Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গ্লাসগো কপ-২৬: কিছু প্রগতি হল, কিন্তু জলবায়ু সঙ্কটের মোকাবিলা করতে এবারও ব্যর্থ

সৌম্য দত্ত

 



তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের জনবিজ্ঞান আন্দোলনের এক অগ্রণী যোদ্ধা। গত দুই দশক ধরে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের বিভিন্ন জন আন্দোলন, বিশ্বের জলবায়ু আর প্রাকৃতিক ন্যায় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাতে অনেক সংগঠন এবং আন্দোলনে অংশ দিয়েছেন। রাষ্ট্র সংঘের ক্লাইমেট টেকনোলজি সেন্টারের অ্যাডভাইজারি বোর্ডের সদস্য ছিলেন ৩ বছর। বর্তমানে মৌসম নামক এক ভারতীয় প্ল্যাটফর্মের ট্রাস্টি; ফ্রেন্ডস অফ দি আর্থ-এর এক্সিকিউটিভ সদস্য; সাউথ এশিয়ান পিপলস অ্যাক্সন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর সহ সংযোজক, গ্রিন পিস এনভায়রনমেন্ট ট্রাস্ট-এর বোর্ড সদস্য, ইন্ডিয়া ক্লাইমেট জাস্টিস-এর এক সংস্থাপক।

 

 

কপ-২৬,  অর্থাৎ ২৬ নম্বর “কনফারেন্স অফ পার্টিস” এই অক্টোবর ৩১, ২০২১ তারিখ থেকে নভেম্বরের ১৩ তারিখ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানে পার্টি মানে যে সমস্ত দেশের সরকার “রাষ্ট্র সংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ” বা UNFCCC-এর সদস্য, তারাই। কোনও রাজনৈতিক দল নয়। ১৯৯২ সালের “ধরতি সম্মেলন বা আর্থ সামিট” থেকে এই UNFCCC-র প্রতিষ্ঠা হয়, এবং আজ সারা পৃথিবীর ১৯৭টি দেশের সরকার এর সদস্য। কপ-১ বা প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনের শিখর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে, জার্মানির বার্লিনে। কপ-২৬ প্রথম ধার্য ছিল নভেম্বর ২০২০-তে, কিন্তু কোভিড ১৯-জনিত লকডাউন একে এক বছর পিছিয়ে দেয়।

এটি আমার ১২ নম্বর কপ, প্রথমবার ২০০৯-এ কোপেনহাগেনের কপ-১৫ থেকে। এবার নভেম্বর ১ থেকে ১২ অবধি আমি উপস্থিত ছিলাম গ্লাসগো শিখর সম্মেলনে— অংশ নিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি, প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়েছি, বিভিন্ন টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়েছি এর বিষয়, অনেক জুনিয়রদের শেখানোর কাজ করেছি প্রায় ২৫টি আলাদা প্রোগ্রামের মাধ্যমে।  আর দেখে গেছি, নজর রেখেছি রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ওপর, যাকে বলে ক্লাইমেট নেগোসিয়েশন। তারই অনুভব থেকে এই লেখা।

বেশ কিছু কারণে এই কপ-২৬ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিগত ১০-১৫ বছরে সারা পৃথিবীতে যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে এবং বাড়ছে, কোটি কোটি লোক যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত এর মোকাবিলা করার প্রয়োজন সারা বিশ্বের লোক অনুভব করছেন। এই বছর ভারতের বহু শহর এবং রাজ্য অসময়ের ভীষণ বন্যার কবলে পড়েছে, আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে ৫০ লক্ষ একর বন ভয়ঙ্কর আগুনে জ্বলেছে। মধ্য ইউরোপের ভয়ানক বন্যা, অস্ট্রেলিয়াতে ৬ মাস ধরে জ্বলতে থাকা ‘বুশ-ফায়ার’, উত্তর আমেরিকা আর কানাডার মতো ঠান্ডা দেশে ৪৭-৪৮ ডিগ্রি সেন্ত্রিগেড তাপমাত্রা, সাইবেরিয়ার মতো বরফঢাকা জায়গাতে বিরাট এলাকা জুড়ে বনের আগুন, অত্যধিক তাপপ্রবাহে মৃত্যু, সমুদ্র জুড়ে মেরিন হিট ওয়েভ, ভারতের বঙ্গোপসাগর আর আরব সাগরের উপকূলে একের পর এক বড় সাইক্লোনের মার, টেক্সাসের মতো গরম রাজ্যে ভয়ঙ্কর তুষার ঝড়, মেক্সিকো উপসাগরে এক বছরে ৬টি হারিকেন… এসবই পরিষ্কার দেখাচ্ছে যে পৃথিবীর ক্লাইমেট সিস্টেমস বা জলবায়ুতন্ত্র এক খুব খারাপ পরিস্থিতির দিকে দ্রুত বাড়ছে।

