অনর্ঘ মুখোপাধ্যায়
লেখক ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে মগ্ন, কথা ও সুরে সঙ্গীতস্রষ্টা, একটি বাংলা ব্যান্ডের ভোকালিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও পিয়ানিস্ট। সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ও টেকনিকাল বিষয়ে যেহেতু সকলে সমানভাবে অবগত নন, অবগত থাকার কথাও নয়, তাই সকল পাঠকের সুবিধার্থে গত পর্বগুলির মতো এই পর্বে আবারও লেখক নিজে পিয়ানো বাজিয়ে এবং গেয়ে কয়েকটি অডিও ক্লিপের মাধ্যমে বিভিন্ন সঙ্গীতকারদের গানগুলিকে বিশ্লেষণ করেছেন। আগ্রহী পাঠক সেই অডিও ক্লিপগুলি শুনে নিতে পারেন।
পূর্ব প্রকাশিতের পর
নজরুলের হাত ধরে বাংলা গানের জগতে যে কজন যশস্বী সঙ্গীতজ্ঞ পদার্পণ করেছেন, কমল দাশগুপ্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খান, কাজী নজরুল ইসলাম, কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং দিলীপকুমার রায়ের কাছে ভারতীয় সঙ্গীত আর HMV-র অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টর নিউম্যানের কাছ থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তালিম নেন। ভারতীয় আর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যৌথ প্রভাবেই তাঁর একেকটা কম্পোজ়িশন হয়ে উঠেছে কালজয়ী। “তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন” গানে সুর দেওয়ার সময়ে মাইনর পেন্টাটোনিক (minor pentatonic) স্কেলের সঙ্গে কাফি ঠাটকে মিলিয়েছেন (অর্থাৎ অন্ধভাবে ভারতীয় কিংবা পাশ্চাত্যের সঙ্গীতশৈলীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করে, যেখান থেকে যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকু উপাদান ব্যবহার করছেন)। “কতদিন দেখিনি তোমায়” গানটার মধ্যে একদিকে যেমন ভৈরবী এবং আশাবরী ঠাট (রাগ নয়, “ঠাট”) প্রয়োগ করেছেন, তেমনই গায়কিতে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সমসাময়িক পাশ্চাত্য সঙ্গীতের গায়নশৈলী। “পৃথিবী আমারে চায়” গানটা তো পুরোপুরি পাশ্চাত্যের স্কেলে নির্মাণ করেছেন— রাগরাগিণীর ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে, তদুপরি, গানের প্রিলিউডে স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা আর ফ্ল্যুট অর্কেস্ট্রায় বেজে উঠছে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আন্দান্তে (Andante) মুভমেন্ট। “এমনই বরষা ছিল সেদিন” গানে কমলবাবু যখন শুদ্ধ এবং কোমল ধৈবত ব্যবহার করেছেন, তখন একটা ব্লুজ়্ (Blues)-এর স্কেলকে প্রয়োগ করেছেন। তিনি যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য “ভেবেছিনু চিরদিন, তুমি রবে এ জীবনে” আর “জানি জানি একদিন ভালোবেসেছিলে মোরে” গানদুটোয় সুর করেছিলেন, তখন গজলের আঙ্গিক ব্যবহার করলেন গোটা গান জুড়ে। কমল দাশগুপ্ত যখন তালাত মাহমুদের জন্য সুর করেছেন “দুটি পাখি দুটি তীরে” গানে, সেখানে খাম্বাজ বিলাবল আর কল্যাণ ঠাটের মেলবন্ধন দেখা গেছে এবং “ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে” গানের মধ্যে দেখা যাচ্ছে কাফির সঙ্গে খাম্বাজ আর পিলু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
‘শেষ উত্তর’ সিনেমাতে তাঁর কানন দেবী যখন গাইছেন “তুফান মেল যায়”, তখন আবহে স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা স্ট্যাকাটো (Staccato)-তে ধরে রাখছে ছন্দ, আর আরেকটা বেহালার সোলোতে তারসপ্তকে সা আর গা স্বরদুটো বেজে চলেছে এবং এই পুরো বিষয়টা একটা চলন্ত ট্রেনের কল্পচিত্র সৃষ্টি করছে। ঐ একই সিনেমাতে “আমি বনফুল গো” গানটার প্রিলিউড শুরু হচ্ছে হাবানেরা (Habanera)-র ছন্দে আর তারপর যখন কানন দেবীর ভোকালের অংশটা শুরু হচ্ছে, তখন তাতে মিশছে আট মাত্রার কাওয়ালির ছন্দ।
