প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
১৪ মার্চ। ২০০৭।
সারাজীবন তারিখটা মনে রেখে দেবে বনি।
মাধ্যমিক শেষ হয়েছে দশদিনও হয়নি। এখন অনন্ত ছুটি। বনি জানে তার বন্ধুরা ইতিমধ্যেই টিউশন নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। যারা সায়েন্স নেবে, তাদের দেমাক চিরকালই বেশি। বনি এসব নিয়ে চাপ নেয় না। যতই ওর বাবা-মা মাঝেমধ্যেই— কৌশিক অমুক স্যরের কাছে ভর্তি হল, শশাঙ্ক অঙ্কের ভীতি কাটাতে আর্যভট্ট কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে যেখানে প্রায় মিলিটারি শাসন চলে— এ-জাতীয় খবর ওর কানে তুলুক না কেন; বনি থোড়াই কেয়ার করে। বনি এখন অনেকদিন ছুটি কাটাবে। টেস্টের পরের তিনমাসের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেতে হবে ওকে। বাড়িতে বসে বসে অঙ্ক করার বিভীষিকা, প্রতিদিন একবার, কখনও কখনও দিনে দুবার করে হস্তমৈথুন ছাড়া কোনও বিনোদন নেই!
না। আরেকটা বিনোদন ছিল বটে বনির।
ওর দাদা বাপ্পা-ই ওকে নেশা ধরিয়েছে সিনেমা দেখার। ৩৫ টাকা দিয়ে ভিসিডি আর ৭০ টাকা দিয়ে ডিভিডি কেনার নেশা ওদের পেয়ে বসেছিল। আর এমপিথ্রি কিনত ৬০ টাকায়। শ্যামবাজার চত্বরে পা রাখলেই মনটা আনচান করত সিডি কেনার জন্য। বাপ্পা আর বনির ঘর চিলেকোঠায়। ওখানেই ওদের কম্পিউটার। বনির রুটিন ছিল সকালে উঠে টেস্টপেপার খুলে বসা। আর পাশাপাশি কম্পিউটারে একটা করে এমপিথ্রি চালিয়ে রাখা। বেলা ওতেই কেটে যেত। স্নান-খাওয়া সেরে তারপর দুপুরে একটা সিনেমা দেখা। তারপর বিকেলে আবার টেস্টপেপার খুলে বসা। ততক্ষণে বাপ্পা চলে আসত কলেজ থেকে। এবার সারা সন্ধে বাপ্পার দায়িত্ব ছিল বনির ইংরেজি আর অঙ্কের দেখভাল করা, অবশ্যই যেদিন যেদিন বাপ্পা বাড়ি থাকত। নটার মধ্যে খেতে দেওয়া হত বনিকে। তারপর বাপ্পাকে পটিয়েপাটিয়ে আরেকটা সিনেমা দেখা, তারপর ঘুমোতে যাওয়া। এমপিথ্রি আর ভিসিডি-ডিভিডিতে এইভাবে মজে থেকে ওই ঘরবন্দি ফ্রাস্ট্রেশনের কিছুটা মোকাবিলা করত বনি।
বাপ্পার জীবন অন্যরকম। সে এখন কলেজে পড়ে। একটা ব্যান্ড করেছে ওরা বন্ধুরা মিলে। ব্যান্ডের নাম ‘রাইফেল’। বাপ্পা বাজায় ইলেকট্রিক গিটার। ওর বন্ধু জিদান বাজায় ড্রামস। বাপ্পা আর জিদান ব্যান্ডের বাইরেও নিজেদের মতো করে গান গাওয়ার চেষ্টা করে। এই চিলেকোঠার ঘরে মাঝেমধ্যে নিজেদের মতো করে রিহার্সাল দিত ওরা। বনির টেস্টের পর কিছুদিন সেটা বন্ধ ছিল। বনির পড়াশোনার জন্য। এখন আবার শুরু হয়েছে। আর রিহার্সাল হলেই ওই ঘর থেকে বনিকে বের করে দেয় বাপ্পারা।
আজ বাপ্পারা রিহার্সাল শেষ করে গঙ্গার ধারে ঘুরতে গেছে। বনি দুপুরে নীচের ঘরে কিছুক্ষণ ঘুমোনোর চেষ্টা করে অস্থির হয়ে তারপর ঘর থেকে বেরোল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখল, বাপ্পা আর জিদান বেরিয়ে যাচ্ছে। ও চিলেকোঠার ঘরের দিকে রওনা হল উলটোমুখে। ওরা বেরোচ্ছে মানে কিছুক্ষণ ফাঁকা থাকবে ঘরটা।
বাপ্পা-বনিদের বাড়ি চিৎপুর রোডের ওপর। প্রায় দুশো বছরের পুরনো বাড়ি। উত্তরের শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ির একটা চেনা কাঠামো রয়েছে। তিনতলা বাড়িতে ওদের সব মিলিয়ে বারোটা ঘর। ওদের বাড়ির নিচের তলাটায় ঠাকুর তৈরি হয় পুজোর আগে। আরেকপাশে একটা লেদের কারখানা আছে। কিছু বিহারি শ্রমিক থাকে নিচের তলা সংলগ্ন উঠোনে। দোতলায় পার্মানেন্ট ভাড়াটে থাকে দু ঘর। আর তিনতলা আর চিলেকোঠা মিলিয়ে ওরা। চৌকো বারান্দা। অলিন্দের ওপর ঘরগুলো ছড়িয়ে।
চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে বনি বাপ্পার সিডির বাক্স খুলল। কী দেখা যায়… কী দেখা যায়…
অনেকক্ষণ এই সিডি ওই সিডি করে শেষমেশ বোর হয়ে ‘জুরাসিক পার্ক টু’ দেখতে বসেছিল বনি। ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’। এই যে শহরে ডাইনোসর ঢুকে পড়ে, এই ক্যাজরাটা হেবি লাগে বনির।
কিন্তু অত অবধি সিনেমাটা এগোনোর আগেই ঘটল ঘটনাটা।
প্রথমেই কম্পিউটারটার পেছনদিকে চার-পাঁচটা বিদ্যুৎঝলকের মতো কারেন্ট খেলল। তারপর ফটাস করে একটা আওয়াজ হল আচমকা। কম্পিউটার বন্ধ হল, মেশিনের পেছন থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল।
এত অবধিই বনিকে শক দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এরপরই ঘটল সবচেয়ে আশ্চর্য আর ব্যাখ্যার অতীত ঘটনাটা।
গোটা চিলেকোঠার ঘর হঠাৎ ঘুরঘুট্টি অন্ধকার হয়ে গেল ভর বিকেল চারটের সময়। চারদিকে তখন আলো। জানলা হাট করে খোলা। অথচ…
এবার জানলার দিকে তাকিয়ে বনি স্তব্ধ হয়ে গেল।
জানলার বাইরে নিশুত রাতের আকাশ। না। রাতের আকাশ এমন অস্বাভাবিক রকমের অন্ধকার হয় না।
এবার হঠাৎ একটা আশ্চর্য আলোতে ভরে গেল চিলেকোঠা। দশ সেকেন্ডের জন্য। সঙ্গে একটা বোঁ বোঁ করে অসহ্য আওয়াজ। বনির সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন একসঙ্গে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। বনি চোখ বন্ধ করে কান চাপা দিল।
মুহূর্তে সব স্বাভাবিক। আলো ফিরে এল আবার। একটু আবছায়া হয়ে যেন। বিকেলটা হঠাৎ কিছুটা যেন গড়িয়ে গেছে সন্ধের দিকে।
বনির কানে তালা লেগে যাওয়ার পরের অনুভব। চোখটাও যেন ব্যথা করছে খুব।
ও সভয়ে তাকাল কম্পিউটারের দিকে।
বনি কি ভুল দেখছে?
কম্পিউটার চলছে নিজের ছন্দে, টি-রেক্স পাড়ি দিয়েছে স্যান ডিয়েগোর দিকে।
কী ঘটে গেল এইটুকু সময়ে? ও কি স্বপ্ন দেখছিল? তা কি আদৌ সম্ভব?
বনি কিছুক্ষণ থমকে রইল।
আজকের দিনটা রেডলেটার ডে হয়ে রইল ওর জন্য। কারণ এই দিনটাতেই বনির জীবনের মোড় ঘোরা শুরু হল।
চক্ররেল গেলে ডোমবস্তির ঘরগুলো থরথর করে কেঁপে ওঠে। ৩১ক হঠাৎ বস্তি— এই বস্তির সরকারি খাতায় নাম। হপ্তায় হপ্তায় শনিপুজো, শেতলাপুজোতে সরগরম থাকে এই বস্তিটা। এখনও এমন কিছু একটা পুজো হচ্ছে। তারস্বরে মাইকে বাজছে, …জালিম নজর হটা লে/বরবাদ হো রহে হ্যায় জি/তেরি আপনি শহরওয়ালে। ডিজে সাউন্ড ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ নতুন। এই সাউন্ডে এমনিতেই চারপাশে কেমন একটা কাঁপুনি ধরে। তার মধ্যে চক্ররেল গেল। ডোমবস্তির ছোট ঝুপড়ি ঘরটায় যেন একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়ে গেল।
সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ লোকটা একমনে বই পড়ছিল গদিখাটানো খাটিয়ায় শুয়ে। এই প্রায়-ভূকম্পন তাকে নড়াতে পারেনি একচুলও।
কিন্তু এত আওয়াজে সে খেয়াল করেনি যে, দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
–আদিনাথদা!
