ত পৌঁছয়, যা বিতর্কিত সৌধ থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার। কিন্তু র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের কমান্ডান্টকে ফৈজাবাদ জেলাশাসক রবীন্দ্রনাথ শ্রীবাস্তবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, তাই কেন্দ্রীয় বাহিনির দরকার নেই।’ জেলাশাসক এও বলেন যে বাহিনি যেন তাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্যই এখনই ফৈজাবাদ ফিরে যায়। এরপর ব্যাটেলিয়ান ফৈজাবাদ ফিরে যায়।

২টা ৫৫: বিতর্কিত সৌধ ভাঙার কাজ পদ্ধতি মেনেই চলতে থাকে। বামদিকের গম্বুজ আর নেই।

৩টা ৫: ডানদিকের গম্বুজ ধুলিসাৎ।

৩টা ১৫: গণপ্রচারব্যবস্থা থেকে আদবানির গলা শোনা যাচ্ছিল, ‘অযোধ্যা ঢোকার সমস্ত পথ বন্ধ করে দাও, কেননা কেন্দ্রীয় বাহিনি এসে করসেবা বন্ধ করে দিতে পারে।’

৪টা ৫০: কেন্দ্রীয় গম্বুজ ধুলিসাৎ।

৬টা ১০: ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

৬টা ৩৫: রামলালার বিগ্রহ আনা হল, রাখা হল সেখানে যেখানে আগে ছিল। তারপর ধ্বংসস্তূপ সরানো হল। জল দিয়ে পরিষ্কার করা হল, ঠিক এই সময়েই মুসলিমদের বাড়ি এবং দোকান আক্রমণ শুরু হল।

১২টা-১টা: রামলালার বিগ্রহ ঠিকভাবে রাখা হল। একটি হলুদ শামিয়ানা টাঙানো হল। সমস্ত কাজ দাঁড়িয়ে থেকে তত্ত্বাবধান করলেন অশোক সিঙ্ঘল, বিনয় কাটিহার, আচার্য ধর্মেন্দ্র এবং আচার্য বামদেব।

ডিসেম্বর ৭

সারাদিন ধরে শামিয়ানা বরাবর সিমেন্ট-ইটের কাঠামো গড়া হল। সন্ধ্যায় তা শেষ হল। একইভাবে সারাদিন মুসলিমদের বাড়িতে ও দোকানে চলল আক্রমণ। প্রায় এক হাজার বাড়িতে আগুন লাগানো হল। প্রায় ১৫০ জন মুসলিম রামজন্মভূমি থানায় এসে আশ্রয় নেয়, সারাদিন তারা কোনও খাবার বা জল পায়নি।

পাঁচ ফুট উঁচু দেওয়াল দেওয়া হয়ে গেলে অশোক সিঙ্ঘল জানান যে আগামীকাল কেন্দ্রীয় বাহিনি ঢুকতে পারে, এখনই করসেবকদের এলাকা খালি করা দরকার। সন্ধ্যা থেকে করসেবকরা চলে যেতে থাকে।

মধ্যরাত্রি, ডিসেম্বর ৭-৮: র‍্যাফ এবং সিআরপিএফকে অযোধ্যা যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।[1]

 

সাংবাদিক হিসাবে ৯০-এর দশকে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম বিহার, উত্তরপ্রদেশ। ১৯৯০ সাল থেকে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে দেখি বাড়ির পাঁচিলে বা রাস্তার পাশে সরকারি অফিসের পাঁচিলে আস্ফালন—

ভারত মে আগর রেহেনা হোগা তো বন্দেমাতরম কাহেনা হোগা’
‘এক ধাক্কা ওর দো, বাবরি মসজিদ তোর দো’

মসজিদ ভাঙার পর সেই আস্ফালন কিছুটা বদল হয়, এবারে উদ্ধত হিন্দুত্ব।

‘ইয়ে তো স্রিফ ঝাঁকি হ্যায়, আব কাশি মথুরা বাকি হ্যায়’।

এই সময় থেকেই ফৈজাবাদের পাঁচিলে দেখা যায়, ‘গো-ঘাতককে হত্যা করা হিন্দুদের আবশ্যিক কর্তব্য’ শীর্ষক ঘোষণা।[2]