নজরুল তাঁর বহু গানে সুরারোপ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন কমলবাবুকে। সেখানেও কমল দাশগুপ্ত যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। নজরুলের গানের মধ্যে যাঁরা যথার্থভাবে আধুনিকতাকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন, কমল দাশগুপ্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যূথিকা রায়ের সঙ্গে তিনি যখন “রুমুঝুম রুমুঝুম নুপুর বাজে” গাইছেন, তখন সেখানে পিয়ানোতে আর্পেজিও (arpeggio) ব্যবহার করেছেন আর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আল্লেগ্রো (Allegro) চলনে ঐ আর্পেজিওকে একটা ফ্রেজ (Phrase) বেজে চলেছে স্ট্রিং অর্কেস্ট্রায়। “ওরে নীল যমুনার জল” গানটাকে সুর দিলেন কীর্তনের আদলে— রেকর্ডিংয়ের সময়ে বেজেছিল কেবল হারমোনিয়াম, খোল আর করতাল। “আমি চাঁদ নহি, অভিশাপ” গানটা, ছন্দগতভাবে, যেকোনও সচেতন শ্রোতার কানে ওয়ালৎস্ (Waltz) হিসাবে ফুটে উঠবে। এবং, এই গানেও কমল দাশগুপ্ত কিন্তু অন্ধভাবে রাগসঙ্গীতের দাসত্ব করছেন না। কমলবাবু যখন “গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়” গানে সুর দিয়েছেন, তখন অর্গ্যানে কর্ড ব্যবহার করছেন, তবলাতে দাদরা বাজালেও তাতে বাজছে ওয়ালৎস্-এর ছন্দ। ‘রাগ বাগেশ্রী’-কে কেন্দ্র করে গানটা শুরু হলেও পরে রাগ বদলে যাচ্ছে, সাময়িকভাবে অন্তরাতে গিয়ে পাশ্চাত্যের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। ঐ একই ওয়ালৎস্-এর ছন্দ “আধখানা চাঁদ, হাসিছে আকাশে” গানে ব্যবহার করেছেন, আর তার সঙ্গে প্রিলিউডে ব্যবহার করেছেন একটা আল্লেগ্রো (Allegro) মুভমেন্ট। “শঙ্কাশূন্য লক্ষ কণ্ঠে বাজিছে শঙ্খ ঐ” গানে কমল দাশগুপ্ত সরাসরি পাশ্চাত্যের সুর তো প্রয়োগ করছেন তো নিঃসন্দেহেই, সেটা রীতিমতো সৈন্যবাহিনির কুচকাওয়াজের সুর। “আমি নহি বিদেশিনী” গানে সুর দেওয়ার সময়ে কমল দাশগুপ্ত ক্রোম্যাটিক প্রোগ্রেশন ব্যবহার করেছেন এবং অন্তরা আর আভোগে ক্ষণিকের জন্য ব্লুজ়্ স্কেলকে ছুঁয়ে গেছেন। নজরুলের লেখা লিরিক্সের ওপরে কমল দাশগুপ্ত যখনই সুর দিয়েছেন, তখনই উনি একজন অনুসন্ধিৎসু উদ্ভাবক হয়ে উঠেছেন।
১৯৩০-এর দশকে বাংলা গানের জগতে আবির্ভূত হলেন অনুপম ঘটক। শুরুতে রেডিওতে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তিনি। ১৯৩২ সালে তিনি দেশ রাগের ওপরে সুর দিয়ে রেকর্ড করলেন “আজি এ শারদ বিজয়াগোধূলি”। ১৯৩৫ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও দীর্ঘদিন অবধি তিনি রাইচাঁদ বড়াল এবং বিষেণচাঁদের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন মেল এবং ঠাট আর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিভিন্ন স্কেল এবং মোড নিয়ে রীতিমত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন অনুপম ঘটক। “জাগার সাথী গো” গানে কলাবতী আর শিবরঞ্জনী রাগের মধ্যে মিশে গেছে ব্লুজ় (Blues) এবং বুগি (Boogie)-র স্কেল। আবার যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য “যতদিন তারা জ্বলিবে সুদূর নভে” গানে সুর দিয়েছেন, তখন মালগুঞ্জী রাগকে ব্যবহার করেছেন অনুপম ঘটক। আবার ঐ একই গানে কয়েক জায়গায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগের তিরোভাব-আবির্ভাবের পদ্ধতি খুব মসৃণভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁরই সুরে সুধীরলাল চক্রবর্তীর গাওয়া একটা বিখ্যাত গান ছিল “তুমি ছিলে তাই”। সেখানে রাগ জয়জয়ন্তীর সঙ্গে শিবরঞ্জনীর মধ্যে এক অদ্ভূত এবং অনির্বচনীয় সমন্বয় সৃষ্টি করেছেন অনুপম ঘটক। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমাতে “গানে মোর ইন্দ্রধনু” গানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ভোকালের অংশে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ট্রিলিং (Trilling) প্রয়োগ করেছেন তিনি, এবং ঐ সিনেমাতেই “কে তুমি আমারে ডাকো” গানে চেলোতে সৃষ্টি করেছেন শ্রুতিমধুর কাউন্টারপয়েন্ট। আবার, যখন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য উনি ঐ একই সিনেমাতেই কম্পোজ় করেছেন “আজ আছি কাল কোথায় রব?” গানটা, তখন সেখানে ব্যবহার করেছেন গজলের আঙ্গিক। ‘শ্রী তুলসীদাস’ সিনেমার জন্য তৈরি করা অনুপম ঘটকের প্রত্যেকটা গানই অনবদ্য। তার মধ্যে দুটো গান বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল “আমি তনুচন্দন বাটি” আর “লিখিনু যে লিপিখানি প্রিয়তমারে”। প্রথম গানটা, (অর্থাৎ “আমি তনুচন্দন বাটি”) তৈরি হয়েছে কীর্তনের আঙ্গিকে। কিন্তু সেখানে গোটা গানটার ছন্দকে পরিপূর্ণতা দিচ্ছে গিটারের কর্ড। “লিখিনু যে লিপিখানি প্রিয়তমারে” গানটার দুটো পর্যায়। প্রথম পর্যায়টা একদম চিরাচরিত রীতি মেনে চার স্তবক (স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী এবং আভোগী) দিয়ে তৈরি এবং প্রধানত মেলোডি-নির্ভর। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে গোটা গানের স্ট্রাকচারে অনুপম ঘটক দুঃসাহসিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। স্থায়ী শেষ হওয়ার পরেই শুরু হচ্ছে সঞ্চারী, আর সঞ্চারীর পরে আভোগী না এসে যুক্ত হচ্ছে নতুন একটা স্তবক। সর্বোপরি, প্রথম পর্যায়ে যেখানে গানটা ছিল মেলোডি-নির্ভর, এবারে সে হয়ে উঠল সিম্ফোনি-ভিত্তিক: জার্মান কম্পোজ়ার যোহান স্ট্রাউস (Johann Strauss)-এর বিখ্যাত ওভার্চার (Overture) “ডি ফ্লেডারমাউস” (Die Fledermaus)-এ যে ধরনের ডায়নামিক্স ব্যবহার করেছিলেন, দেশীয় রাগরাগিনীর ওপরে তারই দেশীয় রাগরাগিনীর প্রায় অনুরূপ প্রয়োগ করেছেন অনুপম ঘটক। দ্বিতীয়ত, প্রথম পর্যায়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একাই ভোকালের অংশটা ধরে রেখেছিলেন, কিন্তু এবারে তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন বৃন্দগায়করা আর পুরো অ্যারেঞ্জমেন্টকে ধরে রেখেছে পাখোয়াজের বোল। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে অনুপম ঘটকের মতো এহেন একজন সঙ্গীতকারের অকালপ্রয়াণের জন্য বাংলার সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্রের জগত তাঁকে বেশিদিন পেল না।
অনুপম ঘটকের হাত ধরেই বাংলা গানের জগতে এসেছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। নীরেন লাহিড়ীর সুপারিশেই অনুপম ঘটক রবীন চট্টোপাধ্যায়কে নিজের সঙ্গে সহকারী সঙ্গীত পরিচালক, ট্রেনার এবং অ্যারেঞ্জার হিসাবে কাজ করার সুযোগ দেন। অনুপম ঘটকের সঙ্গে কাজ করতে করতেই তিনি তিমিরবরণ ভট্টাচার্য্য, শচীন দেব বর্মণ, দুর্গা সেন এবং ক্ষেমচন্দ্র প্রকাশের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে তিনি যখন “সূর্য তোমার সোনার তোরণ খোলো” গানটা খাওয়াচ্ছেন ‘লালু ভুলু’ সিনেমাতে, তখন গানটার সুরসজ্জায় রাগ-রাগিনী অণ্বেষণকারী মননের শ্রোতা এবং আলোচকরা কোনও বিশেষ একটি রাগের প্রাবল্য খুঁজে পাবেন না কোনওভাবেই; বরং, পাশ্চাত্যের মাইনর স্কেলের সঙ্গে মেজর স্কেলের সহাবস্থানের ওপর ভিত্তি করে রবীনবাবু বিভিন্ন রাগের অংশবিশেষ পাশাপাশি বসিয়ে গানের ভোকালের জন্য মেলোডি তৈরি করছেন, আর তার সঙ্গে তালে-ছন্দে চলেছে ওয়ালৎস্ (Waltz)। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই ছবিতেই “মেঘঝরা লগনে”, “প্রাণঝরণা জাগল” আর “দুঃখের পথে নামলি যদি”— এই তিনটে গানে অনায়াসে হার্মোনিকা বা মাউথ অর্গান ব্যবহার করেছেন, এবং খুব সহজেই তা বাংলা গানের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে।
