Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পথেই হবে পথ চেনা

শঙ্কর সান্যাল

 



সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

ভারতীয় জনতা পার্টি ভয় পেয়েছে। দিগন্তজোড়া সিঁদুরে মেঘের প্রেক্ষাপটে উত্তোলিত কোটি কোটি বিরুদ্ধতার তর্জনী দেখে দিল্লি প্রাসাদকূটে ঘুম ছুটে গিয়েছে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির। অঙ্ক মিলছে না। ভেবেছিলেন গেরুয়া রুমাল দিয়েই যাবতীয় অনাচার ঢেকে রাখা যাবে অনন্তকাল। কিন্তু সেই রুমালের নিচ থেকে কখন যে অভুক্ত বিড়াল ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে সামনে চলে আসবে, আন্দাজ করতে পারেননি। ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা হয়ে গিয়েছে ঢের। আঁধার ঘনাতে আর বেশি দেরি নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের পোষ্য বিপুল গোয়েন্দাবাহিনির রিপোর্ট, তাঁবেদার বিস্ফারিত অক্ষিগোলক বলে দিয়েছে, আর নাই রে দেরি, নাই রে দেরি/জলেস্থলে বাজছে ভেরী— দিল্লি থেকে লোটাকম্বল গুটিয়ে নাগপুরের ঝান্ডেওয়ালা ভবনে গিয়ে মাথা গোঁজার সময় যে সমাসন্ন। পাঁচ রাজ্যের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনেও পরিব্যাপ্ত অশনিসঙ্কেত। গত এক বছর ধরে গলায় বিঁধে য়েছে মস্ত এক কাঁটা। দিল্লির উপকণ্ঠ জুড়ে কৃষক সমাবেশ। অনেক চেষ্টা করেছেন। চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালে তালব্য শ আর রুমালের মা দিয়ে চশমা বানিয়ে দেশবাসীকে পরানোর— হিন্দুত্বের চশমা। ২০১৯ সালে পুলওয়ামাকাণ্ড আর তথাকথিত সার্জিকাল স্ট্রাইকের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন করে পার হয়ে গিয়েছিলেন ভোটবৈতরণী। এবার আর জুজুবুড়ির চাষে ফলন নেই। পাকজুজু, জঙ্গিজুজু, চিনজুজুর বড় অজন্মা। নির্বিকল্প বিভাজন তথা মেরুকরণের জন্য মরিয়া হয়ে দু-একটা গুজরাট গণনিধন কিংবা মুজফফরনগর করা যেত। কিন্তু চরম ঠেকা ঠেকে গিয়ে কার্যত ঠকেই গিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্রাহ্মণ-শিখ দাঙ্গাটা লাগানো গেল না। অতঃপর গুরু নানকের জন্মদিনে ঘোষণা করলেন, তিনটি নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ঘোষণাতেও বিভাজন-বিষ। ভারতীয় কৃষি অ-ব্যবস্থায় দর্দক্লিষ্ট ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য তাঁর দরদ উথলে উঠল। গ্যালনখানেক কুম্ভীরাশ্রুতে কুর্তার আস্তিন ভিজিয়ে ফেললেন।

মোদিজির মাস্টারস্ট্রোক, বলছে ‘গোদি মিডিয়া’। গলা ধরে গেল দিনভর ঈশান থেকে নৈঋত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়া চিৎকৃত সাফাইঝঙ্কারে। শুনতে শুনতে কর্ণপটহে লকডাউন। কিন্তু যুক্তি তো মিলছে না। কিসের মাস্টারস্ট্রোক? বিজ্ঞাপনভোগী গো-স্বামীরা দিনান্তেও প্রমাণ করতে পারলেন না, নরেন্দ্রভাইয়ের কুঞ্চিত ললাটে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। কর্পোরেট চশমার আড়ালে বিস্ফারিত অক্ষিগোলকে কোনও আতঙ্ক নেই। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ স্যার, মুখে যতই মন কা বাত বলুন না কেন, শরীরীভাষা তো ভিন্ন গল্প শোনাচ্ছে। সিংঘু আর গাজিপুরে ঠায় বসে থাকা কৃষকদের জুজু বানাতে কতই না ঘোরতর প্রচেষ্টা ছিল। কখনও পাক এজেন্ট, কখনও খলিস্তানি, আবার কখনও মাওবাদী জুজু। বছরের শুরুতেই প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিলে এজেন্ট ঢুকিয়ে বিস্তর গোলমাল পাকিয়ে জনমত ঘুরিয়ে দেওয়ার শাহীবুদ্ধিও কাজ করল না। শেষ পর্যন্ত পাঁচ রাজ্যের উপনির্বাচনের গলাধাক্কা আর সইতে পারলেন না। সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে কৃষকদের অবস্থান তুলে দেওয়ার হিম্মত হয়নি। প্রবল শীতে আর প্রখর গ্রীষ্মে বসে বসেই শহিদ হয়ে গিয়েছেন কমপক্ষে ৭০০ জন কৃষক। গাড়িচাপা দিয়ে কৃষকদের খুন করে দাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়ার ছকও বানচাল হয়ে গিয়েছে। আসলে কোনও চেষ্টাই বাদ দেননি ওঁরা। পঞ্চনদীর অববাহিকায় আর উত্তরপ্রদেশে ভোটঘণ্টা বাজবে সামনের বছরেই। কী হতে পারে? গোয়েন্দা রিপোর্ট, কর্পোরেট নমুনা সমীক্ষা বলছে, ওরে আশা নাই/আশা শুধু মিছে ছলনা। কিন্তু গো-স্বামী মিডিয়া শেষ চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। সাফাইটা এমনই, কৃষি আইন বাতিল করার ঘোষণা করে মোদিজি নাকি বিরোধীদের পালের বাতাস হাপিস করে দিয়েছেন। কৃষকরা কী বলছেন? ভীষণ সতর্ক প্রতিক্রিয়া— বাটপারের ঘরে নিমন্ত্রণ, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে আগে আইন প্রত্যাহার হোক, তারপর বুঝব হয়েছে। একেই নাকি বলে মোদি-ম্যাজিক! কিন্তু দাবি তো কেবল নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহারই নয়, ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি কোথায়? নয়া বিদ্যুৎ বিলের কী হবে? চার লক্ষ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। তা নয়া কৃষি আইনের জন্য নয়, ফসলের দাম না পেয়ে। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না পেলে কৃষক বাঁচবে না, সেইসঙ্গে অপঘাতে মৃত্যু হবে ভারতীয় কৃষিরও। তাই আন্দোলন চলবে। ঘরে ফেরার কোনও গল্পই নেই।