অনেকেই হয়তো জানবেন যে ২০১৫ সালে, প্যারিসে আয়োজিত কপ-২১-এ একটি চুক্তি বা সন্ধি হয় বিশ্বের দেশগুলির সরকারদের। এটি পারিস এগ্রিমেন্ট (PA) নামে বিখ্যাত। এখানে মানা হয় যে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে শিল্প বিপ্লবের সময়কার গড় তাপমাত্রা থেকে ২ ডিগ্রি বেশি— এর মধ্যে বা এর চেয়ে কম রাখতেই হবে। আর সবাই চেষ্টা করবেন যাতে এটা ১.৫ ডিগ্রির বেশি না যায়। কারণ যদি এই ২ ডিগ্রি সীমা পার হয়ে যায়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক বেশি হবে, এবং পৃথিবীর সমস্ত পরিবেশতন্ত্রও ভেঙে পড়তে পারে। যা পুরো মানবজাতির কাছে এক বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রায় ১০ লাখ প্রজাতির জীব-জন্তু-উদ্ভিদ-পতঙ্গ… বিলুপ্তির কবলে পড়বে। গত কয়েক বছরে ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা IPCC-র রিপোর্ট, IPBES-এর রিপোর্ট, WMO-র রিপোর্ট… সব দেখাচ্ছে যে পৃথিবীর সমস্ত ক্লাইমেট সিস্টেম দ্রুত বিগড়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র সংঘের সেক্রেটারি জেনারেলও বলছেন যে এটা মানবজাতির জন্যে লাল (মানে বিপদ) ঘণ্টা।

এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিও তো একটা প্রভাব, যার মূল কারণ অত্যধিক পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎসর্জন; কয়লা, তেল (পেট্রোলিয়াম) আর ইন্ধন গ্যাস বা প্রাকৃতিক গ্যাস (যাদের বলে ফসিল ফুয়েল)-এর ব্যবহার থেকে। তাই ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার কম করা আর শীঘ্র বন্ধ করা; “গ্রিন এনার্জি”র দিকে দ্রুত পরিবর্তন; বনজঙ্গল কাটা বন্ধ করা; বিশ্বের ধনী সমাজের অত্যধিক পরিমাণ এনার্জি আর বস্তুর ব্যবহার অনেক কম করা; অর্থব্যবস্থাকে অনেক বেশি দক্ষ করা… এই সবই এর অংশ। এখানে মনে রাখা দরকার যে গড় তাপমাত্রা এখনই (২০২০) ১.১ ডিগ্রি বেশি হয়ে গেছে, আর দ্রুত বাড়ছে। তাই ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে গেলে বিশ্বজোড়া পরিবর্তন দ্রুত প্রয়োজন। আর কীভাবে, কী পরিকল্পনার মাধ্যমে এই পরিবর্তন করা হবে, সেটা সমস্ত দেশের সরকার নিজেদের পরিকল্পনা Nationally Determined Contribution বা NDC-র মাধ্যমে জানিয়েছিল প্যারিসে। সমস্যা হল— এই সমস্ত প্ল্যান বা NDC একত্র করলে যা রেজাল্ট— তাতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২.৭ সেন্টিগ্রেড বা তারও বেশি হয়ে যাবে ২১০০ সালের আগেই, আর সেটা ডেকে আনবে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়। অতএব, NDC-গুলো পর্যাপ্ত নয় একেবারেই।

গ্লাসগো কপ-২৬-এর সামনে যে কটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, তা হল—

