Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ: এবার লক্ষ্য নাগরিক সমাজ

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

সম্প্রতি হায়দরাবাদে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ন্যাশানাল পুলিশ অ্যাকাডেমির এক অনুষ্ঠানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সরকারের ‘আগামী যুদ্ধে’র লক্ষ্যবস্তু হিসাবে ভারতের নাগরিক সমাজকে চিহ্নিত করেছেন। কোনও রকম রাখঢাক না রেখেই তিনি বলেছেন নাগরিক সমাজকে কাজে লাগিয়ে দেশের স্বার্থকে বিঘ্নিত করা হতে পারে। তাঁর মতে রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে প্রথাগত যুদ্ধ খুবই ব্যয়বহুল ও অকার্যকরী। তাই নাগরিক সমাজকে বিভ্রান্ত করে, বিভক্ত করে বা বশীভূত করে ‘শত্রুরা’ তাদের লক্ষ্যপূরণ করতে পারে। মোদ্দা কথাটা হল ভারতবর্ষের বিপদ লুকিয়ে আছে দেশের মধ্যে। ইদানীং দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে একটা কথা খুবই প্রচারিত। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের পর এই সরকারের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ডোভাল। নিরাপত্তা উপদেষ্টার এই বচন তাই স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।

মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে দুটি শব্দবন্ধ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আবশ্যক। প্রথমটি হল ‘চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ’ (fourth generation warfare) এবং দ্বিতীয়টি হল ‘নাগরিক সমাজ’ (civil society)। চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ সম্পর্কে আধুনিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও কর্পোরেট মিডিয়া যে সংজ্ঞা হাজির করেছে তা হল এ এমন এক সংঘাত যেখানে যুদ্ধ ও রাজনীতি, যোদ্ধা ও নাগরিকের মধ্যেকার বিভেদরেখাটি বিলুপ্ত হয়ে গোটা বিষয়টি একাকার হয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদল রণনীতি বিশেষজ্ঞ ১৯৮০ সালে এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন। সরল ব্যাখ্যায় বিষয়টি হল এমন এক যুদ্ধ যাতে একটি পক্ষ হল অরাষ্ট্রীয় উপাদান (সংগঠন/আন্দোলন)। এই অরাষ্ট্রীয় পক্ষকে সমাজবিজ্ঞানীরা ‘Non State actor’ বলে চিহ্নিত করেন। এই সংজ্ঞা মেনে চললে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দাস বিদ্রোহও চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে প্রথাগত যুদ্ধের বদলে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ, সাংস্কৃতিক আক্রমণ, স্বল্প মাত্রার সংঘর্ষ, আর্থিক মদত, গোপন নেটওয়ার্কিং প্রভৃতিকে যুদ্ধের উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকার এই যুদ্ধে যে সমস্ত অরাষ্ট্রীয় উপাদানগুলিকে তাদের প্রচারে ‘শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত করবে তারা মিডিয়ায়, যে কোনও সরকারি ন্যারেটিভে ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে ঘোষিত হবে। চিহ্নিত হবে শাসক-কর্তৃক প্রচারিত ‘রাষ্ট্রহিত’ সম্পর্কিত ধারণার প্রতিবন্ধক হিসাবে। এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট— রাষ্ট্রের কোনও নীতি জনগণের কোনও অংশ জনবিরোধী মনে করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করলে তাও এই যুদ্ধের উদাহরণ হিসাবে ঘোষিত হবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘নাগরিক সমাজ’ (civil society) এক জটিল ধারণা। বহু দিন ধরে মনে করা হয় এটা এক তৃতীয় ক্ষেত্র (প্রথম দুটো হল সরকার এবং বাণিজ্য/আর্থিক ক্ষেত্র)। কেউ বলেন নাগরিক সমাজ হল অ-সরকারি সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের যোগফল যারা নাগরিকের স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে। সিভিল সোসাইটি কথাটি জনপ্রিয় হয় আশির দশকে বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের দাবিতে যে গণ-আন্দোলন শুরু হয় সেক্ষেত্রে এনজিওগুলি সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ায়। আবার এটাও সত্যি পূর্ব ইউরোপে সোশাল ডেমোক্র্যাটদের দ্বারা পরিচালিত সরকারগুলির পতনের ক্ষেত্রে সেদেশের সিভিল সোসাইটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নাগরিক সমাজের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাঙ্ক তার প্রয়োজনে সিভিল সোসাইটির এক সংজ্ঞা নির্দেশ করে— ‘civil society… refers to a wide array of organisations; community, groups, non-governmental organisations, labour unions, indigenous groups, charitable organisations, faith-based organisations, professional associations and foundations.” যদিও একই সঙ্গে একথাটা মনে রাখা প্রয়োজন যে নাগরিক সমাজ কোনও সমসত্ত্ব শক্তি নয়, বরং তারা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। ভারতের মত দেশ যেখানে অন্তত ঘোষিতভাবে একটি লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয় সেখানে নাগরিক সমাজের উপস্থিতি গণতন্ত্রের এক অনিবার্য শর্ত রূপে বিবেচিত হয়। সেই নাগরিক সমাজ কেন রাষ্ট্রের বর্তমান পরিচালকবর্গের কাছে শত্রু হিসাবে বিবেচিত হল তা বিচার করা আজ প্রধান কাজ।

