সৌম্যজিৎ রজক
লেখক রাজনৈতিক কর্মী
প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হেরে যেতে যেতে অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে খবরটা পেয়ে অনেকে বিশ্বাসই করে উঠতে পারিনি প্রথমে। বন্ধুরা বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছে, “সত্যিই? খবরটা কি সত্যি?”
প্রধানমন্ত্রী কৃষি আইন তিনটে প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছেন, এই সংবাদে আমাদের অনেকেরই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময় প্রকাশ। আনন্দ প্রকাশ করতে সময় লেগেছে খানিকটা। আসলে জেতা যে যায়, আন্দোলন যে কেবল দাবি উত্থাপন করেই হারিয়ে না গিয়ে শেষতক দাবি ছিনিয়েও আনতে পারে, আমরা অনেকে এমন আত্মবিশ্বাসই হারাতে বসেছিলাম। আর তাই এত বড় জয় আমাদের মতো অধিকাংশ লোকের কাছে ছিল অ-কল্পনীয়। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের এই যুগে সর্বগ্রাসী, সর্বশক্তিমান আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজিও যে একরোখা জনতার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়তে পারে, কল্পনা করাও ছিল অসম্ভবপ্রায়।
কিন্তু কেউ কি আন্দাজ করতে পারেননি যে এমন ‘অঘটন’টাই ঘটতে চলেছে? কেউই কি পারেননি? পেরেছিলেন। গত ১১ নভেম্বরই এক প্রকাশ্য বিবৃতিতে সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছিলেন, “চলতি কৃষক আন্দোলন প্রতিদিনই আরও শক্তিশালী, আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বিজেপি এবং তাদের তল্পিবাহকেরা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে।”
এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই খোদ নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করলেন যে তাঁর সরকার পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা অনেকে ১৯ তারিখের ঘোষণায় প্রাথমিকভাবে বিশ্বাস করে না উঠতে পারলেও, সংযুক্ত কৃষক মোর্চা কিন্তু ঘটনার গতিপ্রকৃতি অনুভব করতে পারছিল; এমনকি প্রকাশ্য বিবৃতিতে সেটার অ্যায়লানও করে দিয়েছিলেন তাঁরা। ১১ নভেম্বর ২০২১ তারিখে। এই একই দিনে দিল্লিতে আরেকটি ঘোষণাও হয়েছিল, তারিখটি খেয়াল রাখুন, সে কথায় একটু পরেই আসছি।
আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রসঙ্গে কথা সেরে নিই। কেননা তিনিই সর্বাগ্রগণ্য। আজকের ভারতে আর সবকিছুই নরেন্দ্র মোদির পরে, আগে ওঁর কথা।
তিনটে কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা বললেও, তিনি একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে একাজ তাঁর সরকার যে খুব স্বেচ্ছায় করছে এমন নয়। বরং কার্যত বাধ্য হয়েই এমনটা করতে হচ্ছে। কেন বাধ্য হয়ে? কারণ এই আইনগুলি যে কৃষকদের পক্ষে কতটা ভালো ছিল, একাংশের কৃষক নাকি তা বুঝতেই অক্ষম হয়েছেন। এমনকি তিনিও (স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিও) অক্ষম হয়েছেন এই বোকা চাষাদের বুঝিয়ে উঠতে। হ্যাঁ একথাই তিনি বলেছেন আসলে সেদিনের ভাষণে।
যাঁরা ভাবছেন, নরেন্দ্র মোদি তাঁর স্বভাবসুলভ ঔদ্ধত্য থেকে পিছু হটে এই ভাষণটি দিয়েছেন, তাঁরা পুরোপুরি সঠিক ভাবছেন বলে মনে হয় না। আদতে এই ভাষণের বয়ানে অমার্জনীয় ঔদ্ধত্যই প্রকাশ করেছেন তিনি। একদল বোকা চাষির একগুঁয়েমির কাছে দেশের স্বার্থ পূরণে তাঁর যে আন্তরিক সদিচ্ছা থেকে সরে আসতে হল শেষমেশ, আহারে বেচারা মহান শাসক!
