Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘ওমিক্রন’ এল প্রাকৃতিক টিকার রূপ ধরে, কোভিড-১৯ এখন সমাপ্তি পর্বে

অমিতাভ ব্যানার্জি

 

ভাষান্তর: স্থবির দাশগুপ্ত

 


বছরের শেষে করোনা ভাইরাস এল নতুন রূপ ধরে, স্বভাবেও তা আগের চেয়ে আলাদা। আমরা তার নাম দিয়েছি, ‘ওমিক্রন’। তাকে নিয়ে কোলাহল উঠেছে। করোনা যে ফ্লু-এর মতো বারবার রূপ আর স্বভাব পালটাবে তা জানাই ছিল। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘ওমিক্রন’-এর সংক্রমণ ক্ষমতা যথেষ্ট হলেও মারণ ক্ষমতা অতি সামান্যই, বা তাকে প্রায় নখদন্তহীন বললেও চলে। তাই সত্যিই যদি এমন একটি ভাইরাস আমাদের জনসমাজে ছড়িয়ে পড়ে তাতে আখেরে লাভ।

এমন আশার পিছনে তিনটি যুক্তি—
  1. ‘ওমিক্রন’ সংক্রমণ তীব্র ব্যাধির সৃষ্টি করছে না।
  2. এই সংক্রমণ অতি মৃদু, তাই করোনার বিরুদ্ধে জনসমাজে এক ধরনের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হচ্ছে।
  3. ডারউইন-এর সূত্র ধরে করোনা এবার মহামারির রূপ হারিয়ে সমাজে থেকে যাবে আমাদের সহযাত্রী বা প্রতিবেশী হয়ে।
কিন্তু অনেকে বলছেন, ‘ওমিক্রন’ এসে গেল, তাই এক্ষুনি টিকার ‘বুস্টার ডোজ’ নিয়ে ফেলা উচিত।

এই ধারণাগুলো নিয়ে সম্প্রতি, ২৯শে ডিসেম্বর, ২০২১-এ ডাক্তার অমিতাভ ব্যানার্জির সঙ্গে “নিউজনাইনলাইভ”-এর কথোপকথন হয়েছিল। তিনি দেশের একজন স্বনামধন্য জনস্বাস্থ্যবিদ, পুনের ডাক্তার ডি ওয়াই পাতিল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টার-এর কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান।

 

‘ওমিক্রন’ হল কোভিড-এর বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক টিকা। আমাদের জানানো হয়েছিল যে, কোভিড-টিকা বলে যা এখন প্রচলিত তা করোনা সংক্রমণ আটকাতে পারবে না, সংক্রমণ ছড়ানোও কমাতে পারবে না, তবে ব্যাধির তীব্রতা কমিয়ে দেবে, আর তার ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন কমবে, মৃত্যুর আশঙ্কাও কমে যাবে। এসব কথা যদি মেনে নিই তাহলে ‘ওমিক্রন’-এর বিরুদ্ধে টিকার দাবিটা দাঁড়াচ্ছে কোথায়? এই সংক্রমণে যদি তীব্র ব্যাধিই না-হয় তাহলে টিকা আলাদা করে কী উপকার করবে? বরং বলতে হয় যে, ‘ওমিক্রন’ টিকাকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ করে দিল, টিকার যা করণীয় ছিল ‘ওমিক্রন’ সে-কাজটাই করে দিল। তার মানে, প্রাকৃতিকভাবেই আমরা প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করছি।

তা সত্ত্বেও যদি টিকা নিয়ে জবরদস্তি করা হয় তাহলে তা টিকার অপচয়। তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় রব উঠেছে, এবার আমরা ধীরে ধীরে আগেকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাই। আতঙ্কবাণী প্রচার বন্ধ হোক, কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন ইত্যাদি সর্বনেশে কীর্তিকলাপ বন্ধ হোক… এসব করে যে কোনও উপকারই হয় না তা বারবার প্রমাণিত। ‘ওমিক্রন’ আমাদের ক্ষতি করতে আসেনি, বরং তার আগমনে আমাদের উপকারই হবে। সংক্রমণের সংখ্যা যে এখন বাড়বে তা ঠিক, কিন্তু তা নিয়ে আমরা যদি জনসমাজে আতঙ্ক ছড়ানো বন্ধ না-করি তাহলে লোকে সামান্য কারণেই ভয় পেয়ে হাসপাতালে ছুটবে। তাতে আমাদের স্বাস্থ্যপরিষেবা আবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, যাদের সত্যিই দরকার তারা হাসপাতালে জায়গা পাবে না। এমন বিধ্বস্ত অবস্থা সমীচীন হবে না।

‘ওমিক্রন’ একটা সাধারণ, মরশুমি ফ্লু-এর মতোই আচরণ করবে আর তাতে প্রমাণিত হবে যে, কোভিড-১৯ অবশেষে আমাদের সহযাত্রী হয়ে গেল। এটা ডারউইন-কথিত জীবজগতের একটা প্রাকৃতিক সূত্র— যে-ভাইরাস অতি-মারক সে বেশি ছড়াতে পারে না, কেননা তার মারণক্ষমতা বেশি বলে সে নিজেও মারা পড়ে। আর যে-ভাইরাসের মারণক্ষমতা নেই বা অতি সামান্য সে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে; তাতে মানুষ যেমন মারা যায় না তেমনি ভাইরাসও বেঁচে থাকে। আমরা চাই বা না-চাই, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে ভাইরাসের নিয়মই অমন, তারও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমরা অজান্তেই তাকে বরণ করে নিই, তাকে নিবিড়ভাবে চিনে নিই; তাই সে আমাদের নতুন কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

