Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অতি দ্রুত কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করাই সঙ্কট এড়ানোর একমাত্র পথ

প্রদীপ দত্ত

 



পরমাণু শক্তি-বিরোধী সমাজকর্মী ও পরিবেশবিদ

 

 

 

জলবায়ু নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈজ্ঞানিক সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) তিন বছর আগে এক রিপোর্টে বলেছিল শিল্পসভ্যতার আগের থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে যে বিপর্যয় নেমে আসবে তা আর শোধরানো যাবে না। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল যে আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ নিই তাহলে সেই ক্ষতি সীমিত করার অনেক পথ রয়েছে।

এ বছর কয়েক মাস আগে আইপিসিসি নতুন রিপোর্টে বলেছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির নীচে সীমিত করার সুযোগ কমে আসছে, এখন তা করতে গেলে অসাধারণ মাত্রার পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং তাহলেও কোনও নিশ্চয়তা নেই। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর অভাবনীয় কাঠামোগত পদক্ষেপ অতি দ্রুত নিলে হয়তো সবচেয়ে ভয়ানক প্রভাবের কয়েকটিকে আটকানো যাবে। তবে অবস্থা যত খারাপই হোক নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং ব্যক্তিরা জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপের মাধ্যমে অবস্থা তার চেয়েও খারাপ হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। এই অবস্থাতেই নভেম্বর মাসে গ্লাসগোয় বসেছিল শীর্ষ সম্মেলন।

গত বছর বাতাসে মিশেছে ৪০০০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড। ২০২১ সালের মে মাসে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৪১৯ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ৪০ লক্ষ বছরের মধ্যে এতটা বৃদ্ধি কখনও হয়নি। এই নিঃসরণের শতকরা তিরিশ ভাগ আসে কয়লা পুড়িয়ে। ইউরোপ, আমেরিকার নিঃসরণ কমলেও চিন ও ভারতে বাড়ছে। শীর্ষ সম্মেলনকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। নীচের আলোচনায় আমরা শুধু ভারতের কথা বলব। একথাও বলা দরকার যে ভারতের দ্বিগুণের বেশি নিঃসরণ করে আমেরিকা, চিন করে প্রায় পাঁচ-ছ গুণ।

 

উষ্ণায়ন বা জলবায়ু বদল এবং বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে দায়ী কয়লা, কারণ তা সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আজ কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিচ্ছন্ন বিকল্প উপস্থিত রয়েছে। কয়লা পুড়িয়ে পাওয়া তাপবিদ্যুতের বিকল্প সৌর ও বায়ুবিদ্যু্ৎ হু হু করে বেড়ে উঠছে। তাই কয়লার ব্যবহার আগে বন্ধ করা দরকার। এই কারণেই গ্লাসগো শীর্ষ সম্মেলনে প্রায় দুশোটি দেশ কয়লার ব্যবহার ‘ফেজ আউট’ করার বা ব্যবহার বাতিল করার অঙ্গীকার করতে চেয়েছিল কিন্তু তা হয়নি। অঙ্গীকারের ভাষা লঘু করার জন্য মূলত চিন ও ভারত দায়ী। তাই সম্মেলনে অঙ্গীকারের ভাষা বদলাতে হয়েছে। তবে তারা আজ কয়লার ব্যবহার কমাতে সম্মত বা তা ‘ফেজ ডাউন’ করতে চায়।

পৃথিবীর ঘোরতর জলবায়ু বদল থেকে বাঁচতে হাতে একেবারেই সময় নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে সব দেশ নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনুক এটাই আকাঙ্খিত ছিল। তাই পরিবেশবাদী ও উদ্বিগ্ন বিশ্বের কাছে বিষয়টা ঘোরতর হতাশার। চিন আমেরিকা ও ভারতই সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। তারা তিরিশ সালের মধ্যে তা বন্ধ করবে না। তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি বৃদ্ধিতেই বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটছে। বিজ্ঞানীদের হিসাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়াটাও নিশ্চিত। তাই এ নিয়ে পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

কয়লা থেকে বিশ্বের মুক্তি কবে হবে তা নিয়ে গ্লাসগো চুক্তিতে কোনও চূড়ান্ত কথা কথা হয়নি। ভারত অবশ্য বলেছে, শুধু কয়লা নয় সবরকম জীবাশ্ম জ্বালানিকেই ফেজ আউট করতে হবে এবং যেসব দেশ তা বেশি খরচ করেছে তাদেরই পথ দেখাতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থাটা খতিয়ে দেখা যাক। ‘ফেজ ডাউন’ কথাটা হতাশাব্যঞ্জক হলেও ভারত দেশকে নিঃসরণশূন্য করতে রাজি হয়েছে— এটুকুই শুধু ধরতে হবে। শীর্ষ সম্মেলনে ভারত জানিয়েছে, ২০৭০ সালের মধ্যে নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনবে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের শতকরা ৫০ ভাগ তৈরি হবে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে, উৎপাদন ক্ষমতা হবে পাঁচ লক্ষ মেগাওয়াট।