সে প্রসঙ্গে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে বলা প্রয়োজন। তা হল নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালর যে বক্তব্য নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তা অর্ধসত্য। আগামী যুদ্ধ নয়, নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদি সরকারের যুদ্ধ ঘোষণা বহুদিন আগেই হয়েছে ও অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যেকদিন তাঁদের নিজেদের জীবনে উপলব্ধি করছেন। এই যুদ্ধেরও একটা সলতে পাকানোর পর্ব রয়েছে। মূলত আশির দশক থেকে মানবাধিকার ও নাগরিক সমাজের প্রশ্নটি জনমানসে আলোচিত হতে শুরু করে, মানবাধিকার সহ বিভিন্ন অধিকার সংগঠনের সক্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শাসকশ্রেণির পক্ষ থেকে এই অধিকারের মতাদর্শকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানোর এক সুপরিকল্পিত প্রয়াস শুরু হয়। জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে মানবাধিকারের মতাদর্শকে ব্যঙ্গ করা, অপরাধীদের ঢাল হিসাবে চিহ্নিত করা, সর্বোপরি অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের সুশাসনের প্রতিবন্ধক হিসাবে গণ্য করা শুরু হয়। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই এই দোষে দুষ্ট হলেও এক্ষেত্রে সংঘ পরিবার ও তার রাজনৈতিক অঙ্গ বিজেপি এই নাগরিক সমাজের সক্রিয়তার সবচেয়ে তীব্র বিরোধী অবস্থান নেয়। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন সংগঠিত গুজরাট গণহত্যা এবং পাইকারি হারে মুসলিম নিধনের ঘটনাকে প্রকাশ্যে আনতে ও তাকে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচার করার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। সেই সময় থেকেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে বিজেপি ধারাবাহিকভাবে বিষোদ্গার করতে শুরু করে। যদিও মজার ব্যাপার হল খোদ সংঘ পরিবারের প্রভাবাধীন অজস্র সংগঠন রয়েছে যারা সমস্ত নিরিখেই সিভিল সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত। এমনকি যে ডোভাল এই সিভিল সোসাইটির বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলছেন তিনি নিজে ও তাঁর পরিবার ‘বিবেকানন্দ রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ নামে একটা সংগঠন চালান যাদের কাজ ভারতের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করা। আবার তথ্যের খাতিরে এটাও উল্লেখ থাকা দরকার যে মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতার বিরুদ্ধে সিভিল সোসাইটির নেতৃত্বে যখন শক্তিশালী গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে (আন্না হাজারে ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন ও নির্ভয়া আন্দোলন) তখন বিজেপি তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে দমন নীতি প্রয়োগ করা হতে থাকে। ২০১৫ সালে বিচারপতিদের এক অনুষ্ঠানে মোদি তাঁদের ‘five star activist’-দের সম্পর্কে সতর্ক থাকার কথা বলেন। অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল ‘তথ্যের অধিকার আইন’-কে নখদন্তহীন করা হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি যাতে সরকারের বিরোধিতা করতে না পারে তার জন্য তাদের ভাতে মারতে FCRA আইনে নানা সংশোধনী আনা হয়। ভুয়ো মামলায় অধিকার কর্মী, আইনজীবী, ধর্মযাজকদের কীভাবে দানবীয় ইউএপিএ আইনে বন্দি করা যায় তার আদর্শ উদাহরণ হল ‘ভীমা কোঁরেগাও মামলা‘। এই মামলার কারণে অধিকার আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আজ কারান্তরালে। এছাড়া রয়েছে বিরুদ্ধ মতকে নজরদারি করার জন্য অসাংবিধানিক পেগাসাস প্রযুক্তির প্রয়োগ। কর্পোরেট মিডিয়ার বাইরে যে নিউজ পোর্টালগুলি সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন করছে, সমালোচনায় সরব হচ্ছে, তাদের অফিসে ইনকাম ট্যাক্স ও ইডি হানা আজ রোজকার ব্যাপার। তাই বলা যায় নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আজ চলমান, এটা আগামী দিনের অ্যাজেন্ডা নয়।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার ক্ষমতাসীন হয়। মনে রাখতে হবে মোদির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রথম বিষয় ছিল কর্পোরেট লবির নির্দেশে তৈরি যে আর্থিক নীতির সফল প্রয়োগ করতে মনমোহন সিং-এর সরকার ব্যর্থ হয়েছে (তখনকার মিডিয়ার ভাষায় নীতিবৈকল্য), তা মোদি সরকার সফল করবে। একই সঙ্গে সরকারের আরেকটি ঘোষিত বিষয় ছিল, তারা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নির্দেশিত হিন্দি-হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রয়োগ করবে। বস্তুত নয়া অর্থনীতির আগ্রাসন ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে হিন্দুত্বের রাজনীতির বিষয়টি ছিল একে অপরের পরিপূরক। সেক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল এমন এক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র তৈরি করা যারা কোনও রকম প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে তাদের অ্যাজেন্ডা রূপায়ণ করতে পারবে।