এক. প্যারিস চুক্তি কার্যকর করার নিয়মকানুন বা রুলবুক ফাইনাল করা, যেটা নানান টানাপোড়েনে আটকে ছিল। এর মধ্যে কার্বন বাজার ব্যবস্থা একটা ভীষণই টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। এটা মনে রাখা দরকার যে এই কার্বন বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিশ্বের বহু জলবায়ু-ন্যায় চাওয়া দেশ এবং সংস্থা জোরদার প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে বহু বছর।

দুই. আর একটা জরুরি কাজ, যে NDC দেওয়া হয়েছে ২০১৫-তে, তার থেকে উন্নত, মানে অনেক বেশি মাত্রায় কাজ করার পরিকল্পনা করা। এটা প্যারিস চুক্তির একটা শর্তও ছিল, যে প্রতি ৫ বছর অন্তর NDC-গুলো আরও বেশি কাজের পরিকল্পনা করে এগোবে। তবেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট ঠেকানো সম্ভব।

তিন. আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল— গরীব দেশগুলিকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া, ধনী দেশগুলির পক্ষ থেকে। এর পেছনে কারণ স্পষ্ট— জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটের জন্যে প্রধানত ধনী দেশগুলিই দায়ী, গত ২০০ বছর অত্যধিক পরিমাণে কয়লা তেল আর গ্যাস জ্বালিয়ে তারা ধনী হয়েছে। সঙ্গে বিভিন্ন গরীব দেশকে কলোনি বানিয়ে তাদের সম্পদ লুঠ করে নিজেদের উন্নত করেছে। গরীব দেশগুলির এই সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল না। যদিও গত ২৫-৩০ বছর চিন, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া… এদের মতো দেশ নিজেদের গ্রিনহাউস গ্যাস উৎসর্জন অনেক বাড়িয়েছে। আজ চিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দূষণকারী দেশ।

প্যারিস চুক্তিতে এই আর্থিক সাহায্য বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঠিক করা হয়েছিল। যেটা ২০২০ থেকে প্রতি বছর দেওয়ার চুক্তি। কিন্তু ধনী দেশগুলির টালবাহানাতে এখনও অনেক কম অর্থ আসছে, আর জলবায়ু সঙ্কটের ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। এটা একটা বড় বিষয় ছিল কপ-২৬-এর সামনে। এই আর্থিক সহায়তা বিনা গরীব দেশগুলির পক্ষে তাদের এনার্জি সিস্টেম আর অর্থব্যবস্থাকে কম উৎসর্জনকারী করা সম্ভব হবে না।

চার. আর একটি বড় বিষয়, যাকে বলা হয় ‘Loss and Damage’। এর মানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে গরীব দেশগুলি এবং তাদের গরীব মানুষ, তাদের এই ক্ষতির পরিমাণ কিছু ধনী দেশগুলির দেওয়া প্রয়োজন, ক্ষতিপূরণ হিসাবে। ২০১৩-য় পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে যে কপ-১৯ হয়েছিল, সেখানে এই চর্চার ওপর এক ওয়ারশ মেকানিজম তৈরি হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে ধনী দেশগুলি একদম বেঁকে বসেছে— এটা মেনে নেবে না তারা।

এখন এক নজর দেখা যাক কী ফল পাওয়া গেল কপ-২৬ থেকে—

এক. জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট ঠেকাতে যে পরিমাণ উন্নতি সব বড় দেশের প্ল্যান বা NDC-তে প্রয়োজন ছিল, তার থেকে আমরা এখনও অনেক দূর। প্যারিসের NDC-গুলোকে একত্র করলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২.৭-২.৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়বে ২০২১-এর মধ্যে, এই হিসাব ছিল। গ্লাসগো কপ-২৬-এর পর হিসাব দেখাচ্ছে যে এটা কমে ২.৪ ডিগ্রি হয়েছে। অর্থাৎ, প্রগতি হল কিছুটা, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এখনও অনেক কম। তাই অনেক ছোট আর গরীব দেশ হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। অনেক দ্বীপের দেশ, যারা আতঙ্কিত কারণ তাদের পুরো দেশটাই সমুদ্রের বাড়তে থাকা জলস্তরের নিচে তলিয়ে যাবে— ক্ষোভ আর দুঃখ নিয়ে ফিরেছে। আর অনেক ‘নেতা’ বলেছেন যে আগামী বছর মিশরের কপ-২৭-এ অনেক বেশি উন্নত প্ল্যান নিয়ে ফিরে আসতেই হবে, যদি পৃথিবীতে জীবন তছনছ করা ঠেকাতে হয়।

