Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভারভারা রাও-এর কবিতা

রূপায়ণ ঘোষ

 

ভারভারা রাও। জন্ম ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে, অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ারাঙ্গল জেলায়। দীর্ঘ চল্লিশ বছর তেলেগু সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি সমকালীন রাজনীতিতেও তিনি এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ৭০-এর দশক থেকে নানান সময়ে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছেন। জরুরি অবস্থা থেকে শুরু করে ৮০-র দশকে শ্রমিক আন্দোলন, ১৯৯০-২০১০ সময়পর্বে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের পুরোভাগে ভারভারা রাও-এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে দশ-পনেরো বছরের তাঁর বন্দি জীবন।

তাঁর কবিতা স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ। নিজ রচনার ছত্রে ছত্রে তিনি ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়েছেন, প্রশ্ন করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো, যার মধ্যে ‘সমুদ্রম্’ (১৯৮৩), ‘ভবিষ্যত চিত্রপটম্’ (১৯৮৬) তাঁর অসামান্য দুটি কাব্যগ্রন্থ।

 

শব্দ 

পৃথিবীর সমস্ত শব্দ স্পর্শ করতে হবে
ভিতরের নিঃশেষিত শব্দগুলির এইবার নির্দেশনা প্রয়োজন
আমার কথাগুলি হতে হবে দীর্ঘ খরার পর
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো তাজা।
আমাকে আবার শব্দ শিখতে হবে।
স্কুলে কিংবা গির্জার বাচ্চাদের থেকে, লোকেদের থেকে
আমাকে বিশ্বের প্রতিটি রাস্তায় কথা বলতে হবে।
শব্দ হারিয়ে গেলে মানুষের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না—
আমি ও আমার ছায়া মুখোমুখি দাঁড়ালে দেখি
শব্দ মুছে যায় না…
অনেক দিন ধরে আমি চুল্লির আগুনে শব্দদের বিদ্ধ করে এসেছি
জোয়ারের নীচে সাঁতার কাটা মাছ
ভ্রমহীন মানুষের কানে উড়তে থাকা চিৎকার জানে,

আমি জল ও আগুনের সামনে একই কথা বলেছি
আমি আয়না ও ছায়ার সামনে একই সত্তা রেখেছি…

 

প্রতিবিম্ব

আমি কখনও ওদের বিস্ফোরক সরবরাহ করিনি
এমনকি তার ধারণাও না।
পিস্তলে ভরে দিইনি ক্ষুব্ধ কার্তুজ।

তোমরা নৃশংস জুতো দিয়ে মাড়িয়ে গেছ পিঁপড়ের সারি
সেই পদদলিত মাটিতে প্রতিশোধ ফুটে ওঠে—

তোমরাই পাথর ছুড়ে ভেঙেছ মৌচাক
শহরময় ছড়িয়ে যাওয়া মৌমাছির বিক্ষুব্ধ শব্দে আজ,
ভীষণ ভয়ে ঘন লাল হয়ে ওঠে
তোমার কম্পিত অট্টালিকার দরজা।

যে অরণ্যে তোমাদের আলো এসে পৌঁছয়নি কখনও
সেখানে নিতে এসেছ অধিকার!
যখন বিজয়ের শিঙ্গা বেজে ওঠে ওদের হৃদয়ে
তোম‍রা সে বিজয় নিজেদের ভেবে ভুল করো।

তোমাদের বন্দুক আশ্চর্য সচল দেখে
আমি কোনও বার্তা সরবরাহ করিনি
ওদের সমস্ত দিগন্তে আজ জেগে উঠছে তোমাদের নিঃশব্দ অনুপ্রবেশ…

 

সূর্য 

পৃথিবীতে প্রকৃত সকাল আনে
এমন ক্লান্তিহীন হাতগুলি বাঁধা হয়ে গেলে
আলো দেখবে বলে তীব্র উৎসুক চোখের সামনে
একের পর এক পর্দা ঝুলিয়ে দিচ্ছ তোমরা।

প্রারম্ভ সকালকে অভিবাদন জানানো গলায়
একদিন পরিয়ে দিচ্ছ ফাঁসির দড়ি—

বন্দুকের উদ্ধত ট্রিগার চালিয়ে
পিছন ফিরলে দেখা যায়
সমস্ত আকাশ কী ভীষণ রক্তিম!

কেউ কেউ স্তব্ধ হয়
শব্দের আঁধার মিলিয়ে যেতে যেতে দেখি
রক্তাক্ত কোলের মধ্য থেকে
সদ্য চোখ খুলছে কেউ…

 

বেতাল শব 

জেলের মধ্যে থেকে
শব তুলে নিয়েছি কাঁধে,
দ্রুত এক রাত্রির মতো এগিয়ে চলেছি আমি—

ঝুলন্ত দেহ প্রশ্ন করে,
আমার মৃত্যুর কথা বলব?
বলব, কীভাবে হয়েছিল দমন
স্বাভাবিক নাকি হত্যা?

যে মৃতদেহ জেলের ভিতরে প্রশ্ন করে
আমি তাকে কেঁপে কেঁপে বলি,
আহত শরীর বলে দেয়—
এ মৃত্যুর ভিতর হত্যা লুকোনো আছে।

মিথ্যা শুনতে শুনতে
ক্লান্ত হয়ে পড়া শব খুশি হয়—
কেননা সে গারদের অন্ধকার থেকে
কোনওদিন সত্য ভেসে আসতে শোনেনি!

শর্ত ভেঙে কথা ফুটে ওঠে
জেলের মধ্যে জীবিত মানুষের কথা বলা অপরাধ
শব তাই নিমেষে অদৃশ্য হয়;

আমার হাঁটা শেষ হয় না
তার সাথে দেখা হয়ে যায় কারাগারের অন্য অন্ধকারে…