গত সাত বছরের ইতিহাস অতি সংক্ষেপে পর্যালোচনা করলে এই বিষয়টা পরিষ্কার হয়। বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশের লক্ষ্যে যাবতীয় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ, জিএসটি, বিমুদ্রাকরণ, শ্রমকোড— এই ধারাবাহিক আক্রমণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই আক্রমণকে সমন্বিত করার জন্য একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়, অন্যদিকে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল করে রাজ্য সরকারগুলিকে আরও শক্তিহীন করা হয়। এই জনবিরোধী নীতিগুলিকে মসৃণভাবে কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নির্দেশিত হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নকে মদত জোগানো হয়। সংখ্যালঘু মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার লক্ষ্যে ঘৃণার মতাদর্শ ফেরি (গোমাংস নিষিদ্ধ করা, লাভজেহাদ, প্রকাশ্যে নামাজ পাঠে বাধা) করা হয়। কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, সিএএ-এনআরসির মত বিভেদকামী বিষয়গুলিকে সামনে আনা হয়। একদিকে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তথা বৃহত্তর জনসমাজ ভয়ঙ্কর আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, অন্যদিকে মহিলা, আদিবাসী, দলিত, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা হিন্দুরাষ্ট্রের মতাদর্শ দ্বারা পদদলিত হতে থাকে। কোভিড অতিমারি পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সরকার তাদের আক্রমণ আরও তীব্র করে যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কৃষি আইন ও শ্রম কোড।