দুই. নিজেদের গ্রিনহাউস গ্যাস উৎসর্জন আর বিলাসী জীবনযাত্রা অনেক কম না করে, কার্বন বাজারের ধোঁকা দেওয়ার হিসাব অ্যাকাউন্টসের খাতাতে তুলে যেসব প্ল্যান হল গ্লাসগোতে, তাতে বহু গরীব দেশের সবচেয়ে পেছনে পড়ে থাকা মানুষ আরও মার খাবেন। বিশেষ করে যারা জঙ্গল বা ছোট কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবন চালান। গ্লাসগোতে কার্বন বাজারের নিয়ম চূড়ান্ত হয়ে গেছে— প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬-এর মধ্যে। তাই এবার কার্বন বাজারের ফ্লাড গেট খুলে যাবে, কার্বন অ্যাকাউন্টিং-এর খেলা জমে যাবে, অজস্র পয়সা কামাবে কনসালট্যান্ট, সার্টিফিকেট দেওয়ার সংস্থা, এক্সপার্ট, আর বড় কর্পোরেশন। সরকার খুশি, বিজনেস খুশি, গরীব মানুষ আরও মার খাবেন।

তিন. ক্লাইমেট ফাইন্যান্স বা জলবায়ু পরিবর্তন সঙ্কটের আর্থিক সহায়তা বিষয়ে এখনও নানা সমস্যা রয়ে গেল। বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো ছোট সংখ্যাও পুরো হচ্ছে না,  সরাসরি গ্রান্টের জায়গাতে লোন এবং লিভারেজড “সাহায্য”কেও ওরা ক্লাইমেটের আর্থিক সাহায্য বলে চালাচ্ছে। এটাও বোঝা প্রয়োজন যে বিশ্বের সমস্ত দেশকে সবরকমের ক্লাইমেট সংক্রান্ত আর্থিক সাহায্যের জন্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আজকের হিসাবে অত্যন্ত কম। তুলনা করুন— মোদী সরকারের ফ্যান্সি প্রোজেক্ট মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ মাত্র ৫০৮ কিলোমিটার এক বুলেট ট্রেন প্রোজেক্টের বাজেট ১৭-১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!! এই ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের হিসাব শুরু হয়েছিল ২০১০-এ, তারপর এগারো বছর চলে গেছে, অর্থের মূল্য কমেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়েছে, কিন্তু ১০০ বিলিয়নের হিসাব বাড়েনি!!

চার. লস এবং ড্যামেজের জট এবারও খুলল না। ধনী দেশগুলো জানাল তারা জলবায়ু সঙ্কটের ক্ষতির সামনে গরীব দেশের মানুষকে “টেকনিক্যাল সাহায্য” দেবে। আহা, কত সহানুভূতি!

পাঁচ. কপ-এর শেষ দিন ১২ নভেম্বর যখন গ্লাসগো প্যাক্ট-এর খসড়া পেশ করা হল, তাতে কয়লা ব্যবহারকে ধীরে ধীরে শূন্যতে নিয়ে আসার কথা ছিল। যদিও তেলের গ্যাসের বিরুদ্ধে কিছুই বলা হয়নি। চিন আর ভারতের শেষ মুহূর্তে বাগড়া দেওয়াতে এই প্রস্তাবও ভেস্তে গেল। অর্থাৎ কয়লা ব্যবহার আমরা বন্ধ করব না, শুধু কিছু কম করব! তাতে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট আরও খারাপ হোক, কয়লা কোম্পানিদের মুনাফা অর্জন পুরো চলতে থাকবে। সেটা বেশি জরুরি, জীবন নয়!