এই ধরনের ভাইরাস আমাদের শরীরে তেমন কোনও কষ্ট বা উপসর্গের সৃষ্টি করে না, তাই আমরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখি, আর এই সুযোগেই সে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। যে-ভাইরাস আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবে প্রকৃতি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে, ছড়াতেও দেবে। ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’-এর এই যে সূত্র তাতে ভাইরাস এবং মানুষ উভয়েরই উপকার হয়। এইভাবে প্রকৃতি প্রাণীসমাজে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই “ছড়াচ্ছে, ছড়াচ্ছে”, বলে হাহাকারের কিছু নেই। এমনিতেই করোনা ভাইরাস আমাদের জনজীবনে ক্রমশ সহযাত্রী হিসেবে থেকে যাচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধক্ষমতাও তৈরি হচ্ছিল; ‘ওমিক্রন’ সে-কাজটাকেই ত্বরান্বিত করবে, দুর্যোগের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

মানবসমাজ সমসত্ত্ব না, তাই দেশে দেশে ভাইরাসের আচরণ ভিন্নতর হয়। ‘ওমিক্রন’-এর আগে এসেছিল ‘ডেল্টা’। আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে ‘ওমিক্রন’ ‘ডেল্টা’কে সরিয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছে, সংক্রমণ ছড়িয়েছে প্রচুর। কিন্তু ভারতেও যে অমনই হবে তা না। কারণ, এখানে জনসংখ্যা অনেক বেশি, আর তার মধ্যে ৭০ বা ৮০ শতাংশ মানুষ কম-বেশি, জেনে বা না-জেনে সংক্রমিত হয়ে গেছে। সংক্রমণের ফলে তারা ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে, টিকা বাজারে আসার আগেই। পরীক্ষায় তা প্রমাণিত। যারা আজও সংক্রমিত হয়নি তারাও এবার ‘ওমিক্রন’-এ কম-বেশি সংক্রমিত হবে, জেনে বা না-জেনে। তাতে জন-প্রতিরোধক্ষমতা আরও বেড়ে যাবে।

টিকা আমাদের প্রতিরোধক্ষমতা দিতে পারে; কিন্তু প্রাকৃতিক সংক্রমণের ফলে আমরা তার চেয়ে ১৩ গুণ বেশি প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করতে পারি। একথাও পরীক্ষায় প্রমাণিত। তাই যে-সংক্রমণ আমাদের তেমন ক্ষতি করে না বরং প্রতিরোধক্ষমতা দেয় তাকে নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো অন্যায়। তাই কথায় কথায় ইউরোপ আর আমেরিকার দিকে তাকানোর অভ্যাস আমাদের বদলাতে হবে; তাদের সঙ্গে আমাদের মিল খুবই কম। তার চেয়ে বরং আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর নজর রাখা দরকার, তাদের সঙ্গেই আমাদের মিল বেশি।

আমাদের আরেকটি বদভ্যাস হয়েছে, ‘মিউটেশন’ নিয়ে পরিতাপ করা। ‘স্পাইক প্রোটিন’ নিয়েও অনেক কথা শুনি। অথচ ভাইরাসে-এর শরীরে মিউটেশন-এর পরিমাণ ১ বা ২ শতাংশের বেশি না; শরীরের ৯৮ শতাংশে বিরাট কোনও পরিবর্তন হয় না। যে-টিকা এখন বাজারে এসেছে তার লক্ষ্য শুধু ‘স্পাইক প্রোটিন’ যা ভাইরাস-এর মাত্র ১ বা ২ শতাংশ। কোভিড-১৯ সংক্রমণ মানে কিন্তু শুধু ওই ‘স্পাইক প্রোটিন’ সংক্রমণ না, পুরো ভাইরাসটাই তার জন্য দায়ী। তার মানে, যে সংক্রমিত হল তার শরীর কিন্তু পুরো ভাইরাসটার সঙ্গেই পরিচিত হল, পুরো ভাইরাসটার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ তৈরি হল। তাহলে যে-টিকা বাজার ছেয়ে ফেলেছে তার বদলে পুরো ভাইরাস থেকে যদি কোনও টিকা তৈরি হয় সেটা হবে এগুলোর চেয়ে উন্নত, বেশি উপকারী।

‘ওমিক্রন’-এ সংক্রমিত হওয়া মানে, পুরো ভাইরাসটারই সংক্রমণ, শুধু তার ‘স্পাইক প্রোটিন’-এর সংক্রমণ না। তাহলে যারা এখনও টিকা নেয়নি তাদের যদি এখন সংক্রমণ হয় তারা বরং পুরো ভাইরাসটার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধক্ষমতা পেয়ে যাচ্ছে। সেটা তো ভালোই। তাই টিকার ‘বুস্টার ডোজ’ নিয়ে যে-কোলাহল চলছে তার কোনও যুক্তি নেই। টিকার দু-দুটো ডোজ নিয়ে যদি উপকার না-হয় তাহলে বুস্টারের পর বুস্টার নিয়েও কাজ হবে না। তবু যদি তা দিতেই হয় তবে তা অতিবৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো; সংক্রমণের ফলে তাদের মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি, তাই তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দিকেই নজর রাখা ভাল। জনস্বাস্থ্যের নীতি আর অর্থনীতির কথা ভাবলে এটাই যুক্তিগ্রাহ্য পথ।