ভরাট গলার আওয়াজটা শুনে মুখ তুলল আদিনাথ রায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার এককালের ভাবশিষ্য, হিপি আস্তানায় ড্রাগ নিয়ে পড়ে থাকা যে বখে যাওয়া বড়লোকের ছেলেকে হাতে করে তৈরি করেছে সে। রোহিতাশ্ব মজুমদার।
নকশাল আমলের মাঝে একসময় পুলিশের ত্রাস হয়ে ওঠা পাঁচজনের মধ্যে আদিনাথের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কমরেড রোহিতাশ্ব এখন মধ্য-ষাটের প্রৌঢ়, রয়টার্সের সাংবাদিক ছিল দীর্ঘদিন, এখন অবসর নিয়ে দেশে ফিরে ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফি করে বেড়ায়। আদিনাথদের সঙ্গেই পুলিশের খাতায় রোহিতাশ্বর নাম উঠেছিল বটে, কিন্তু বামেরা ক্ষমতায় আসার পর সেই মামলা প্রত্যাহৃতও হয়। তাছাড়া রোহিতাশ্ব, আদিনাথ, তপন বা অঞ্জন-রঞ্জন, অর্থাৎ, ন্যাংটা নকশাল নামে খ্যাত দুই ভাই— এদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেউ করেওনি বিশেষ খোঁজ। পার্টির থেকে বিচ্ছিন্ন কেবল পুলিশ মারার অভিযান চালিয়েছিল ওরা, সেই অভিযানের কোনও রাজনৈতিক মূল্য ওদের কমরেডদের কাছে তখনও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু ওরা জানত, ওদের এই বিক্ষিপ্ত কর্মসূচি সফল হলে মরা আন্দোলন একটু হলেও গতি পেত। রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নেরও যোগ্য জবাব হত তা।
আদিনাথ কিছুক্ষণ রোহিতাশ্বকে দেখল আপাদমস্তক। রোহিতাশ্বর পরনে একটা নেভি ব্লু ফুল শার্ট, হাতা গুটিয়ে পড়া। একটা জিনসের প্যান্ট, আর শার্টের ওপর একটা হাতকাটা ফোমের জ্যাকেট। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। কাঁধ থেকে একটা লেদারের ব্যাগ নেমে এসেছে। অন্য কাঁধ থেকে ঝুলছে দামী ক্যামেরা। সুদর্শন যৌবনেও ছিল রোহিতাশ্ব, এই বয়স বাড়ার পরের চেহারায় যে সৌম্য ভাবটা ফুটে উঠেছে, তাতে যেন আরও জেল্লা বেড়ে গেছে ওর।
রোহিতাশ্বর চোখেমুখে একটা আশ্চর্য বিস্ময়। সে সামনে দেখছে তার যুবাবয়সের হিরোকে। যার সঙ্গে পঁয়ত্রিশ বছর দেখা হয়নি ওর।
আদিনাথের মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল।
–পালিশ বেড়েছে দেখছি!
–আদিনাথদা! এ কী চেহারা হয়েছে তোমার! আর হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হিয়ার?
আদিনাথ কথার উত্তর না দিয়ে বলল, তুই যে মেলটা পেয়ে সত্যিই এতদূর চলে আসবি, ভাবিনি!
রোহিতাশ্ব ঘরের আশপাশ দেখে বলল, মনে তো হচ্ছে সন্ন্যাসীর জীবন কাটাচ্ছ, মেলটা করলে কোথা থেকে?