ছয়. অনেক বছর থেকে মেনে নেওয়া সিদ্ধান্ত, যে গরীব দেশগুলো এই সঙ্কট সৃষ্টি করেনি, করেছে ধনী দেশ— তাই তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি এর সমাধানের জন্যে। আর জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বালিয়ে তারাই ধনী হয়েছে, অর্থাৎ তাদের এই সঙ্কটের বিরুদ্ধে কাজের শক্তিও বেশি। একে বলে “Common But Differentiated Responsibility, with Respective Capacities” বা CBDR-RC। এবারের শিখর সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তকেও জল মিশিয়ে পাতলা করা হয়েছে। বলা হল— “Common and Shared Responsibility”, অর্থাৎ “differentiation” প্রায় বাদ চলে গেল!

কিছুই কি ভালো হয়নি গ্লাসগো কপ-২৬-এ? সেটা নয়— কিছু ছোটখাট অগ্রগতি তো হয়েইছে—

এক. একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ২০৩০-এর মধ্যে পৃথিবীতে সমস্ত বনজঙ্গল ধংস করা বন্ধ করা হবে। আর এর জন্য ধনী দেশগুলো পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে। আশ্চর্য এই যে, মহান ভারত সরকার এতেও রাজি নয়, সই করেনি তারা এই চুক্তিটিতে! বন সম্পদের ব্যবসা বন্ধ করা নিয়ে যেহেতু এতে কথা আছে, তাই ভারতের মহানুভব সরকার এতে নারাজ!

দুই. যেমন আগেই লিখেছি, আগের থেকে কিছু ভালো অ্যাকশন প্ল্যান বা NDC পাওয়া গেল, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এখনও অনেক অনেক কম। আগামী বছর মিশরে কি অনেক উন্নত প্ল্যান আসবে? খোলা প্রশ্ন।

তিন. আরও একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কপ-২৬-এর ফলে— মিথেন বা CH4, যেটা অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস, আর কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকে ৮৫-৯০ গুণ বেশি গরম করতে পারে কম সময়ে, সেই মিথেনকে ৩০ শতাংশ কম করা হবে ২০৩০-এর মধ্যে। এটা একটা ভালো পদক্ষেপ, কিছুটা অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাবে সঙ্কটের সামনে। “অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি”— ভারত সরকার এতেও রাজি নয়। স্বাক্ষর করল না তারা গ্লোবাল মিথেন প্লেজ-এ!! কারণ? আমাদের কৃষি অর্থনীতির নাকি ক্ষতি হবে!

চার. আমেরিকা, যে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রিনহাউস গ্যাস উৎসর্জনকারী দেশ, তারা ফিরে এল এই চুক্তিটির আওতায়, গ্লাসগো কপ-এর আগেই। ট্রাম্পের শাসনকালে এর বাইরে চলে গিয়েছিল আমেরিকা।

কিছু ছোটখাট অগ্রগতি, বেশ কিছু হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে ২০,০০০-এর বেশি লোক, যারা পৃথিবীর ১৬০-১৭০টি দেশ থেকে এসেছিলেন গ্লাসগোয় কপ-২৬-এ অংশ নিতে, ফিরে গেছেন নিজের নিজের দেশে।

কিন্তু একটা বড় পাওনা— এক লক্ষেরও বেশি মানুষ যেভাবে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা আর বরফঠান্ডা বৃষ্টিতে, হাওয়ার প্রকোপ ভুলে ৬ নভেম্বর গ্লাসগোর সমস্ত রাস্তা জুড়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন, প্রত্যেক দিন যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে জলবায়ু সঙ্কটের ন্যায়পূর্ণ সমাধান চেয়েছেন, যেভাবে ২০-২৫০০০ বাচ্চা এবং অল্পবয়সিরা রাস্তায় নেমে দাবি করেছে যে তাদের সবার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা হোক, মুনাফা কমানোর অর্থনীতি রাজনীতি শেষ হোক… সেটা আগামী দিনের একটা আরও বড় সংঘর্ষের ইঙ্গিত করছে। আর ভারতের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন তো দেখিয়ে দিল যে জনতা যখন জাগে আর সংঘর্ষের পথে আসে, তখন কোনও ভ্রষ্ট শক্তিই তাকে আটকাতে পারে না।

সেই আশার সঙ্গে……