Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আইনের উদ্দেশ্য অপরাধীকে আইনের ফাঁক দেখানো নয়

প্রতিভা সরকার

 



প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী

 

 

 

 

একুশে নভেম্বর, দুহাজার একুশ, সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকে চোখ রেখে মনের ওপর পাষাণ ভার নেমে এল। শিশুঘাতের খবরে কাগজ বোঝাই। কোথাও হোমের অবোধ শিশুদের ওপর চলেছে অবাধ যৌন নির্যাতন, দশ বিশ লাখ টাকায় হোমের শিশু বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, কোথাও আবার দুই অঝোরে কাঁদতে থাকা নাবালিকাকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে বাইকে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া আটকাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।

শিশুদের ওপর অত্যাচার যেন সর্বাধিক অসহ্য বোধ হয়, কারণ একে তো তারা অবোধ, বোঝেই না কী কারণে তাদের সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ, জাতির মেরুদণ্ড। তাদের শৈশবে লালসার শিকার বানানো যে অপরিমেয় শারীরিক মানসিক ক্ষতি সাধন করে তাতে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় ভবিষ্যতের সব আশাভরসা।

অথচ এদেশে এক বছরে পকসো মামলার সংখ্যা ৪৩,০০০।

শিশু-পর্ণোগ্রাফির উপভোক্তা এ দেশে বড় কম নয়। জঘন্য অত্যাচারের বলি শিশুর কথা সবসময় প্রকাশ্যে আসে না। যা আসে তাইই অবশ্য নিজেদের প্রতি ঘৃণা বোধ করার পক্ষে যথেষ্ট। একদিনের কাগজই যদি তার ওপর নিপীড়নের খবরে ছয়লাপ, তাহলে বাকি দিনগুলিতে অত্যচারের সংখ্যা কোথায় দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। তার ওপরে যদি গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ঘটে যায় পকসো মামলায় শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর রায়দান, তাহলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো বিড়ম্বনা ঘনিয়ে আসে।

সেই কারণেই যখন মুম্বাই হাইকোর্ট এক শিশুর ওপর অত্যাচারের অভিযোগে অভিযুক্তকে এই বলে রেহাই দেয় যে সে “skin to skin contact” অর্থাৎ ত্বকের সঙ্গে ত্বকের সংযোগ ঘটায়নি, কেবলমাত্র জামাকাপড়ের ওপর দিয়ে শিশুটিকে ছুঁয়েছে, তখন স্বাভাবিক কারণেই দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। POCSO-র সেকশন ৭-এ পরিষ্কার বলা আছে—

Whoever with sexual intent touches the vagina, penis, anus or breast of the child or makes the child touch the vagina, penis, anus or breast of such person or any other person, or does any other act with sexual intent which involves physical contact without penetration is said to commit sexual assault.

এখানে পরিষ্কার সেক্সুয়াল ইন্টেন্ট বা যৌনেচ্ছার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। উৎপীড়কের অভিসন্ধিই মূল বিচার্য, সে ত্বকে ত্বকে সংযোগ ঘটিয়েছে, নাকি জামাকাপড়ের ওপর দিয়েই শিশুটির ওপর উৎপীড়ন চালিয়েছে তা কখনওই বিবেচনায় আসতে পারে না।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা রুজু হলে বিচারপতিরা পরিষ্কার বলেন আইনের উদ্দেশ্য তো অপরাধীকে আইনের ফাঁকে গলিয়ে রেহাই এনে দেওয়া নয়। স্পর্শের সংজ্ঞাকে সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার করে মুম্বাই হাইকোর্ট পকসো আইনের সাত নম্বর ধারার এক অসম্ভব ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং তার ভিত্তিতে অপরাধীকে রেহা করিয়েছে। সেক্সুয়াল ইন্টেন্ট বা যৌন অভিপ্রায় কথাটিকে লঘু করে ত্বক স্পর্শ করাকে এখানে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাহলে তো সার্জিক্যাল গ্লাভস পরে কেউ শিশুর সঙ্গে চূড়ান্ত অন্যায় করলে, সেও আইনের চোখে নির্দোষ প্রতিপন্ন হবে।

অতএব হাইকোর্টের রায়কে নাকচ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেয় উচ্চতম ন্যায়ালয়।

অনেক সময় অনেক কারণে মনে হয় ভারতীয় গণতন্ত্র অভিভাবকহীন। তাকে ন্যায় দেবার কেউ নেই। সমস্ত কিছু বিকিয়ে গেছে ক্ষমতার কাছে। কিন্তু এই ধরনের রায় আস্থার নিভু নিভু প্রদীপের সলতেটিকে আবার উসকে দেয়। কিন্তু আলোর আভাসের মধ্যেও মনে পড়ে যায় কীভাবে বিচারব্যবস্থা কলঙ্কিত হচ্ছে শাসকের স্থূল স্পর্শে। মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব ব্যানার্জিকে যেভাবে তাড়াহুড়ো করে মেঘালয় হাইকোর্টে বদলি করে দেওয়া হল প্রবল প্রতিবাদের তোয়াক্কা না করেই, তাতে সন্দেহ হয় ন্যায় পাওয়ার রাস্তাগুলি কি একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!