পুষ্করিণী
পুকুর না বলে তাকে যদি ‘পুষ্করিণী’ বলা যায়,
তার জলে নামানো যায় আদ্যিকালের ভাঙা ঘাট
আর তার শ্যাওলা-ধরা ধাপগুলিকে বলা যায় ‘সোপান শ্রেণি’,
যদি তার পাড়ে রাখা যায় ঝুরি-নামা একটা প্রাচীন বট,
তার নাম দেওয়া যায় ‘ন্যগ্রোধ’, আর কত শত বছরের
পুরোনো ছায়াগুলিকে তার তলায় জমানো যায়,
দুপুরের ক্লান্ত পথিকটিকে আশ্রয় দেওয়া যায় সেই ছায়ায়,
তবে সেই পুকুরটিকে ‘পুষ্কর’-এর স্ত্রীলিঙ্গ বলে ভাবতে অসুবিধা হয় না।
আর রাজস্থানের থর মরুভূমি ছেড়ে এত দূরে
এই জল-কাদা মাখা পশ্চিমবাংলায় এসে
বিরহিণীর চোখের মতো টল টল করে ওঠে তার কালো জল।
তখন তাকে আদর করে ‘পুষ্কর্ণী’ ডাকাই যায়,
আদি পিতা আর আদি মাতার মতো এক কৃষক দম্পতি
অনাদিকাল ধরে জল তুলে সন্তানের শুকনো গলায় ঢেলে দেয়।
সন্তানের মুখের হাসির মতো তখন হাসতে থাকে মাঠের ফসল ,
বারোভুঁইয়ার পরে কোনও ত্রয়োদশ ভুঁইয়া বংশীয়দের সেই প্রাচীন পুকুরে
ব্রহ্ম-কমলের মতো ফুটে ওঠে একরাশ প্রসন্ন শালুক…
কদলীবালা
দিনের আলোয় যাকে কলাগাছ বলে ভ্রম হয়,
সে আসলে ছলা-কলাময়ী এক নারী,
সারারাত ধরে যাকে ধ্বস্ত করে ব্যাভিচারী হাওয়া।
চাঁদনী রাতের ফাঁকা মাঠ তাকে চেনে,
তাকে চেনে জানালার অর্ধেক কপাট।
জ্যোৎস্নায় তার সাদা শাড়ির আঁচল উড়ে উড়ে
বেদনা মাখানো হাতছানি দিয়ে যায়।
সে ডাক এড়াতে পারে সাধ্য কী গৃহী পুরুষের !
বুকের ভিতর থেকে ছ্যাঁত করে ওঠা এক হাড়হিম ভয়
সহসা চারিয়ে যায় পায়ের পাতায়।
মন্ত্রমুগ্ধ পুরুষেরা জীবনের বাকি দিনগুলি
কদলীবালার মোহে স্থাণুবৎ জীবন কাটায়…
গ্রামীণ
অশ্বত্থ গাছের নিচে অনেক দোকান খুলে গেছে,
দূরের বাজারমুখী পথটিও এখন পিচের,
মাঝে মাঝে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় টোটো।
সন্ধ্যাবেলা তেমাথার মোড় সেরকম জনহীন নয়,
যেরকম ছিল বলে নয়ন দাসের বউ সেই পথে
গোপনে চাঁদের কাছে যেত।
চায়ের দোকানি ভোলা, দোকানের সম্ভবনা যখন ছিল না,
যে তখনও কেবল শ্রমিক, অপরের ক্ষেতে, সেই ভোর রাতে
অশ্বত্থের ডালে তাকে ঝুলতে দেখত।
নয়ন দাসের বউ, যার চাঁদপানা
মুখটির খ্যাতি ছিল এ গ্রাম বিখ্যাত,
চায়ের দোকানি তাতে গ্রহণের ছায়া দেখেছিল।
সেসব গ্রামীণ কথা ভুলে গেছে অশ্বত্থের ডাল,
শীত রাতে জমে থাকা শিশিরের ফোঁটা।
বেশি রাতে দোকান বন্ধ করে ফেরার সময়
চায়ের দোকানি ভোলা দেখে – সেই থেকে
বিমর্ষ চাঁদের আলো, নীচু পথে উড়ে যায়
একাকী বাদুড়…
জলাভূমি
শ্মশান পেরিয়ে ওই জলাভূমি, তুন্দ্রা অঞ্চল।
আরও কিছু পরে আছে ফাঁসুড়ে পুকুর, যার পাড়ে
দুটি বট গাছ সৃষ্টির শুরু থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
চোখের কোটরগত ব্যথার মতোই সদ্যফোটা বাচ্চা রেখে
শকুনেরা উড়ে গেছে দূরের ভাগাড়ে।
এইখানে এসে চাঁদ প্রতিদিন একবার থমকে দাঁড়ায়,
তখন শুকনো ডালে তুষারের মতো
ঝরে পড়ে জ্যোৎস্নার রুপালি পালক,
তখন কঙ্কালসার গাছেরাও হারানো যৌবন ফিরে পায়…
তারপর সেইসব গাছেরা কী করে জানা নেই।
অতদূরে আমাদের যেতে নেই, দেখাও বারণ
ঘাসের আড়াল থেকে উঁকি মারা হাতছানিদের।
দুটি পুকুরের পাড় যেখানে মিশেছে,
আমাদের মুক্তাঞ্চল তারই মধ্যবর্তী এক ফাঁকা উপত্যকা।
কেবল হাওয়ার টানে আমাদের সুতো কাটা ঘুড়ি
মাঝে মাঝে উড়ে গেছে শ্মশান পেরিয়ে,
মাথায় ঘাসের বোঝা নিয়ে যারা জলা থেকে ফেরে,
তাদের জিজ্ঞেস করি হারানো বলের কথা, কাটা ঘুড়িদের কথা,
তারা কোনও জবাব দেয় না, শুধু ওই দিকে আঙুল বাড়ায়।
তাদের সে নীরবতা জলাভূমিটিরই মতো রহস্যজনক।
সাপিনী
মঙ্গলকাব্যে দেখা যায় মর্ত্যে নিজের পুজো প্রচলিত করতে দেবী সাধারণ গ্রাম্য নারীর রূপ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ‘নাগিনা’ সিনেমাতেও দেখেছি, সাপ কেমন ধীরে ধীরে শ্রীদেবী হয়ে যাচ্ছে, আবার চোখের সামনে নাচতে নাচতে শ্রীদেবী ফিরে পাচ্ছে সাপের চেহারা।
তাই সেদিন যখন গ্রামের মনসা থানের পিছনের জংলা মতন জায়গাটায় গাছ-কোমর করে শাড়ি পরা এক অচেনা মেয়েকে দেখলাম, বিশেষ অবাক হইনি। জায়গাটার বিশেষ সুনাম না থাকায় খুব একটা কেউ আসে না, মেয়েরা তো নয়ই।
আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছিল, আমি তাকে ছুঁতে যেতেই দুচোখে আগুন জ্বেলে সেই মেয়ে আচমকা ‘ফোঁস’ করে ওঠায় !