ভারতের সংসদীয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যক্ষেত্রে কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এর দুটো কারণ আছে। প্রথমটি হল নীতিগতভাবে দলমতনির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক দল নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থক। দ্বিতীয় কারণটি হল এরা সবাই নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণে নরম হিন্দুত্বের সমর্থক। তাই ভোট হারানোর ভয়ে এরা হিন্দুত্বের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেভাবে প্রচারে নামেনি, বরং প্রতীকী প্রতিবাদে নিজেদের সীমায়িত রেখেছে।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও কর্পোরেট মদতপুষ্ট অর্থনীতি ও হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন প্রতিস্পর্ধার সম্মুখীন হয়। আর সেই প্রতিস্পর্ধার নেতৃত্ব দেয় ভারতের নাগরিক সমাজ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অনুপস্থিতিতে প্রতিবাদের মুখ হিসাবে উঠে আসে নাগরিক সমাজ। কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, কখনও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আদর্শে অনুপ্রাণিত আইনজীবী, সত্যকথনে আগ্রহী সাংবাদিক, কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণে না থাকা নিউজ পোর্টাল, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত বুদ্ধিজীবী বা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অধিকার সংগঠন— প্রতিরোধের বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় আসার পরই সরকারের পক্ষ থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ভারত-বিরোধী কর্মকাণ্ডের আখড়া ঘোষণা করা হয়। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাভজা উপাচার্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জাতীয়তাবাদের পাঠ দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সামরিক ট্যাঙ্ক বসানোর প্রস্তাব দেন। এরপর ঘটে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনা। ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করে ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব আন্দোলন। ভীমা-কোঁরেগাও-এর শতবর্ষ পূর্তি পালন হোক বা আখলাখ হত্যাকাণ্ড, জিএসটি-বিমুদ্রাকরণের স্বরূপ উন্মোচন বা রাফাল বিমান ক্রয় দুর্নীতির পর্দা ফাঁস— নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা মোদি সরকারকে একাধিক অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। এই খণ্ড খণ্ড প্রতিরোধগুলো একটা ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতার আকার নেয় এনআরসি-সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়। চলমান কৃষক আন্দোলনের পক্ষে দেশব্যাপী সমর্থনের যে বাতাবরণ তৈরি হয় তার ক্ষেত্রেও নাগরিক সমাজের সদর্থক ভূমিকা রয়েছে। দিল্লির সরকার কখনও টুকরে টুকরে গ্যাং, কখনও খান মার্কেট অ্যাক্টিভিস্ট, আর্বান নকশাল, খলিস্তানি আখ্যা দিয়ে এই নাগরিক প্রতিরোধগুলিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ইউএপিএ আইনে একের পর এক সমাজকর্মীকে জেলে পোরা হয় কিন্তু প্রতিবাদ থেমে থাকে না। তাই নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা বর্তমান সরকারের এক বাধ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে একটা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষিত একটা দেশে সাংবিধানিক ইতিকর্তব্য পালনে শপথ নেওয়া এক আমলা কীভাবে সেদেশের নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে! আসলে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে যে গণতন্ত্রের পাঠ পড়ানো হচ্ছে তাতে কোনও কিছুই আর অস্বাভাবিক নয়। ডোভাল নিজের গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার পরিচয় তাঁর এই বক্তব্যে রেখেছেন— ”the quintessence of democracy did not lie in the ballot box… it lies in the laws made by the people who are elected through those ballot boxes.” এ আসলে এক ঔপনিবেশিক রাজতন্ত্রের ধারণা। আমাদের সংবিধান বলছে গণতন্ত্র হল জনগণের শক্তি, কখনওই তা রাষ্ট্রশক্তি নয়। আর ডোভালের মতে এদেশের মানুষ আসলে প্রজা (সাবজেক্ট), রাষ্ট্রের আদেশ মান্য করা তার একমাত্র কাজ, যেখানে সংবিধান বলছে নাগরিককে তার অধিকার দিতে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। অনেকে ডোভালের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ন্যাশানাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (যার মিটিং-এ সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং) এবং ন্যাশানাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসারি বোর্ডের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কীভাবে অজিত ডোভাল হয়ে ওঠেন দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির শেষকথা সে বিষয়টি যথেষ্ট চিন্তার। সংবিধান মতে এই পদের কোনও সাংবিধানিক ও সংসদীয় মান্যতা নেই। আসলে এটাই নতুন ভারতের দস্তুর। কিছুদিন আগে টাইমস নাও চ্যানেলের এক অনুষ্ঠানে চিফ অব আর্মি স্টাফ (এই পদটিরও জন্ম ২০১৯ সালে) জেনারেল রাওয়াত বললেন এটা খুব ভালো বিষয় যে জম্মু-কাশ্মিরের একটা বড় অংশ আজ নিজেরাই সন্ত্রাসবাদীদের নিকেশ করতে তৈরি। এও আসলে গৃহযুদ্ধের প্ররোচনা। আর অজিত ডোভাল বা জেনারেল রাওয়াতের বক্তব্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এক বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। কিছুদিন আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত এক আলোচনাসভায় খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন— “selective behaviour is harmful for democracy… some try to dent the country’s image in the name of human rights…. looking at human rights with an eye on political gains and loss harms these rights as well as democracy.” এই কথার অন্তর্নিহিত বার্তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না যখন দেখি ৯ নভেম্বর (২০২১) সেন্ট্রাল প্যারামিলিটারি ফোর্সের জন্য আয়োজিত বার্ষিক বিতর্কসভার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যে বিষয় ঠিক করে দেয় তা হল— “are human rights a stumbling block in fighting evils like terrorism and naxalism?” মানবাধিকার রক্ষার জন্য তৈরি হওয়া এক সাংবিধানিক সংস্থা নিজেই মানবাধিকারকে প্রতিবন্ধক মনে করছে আজ এদেশে।

এই অভাবনীয় কিন্তু বাস্তব অবস্থায় নাগরিক সমাজ কীভাবে তার লড়াই জারি রাখবে সেটাই এখন দেখার।