আদিনাথ এবার একটা টুল টেনে এনে বলল, তুই তো জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিস। আতিথেয়তা তেমন করতে পারব না, কিন্তু তাতে তোর খুব ট্রাবল হবে বলে মনে হয় না। এই টুলটায় বোস আগে। নয়তো খাটিয়াতেও বসতে পারিস। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো এত কথা হয় না।
রোহিতাশ্ব একটু হেসে টুলটায় বসল।
আদিনাথ পর্দা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কাউকে একটা দুটো লিকার চা দিতে বলল, আদা দিয়ে, চিনি ছাড়া। তারপর এসে রোহিতাশ্বর মুখোমুখি বসল, খাটিয়ায়। ওর দিকে চেয়ে বলল, তোর দামী সিগারেট একটা দিবি?
রোহিতাশ্ব একটুক্ষণ আদিনাথের দিকে চেয়ে থেকে পকেট থেকে গাবদা মার্লবোরোর প্যাকেট বের করে সেখান থেকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল আদিনাথকে, আদিনাথ সিগারেটটা হাতে নিয়ে একটু ঠুকে নিল তালুর ওপর। রোহিতাশ্ব ঠোঁটের কোণে একটা সিগারেট চেপে ধরে লাইটার জ্বালিয়ে আগুনটা এগিয়ে দিল আদিনাথের দিকে। আদিনাথ নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে নিল সেই আগুন থেকেই।
–আমি কোথায় আছি, আমার ইমেল আইডি কী, আমি যে ইদানীং আদা দিয়ে লিকার চা খাই, দামী সিগারেট খাই… এইসব তুমি জানলে কী করে আদিনাথদা?
আদিনাথ সিগারেটটা জোরে টেনে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ধোঁয়া ছাড়ল।
রোহিতাশ্ব বুলেটের মতো আরও প্রশ্ন ছুড়ে দিল, তুমি এখানে আছ কবে থেকে? মাঝে এতগুলো বছর ছিলে কোথায়?
আদিনাথ একটু হাসল। হেসে বলল, তোর মেল আইডি পেয়েছি গুগল থেকে। তোর তোলা একটা ব্ল্যাক প্যান্থারের ছবি নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলিস তুই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ। মনে পড়ছে? মানসে তুই ছিলিস কতদিন, কীভাবে ট্র্যাক করছিলিস ব্ল্যাক প্যান্থারটাকে? সেই লেখার নিচেই তোর মেল আইডিটা ছিল, তোর রিসেন্ট হোয়ারঅ্যাবাউটসও লেখা ছিল। খুব বেশি স্পাইং করতে হয়নি। আর তুই আদা দিয়ে লিকার চা আর মার্লবোরোর কম্বিনেশন নিয়ে তোর মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলিস অরকুটে। সেখান থেকেই এগুলো জানা। এমন কিছু গুরুতর সারভেইল্যান্স আমি বজায় রাখিনি তোর ওপর।
রোহিতাশ্বর মুখ হাঁ হয়ে রয়েছে। রোহিতাশ্ব বলল, মানে? তুমি গুগল, অরকুট… এসব?
–কাছেই একটা সাইবার ক্যাফে রয়েছে বুঝলি? ওখানে বসে দিনরাত এই করি।
রোহিতাশ্ব একটু থমকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কী করো আদিনাথদা? এতদিনই বা কী করছিলে?
আদিনাথ সিগারেট-সহ হাতটা তুলে বলল, ধীরে বৎস ধীরে! আগে বল, তুই কেমন আছিস?
রোহিতাশ্ব হেসে বলল, এই! যেমন দেখছ! রেভলিউশন থেকে অনেক দূরে আমি আছি। সেই যে, যে যার মতো ছিটকে গেলাম, তারপর বাবির এক বন্ধুর সূত্রে সোজা বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। সেখানেই টুকটাক জার্নালিজম। আর জার্নালিজমের কাজ করতে গিয়ে ছবি তোলার নেশা, আর মানাওসে একটা রিপোর্টিং করতে গিয়ে আমাজনে যাওয়া এবং শুধু ওয়াইল্ডলাইফেরই ছবি তুলব বলে মনস্থির করা। এই আমার জীবনের ঘটনা।
–বিয়ে-থা করিসনি নিশ্চয়ই?
–করেছিলাম। একবার। ভেঙে গেছে। সম্পর্ক আসবে, যাবে, এই ভালো। থিতু হতে পারিনি, আর পারবও না।
আদিনাথ জানলার বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে।
–কী ভাবছ? ডিরেলড হয়ে গেছি? মুচকি হেসে বলে রোহিতাশ্ব।
আদিনাথ ম্লান হেসে বলে, না রে! তুই সাংবাদিক হিসেবে যেটুকু কাজ করেছিস, ওই গুগল-টুগলে যা পাওয়া যায়… সেসব খুব জরুরি কাজ। ডিপ্রাইভেশন নিয়ে অনেকগুলো জরুরি কাজ করেছিস তুই।
রোহিতাশ্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, বাকিদের কী খবর? জানো কিছু?