অর্থাৎ ভাষণ শেষে চাষিরা ‘বোকা’, প্রধানমন্ত্রী ‘ট্র্যাজিক হিরো’ আর অবশিষ্ট আমরা দেশসুদ্ধু লোক নিছকই হাততালি দেওয়া পাবলিক! দেশ ও দেশের কৃষকদের কল্যাণে মহানুভব প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে কুর্নিশ জানাতে এবার এক পায়ে উঠে দাঁড়াব আমরা সবাই। আর হাততালি বাজাব। আমাদের সম্মিলিত করতালিতে ঢাকা পড়ে যাবে আর সব কথারা।
চাপা পড়ে যাবে এই সত্যটিও যে আমাদের দেশের কৃষকরা গত তিনটে দশকজুড়ে নয়াউদারনীতির গনগনে আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছেন। হাজারে হাজারে আত্মহত্যা করছেন, লাখে লাখে কৃষিকাজ ছেড়ে যেকোনও কাজের খোঁজে ভিটে-মাটি-গ্রাম-ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন পরবাসে। নয়াউদার কৃষিনীতির সেই আগুনে এই তিনটে আইন ছিল তিনফোঁটা ঘি ঢালার মতন। সেই ঘৃতাহুতি থেকে যদি সরকার বিরতও হয় তাহলেও জ্যান্ত পুড়ে মরা থেকে মুক্তি পাবেন না কৃষকেরা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা সহজ ভাষায় বলেছেন এই কথাটাই। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এই পুড়ে মরা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য “কৃষকরা শুধু তিনটে কালো আইন বাতিলের দাবিই করেনি, তারা একটা সাদা আইন বানানোর দাবিও জানিয়ে আসছে আগাগোড়া।”
স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে ফসলের ন্যূনতম দাম প্রণয়নের আইন করতে হবে। ফসল ফলানোর যে খরচ তার দেড়গুণ হিসেবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করার সুপারিশ করেছিলেন স্বামীনাথন। উৎপাদন খরচ হিসেব করার সময় শুধু বীজের দাম, সারের দাম, আর সেচের জন্য বিদ্যুতের খরচ ধরে হিসবে করলে সহায়ক মূল্য কম হবে। যদি এর সঙ্গে জমির ভাড়াকে যুক্ত করা হয়, যদি যুক্ত করা হয় চাষের জন্য যে শ্রম দেওয়া হয় তার মূল্য বা মজুরি, মাঠ থেকে ফসল তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে পরিবহন খরচ হয় সেটাও যদি উৎপাদন খরচে যুক্ত করা হয় তাহলে স্বাভাবিক কারণেই সহায়ক মূল্য হয় অনেকটা বেশি। আসলে কিন্তু ফসল ফলানোর জন্য এই পুরো খরচটাই হয় (এর চেয়ে একটু বেশিই হয়)। কিন্তু সরকার সবটা হিসেবে ধরে না, ঠকায় কৃষককে। স্বামীনাথন কমিশনের (সি২+৫০%) ফর্মুলায় কীভাবে এই সহায়ক মূল্য হিসেব করতে হবে তার প্রস্তাব আছে। কৃষকরা এই প্রস্তাবিত ফর্মুলা মেনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করার জন্য আইনের দাবি করছেন। তিনটে আইন রদ করার দাবিটা হল নতুন মারণাস্ত্রের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য, নতুন আইন বানানোর দাবিটা হল বাঁচার জন্য। প্রসঙ্গত ২০১৪ সালের আগে নরেন্দ্র মোদি নিজে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
চলতি কৃষক আন্দোলন শুরু থেকে “বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০-২১” বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। “কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট ইন ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন অ্যান্ড অ্যাডজয়েনিং এরিয়াস বিল ২০২১”-এ কৃষকদের জন্য যে সকল শাস্তির বিধান আছে সেইগুলি মুছে ফেলার দাবি জানিয়ে আসছে। আন্দোলনের তিন বছরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও তিনটে দাবি। এক, বিভিন্ন রাজ্যে আন্দোলনের সময় সহস্রাধিক কৃষকের নামে যেসকল মামলা দায়ের হয়েছে সেইসব প্রত্যাহার করতে হবে। দুই, লখিমপুর খেরিতে গাড়ি চাপা দিয়ে কৃষকদের হত্যা করার ঘটনার মূল নায়ক অজয় মিশ্র টোনিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করে গ্রেপ্তার করতে হবে। তিন, আন্দোলনে শহিদ কৃষকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দিতে হবে এবং সিংঘু বর্ডারে তাঁদের স্মৃতিতে শহিদ স্মারক নির্মাণের জন্য জমি দিতে হবে। সর্বোপরি, থুথুটা যেখানে ফেলেছিলেন সেখান থেকেই চেটে খেতে হবে অর্থাৎ পার্লামেন্টে পাশ করানো আইন তিনটে পার্লামেন্টে বিল পাশ করিয়েই বাতিল করতে হবে।
