Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কপ-২৬: কী পেলাম?

সমর বাগচি

 


পরিবেশবিদ, বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনিকাল মিউজিয়মের প্রাক্তন অধিকর্তা

 

 

 

৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর সিওপি-২৬ সম্মেলন শেষ হল। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত কী হল পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচানোর? ৯ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে ৮ হাজার যুবতী-যুবক, মাতা-পিতা, শিক্ষিকা-শিক্ষক রাস্তা দিয়ে মিছিল করল এই স্লোগান দিতে দিতে, “তোমরা যারা রাষ্ট্র চালাচ্ছ, শক্তিধর তোমরা, ভবিষ্যৎ বংশধরদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিও না।” পরের দিন, ১০ নভেম্বর, প্রায় এক লক্ষ লোক মিছিলে ধ্বনি দিতে দিতে হাঁটল “জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করো।” “ধনী দেশগুলো, তোমরা নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনে আর্থিক সাহায্য করো এবং আদিবাসীদের খেসারত দাও।” সম্মেলনের প্রধান মঞ্চ থেকে উগান্ডার বিখ্যাত জলবায়ু আন্দোলনকারী ভানেসা নাকাটে সম্মেলনে উপস্থিত কর্মকর্তাদের— যাঁদের মধ্যে অনেকেই পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী— বললেন,

We see business leaders ad investors flying into COP on private jets. We see them making fancy speeches. We hear about new pledges and promises…. I have come here to tell you that we don’t believe you. I am here to say, prove us wrong.

ভানেসা নাকাটে

আমি দেখলাম সম্মেলনে তাই হল। আইপিসিসি-র বর্তমান রিপোর্ট এবং রাষ্ট্রসংঘের প্রধান আন্তোনিও গাটেরেস বলছেন যে পৃথিবী আজ এক ধ্বংসের কিনারায়। মানুষ যদি শিল্প-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে সীমিত না রাখতে পারে তাহলে বিজ্ঞানীদের সাবধানবাণী যে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি আসছে তা সত্য হবে। স্ট্যানফোর্ড, বার্কলে এবং প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীরা এই সাবধানবাণী দিয়ে বলেছেন যে মানুষই প্রথম বিলুপ্ত হবে যদি সমাজ একইভাবে চলে। সত্যি কথা বলতে কি বিলুপ্তি অনেকদিন আগেই শুরু হয়ে গেছে। মানুষ পৃথিবীতে আসার আগে যত প্রজাতি পৃথিবীতে ছিল তার মাত্র ২ শতাংশ অবশিষ্ট আছে। তাই, মানুষকে বাঁচাতে গেলে গ্রেটা থুনবার্গ বলছে, ‘Uproot the system’। গ্লাসগো সম্মেলনে প্রায় এক লক্ষ মানুষের সামনে সে সমাজ বদলের কথা বলেছে, শুধু জিএইচজি কমানো নয়। Counterpunch-এর এক প্রবন্ধে পড়লাম গ্রেটা পুঁজিবাদকে ধংসের কথা বলেছে গ্লাসগোতে।