আদিনাথ সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে মাটিতে ফেলে হাওয়াই চটি পরা পা দিয়ে চেপে দেয়। তারপর বলে, অঞ্জন-রঞ্জনের কোনও খবর জানি না। তবে তপন ব্যাক করেছে। নাইন্টিজের মাঝে যখন মাওয়িস্ট রিসার্জেন্স হচ্ছিল, সেই সময়ই।
রোহিতাশ্ব এবার একটু চাপা গলায় বলল, ও কি অ্যাক্টিভলি ফ্রন্টে আছে?
আদিনাথ বলল, পুরুলিয়াতে ছিল জানি। তবে এখন তো আবার অ্যাক্টিভিটি বাড়ছে বলে খবর পাচ্ছি। নন্দীগ্রামের ইনসিডেন্টটার পর তো আরও বাড়বে।
–খবর পাচ্ছ মানে? তুমি কি…
আদিনাথ হঠাৎ খুব তৎপর হয়ে পড়ল যেন। বলল, না না! আমি আর নেই এসবের মধ্যে!
কথাটা ভীষণ কানে লাগল রোহিতাশ্বর। ওর মনে হয়েছিল, যাই হয়ে যাক, আদিনাথদা কখনও এই পথ ছাড়বে না। আদিনাথদা যেন সুপারহিরো, তাকে কোনওভাবেই ওই পথ থেকে বের করে আনা যাবে না।
আদিনাথ হঠাৎ খুব গলা নামিয়ে বলল, রোহিতাশ্ব, তোকে একটা বিশেষ কারণে ডেকে পাঠিয়েছি।
বলেই সচকিত হয়ে তাকাল বাইরের পর্দার দিকে।
পর্দার আড়ালে একটা ছায়া যেন দাঁড়িয়ে ছিল। আদিনাথ ওদিকে তাকাতেই পর্দা ঠেলে ঢুকল একটা ষোলো-সতেরো বছরের কিশোর। ফতুয়া আর হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটার একহাতে চায়ের কেটলি, অন্যহাতে দুটো ছোট চায়ের গেলাস, কেটলি থেকে গেলাসে গরম চা ঢেলে দুজনের হাতে দিয়ে ছেলেটা বেরিয়ে গেল।
রোহিতাশ্ব চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটুক্ষণ থমকে রইল। আদিনাথ যাইই করুক না কেন, কোনও বিশেষ কারণে তাকে ডেকেছে। একটা পুরনো উত্তেজনা যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করল রোহিতাশ্ব।
ছেলেটা বেরিয়ে যেতেই আদিনাথ হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে চারপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে তারপর ঘরে ঢুকে এসে পলকা কাঠের দরজাটা কোনওমতে বন্ধ করল খিল দিয়ে। তারপর রোহিতাশ্বর দিকে ফিরে বলল, তোকে কিছু কথা বলার আছে। আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। মরার আগে তোকে কথাগুলো না বলে গেলে হবে না।
রোহিতাশ্ব ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। এবার আদিনাথ এগিয়ে এসে ওর শতচ্ছিন্ন পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ছোট বাক্স বের করল। সেটা রোহিতাশ্বর হাতে দিয়ে বলল, যতটা সম্ভব গোপনে এটা রাখ। এটার জন্য তোকেও হয়তো বিপদে পড়তে হবে। কিন্তু আমার আর উপায় নেই রে। এইটা কেবল তুইই ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারবি।
আদিনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করছিল যখন, তখন একটু দূরেই দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিল এক যুবক। আদিনাথের ঘরের দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। আদিনাথ ঘরের দরজা বন্ধ করতে সে বিড়িটা ফেলে হাঁটা লাগাল গঙ্গার ধারের রেললাইন ধরে। রেললাইনের একধারে অনেকগুলো বস্তা রাখা। তার ঠিক পাশে আরও দুটো ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে যুবক বলল, ঘরে একটা বেপাড়ার হুলো ঢুকেছে। চিনি না মালটাকে। কান পাতা আছে। তবে মনে হচ্ছে, ওটাকে নজরে রাখা দরকার। হুলো যখন বেরোবে ঘর থেকে, তখন তোরা ফলো করবি। বোঝা গেল?