মিনিস্ট্রি অফ পাওয়ারের ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের হিসাব অনুযায়ী ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩ লক্ষ ৯০ হাজার মেগাওয়াট। কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদিত হয় প্রায় ২ লক্ষ ২ হাজার মেগাওয়াট,  কয়লা গ্যাস সহ জীবাশ্ম জ্বালানির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২ লক্ষ ৩৪ হাজার মেগাওয়াট। পরমাণুবিদ্যুৎ ৬৭৮০ মেগাওয়াট। জলবিদ্যুৎ ৪৬ হাজার, বাকি নবায়নযোগ্য শক্তি ১ লক্ষ ৩ হাজার মেগাওয়াট। এখনই বড় জলবিদ্যুৎ সহ নবায়নযোগ্য শক্তির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১ লক্ষ ৪৯ হাজার মেগাওয়াট। আরও ৬২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। তার মানে কিছুদিনের মধ্যেই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২ লক্ষ ১২ হাজার মেগাওয়াট। বাকি প্রায় এক দশকে ৩ লক্ষ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা যোগ করা মোটেও কঠিন নয়। পরিকল্পনা রয়েছে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা হবে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের, আর জলবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মেগাওয়াট।

কয়েক বছরের মধ্যেই আরও ৩০ হাজার মেগাওয়াটের নির্মীয়মান তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। তাছাড়া ২৭ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তোড়জোড় চলছে— যার নির্মাণের কাজ এখনও শুরু হয়নি। এর  বেশিরভাগই হবে সরকারি খরচে। বিশেষজ্ঞদের মতে এর জন্য বিপুল ক্ষতির বোঝা বইতে হবে। দুই বিশেষজ্ঞ সংস্থা ক্লাইমেট রিসার্চ গ্রুপ এবং এম্বার-এর মতে এই খাতে খরচ হবে দু লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার কোটি টাকা। যে অর্থ  পরিচ্ছন্ন শক্তি, ব্যাটারি স্টোরেজ এবং গ্রিড শক্তিশালী করার কাজে লাগানো যেত।

নতুন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু যে খরচসাপেক্ষ হবে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির সঙ্গে প্রতিযগিতায় পেরে উঠবে না তাই নয়, বিদ্যুৎগ্রাহককে বেশি টাকা গুনতে হবে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন করে ননপারফর্মিং সম্পত্তি বাড়ার ঝুঁকি বাড়বে। ভারতে প্রচুর বিদ্যুৎ জোগানের প্রয়োজন নেই, কারণ চাহিদা সেইমত বাড়ছে না।

তাছাড়া অদক্ষতা, বায়ুদূষণে ভূমিকা, পরিচালন খরচ বেশি ইত্যাদি কারণে সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী পঁচিশ বছরের বেশি চালু ৫৪ গিগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে। আগামী দশকের মধ্যে সেই জায়গা ভরাবে নবায়নযোগ্য শক্তি, ব্যাটারি স্টোরেজ, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্ধিত লোড ফ্যাক্টর এবং কিছু সুদক্ষ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।

নতুন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু না করা এবং পুরনো কেন্দ্র বন্ধ করার মানে দাঁড়ায়— যদি নবায়নযগ্য শক্তি উৎপাদন এবং শক্তির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্য বজায় থাকে তাহলে শক্তি নিরাপত্তা বিপন্ন না করেও ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ হবে।

দেশের উৎপাদন লক্ষ্য যাই থাকুক দশ বছর আগেও আমরা কেউ ভাবিনি যে ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা এক লক্ষ মেগাওয়াট ছাড়াবে। সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যে নতুন তাপবিদ্যুতের অর্ধেক হবে তাও কল্পনা করতে পারিনি। গত পাঁচ বছরে যা দেখা যাচ্ছে সেই গতি থাকলে শক্তি উৎপাদনে পরিবর্তন যেভাবে ঘটছে মনে হয় ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কবে বন্ধ করব সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আর্ন্তজাতিক চাপের দরকার হবে না, অর্থনৈতিক কারণেই তা হবে।

কয়েক বছর ধরে আদানি-আম্বানি-টাটা সৌরবিদ্যুতে বেশি বেশি বিনিয়োগ করছে। এবার দেশের সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎ উৎপাদক এবং তেল কোম্পানি নবায়নযোগ্য উন্নয়নে জুটি বাধছে। এনটিপিসি ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের হয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়ন এবং শক্তি মজুত করার ব্যবস্থা করবে। এ বিশ্বে দুই সরকারি কোম্পানির জোট এই প্রথম।  এনটিপিসির ৭০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় পুরোটাই তাপবিদ্যুৎ; সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম, এক হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। সাম্প্রতিককালে তারা নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের জন্য ডাকা টেন্ডারে অংশ নিচ্ছে। এইভাবে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১-এর মার্চ পর্যন্ত চার হাজার তিনশো মেগাওয়াট উৎপাদনের বরাত পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের ৬০ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। ওদিকে ইন্ডিয়ান অয়েল তাদের একটি রিফাইনারিতে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন করবে বলে জানিয়েছে। এছাড়া তাদের রিটেল কেন্দ্রে রুফটপ সোলার এবং ইভি চার্জিং স্টেশন করবে। তাদের পরিকল্পনা হল নতুন প্রকল্পের শতকরা ৮৫ ভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে আসবে। ২০১৯ সালে তারা এ বাবদ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছে।

এই পরিস্থিতিতে ভারতের (সঙ্গে চিন ও আমেরিকার) উচিত ছিল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা পুড়িয়ে নিঃসরণ বন্ধ করা। প্রয়োজনের তুলনায় শুধু কয়লা থেকে নিঃসরণ বন্ধ করা ছিল প্রাথমিক পদক্ষেপ। যাবতীয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকেই নিঃসরণ এখনই বন্ধ করা দরকার। তাহলেও মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্র এক-চতুর্থাংশের সমাধান হত। কারণ বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদন করতে মোটের শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ নিঃসরণ হয়। অবস্থা এতটাই করুণ।

 

আগ্রহীরা নিচের লিঙ্কগুলি থেকে এ বিষয়ে আরও বিশদ তথ্য পেতে পারেন—