তখনও ঝাড়খণ্ড হয়নি, অখণ্ড বিহার। হিন্দুত্ব রাজনীতিতে ধানবাদ হয়ে ওঠে অন্যতম এক ভূ-রাজনৈতিক কেন্দ্র। রাজনীতিতে প্রায় সন্ত ধরনের এক চরিত্র এ কে রায় ছিলেন ধানবাদ লোকসভা কেন্দ্রের বহুবারের এমপি বা সাংসদ। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী)-র সদস্য ছিলেন তিনি, পরে পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মার্ক্সিস্ট কোওর্ডিনেশন পার্টি গঠন করেন। ১৯৯১-এর লোকসভা ভোটে তিনি পরাজিত হন বিজেপি প্রার্থী রীতা ভার্মার কাছে। বলা যেতে পারে শ্রমিক আন্দোলন ও ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের মিশ্রিত যে রাজনীতি (এবং আদর্শ) সেই রাজনীতির পরাজয় হল হিন্দুত্বের কাছে। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৯ ধানবাদের রাজনীতির পরিবর্তন দেখেছি। কীভাবে একটি এলাকা যা ‘শ্রমিক সংগঠন, তাদের দাবিদাওয়া, আদিবাসী অধিকার, ঝাড়খণ্ডের দাবি, বহিরাগতদের শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ’— এই রাজনীতি থেকে হিন্দুত্ব রাজনীতির অন্যতম স্থান হয়ে ওঠে, তা দেখেছি। সেই সময় একটি সমীক্ষায় যুক্ত থাকার কল্যাণে জেনেছিলাম হিন্দু মানসের পরিবর্তন। ঝরিয়ার শ্রমিক কলোনি হোক বা হিরাপুরের প্রতিষ্ঠিত বাঙালিপাড়া, ‘রাম মন্দির হতে গেলে বাবরি মসজিদ ভাঙতে হয়’, এর মধ্যে ভুল কোথায়— এই মত ছিল সংখ্যাগুরু। এর সঙ্গে ‘ওয়াশিপুর মানে মিনি পাকিস্তান’, ‘বিজেপি মানে ভাগো জোলা পাকিস্তান’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ধানবাদের বিজেপি জেলা অফিস ছিল বাঙালিপাড়া, হিরাপুরে। সেখানে মাথা ছিল এক বাঙালি। আরএসএস-এর রিক্রুট। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে আসা এই বিধান সিংহ ছিল হিন্দুত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সঙ্ঘের বিভিন্ন শিবির ঘোরা, পাটনায় প্রদেশ কার্যালয় থেকে নাগপুরে সদর কার্যালয় ঘোরা এই যুবক ছিল বাগ্মী এবং উদ্ধত। একবার পাড়ায় এক খাওয়ার হোটেলে কলকাতার এক বাঙালি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ আদবানিকে আদবানিজি না বলার অপরাধে বিধান সিংহের রোষের মুখে পড়ে। প্রহৃত হন সেই রিপ্রেজেন্টেটিভ। হিন্দুত্বের আস্ফালনের এইরকম বহু ঘটনার সাক্ষী তখন সাধারণ মানুষ। বিধান সিংহের দেওয়া স্লোগান হোক বা ভাষণ আগ্রাসী হিন্দুত্বের প্রকাশ দেখেছি বহুবার। ৯২ অর্থাৎ বাবরি ধ্বংসকাল সমাজে বহু বিধান সিংহের প্রবেশ ঘটিয়েছে।

এই বিষয়ে একটু অন্য কথায় আসা যাক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সৌধ ভাঙার আগে ও পরে সন্ত্রাসের সমর্থনে একাধিক নিবন্ধ/সংবাদ প্রকাশিত হয়। হিন্দুত্বের আন্তর্জাতিক প্রকাশনা (প্রাক ও উত্তর-৯২) যথেষ্ট ক্ষমতাধর। যেমন, হিন্দুইজম টুডে। বহুল প্রচারিত এই পত্রিকাটি পাঁচ-ছয়টি ভাষায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে থাকে। হিন্দুইজম টুডে-র মার্চ, ১৯৯৩ সংস্করণে, ‘A question of National Honor’ নিবন্ধে লেখা হয়—

So what happened on December 6, 1992, was that the lava of Hindu discontent, anger and rage erupted at Ayodhya. The structure came down, and that gave a big handle to all the anti-Hindu forces to launch a vicious attack on the BJP.[3]

উল্লেখ্য এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রবাসী ভারতীয়দের বোঝানো হয়, ভারতবর্ষে হিন্দুত্ব বিপন্ন। সুকুমারী ভট্টাচার্যর লেখা থেকেও পাচ্ছি, হিন্দুইজম টুডে-র উল্লেখ।

হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন আশু প্রয়োজন, অযোধ্যায় রামমন্দিরের পুননির্মাণ। বারাণসী, বৃন্দাবন, মথুরায় ‘মুসলিম-অধিকৃত’ মন্দিরগুলি পুনরুদ্ধার, শত্রু মুসলমান, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্টদের সঙ্গে প্রয়োজনমত দাঙ্গা ও লড়াই ঘটাবার জন্য সুশিক্ষিত সৈন্যদল ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন— অতএব প্রবাসী ভারতীয়রা যেন মুক্তহস্তে এই পুণ্য উদ্যমের জন্যে অর্থসাহায্য করেন।[4]