গ্রেটা থুনবার্গ

সম্মেলনে শেষ দিন পর্যন্ত তর্কবিতর্ক চলছে কার্বন ডাই অক্সাইড ‘phase out’ করতে হবে, না ‘phase down’ করতে হবে। অর্থাৎ, কার্বন নিঃসরণ-কে শূন্য করা না, তাকে কমাও। ১৩ তারিখে ১৯৭টি দেশ সহমত হল যে কয়লার ব্যবহার phase down, অর্থাৎ, কমাতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বললেন যে ভারত ২০৭০ সালে কয়লার ব্যবহার শূন্য করে দেবে। যেন উনি ২০৭০ অব্দি বেঁচে থাকবেন এবং রাজত্ব করবেন। এর থেকে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে না। অধিবেশন শেষ হওয়ার আধ ঘন্টা আগে ভারতের দাবীতে কয়লার ব্যবহার বন্ধ এবং জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়ার দাবীকে বাদ দেওয়া হয়। কারণ, ভারতকে উন্নয়ন করতে হবে। আহা, কী উন্নয়ন? পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত মানুষ বাস করে এই ভারতে। কয়দিন আগে খবর বেরিয়েছে যে এই কয়েক মাসে গুজরাতের আদানি সম্পদে আম্বানিকে ছাড়িয়ে গেছে। ভারতের মতের বিরুদ্ধে সুইৎজারল্যান্ড এবং বিভিন্ন ছোট ছোট দ্বীপ দেশ শক্তিশালী প্রতিবাদ জানায়। সুইৎজারল্যান্ডের প্রতিনিধি বলে আমরা ‘phase down’ চাই না ‘phase out’ চাই। কারণ, যে সিদ্ধান্ত হল তাতে, “This will not bring us closer to 1.5 degree Celsius but make it more difficult to reach.” প্রথমে যে টেক্সট করা হয় তাতে বলা হয়েছিল, “accelerating efforts towards the phase out of unabated coal power and inefficient fuel subsidies, recognizing the need for support towards a just transition.” শেষ মুহূর্তে বদলে গেল ভারতের দাবীতে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি Frans Timmermans বলেন, “The longer you take to phase out coal, the more burden you put on the natural environment and the more burden you put on your economy.”

সব দেশ সিদ্ধান্ত নিল যে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে টার্গেট নেওয়া হয়েছে তাকে ২০২২ সালে আরও জোরদার করা হবে। সম্মেলন ধনী দেশগুলোর কাছে আবেদন রেখেছে যে তারা যেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার (adaptation) জন্য আর্থিক সাহায্য কম করে দ্বিগুণ করে দেয়।

আজ, পৃথিবীর অরণ্য, জীববৈচিত্র্য, জল শেষ হয়ে যাচ্ছে, মরুভূমির প্রসার ঘটছে, মাটি ক্ষয়ে নদীতে, সমুদ্রে জমা হচ্ছে, বাতাস, জল, সমুদ্র দূষিত হচ্ছে। ভোগবাদী সমাজে সৃষ্ট কোটি কোটি টন বর্জ্যপদার্থ জমা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। যার মধ্যে একটা বড় অংশ খুবই বিপজ্জনক। বিশেষ করে পারমাণবিক বর্জ্য। প্রতি মিনিটে ৪০টি ফুটবল মাঠের সমান অরণ্য নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। যে আমাজন অরণ্য পৃথিবীর ফুসফুস তার ২ কোটি গাছ কাটা হয়েছিল ২০১৮ সালে এবং বিরাট পরিমাণে অরণ্য অপসারিত হয় আগুনে ২০১৯-এ।

ভয়ঙ্কর খবর এসেছে সাইবেরিয়া থেকে। সেখানে পার্মাফ্রস্টের নিচে কার্বনেট পাথর থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস বেরোচ্ছে। মিথেন কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ৮০ গুণ এবং নাইট্রাস অক্সাইড ৩০০ গুণ বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস। আমেরিকার বিখ্যাত স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন (৫ আগস্ট, ২০২১) জানাচ্ছে,

Permafrost Thaw in Siberia creates a Ticking ‘Methane Bomb’ of Green House Gases.

যে পুঁজিপতিদের অঙ্গুলিহেলনে রাষ্ট্রের প্রধানরা চলেন তারা গ্রিনহাউস গ্যাসকে মাটির নিচে থাকতে দেবে না। বিশ্বের জনজাগরণই একমাত্র এই সর্বনাশকে রুখতে পারে। এর সমাধান প্রযুক্তিতে নেই। আছে সমাজ পরিবর্তনে। তাই গ্রেটা বলে আজ, “Uproot the System.” উচ্চবিত্তের এই সর্বগ্রাসী ভোগবাদী সমাজকে উপড়ে ফেলতে হবে। তাছাড়া, নান্য পন্থা। তাই তো কবি বলেন, “না রে না হবে না তোর স্বর্গ সাধন যতই করিস সুখের সাধন।” আর,

Simplicity is the mark of the civilized, Excess of barbarism.