ছায়ামূর্তি দুটো মাথা নাড়ল। তারপর তারা রেললাইন ধরে এগিয়ে গেল আদিনাথের ঘরের দিকে।
এবার যুবক মোবাইল বের করে ফোন করল কাউকে একটা।
কুমোরটুলির সেই পরিত্যক্ত স্টুডিওর ভেতর বসে আগেরদিনের সেই লোকটা, এর নাম ছেনো। সামনে গুন্ডা টাইপের লোকটা পায়চারি করছে, এই গুন্ডার নাম বাবলু। ছেনো ফোন ধরল। উলটোদিক থেকে যুবক যা বলল, শুনল মন দিয়ে। তারপর ফোনটা রেখে বলল, মালটার ঘরে একটা ঘ্যাম টাইপের লোক এসেছে। লোকটাকে আগে দেখা যায়নি।
যেদিকে তাকিয়ে ছেনো কথাগুলো বলল, সেদিকটাতে অন্ধকারে বসে চুরুট টানছিল দশাসই বেগুনিবাবু। ধরা গলায় উত্তর দিল বেগুনিবাবু, এই মালটার সঙ্গে ওর কী কথা হচ্ছে সেই খবরটা পাওয়া যাবে তো?
–চায়ের দোকানের ছেলেটা আড়ি পাতছে স্যার।
–হুমম! গম্ভীর গলায় বলে চুরুটে টান মারল বেগুনিবাবু।
বেশ কিছুক্ষণ পর রোহিতাশ্ব বেরোল ঘর থেকে। দুটো লোক দুদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল। তারা একটু দূরত্ব রেখে পিছু নিতে শুরু করল রোহিতাশ্বর।
কিছুদূর গিয়ে অভয় মিত্র স্ট্রিটের একটা গলির সামনে দাঁড়াল রোহিতাশ্ব। চারপাশে একবার দেখে নিল। তারপর হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে গেল গলির ভেতর।
এইটার জন্য প্রস্তুত ছিল না দুটো লোক। তারা কী করবে বুঝতে পারল না প্রথমে। তারপর ছুটে গেল গলির দিকে। গিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। গলির পেছনদিক দিয়ে একটা পুরনো মডেলের রয়্যাল এনফিল্ড মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াল। স্কুটারের চালকের আসনে বসে হেলমেটের ঢাকনা তুলে একবার লোকদুটোকে দেখল রোহিতাশ্ব।
আদিনাথদা তার মানে ঠিকই বলেছিল।
কেউ পিছু নিলে এখনও রোহিতাশ্বর ছটা ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, আদিনাথদা যা যা বলল, তা শোনার পর থেকে আরও বেশি সতর্ক ছিল আদিনাথ।
লোকদুটোকে ধোঁয়াশায় রেখে মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুতগতিতে মানুষকে জিগজ্যাগ করতে করতে বেরিয়ে গেল রোহিতাশ্ব। ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ় রোহিতাশ্বর মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষিপ্র গতি দেখে মনে হবে, সে তাজা তরুণ।
ওই দুটো লোক তখন মনপ্রাণ ঢেলে খিস্তি করছে রোহিতাশ্বকে। এবং একে অপরকে দোষারোপ করছে।
–বেগুনিবাবু শুনলে তো আর আস্ত রাখবে না!
–বেগুনিবাবুকে বলা যাবে না, আমাদের মালটা চুক্কি দিয়েছে! ছেনোদাকে সেভাবেই ম্যানেজ করতে হবে।
কিন্তু রোহিতাশ্ব সব অনুসরণকারীর গতিবিধি বুঝতে পারেনি। চিৎপুর রোডের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রোহিতাশ্বকে মোটরসাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখছিল একটা লোক। লোকটার পরনে একটা কালো হাফশার্ট। কালো প্যান্ট। চোখে একটা কালো সানগ্লাস। লম্বা সাদা জুলপি। গালে কাটা দাগ। রোহিতাশ্ব বেরিয়ে গেলে লোকটা শান্তভাবে কুমোরটুলির কাছে এসে একটা সরু গলির ভেতর ঢুকল। একটা মার্সিডিজ গাড়ি দাঁড়িয়ে সেখানে। সেই গাড়ির পেছনের দরজার কাচে গিয়ে তিন থেকে চারটে টোকা মারল। অনেকটা মর্স কোডের মতো শোনাল বিষয়টা। দরজাটা খুলে গেল। লোকটা উঠে বসল গাড়িতে। রোহিতাশ্ব যেদিকে গেল, গাড়িটা রওনা দিল তার উলটোমুখে।
[আবার আগামী সংখ্যায়]