 

আফরাজুল হত্যাকাণ্ড

হিন্দুত্ব সন্ত্রাস যা জনমনে বিশেষত সংখ্যালঘু মানসে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে তার হেতু বিবিধ ঘটনাবলি। যার সবগুলি উল্লেখ করা সম্ভব নয়। গণহত্যা, দাঙ্গা, বিতাড়ন সারাদেশেই ঘটেছে, ঘটে চলেছে। তবে নেলি হত্যাকাণ্ড, বাবরি ধ্বংস, গুজরাট গণহত্যার মত বড় আকারে না হলেও আফরাজুল হত্যাকাণ্ড সারা দেশে সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক হিমশীতল ত্রাস বিস্তৃত করেছে।

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭-উদয়পুর কোর্টে সেদিন হুলস্থূল কাণ্ড। হিন্দু ধর্ম-রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লোকজন কোর্টের ছাদে লাগানো তেরঙ্গা খুলে ফেলে গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে দেয়। তাঁদের দাবী, শম্ভুলালকে মুক্ত করতে হবে। কে এই শম্ভুলাল? মানুষ হত্যায় সাম্প্রতিক সময়ে আইসিস-এর নৃশংসতাকে ছাপিয়ে গেছে যার হত্যালীলা। কে তার হত্যার শিকার? এই বাংলার মালদহের কালিয়াচকের এক অভিবাসী শ্রমিক। যে রোজগারের খোঁজে আরও অনেক শ্রমিকের মত পারি দিয়েছিল রাজস্থানে। তাঁর ‘অপরাধ’? একটাই অপরাধ তাঁর, সে মুসলমান।

আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে রোজগারের খোঁজে ভিন্ন প্রদেশে গমনের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শতাংশের হিসাবে রাজ্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দলিত এবং মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক স্তরে পিছিয়ে থাকার মাত্রা উদ্বেগজনক। জন-অভিবাসনের রেখাচিত্রে উত্তর ২৪ পরগণা, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দুই দিনাজপুর জেলাগুলি শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের অন্যান্য জেলার তুলনায় ওপরের দিকে রয়েছে। মালদহের কালিয়াচকেও বহু মানুষ রোজগারের খোঁজে গুজরাট, রাজস্থান, দিল্লি গেছেন। বেশিরভাগ নির্মাণ কর্মী, প্যান্ডেল কর্মী।

‘লাভ জিহাদ’, হিন্দুত্ববাদীদের অন্যতম অস্ত্র, যা তারা বর্তমান সময়ে প্রায়শই সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর প্রয়োগ করে। তারা একটি মিথ্যা দাবী করে যে লাভ জিহাদ বলে একটি সংগঠন আছে যেটি হিন্দু মহিলাদের ইসলামে জোর করে ধর্মান্তরিত করার জন্য প্রেমের (এবং বিবাহের) অভিনয় করে। ১৯২০ সালে উত্তরভারতে এইরকমই অভিযোগ ওঠে ‘অপহরণ’ নিয়ে, বলা হয় হিন্দু মেয়েদের অপহরণ করছে মুসলিম যুবকেরা। ১৯৯৮ সালে কমব্যাট কমুন্যালজিম পত্রিকার অক্টোবরের সংখ্যায় ‘ওয়েলকাম টু হিন্দু রাষ্ট্র’ নামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সুরাট থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে বারদোলই নামে একটি জনপদের কথা লেখা হয়। বিগত কয়েক মাস যাবত জায়গাটি খবরের শিরোনামে ছিল। কারণ, আন্তঃধর্মীয় বিবাহ। হানিফ নামে এক মুসলিম যুবক বর্ষা নামে এক হিন্দু যুবতীকে বিয়ে করেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, আরএসএস অভিযোগ করে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যায়। তারা মিছিল করে, দাবী তোলে ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করতে হবে, এবং মুসলিমদের বয়কট করতে হবে। এর পর শুরু হয় মুসলিমদের দোকান আক্রমণ, শুরু হয় দাঙ্গা। ১৯২০ হোক বা ১৯৯৮ বা হালফিলের ২০১৮ হিন্দু পুরুষতন্ত্র মুসলিম পুরুষের সঙ্গে হিন্দু নারীর বিবাহে আপত্তি একইভাবে বজায় রেখেছে। একইভাবে মুসলিম সমাজেও মুসলিম নারীর সঙ্গে হিন্দু পুরুষের বিবাহে ঘোরতর আপত্তি দেখা গেছে। অর্থাৎ বাড়ির মেয়ে অন্য ধর্মের পুরুষকে বিয়ে করলেই ধর্ম বিপন্ন হবে এই বোধ।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চরম হিন্দুত্ববাদী একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতালাভের পর লাভ জিহাদের অজুহাতে মুসলিম হত্যা এক ব্যাপক আকার নিয়েছে। আফরাজুলকে হত্যাকারী শম্ভুলাল রেগর ক্যামেরার সামনে তার হত্যাকাণ্ডকে লাভ জিহাদের ফল বলে দাবী করে। যদিও সেই দাবীও সম্পূর্ণ মিথ্যা এক দাবী।