একটি কৃষক আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের গণসংগ্রামের কোনও আপাত রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে না। দাবি আদায়টাই আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। সেই লক্ষ্যেই আন্দোলন পরিচালিত হয়। ঔপনিবেশিক ভারতে দুটি অবিস্মরণীয় কৃষক সংগ্রাম তেভাগা এবং তেলেঙ্গানাতেও প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও আপাত রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন দুটি রাজনৈতিক আন্দোলনেরই চেহারা নেয়। মুঘল ভূমিব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক অস্তিত্ব কখনওই প্রবলভাবে ছিল না। অন্ততপক্ষে অধ্যাপক ইরফান হাবিবের গবেষণা সেই কথাই বলছে। ঔপনিবেশিক স্বার্থেই ব্রিটিশরা মুঘল ভূমিবন্দোবস্তকে ধ্বংস করে চিরস্থায়ী, রায়তওয়ারি এবং মহালওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করে। এই তিনটি ভূমিবন্দোবস্তের মৌলিক উপাদান হয়ে দাঁড়ায় সামম্ততন্ত্র। তেভাগা এবং তেলেঙ্গানা আন্দোলন প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রাম। কিন্তু পরবর্তীকালে এই সংগ্রামগুলির মধ্যে রাজনৈতিক উপাদান প্রবলভাবে সংযোজিত হয়ে তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ফলে বাংলা এবং অন্ধ্রপ্রদেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রসার ঘটে। কিন্তু নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তা চরিত্রগতভাবে ভিন্ন। কেননা লড়াইটা সরাসরি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এই তিনটি আইন প্রণয়নে পিছনে যে সিদ্ধান্ত তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে থাকা রাজনৈতিক দলটি তাদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং একদম প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের ভেতরে একটি গভীর রাজনৈতিক উপাদান ছিল। সেই উপাদান প্রবলভাবে আত্মকাশ করল, যখন আন্দোলনকারী কৃষক নেতারা একটি নিখাদ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলেন। সদ্যোসমাপ্ত দেশের পাঁচটি রাজ্যের উপনির্বাচনগুলিতে তাঁরা প্রচারে গেলেন এবং ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বললেন। এবার কিন্তু এই গণআন্দোলন আর কোনওভাবেই নিছক দাবি আদায়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকল না। একটি বৃহত্তর পরিসরে সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলনের চেহারা নিল। এবার এই আন্দোলন তার রাজনৈতিক লক্ষ্যে কতটা টিঁকে থাকতে পারে, সেটাই দেখার।

প্রতিটি সংগ্রামই তার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা দিয়ে একাধিক শিক্ষা দিয়ে যায়। নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন এখনও শেষ হয়নি। সুতরাং আন্দোলন সফল না ব্যর্থ, তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে নরেন্দ্র মোদি গুরু নানক জয়ন্তীতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করায় এই আন্দোলন একটি প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছে, এমনটা বলা যেতেই পারে। এই পর্যন্তই যদি ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের শক্তি এই আন্দোলনের মঞ্চে সমবেত হয়েছে। তারা প্রায় এক বছর ধরে একসঙ্গে এই ইস্যুতে অনড় থেকেই একটি চূড়ান্ত অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, এই আন্দোলন পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ধনী কৃষকদের আন্দোলন। ক্ষেতমজুর, বর্গাচাষি, প্রান্তিক কৃষক এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনও সংযোগ নেই। কিন্তু আন্দোলনের মাঝপথেই এঁদের অংশগ্রহণও প্রবল হয়েছে। আর অর্থনৈতিকভাবে নিম্নবর্গীয় কৃষিজনতার অংশগ্রহণ ব্যাপকতর হওয়াতেই দিল্লিতে বসে গেরুয়া তালেবরদের ঘুম ছুটে গিয়েছে। বাস্তব কারণটা হল, সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলির ফলাফল। ধনী কৃষকদের অংশগ্রহণ যেমন আন্দোলনকে আর্থিক মেরুদণ্ড দিয়েছে, তেমনই বামপন্থীদের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে। কেবলমাত্র সারা ভারত কৃষক সভাই নয়, অসংখ্য ছোট ছোট বামপন্থী গোষ্ঠী এই আন্দোলনের প্রাণশক্তি।

গত প্রায় এক বছর ধরে রাস্তাকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন কৃষকরা। এই রাস্তাই তাঁদের এখনও পর্যন্ত যেটুকু বিজয় অর্জিত হয়েছে, তার রাস্তা দেখিয়েছে। আবার প্রমাণিত হল, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা।