Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এনআরসি ও একটা চোর

এনআরসি ও একটা চোর : বিশ্বজিৎ সরকার

বিশ্বজিৎ সরকার

 

বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মা সরযু আর একবার মনে করিয়ে দিল—

–সাবধানে যাইস বাবা…
–হাঁ হাঁ ও তুমি চিন্তা কইরিও না…

হেমন্তের গড়ানো দুফুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যখন স্ত্রীর উদ্দেশে বলল আমি যাই, সাবধানে রইও— তখন বউও তাকে বলল—

–বাহিরে লকজনের লগে বেশি কথা কইবা না। কানে কত কিছু শুনা যায়।

রাধোহরি ঘর ছেড়ে সরু গলি বেয়ে টোটো যাওয়ার রাস্তার পথে। হেমন্তের শেষ দুফুরের তেজহীন রোদে মৃদু হিমেল হাওয়ার ভাব। শেষ কার্তিকের দুফুরের নীরব নির্জনতায় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে রাধোহরি। মায়াবী আশঙ্কায় তার মন। নিহত আত্মজের ঘা নিয়ে পথ হাঁটা পথিকের মত যেন তার অগ্রসর। উদাসীন দৃষ্টিতে তাকায় হেমন্তের আকাশের দিকে। দূরে চোখ পড়ে কলোনির কোন ঘরের আকাশপ্রদীপ। রঙিন কাগজের মোড়কে একটা মাটির প্রদীপকে বাঁশের ডগায় বেঁধে উঁচুতে তুলে ধরেছে আকাশপ্রদীপ। পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে এই প্রজ্জলন। আকাশপ্রদীপ দেখে রাধোহরির মনে বিষণ্ণতা জেগে ওঠে, মনে পড়ে যায় বাবার কথা। সেই ভোরবেলার কথা— যেদিন তার বাবা তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে বলে— রাধো, চল তোদের অন্য এক জায়গায় লইয়া যামু। রাধো আধো আধো ঘুমে তখন চোখ খুলে তাকায়। তার বিস্ময় কাটে না। সে তো নিজেই ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায় গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে, বাবা তো তাকে ওঠায় না, যাওয়ার কথা তো কালও শোনেনি সে, তবে যাওয়ার কথা শুনেই বিছানাতেই আনন্দে মজে ওঠে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠতেই চক্ষু তার চড়কগাছ। দেখে ঘরের সব জিনিস পোটলা-পুঁটলিতে বাঁধা। মাও কাপড় পরে কোলের বোনকে কাজল পরিয়ে রেডি। শুধু তারই যেন বাকি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সে যখন তৈরি তার বাবা মালপত্রগুলো নিয়ে বলেছিল— ভালো কইরা দেইখ্যা একবার, আর যদি ফিরিয়া না আসি। রাধো বাবার এইসব কথার মানে কিছু বুঝতে পারেনি। তারা কোথায় যাচ্ছে? আর ফিরেই বা আসবে না কেন? তবে বাবার কথামত ফিরে ফিরে তাকিয়েছিল তাদের ছোটো ঘরটির দিকে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে চলে এসেছিল অন্য এক জায়গায়, প্রথমে এক মাস অনেক লোকজনের সঙ্গে গাদাগাদি থাকা, আবার সেখান থেকে আরেক জায়গায় পাঁচ ছয় মাস, তারপর দীর্ঘ তিনবছর। তবে লোকজনের অভাব হয়নি সেইসব জায়গায়। তারপর হঠাৎ করে চলে আসে এক নির্জন জায়গায়। চারিদিকে জলা, বাদাবন ভর্তি দুর্গম ক্ষেত্র। অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু জায়গায় দরমার ঘরে। আশেপাশে আরও দু তিনটি ঘর, তবে বহুৎ ছাড়া ছাড়া। তার মায়ের বিয়ের কানের বিক্রির পয়সা দিয়ে কাউকে ধরে করে তার বাবার এখানে আসা। সে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। জায়গাটা ছিল সত্যিই দুর্গম ক্ষেত্র, বিপদসঙ্কুল। বর্ষাকালে যাতায়াত প্রায় অসম্ভবই ছিল, তবু তার বাবা জল কাদা ভেঙে বেরিয়ে যেত সকালে, ফিরত সন্ধেয়। টিপ টিপ বুকে বিকেলে থেকে পথ চেয়ে থাকত তার মা। তার বাবা তখন সদর বারাসাতে একটা কাজও জুটিয়েছে। সিনেমা হলে দর্শকদের বসানোর কাজ। তবে রাধহরির আর পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি, সে তখন দশ বছরের  কিশোর, তার অফুরন্ত সময়, খেলার সঙ্গী নেই, পড়া নেই, শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়ানো এই নির্জন এলাকায়। রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় সেই সব ইতিহাস।

সেই দরমার ঘর থেকেই বেরিয়েছে রাধো। তবে এখন আর দরমা নেই, একতলা পাকা বাড়ি। এখন আর বাদাবন নেই, নাম হয়েছে নয়া কলোনি। চারদিকে মেলা ঘর, দুতলা তিনতলা পাকা ঘর, কলোনিতে স্কুল ডাকঘর ব্যাঙ্ক, সবই, সদর বারাসাত থেকে সরাসরি বাসও চলে। তবে সেই বাসস্ট্যান্ড রাধোদের কলোনি থেকে কিমি দুই দূরে মেনরোডে। মেনরোড থেকে টোটো অটোর ছড়াছাড়ি। তবে এতসব কিছু দেখে যেতে পারেনি রাধোর বাবা। রাধো যখন উনিশ কুড়ি বছরের যুবক, তখন কয়েকদিনের জ্বরে হঠাৎই মারা যায় রাধোর বাবা। রাধো তখন বারাসাতে গিয়ে ইতিউতি রোজগারের ধান্দায়। বাবা মারা যেতে অবশ্য সিনেমা হলের কাজটা রাধোর মেলে, সিনেমা হলের কাজ থেকেই রাধোর জীবিকানির্বাহ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রাথমিক পাঠও। কিন্তু সিনেমা হলের রমরমা ব্যবসা গত দশ বছর বন্ধ হলে গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার হয়ে বর্তমানে সে এক শপিং মলে পিওনের কাজে কর্মরত।

 

২.

প্রতি বছরই তো বলো, আসছে বছর হবে, বলি তোমার স্লোগান কি বাস্তবে রূপ পাবে কোনওদিন— কিছুটা ঝাঁঝিয়ে সৃজিতা কথাটা ছুড়ে দেয় স্বামী দিবাকরের দিকে। দিবাকর অফিস থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় রাখা ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। বইপত্র ম্যাগাজিন যখন ঘাঁটাঘাটি করে তখন সৃজিতার অনেক কথাই তার কানে ঢোকে না। খেয়ালবশে হুঁ-হা দিয়ে যায়। কিন্তু আজ পাঠে সঠিকমত মনোনিবেশ না হওয়ায়, উপরন্তু সৃজিতার কথার মধ্যে একটু শ্লেষ থাকায় ধাঁ করে রেগেও যায় দিবাকর। গলা চড়িয়ে বলে,

–হেঁয়ালি রেখে আসল কথাটা পাড়ো, কী বলছ খোলসা করে বলো।
–কেন খেয়াল নেই, যে বছরই বলি এবার দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে পুজো দেখব সেই বছরই তো বলো সামনের বছর। লোকে এত দূরদুরান্ত থেকে এসে সারা রাত ধরে কালীপুজো দেখে যাচ্ছে, আর কাছে থেকেও আমার একবারও কালীপুজো দেখা হচ্ছে না, একেই বলে ঘাটের মরা গঙ্গা পায় না।

দিবাকর আর এক প্রস্থ রেগে যায়। চড়া সুরে বলে—

–দেখো ওসব ফালতু কথা রাখো। তোমাকে যেতে কে মানা করেছে? কে ধরে রেখেছে? তুমি তো আর কচি খুকিটি নও, আর তোমার কোলে বাচ্চাও নেই। ছেলেকে নিয়েও তো যেতে পারো। সামান্য একটু থেমে রাগ কমিয়ে আবার বলে, যাও না এ বছরই যাও না।
–এ বছর! এবছর মানে তো কাল থেকেই কালীপুজো, সে খেয়াল আছে।

কাল কালীপুজো শুনে দিবাকর আর একটু মিইয়ে যায়। সত্যিই তো! কাল তো ছুটি, কালীপুজোর ছুটি। সামান্য থম মেরে বলে, চলো কালই চলো, কালীপুজো দেখো।

সৃজিতা বুঝতে পারে  তার স্বামীর রাগ এখন জল। সে একটু সুর মেলায়েম করে বলে,

–কিন্তু ফুডুক করে গিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে চলে আসা যাবে না। আমি কিন্তু সারারাতই থাকব, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা।
–সে থেকো, কিন্তু তোমার যা ঠান্ডার ধাত, সেটা মাথায় রেখো…
–সে তোমায় ভাবতে হবে না, ভবতারিণী মন্দিরের সামনের নাটমন্দিরে বসে থাকব।
–নাটমন্দির! সেখানে তো শুনছি পেশাদারি ভক্তদের হুল্লোড় মাতনে টেঁকা দায়। বক্রাকারে তাদের সমবেত উত্তাল নৃ্ত্যে তোমাদের মত পরিযায়ী ভক্তদের জায়গা কোথায়!
–ঠিক জায়গা করে নেব, তাছাড়া তুমি থাকতে আমার চিন্তা কী!
–অত তোল্লাই দেওয়ার দরকার নেই। বললাম তো আমি যাব!

দিবাকর বেশ কয়েকবার দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির এসেছে। বিয়ের আগে, এবং বিয়ের পরও। কিন্তু স্কাইওয়াক হওয়ার পর আর আসা হয়নি। নতুন সাজে সজ্জিত দক্ষিণেশ্বর দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু লিলুয়া থেকে আর আলাদা করে আসাই হয় না। সৃজিতার কথায় এবার সায় দেওয়ার এটা কারণ। পরের দিনই সন্ধেয় খাওয়াদাওয়া সেরে ছেলে ও বউকে নিয়ে চলে আসে দিবাকর। স্কাইওয়াক ধরেই হাঁটতেই থাকে। স্কাইওয়াক দেখে একটু খুশিই হয়, কেননা প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও কোনওরকম অপরিচ্ছন্নতার চিহ্ন চোখে পড়ে না তার। স্কাইওয়াক থেকে নেমে ভেতরে ঢুকেও যায় তাড়াতাড়ি। কিন্তু ঢোকার লাইন না থাকলেও ভেতরে জমাট ভিড়। ভক্তের ভিড়। ভক্তের সারি। দীর্ঘ লাইনে ভক্তের ভিড় সাপের মত নানান লাইনে এঁকেবেঁকে, গোটা মন্দির চত্বরে, তবে সব লাইনই শেষ পর্যন্ত মিশছে মুল মন্দির ভবতারিণীর আবাসস্থলে। চারিদিকে মানুষের মৃদু কলরব, মন্দিরচাতালের এক কোণে খাটানো হয়েছে বিশাল স্ক্রিন, স্ক্রিনের উল্টোদিকে মন্দিরচত্বরের লাগায়া রুমের দোতলায় তৈরি হয়েছে স্টেজ। সেই স্টেজে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক ক্যামেরা। সেই ক্যামেরা থেকে সরাসরি লাইভ ফুটে উঠেছে স্ক্রিনে। কখনও দেখা যাছে মন্দিরগর্ভের ছবি, কখনও অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন সময় নামী অনামী শিল্পীজনের কলাক্রম। স্টেজের মধ্যে কোনও টানা প্রোগাম নয়, মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন শিল্পীর শ্যামাসঙ্গীত, কারও বা কালীবন্দনা।

সৃজিতাই অগ্রণী ভূমিকা নেয়, সোজা নাটমন্দিরেই চলে আসে। নাটমন্দিরের মাঝখানে, বিশেষত যেখানে থেকে সোজা তাকালেই মা ভবতারিণী মূর্তি চোখে পড়ে সেই জায়গা পেশাদার ভক্তদের দখলে। তাদের নাচগান খঞ্জনীর ঝঙ্কারে জমাটি আসর। বিশের যুবক থেকে সত্তরের প্রৌঢ়, ষাটের পুরুষ এবং মধ্যচল্লিশের মহিলা নিয়ে যেন এক দল। দিবাকরের বেশ মজা লাগে, সৃজিতার দিকে তাকিয়ে বলতে চায়— দেখো হাল, কিন্তু তা আর হয় না। কেননা সৃজিতা তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় এদিক ওদিক করে মায়ের মূর্তি দেখার চেষ্টায় রত। তবে মা মুখ তুলে চাইলেন বোধহয়। হঠাৎ করে দু তিনজন মহিলা উঠে গেল। তারা উঠে যেতেই সৃজিতা সেই দিকে চলে যায়। দিবাকর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয় দুটো খবরেরে কাগজ। গোটা চারেক খবরের কাগজ নিয়েই সে বেরিয়েছিল। কাগজগুলো নেওয়ার সময় সৃজিতা রেগে গিয়ে বলেছিল— ওসব নিয়ে গিয়ে পণ্ডিতি করার থেকে কাগজ কলম নিয়ে গেলেই তো পারতে। সারারাতে তোমার একটা কেন গণ্ডা গণ্ডা গল্প কবিতা নেমে যেত। ভাষা নিয়ে চর্চা করে দিবাকর, এটাই তার পেশা ও নেশা, দুটো একটা গল্পও বেরুচ্ছে, তা বলে এমন খোঁচা! সেও পাল্টা বলেছিল— ওসব জায়গায় ফসল ফলে না, সৃষ্টির বীজ সংগ্রহ হয়। আসলে ছুটির দিনে অনেকগুলো পেপার নেয় দিবাকর, সেগুলো দেখা হয়নি বলে শুধু নিয়ে আসা নয়, কিছু পেতে বসার ব্যাপারটাও তার মাথাতে ছিল। এখন বাড়িয়ে দিয়ে মুচকি হাসি হেসে নয়।

 

৩.

মন্দিরচত্বর সংলগ্ন গঙ্গার ঘাট। বহু পূণ্যার্থীর ভিড়। কেউ স্নানে রত, কেউ আবার হাত মুখ ধুয়ে মাথায় জল নিয়ে ভক্তি করে এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। সেই গেটে সিআরপির ছড়াছড়ি। মন্দিরচত্বরের খোলা প্রাঙ্গনেও পুলিশ এবং  সিআরপির আধিক্য ছিল, কিন্তু গঙ্গার ঘাট চত্বরে এত সিআরপি দেখে অবাক হয় দিবাকর। মানুষ নিজ জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তার জন্যই তীর্থক্ষেত্রে নিজ নিজ আরাধ্য দেবদেবীর কাছে ছুটে আসে। হাজার হাজার সিআরপি দেখে মনে হয় যেন মানুষের সুখ, নিরাপত্তা দেবতার হাত থেকে সরে গিয়ে এদের হাতে চলে এসেছে।  সৃজিতা এবং ছেলেকে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে দিবাকার। একটু চারদিকটা ঘুরে চলে আসবে তাদের কাছে এমনই কথা বলে বেরিয়ে আসা। গঙ্গার ঘাটে এসেই লক্ষ করে গঙ্গার পাড় নতুন চেহা্রায় সুসজ্জিত, দু-দিক সরু তার দিয়ে ঘেরা, মধ্যে নানান ফুলের বাহারি সৌন্দর্য, লতায়পাতায় তার দেখনদারি, চমৎকারিত্ব। এরই মাঝে সুদৃশ্য স্ট্যাচু। দিবাকর সেই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যায় পঞ্চবটীর দিকে। পাড় লাগোয়া রাস্তার দিকের সরু জায়গাতে বহু মানুষকে বসে থাকতে দেখা যায়। সরু পলিথিন পেতে ছোট ছোট দলে আসীন। এভাবে পূণ্যার্থীদের বসে থাকা জমায়েত দেখে দিবাকরের একটু অবাক লাগে। তবে বিস্ময়ের নালা পেরিয়ে মুহূর্তেই অবাক রাজ্যের মহাসমুদ্রে ঢুকে পড়ে। রামকৃষ্ণদেবের শয়ন ঘর ছেড়ে আসতেই বিস্ময়ের ঘোর লেগে যায় তার, চারিদিকে মেলা পূণ্যার্থীর বিপুল সমাবেশ। সবাই পলিথিন ত্রিপল পেতে বসে আলোচনায় রত। রাতের আকাশ নিকষ কালো, মেঘলা আবহাওয়ায় নক্ষত্রের উপস্থিতিও কম, তাই আকাশের দিকে তাকালেই স্পষ্ট অনুভূত হয় অমাবস্যার রাত। তবে দূরে মন্দির কর্তৃপক্ষের আলোয় চারিদিক আলোকিত, সেই আলোকের ছটায় স্পষ্ট চেনা যায় পূণ্যার্থীদের মুখ। বাইরে এত পূণ্যার্থীর সমাগম দেখে দিবাকরের ঘোর যেন কাটে না। মন্দির ছেড়ে অন্দরের উৎসবের জাঁকজমক এড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে কেন এত মানুষ, এ কি শুধু কৃচ্ছ্রসাধন! কেননা হেমন্তের আকাশ থেকে চুঁয়ে পরা শিশিরের পরশ আরামদায়ক নয়, গঙ্গার হিমেল বাতাসের ছোঁয়াও সুখপ্রদ নয়, তবে কেন এত পূণ্যার্থী বাইরে! দিবাকরের সংশয় মনে এসব প্রশ্ন ভিড় করে। ইচ্ছা করে প্রত্যেককে কুড়ে কুড়ে জিজ্ঞাস করতে। সামনের দিকে এগুতে দুচোখ ভরে দেখতে থাকে ভক্তদের। সমস্ত রকম মানুষেরই অবস্থান, কোনও জায়গায় স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়ে, কোনও জায়গায় সমবয়সী মানুষের দল, আবার কেউ একা একা। পঞ্চবটী মন্দির সংলগ্ন চাতালের ভাগ করা ছোট দেওয়ালের গা ঘেঁষে সারি সারি অবস্থান। পলিথিনের শিট, শতরঞ্চি কেউবা আবার ছোট ত্রিপল নিয়ে বসেছে। মন্দিরের দিকে চেয়ে নীরব নিশ্চুপ হয়ে থাকা একজন ভক্তকে দেখে চোখ আটকে যায় দিবাকরের। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, সাদামাটা গড়ন, পাতা ছোট পলিথিন শিটের মধ্যে রাখা ছোট ব্যাগ, সস্তার জুতোগুলো খুলে রাখা সেই শিটে। ছোট ব্যাগটা আবশ্য দেওয়ালগাত্রের পাশে রাখা, সেই ব্যাগে হেলান দিয়ে লোকটা চুপচাপ ভবতারিণী মন্দিরের দিকে তাকিয়ে। দিবাকর ক্ষণিক দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করে তাকে। দিবাকরের যাওয়ার রাস্তায় পাশেই ভদ্রলোকের অবস্থান, কিন্তু খুব নিকটে হলেও দিবাকরের উপস্থিতি খেয়াল করেনি সে। প্রায় আধমিনিট ধরে নিরীক্ষণ করছিল দিবাকর। এবার ভদ্রলোকের খেয়াল হয় কে যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখাচোখি হয়, ভদ্রলোক চোখ সরিয়ে ফের আত্মমগ্ন হয়। এই মানুষটির মনের গহ্বরে ঢুকে টোকা দেওয়ার ইচ্ছে পেয়ে বসে দিবাকরের। দেখা যাক কী হয়!

দাদা একাই নাকি? কিছুটা কৌতুকী স্বরে সম্ভাষণ! ভদ্রলোক তাকায় দিবাকরের দিকে, কোনও উত্তর না দিয়ে চোখ নামায়, ভাবখানা এরকম যেন শুনতেই পায়নি। দিবাকর বুঝতে পারে ভদ্রলোক এড়িয়ে যাচ্ছে। দিবাকর এবার জুতো খুলে তার বসার জায়গার দিকে এগিয়ে এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে— আমায় একটু জায়গা দাও দাদা, তোমার পাশে বসি। কালীপুজোর রাত্রে কালীক্ষেত্রে এমনই এক গান বেজেছে বেশ কয়েকবার। তাই বসতে না বলা মানে মাকেই অবমাননা করা, তাই না বলতে পারে না, তবে তার কিছু বলার আগেই দিবাকর ধপ করে বসে পড়ে, কিন্তু সে যে সহজ নয় তা তার আড়ষ্টতাতেই স্পষ্ট। দিবাকর কথা পাড়ে— মন্দিরের মধ্যে এত জায়গা থাকতে এই খোলা আকাশের নীচে কেন, গুঁড়ি গুঁড়ি  হিমও তো ঝরছে।

এরকম একটা প্রশ্নে প্রস্তুত ছিল না ভদ্রলোক। কিন্তু দিবাকরের প্রশ্নের আন্তরিক ভাবে আকৃষ্ট হয়। স্থানকালপাত্র ভুলে বলে, ভিতরের ওই উৎসব থেকে একটু দূরেই ভালো। সারারাত তো কাটাব, একটু মেলে চড়ে থাকা যাবে, আবার মায়ের আরাধানাও করা যাবে। একসঙ্গে এতগুলো কথা বলার পর ভদ্রলোকের মনে হয়, একটু বেশিই বলে ফেলেছে। তাই আবার চুপ মেরে যায়।

 

৪.

বাড়ি থেকে বেরোবার সময়েই রাধোহরির মা ও বউ সাবধান করে দিয়েছিল কারও সঙ্গে বেশি কথা না বলতে। ওদের ওখানে জোর খবর অনেককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কে বা কারা, তাদের জন্য তৈরি হয়ছে বড় বড় ঘর, পরিচয়পত্র না দেখাতে পারলেই এই ব্যবস্থা। রাধোহারির আশেপাশের গ্রামে যেন আতঙ্কের পরিবেশ, বাড়ির মহিলা অথবা বয়স্ক লোকেদের মধ্যে ভয়টা একটু বেশি। রাধোহারির মত মানুষদের মনেও একটা মানসিক ভীতি তৈরি হয়ে গেছে। তার বাবার নামে জায়গাজমি, তার নিজের পরিচয়পত্র সবই আছে, তবু বাইরে বেরুলেই এই ভয়ে হঠাৎ হঠাৎ করে জেগে ওঠে একটা আশঙ্কা। এই ভয়েই রাধোহরি বেরোবার সময়েই একটা কার্ড নিয়ে বেরিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চারিদিকের খবরে অন্তরে একটা ভয় ভয় ভাব। বিশেষ করে এলাকা ছেড়ে বাইরে এলেই সেই ভয়টা আরও পেয়ে বসে। বাহিরে, বিশেষ করে কলকাতার দিকে সে বিশেষ আসে না। গত তিন বছর এই বিশেষ দিনে দক্ষিণেশ্বর মায়ের কাছে একটি প্রার্থনা করে এসেছে, এবার বাদ দিতে তার মন সায় দেয়নি। হেমন্তের শেষ দুফুরে বাদাবাজারে নয়াপল্লী থেকে বেরিয়ে আধঘন্টা হল সে পৌছেচে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে। গঙ্গায় হাত মুখ ধুয়ে মাকে দর্শন করে মন্দিরের বাইরে এসে সবে বসেছে। দশ পনেরো মিনিট মায়ের কাছে শুধু তার প্রার্থনা ভক্তিভরে বলার সময়েই হাজির একটা উটকো লোক। ইচ্ছা ছিল না কারও সঙ্গে কথাবার্তাতে জড়াতে, কিন্তু হঠাৎ জড়িয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবছে যত তাড়াতাড়ি পারে লোকটা উঠে যাক। আর ঠিক তখনই আর একটা প্রশ্ন তার সামনে আছড়ে পড়ে—

–এ বছরই প্রথম, না এর আগেও এসেছেন?

মায়ের থানে মিথ্যা বলতে ভয় হয় রাধোহরির। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে—

–না, তিন বছর…
–তিন বছর! ইন্টারেস্টিং! সত্যিই আপনাদের ভক্তির তুলনা হয় না। দেখুন ওপারে থেকেও এই ৪৫ বছরে কালীপুজোর রাত এই প্রথম, আর এসে বুঝেছি আমার মত পাপীতাপীর এটা জায়গা নয়।

রাধোহারি শুনে যায় কথাটা। সে আর বেশি কথা বলবে না বলে চুপ করে থাকে, কিন্তু ভেতরে উসখুসও করতে থাকে তার ভক্তমন। ফস করে বলে ওঠে—

–তীর্থক্ষেত্রে এলে সব পাপ ধুয়ে যায়। যেমন গঙ্গাঁয় ডুবলে সব পাপ ধুঁয়ে যায়, আবার ডাঙ্গায় উঠলে সেই পাপ ফিরে আসে— তীর্থক্ষেত্রও তাই। এই বলে সে দিবাকরের মুখের দিকে তাকায়। এই প্রথম ভালো করে দেখে ভদ্রলোককে, তার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। বেশভূষায় আভিজাত্যের ভাব। চোখমুখ দেখে রাধোহরির মনে হয় ভদ্রলোক হয়ত কোনও আফিসের বড় কর্তা। সামাজিক অবস্থান তার থেকে অনেক উঁচুতে স্পষ্ট বুঝতে পারে। কিন্তু এহেন মানুষটি যেভাবে তাকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেছে তাতে তার সহজসরল ভাবটিই ফুটে উঠেছে।

রাধোহরির এই ভাবনা ছন্দ কাটে দিবাকরের কথায়—

–আপনি ভালো লোক, তাই সকলকেই ভালো চোখে দেখেন— দিবাকরের কথা শেষ হয় না, রাধোহরি বলে—
–আর দাদা আজকাল ভালোমানুষদেরই যত সর্বনাশ। তাদের পাশে কেউ নেই, এই জন্যই তো শেষ ভরসাস্থল মায়ের কাছে আসা।

গল্পের গন্ধ পেয়ে দিবাকর একটু নড়েচড়ে বসে বলে,

–কীরকম?

কথার তোড়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। এবার একটু গুটিয়ে নিয়ে বলে, না সেরকম কিছু না। ওই মায়ের কাছে আসার কথা বলছিলাম আর কী।

দিবাকর স্পষ্ট বুঝতে পারে কথা লুকোতে চাইছে ভদ্রলোক, এদিকে তার শোনার আগ্রহও বাড়ে। মানবচরিত্রে ঢুঁ মেরে জীবনের রস সংগ্রহ করা তার জীবনপ্রবাহের অঙ্গ। তাই তার কাহিনি শোনার জন্য বলে—

–দাদা দুঃখ তো সব মানুষের আছে, দুঃখের কথা বললে জানেন তো মনের ভারও লাঘব হয়।
–এই ভার লাঘব হওয়ার নয় যতদিন সে না ফিরে আসে!
–আপনার কি কেউ হারিয়ে গেছে? অথবা রাগ করে ঘর থেকে চলে গেছে?
–শুনে লাভ নেই— রাধোহরির মুখ থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

ভদ্রলোকের কথায় কাহিনির প্লট তৈ্রি। এবার বাকিটুকু বললেই সৃষ্টির বীজ হাতে। দিবাকর তাই বলে—

–দুঃখের কথা বলতে হয়, বলা যায় না কার কাছ থেকে কী উপকার আসে। আমার সাধ্য থাকলেও তো কিছু করতে পারি।

একেবারে ধোঁকা দিচ্ছে না দিবাকর, একক অসহায় মানুষের সে দু-একবার উপকার করেছে। তবে এক্ষেত্রে বোহেমিয়ান দিবাকরের গল্পের রসদ খোঁজের নেশাই স্পষ্ট।

প্রথম প্রথম এড়িয়ে গেলেও রাধোহরি ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে কথার টানে আস্তে আস্তে। খারাপ লাগেনি ছোকরাকে। কে জানে হয়ত মায়েরই দেওয়া, হয়ত এই ভদ্রলোকটিকেই মা পাঠিয়েছেন তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তাই অকপটে বলে—

–দাদা আজ তিন বছর হল আমার মেয়ে ঘরছাড়া। মেয়ের মুখ দেখিনি।
–ঘরছাড়া মানে? রাগ করে পালিয়েছে?
–না দাদা, সামান্য রোজগারেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছি। মেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে বলল, বাবা কলেজে পড়ব। আমার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু মেয়ের যখন ইচ্ছা, তখন সায় দিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই একটা মোবাইলের লগে বায়না ধরল। আমার একটা ছোট মোবাইল ছিল, সেটাই দিতে চাইলাম। কিন্তু ওর চাই নেট মোবাইল, তাই কষ্ট করে কিনে দিলাম। আর এই মোবাইলই কাল হল। কোথাকার একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হল। পড়তে পড়তেই ছেলেটার সঙ্গে পালিয়ে গেল। আমাদের ঘর থেকে ১০ মাইল দূরে ছেলেটার ঘর। দাদা বলবেন না, যেদিন থেকে গেছে সেদিন থেকেই মেয়েটা আমার জ্বলেপুড়ে মরছে। ছেলেটা বদ চরিত্রের, লম্পট, মাতাল, ফোরটয়েন্টি। এখন আমার মেয়ে ওদের সংসারে ঝি-এর মত থাকে, জোর করে ওকে ধরে রেখেছে। ওর মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে, লুকিয়ে চলে গেলে আমাদের সবাইকে শেষ করে দেবে। সেই ভয়ে মেয়ে আসতেও ভয় করেছে, ওকে ঘর থেকে বেরোতেও দেয় না, নজরবন্দি করে রেখেছে। মেয়ে যাতে ফিরে আসে সেই প্রার্থনাই করতে আসি প্রতি বছর। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যায় রাধোহরি।
–দেখবেন, সব ঠিক হয় যাবে। দিবাকর সান্ত্বনা দিয়ে বলে।
–ঠিক কী করে হবে দাদা, ঠিকের লক্ষণ নেই। উপরন্তু অত্যাচার দিনকের দিন বেড়েই চলেছে। ছেলেটা আবার রাজনীতি-টাজনীতি করে…
–থানায় যাননি? দিবাকর মৃদু স্বরে বলে।
–গিয়েছিলাম, থানা বলল এসব স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। সব মিটে যাবে বলে এড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছি। কিছুই তো হল না। এখন মাকালীই শেষ ভরসা।

দিবাকর একটু চুপ করে থাকে, তারপর সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বলে—

–বাড়িটা কোথায় বললেন?
–ওই নয়া কলোনি বাদা বাজার, বারাসাত থেকে ট্রেনে দক্ষিণে ১৫ মাইল।
–ওখানে কতদিন আছেন?
–জন্ম থেকেই ওখানে আছি।

ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে একটু সহমর্মিতা বোধের সঞ্চার হয়েছে দিবাকরের। মাথায় তার সমস্যা নিয়ে ভাবনা একটু একটু করে জাঁকিয়ে বসে। সামান্য সময় চুপ থেকে বলে—

–আদি বাড়ি কোথায়, যশোর না খুলনায়? দিবাকরের এই প্রশ্নে একটু হতচকিত হয়ে যায় রাধোহরি।

তারপর সামান্য ভেবে বলে—

–ওই যে বললাম, বারাসাত বাদাবাজার।
–না বলছি যে আসল বাড়ি কোথায়, অর্থাৎ বাপ ঠাকুরদা কোথা থেকে এসেছেন?

দিবাকরের এই কথা যেন অচেনা ঠেকে রাধোহরির। তাই একটু সাবধানী হয়ে বলে—

–হাঁ, ওই বাদাবাজার নয়াকলোনি।

পাগলাটে দিবাকর একটু মেজাজি, বিশেষ করে সমস্যা নিয়ে ভাবতে বসলে প্রতিকূল পরিবেশ অহেতুক তৈরি হলে তার মাথা বিগড়ে যায়। হঠাৎ করে তার মাথার শিরা উপশিরাগুলো চড়াং করে গজরাতে থাকে। বাংলা সাহিত্যের ভাষা নিয়ে এমফিল করা ছোকরা দিবাকরের শিক্ষিত ইগো মনে হঠাৎ ঝাপটা লাগে। আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে সে শুধু পুঁথিগত বিদ্যার চর্চায় করেনি, এখন এইরকম একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত। অচেনা বিভুঁইয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের আবাসস্থল মিলিয়ে নেওয়াও তার শখ। তার অধীত শিক্ষা শতকরা নিরানব্বই ক্ষেত্রেই ঠিক হয়। এতে এরকম বিদ্যার রসাস্বাদন হয় তার। উদিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গভীরভাবে অনুধাবন করে সেই কথার টানের সুর ও বিস্তার। কথা বলার সময়েই সে খেয়াল করেছে রাধোহরির ভাষা। কিন্তু এক্ষেত্রে তার অধীত শিক্ষা মেলানো নয়, সমস্যাকে ভালো করে জেনে তার প্রকৃ্তি অনুধাবন করার জন্যই তার জিজ্ঞাসা। রাধোহরি যথাসম্ভব তার জন্মভাষার আঞ্চলকিতা বর্জন করেই কথা বলেছে। কিন্তু দিবাকরের সূক্ষ্মকান ও অর্জিত চর্চায় তা বন্দি, তাই এবার একটু রেগে গিয়ে বলে,

–বলছি কোথা থেকে এসেছে আপনার বাপ ঠাকুরদা? খুলনা না যশোর?

দিবাকরের কথাতে রাধোহরির চোখের সামনে ভেসে ওঠে যশোরের বামুনগামের সেই ছোট বাড়িটা। একটু আনমনা হয়ে যায় একটু আমতা আমতা করে বলে ওই ওখানেই। বাদাবন নয়াকলোনি।

দিবাকরের বিরক্তি ধরে, সে স্পষ্ট বুঝতে পারে যশোর খুলনার টান। তার মনে হয় সে মিথ্যা কথা বলছে। তাই একটু অধৈর্য হয়ে বলে,

–বলি অরিজিনাল বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি, খুলনা না যশোর? আমি কনফার্ম আপনার অরিজিনাল বাড়ি বাংলাদেশ।

দিবাকরের সুর ও কথার ঝাঁঝে বেসামাল হয়ে ওঠে রাধোহরি। মুহূর্তে এই মানুষটিকে আর সমব্যথী বলে মনে হয় না তার। রাধোহরি তাকায় তার দিকে। ভয়ার্ত চোখে তার সামনে ভেসে ওঠে নানান বেশে একটা মানুষের ছবি— বুদ্ধিদীপ্ত গম্ভীর সরকারি আমলা, কখনও গোয়েন্দা, আবার কখনও মনে হয় কোনও রাজনৈতিক দলের গুপ্তচর। তার মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। কী ভুলটাই না করেছে! কেন এত কথা তাকে বলতে গেল! তার মানে যা শুনছে তার সবটাই সত্যি। আইনি নাগরিক খোঁজার জন্য গোয়েন্দাগিরি, ধরপাকড়। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত তারও বিপদ! নিজেকে তার খুব অসহায় লাগে। কিন্তু পরক্ষণেই মাথায় বুদ্ধি আসে। সামনের জায়গাগুলো দেখে নেয়, না, আর কেউ নেই, এই লোকের সঙ্গে আর কেউ নেই, অর্থাৎ একা। ওই একা লোক তাকে আটকাতে পারবে না। এই ভেবে হঠাৎ করে উঠে ছুট লাগায়। দিবাকর হতভম্ব হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার কানে আসে শব্দ, মন্দির চত্বরে মানুষের আওয়াজ— চোর, চোর, পালায়, পালায়। কিন্তু পালাবে কোথায়! দিবাকর দেখে মন্দিরের দূর গেটে ডিউটিরত পুলিশের কাছে তালুবন্দি হয়ে যায় একটা চোর।