বাস্তবে কখনও গোমাংস রাখার দায়ে, কখনও লাভ জিহাদের কারণে হিন্দুত্ববাদী দলগুলি মুসলিমদের টার্গেট করছে। এক্ষেত্রে রাজস্থান থেকে অসম, কর্নাটক থেকে পশ্চিমবঙ্গ— এলাকা দিন দিন বাড়ছে। উদ্দেশ্য ত্রাসের মধ্যে রাখা, দাঙ্গা, হত্যা-গণহত্যা। বলা যায়, এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অঙ্গ এইসব ঘটনা।

আফরাজুল হত্যার কয়েকদিন বাদেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে কাজ করা একটি দল, ‘কারওয়া এ মুহব্বত’ রাজস্থানের সেই গ্রামটিতে সফর করে। কথা বলে শম্ভুলালের পরিবারের সঙ্গে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে। এলাকাবাসীদের একাংশ লাভ জিহাদের তত্ত্বে বিশ্বাসী হলেও জানান এই নৃশংস হত্যাকে মেনে নিতে পারেন না। শম্ভুলালের পরিবারের কাছ থেকে জানা যায়, টিভি বা ইন্টারনেটে প্রায়শই হত্যাকাণ্ডের ছবি দেখত সে। কুখ্যাত ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী আইসিস-এর হত্যালীলা দেখত তারিয়ে তারিয়ে। বিভিন্ন হিন্দুত্ব ব্লগগুলি দেখত, দেখত মুসলিমবিদ্বেষী পোস্টগুলি। নিজেও বারংবার এই বিদ্বেষ, এই ঘৃণাকে প্রচার করেছে বিভিন্ন সময়। মানসিকভাবে মুসলিম হত্যার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল শম্ভুলাল। কাজ দেওয়ার অছিলায় ডেকে আনে আফরাজুলকে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা এবং আফরাজুলের ক্ষতবিক্ষত দেহতে আগুন ধরানো— সব ভিডিওবদ্ধ করে তার নাবালক ভাইপো।

সমাজবিজ্ঞানের, মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় এই ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এই জঘন্য হত্যার ছবি তুলতে ছেলেটির হাত কাঁপে না। ঘৃণা সমাজের গভীরে কতটা তা বোঝা যায় এই ঘটনায়। বলা হচ্ছে, শম্ভুলাল আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু বিভিন্ন হিন্দুত্ব গোষ্ঠীর প্রচারে, আদর্শে যে সে প্রভাবিত ছিল তা এখন আর প্রমাণের দাবী রাখে না। তাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণা-বিদ্বেষের গোড়ায় পৌঁছতে হবে। বিষবৃক্ষের শিকর অনেক গভীরে। হিন্দুত্ব সেই বিষ মাটির অনেক ভিতরে চালিত করেছে। মালদহের কালিয়াচকে আফরাজুলের হতভাগ্য পরিবারের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, এলাকার সকল মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকরা ত্রাসের মধ্যে আছেন। আমরা আশেপাশের মানুষের সঙ্গেও কথা বলি, রাজস্থান, গুজরাটে তাঁদের বাড়ির ছেলেদের তারা পাঠাতে চাইছেন না তা জানান।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পশ্চিম ও উত্তরভারতে হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা মুসলিম যুবকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বৃদ্ধি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। যেমন উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাটে, স্বরূপনগরে; ২০১৬ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসায় এই যুবকদের ভূমিকা আমরা দেখেছি। কালিয়াচকে আফরাজুলের প্রতিবেশি বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যদিও কোনও বিদ্বেষ আমরা দেখিনি।

(ক্রমশ)    


[1] ফ্রন্টলাইন, ১ জানুয়ারি, ১৯৯৩, বিশেষ সংখ্যা ‘Behind the Ayodhya Catastrophe’
[2] সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’, পৃষ্ঠা-১৪৪
[3] A question of National Honor, Hinduism Today, March 1993.
[4] সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’, পৃষ্ঠা-১৫১