“যদি কোনওদিন ঝরা বকুলের গন্ধে” গানের প্রিলিউডে শুধু পাশ্চাত্যের হার্প আর ভারতের সুরমণ্ডলকে ব্যবহার করে একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আর্পেজিও (arpeggio) প্রয়োগ করেছেন: অতিসংক্ষিপ্ত, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ— গানের ভোকাল মেলোডির আবির্ভাবের ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করেছে ঐ আর্পেজিওটা। অথচ, তারপরে কিন্তু আর কখনওই হার্প-সুরমণ্ডলের যৌথ বাদন (এমনকি একক প্রয়োগ) নেই, বাকি গানটাকে ইঞ্জিনের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ভোকালিস্ট হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর বাঁশি-পিয়ানো-স্ট্রিং অর্কেস্ট্রার শিল্পীরা তাঁকে অনুসরণ করে চলেছেন। উৎসুক পাঠক-পাঠিকারা যদি স্মরণ করেন, তাহলে দেখবেন যে রবীনবাবুর মতো সুরমণ্ডলকে পাশ্চাত্যে সঙ্গীতের আদলে ব্যবহার করার মতো বৈপ্লবিক কাণ্ড সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কেউই করেননি।
“ঘুম যায় ঐ চাঁদ” গানে রাগ দেশি আর মিশ্র পিলু অবলীলায় মিশে গেছে ইওরোপীয় অর্কেস্ট্রার সুরে। “জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া” গানটায় ভৈরবী রাগ মিশেছে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের গায়ন পদ্ধতিতে। আবার সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য শৈলীতে তিনি কম্পোজ় করেছেন “এই মধুরাত শুধু ফুল পাপিয়ার”, “স্বপ্ন জাগানো রাত”, “ওগো মোর গীতিময়”, “আমি প্রিয়ারে পেয়েছি কাছে”, “ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা, এ মাধবী রাত” কিংবা “আমি আজ নতুন আমি”-র মতো গান।
‘জল জঙ্গল’ সিনেমাতে আদ্যন্ত ভারতীয় এবং ইওরোপীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিদ্বান সঙ্গীতজ্ঞ রবীন চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণভাবে পল্লীগীতির মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন। “আমি যারে স্বপন দেখি” বা “এত ফুল ফুটেছে”-র মতো গানগুলো পল্লীগীতিতে রবীনবাবুর প্রগাঢ় দক্ষতার পরিচয় বহন করে। ‘চন্দ্রনাথ’ সিনেমাতে তাঁর সুর দেওয়া “আকাশ পৃথিবী শোনে” গানটাও একই দৃষ্টান্তের পরিচায়ক।
রবীন চট্টোপাধ্যায় পল্লীগীতির সুরকে রাগসঙ্গীত এবং ইওরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে মিশিয়ে সৃষ্টি করলেন “এ শুধু গানের দিন” গানটা। গানটার স্থায়ী পুরোপুরি পল্লীগীতির সুরের সমান্তরাল পথে ক্রমবর্ধমান হয়, অন্তরার সুর কীর্তন এবং খাম্বাজ ঠাটের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ধারায়। গানটার অ্যারেঞ্জমেন্ট পুরোপুরি পাশ্চাত্য শৈলীতে নির্মিত। “আমি চান্দেরই সাম্পান যদি পাই” গানের প্রধান মেলোডি পল্লীগীতির আঙ্গিকে বাঁধা। আড়ম্বরপূর্ণ অর্কেস্ট্রেশন নেই— রয়েছে কেবল একটা গিটার আর একটা বাঁশি।
১৯৫০-এর দশক অবধি রক্ষণশীল মানসিকতার সাধারণ শ্রোতাদের কথা মাথায় রেখে ব্লুজ় বা জ্যাজ়-এর স্কেল ব্যবহার করতে হত দেশীয় সঙ্গীতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। সেখানে, ১৯৬০-এর দশকের শেষদিক থেকে বাংলা গানের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গেল গানের যন্ত্রানুষঙ্গে। ঐ সময় থেকেই একটু একটু করে বাংলার শ্রোতারা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে প্রত্যক্ষভাবে ব্লুজ়, জ্যাজ় বা রক অ্যান্ড রোলের সুর আর ছন্দে। ফলে, রবীনবাবুর কাজের সুযোগও কমে আসছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু তবুও তিনি তাঁর কর্মজীবনের শেষ দশ বছরে যে ষোলোটি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার কাজে করেছেন, তার অধিকাংশই শ্রোতাদের মন জয় করেছিল।
[ক্রমশ]