এই দাবিগুলো না মেনে সরকার পালাতে পারবে না। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা দৃঢ়তার সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছে, তাঁরা দিল্লির সীমান্ত আগলে পড়ে থাকবেন, পালাতে দেবেন না। তাছাড়া শুধু তো ওঁরা নন, গোটা দেশজুড়েই এই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছে, অকৃষক জনতা বিশেষ করে দেশের শ্রমিকশ্রেণি ব্যাপকতম সংহতিতে রাস্তায় আছেন। যতক্ষণ না দাবিগুলি আদায় হচ্ছে ততক্ষণ এই বৃহত্তর আন্দোলন ফুরিয়ে যাচ্ছে না। চলতেই থাকছে, থাকবে। বরং যে যেখানে, লড়তে লড়তেও হয়তোবা, জেতার হিম্মত হারিয়ে ফেলছিলেন, সেই তারাও ফিরে পেয়েছেন আত্মবিশ্বাস। লড়াই মানে জান লড়িয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা আর লড়াইয়ের একমাত্র সমাপ্তি বিন্দুর নাম বিজয়। ভারতবর্ষের সংগ্রামী জনতাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে এই কৃষক আন্দোলন। সেই আত্মবিশ্বাসকে সংহত করেই অবশিষ্ট মিছিলে হাঁটবে দেশ, হাঁটতেই হবে তাকে।
শাহিনবাগ দাবি উত্থাপন করেছিল, আদায় করা বাকি রয়েছে এখনও। গায়ের জোরে সংসদে কৃষি আইন যেদিন পাশ করানো হয় তার পরদিনই পাশ করানো হয়েছে তিনটে শ্রম কোডও। একটি শ্রম কোড পাশ করানো হয়েছিল তার আগেই। বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দেশের শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত শ্রমআইন-স্বীকৃত অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া চারটি শ্রম কোড প্রত্যাহারের দাবিও আদায় হয়নি এখনও। এনআরসি থেকে শ্রম কোড— অবিরাম লড়াই চলছে। এবার আরও জেদে, আরও আত্মবিশ্বাসে এ লড়াই অর্জন করবে বিজয়। করতে তাকে হবেই। কেননা বিজয় অর্জন করা যায়, থামিয়ে দেওয়া যায় লগ্নি পুঁজির বুলডোজারও। কর্পোরেটের অশ্বমেধের পথ যে রুদ্ধ করা যায়, একথা আজ প্রমাণিত।
একথা প্রমাণিত প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিক কর্মচারীদের ধারাবাহিক সংগ্রামে। সরকার বেসরকারিকরণের লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি একথা সত্য, তবে এটাও সত্য যে এখনও একাজ তারা করে উঠতে পারেনি। শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের চাপেই এলআইসি, ইন্ডিয়ান অয়েল, বিএসএনএল যতটা সহজে/যতটা দ্রুততায় বেচে দিতে চেয়েছিল সরকার তা এখনও পারেনি। তাকে থমকাতে হচ্ছে পদে পদে।
একথা সত্য যে শাসকশ্রেণি নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি, সরে আসেনি রাস্তা থেকে; তবে আন্দোলনের ব্যারিকেডের সামনে সাময়িক থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। আর তাই এখনই সময়, শ্রেষ্ঠ সময়— সমস্ত শক্তিকে একটা জায়গায় সংহত করে ভীষণ জোরে একটা ধাক্কা মারার। যাতে সে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
কর্পোরেটবান্ধব-জনস্বার্থবিরোধী নীতিঅভিমুখ থেকে সরকারকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করার জন্য চূড়ান্ত একটা ধাক্কা মারতে প্রস্তুত হচ্ছে এদেশের শ্রমিকশ্রেণি। সেই যেদিন সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্ব প্রকাশ্য বিবৃতিতে শাসকপক্ষের পিছু হটার কথা জানিয়েছিলেন, সেইদিনই, সেই ১১ নভেম্বরই দিল্লির যন্তরমন্তরে আয়োজিত হয়েছিল এক কনভেনশন। সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনের সময় (ফেব্রুয়ারি মাসে) দু দিনের সারাভারত সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা করেছে ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এই কনভেনশন থেকে। ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণির এই ধর্মঘটের দাবিসনদে যেমন শ্রম কোড প্রত্যাহারের দাবি আছে, তেমনিই যুক্ত রয়েছে চলমান কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলিও। শুধু দাবি উত্থাপনেই এই একতা সীমাবদ্ধ নয়, নিঃসন্দেহেই তা প্রসারিত হবে অ্যাকশনেও।
গত বছর ২৬ নভেম্বর শ্রমিকদের ধর্মঘটে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন কৃষক-ক্ষেতমজুরেরা। আর সেইদনই তাঁরা রাজধানী দিল্লির বর্ডারে শুরু করেছিলেন অবস্থান। তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর কৃষকদের ডাকা ভারত বনধেও একইভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন শ্রমিকেরা। সেদিনের হরতালেও, শুনেছি, অনেকে বলেছেন “কী লাভ রাস্তা আঁটকে?” দুটো মাস পেরোনোর আগেই খোদ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেই সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল।
দাবি ছিনিয়ে আনা সম্ভব হল। যদিও আংশিক। বাকিটা আবারও রাস্তায় লড়ে ছিনিয়ে আনতে হবে।
আর যদি রাস্তায় নামতে আজও দ্বিধাগ্রস্ত হই, ফেব্রুয়ারির দুদিনের ধর্মঘট যদি সফল না করতে পারি… এখনও মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কৃষকদের সহযোদ্ধা, এমনকি সহনাগরিক বলে নিজেদের পরিচয় দেওয়ারও যোগ্যতা হারাব। দ্বিধার বাধা পার হয়েই তাই আসছে ধর্মঘট!